‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত/সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল’;…জীবনানন্দ দাশের কবিতার শিশিরের শব্দ এবং রৌদ্রের গন্ধ খুঁজেছেন, এই মার্কিন গবেষক ক্লিন্টন বি সিলি। তিনি কবিকে নিয়ে কাজ করেছেন নিরন্তর—দশকের পর দশক। তার গবেষনালব্ধ তথ্য ও অন্তর্দৃষ্টিময় বিশ্লেষণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত হয়েছিল—‘আ পোয়েট অ্যাপার্ট’। যদিও রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক আলোচিত এই কবির কবিতা এবং জীবন সম্পর্কিত বহুমাত্রিক-বহুগ্রন্থের সমাবেশ ঘটেছে। তা-ও অতি সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশনী থেকে ক্লিন্টন বি সিলির—গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ হয়ে বেরিয়েছে। ‘আ পেয়েট অ্যাপার্ট’—বহুল আলোচিত ইংরেজি এই বইটি বাংলায় রূপান্তরিত হয়েছে—‘অনন্য জীবনানন্দ’ নামে। জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনীর এই দুর্লভ গ্রন্থটি ফারুক মঈনউদ্দীনের তীক্ষ্মমেধা ও অতি নিষ্ঠায় অনুবাদিত হয়েছে—তা যেন বইটি পাঠ করলেই বোঝা যায়। এ-ও বোঝা যায়, যেহেতু ক্লিন্টন বেঁচে আছেন। তিনি নিজেও ভালো বাংলা জানেন/বোঝেন এবং অবাধ ইলেকট্রনিক্স তথ্য প্রবাহের সুবিধার মাধ্যমে অনুবাদক সর্বত্রই কাজে লাগিয়েছেন এই গ্রন্থের মূল লেখককে। ফলে গ্রন্থটি এখন জীবনানন্দ প্রেমীদের জন্য, কবিকে জানার/বোঝার জন্য এই বইটি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
তা’হলে কে এই লেখক ক্লিন্টন বি সিলি। কেনই বা তিনি জীবনানন্দকে নিয়ে মেতে উঠেছিলেন? বরিশাল জিলা স্কুলের ১৭৫ বর্ষপূর্তি উৎসবে ২০০৫ প্রকাশিত শতাব্দীর বন্ধন স্মরণীকায় আ ব ম মহিউদ্দিন খান চৌধুরীর লেখা থেকে পাওয়া যায়,…‘সাদা চামড়ার লম্বা সুন্দর সেই মানুষটি ক্লিন্টন বি সিলি, ১৯৬৩ সাল থেকে জীববিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক হিসেবে প্রাকটিক্যাল ক্লাসে পড়াতেন আমাদের জিলা স্কুলে। সে সময় জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মি. পল গুডা। সিলি তখন গবেষণা করতেন অনেক বিষয় নিয়ে, চর্চা করতেন বাংলা সাহিত্য নিয়েও। তখন ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতেন। থাকতেন জিলা স্কুলের নতুন ভবনের দোতলার পশ্চিম দিকের একটি কক্ষে।’ এ সম্পর্কে সিলি নিজেও লিখেছেন…৬০ এর দশকের প্রথম দিকে যদিও আমি ‘পিস কোর’ এর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দুই বছর জীবনানন্দর নিজ শহরে বরিশালে কাজ করেছি…’ তখন অবশ্য তিনি জীবনানন্দ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতেন না। সে সময় বাংলা ভাষা শেখার প্রতিই সর্বাগ্রহ ছিলেন। মিশনারি দ্বারা পরিচালিত সাগরদী ওরিয়ান্টাল ইন্সটিটিউট-এ সপ্তাহে অন্তত ৩/৪ দিন বাংলা শিখতেন। সিলি লিখেছেন, ‘জীবনান্দ সম্পর্কে আমি জানে পারি আরও পরে, শিকাগোয়, তাঁর কবিতার মাধ্যমে। আইওয়ার লেখন কর্মশালার সতীর্থ এবং একসমরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং লেকচারার কবি জ্যোতির্ময় দত্ত আমাকে জীবনানন্দের শব্দ ও রূপকল্পের বিস্ময়কর ভুবনের সঙ্গে পরিচিত করান।’ যে কবির কবিতা গল্প উপন্যাসের সমস্ত উপমা/উৎপ্রেক্ষার সঙ্গে মিলেমিশে আছে এই বরিশালের জল-মাটি-হাওয়া-গাছপালা-পাখি-প্রকৃতির প্রতীতি। ক্লিন্টন সিলিও কিছুকাল এই প্রকৃতির কাছে, পাখির কোলাহল শুনেছেন। ভাট-বঁইচি-বেতের বন দেখেছেন। থেকেছেন মাঠের ঘাসের সঙ্গে। ‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে—সবচেয়ে সুন্দুর করুণ;/সেখানে সবুজ ডাঙ্গা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল ;’- সবচেয়ে সুন্দর করুণ এই দেশে জন্ম নিয়েছেন, এমন সৌভাগ্যবান কবি জীবনানন্দ দাশ। এখানেই সৌভাগ্য বশত দুবছর কাটিয়েছেন ক্লিন্টন বি সিলি।
তাই সিলির ‘আ পোয়েট অ্যাপার্ট’- গ্রন্থে জীবনানন্দ সম্পর্কে তার আলোচনায় কবির সেইসব বোধের সংগ্রাম, বস্তুত ভাষার সংগ্রামের চেয়েও-একজন কবি দার্শনিকের চেয়েও কতটা ভিন্নতর। এ রকমই প্যাডাইম করেছেন। যা কি-না বাঙালি যে কোনও লেখকের গভীরতার থেকেও গভীরতর বিস্ময় হয়ে উঠেছে। সিলির বইয়ের জীবনানন্দ সম্পর্কিত নানা তথ্য এবং ঘটনার উল্লেখ যেভাবে করেছেন। তখন কবির সেই উন্মেষ পর্বে, তিনি যে সমস্ত পত্র-পত্রিকায় লিখতেন, তার পক্ষে/বিপক্ষে যা কিছু আলোচনা/ সমালোচনা হয়েছে, সমস্ত কিছু ঘেটেঘুটে দেখেছেন। কবির চিঠিপত্র-বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষী! শত্রু সজনী কান্তের সঙ্গেও কথা বলেছেন। আলাপ করেছেন, কবি লেখক বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গেও। সিলি চুনিলালের সঙ্গে দেখা করেছেন, জেনেছের সেই দিনের ঘটনার সমস্ত বিবরণ। যে চুনিলাল ১৯৫৪ সালে ১৪ অক্টোবর ট্রামের নিচে চাপা পড়ে থাকা জীবনানন্দকে উদ্ধার করেছিনে। শুধু কি তাই, সিলির বইয়ে আছে বহু পারিবারিক/ব্যক্তিগত তথ্য। নিঃসঙ্গ জীবনের মেরুকরণ। যে তথ্য-উপাত্ত তিনি জেনেছিলেন, কবির বিধবা পত্নী লাবণ্য দাশ, দুই সন্তান-মেয়ে মঞ্জুশ্রী, ছেলে সমরানন্দ- এবং ভাই অশোকানন্দ, বোন সুচরিতার কাছ থেকে। এ কারনে ক্লিন্টন বি সিলির এই গ্রন্থটি আমাদের কাছে বহুমাত্রিক এবং বহুবাঙ্গালী লেখক/গবেষকের লেখার চেয়েও অধিক গুরুত্বের। সিলি তার বইয়ে-শেকড়, কল্লোল যুগ, বরিশালে ফেরা, যুদ্ধকাল : প্রস্তাবনা ও ফলাফল, উপন্যাসের আরেকটি প্রয়াস, রাজনীতির কবিতা, মরণোত্তর জীবনানন্দ- এরকম ৭টি অধ্যায়ের মাধ্যমে জীবনান্দ দাশের ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যকর্মের আধুনিক/উত্তর-আধুনিক কিংবা বিটনিক ধারার সামগ্রিক ও অনুপুঙ্খ চিত্র- চিত্রায়ন…। এই অনন্য জীবনানন্দ…।
অনন্য জীবনানন্দ
ক্লিন্টন বি সিলি
অনুবাদ: ফারুক মঈনউদ্দীন
প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা।
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী
মূল্য- আট শ টাকা।