বাংলা সাহিত্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। ক্ষণজন্মা মানুষটির সৃষ্টিকর্ম হাতেগোনা হলেও সবই কৃতিত্বের দাবি রাখে। শুধু এক ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ই তাকে স্মরণযোগ্য করে রেখেছে পাঠক ও সাহিত্যবোদ্ধা মহলে। এছাড়া, তিনি বিভিন্ন কারণে পাঠক মহলে গুরুত্বের দাবি রাখেন। কেননা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে বাংলা ছোটগল্প অগ্রবর্তী হয়েছে ঠিক। কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে যে অল্প কয়েকজন লেখক ছোটগল্পে সাফল্য দেখিয়েছেন, অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাদের একজন।
আমার আলোচনার বিষয় তার সার্বিক সাহিত্যকর্ম নয়। আমি কেবল তার গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত কিছু গল্প নিয়ে কথা বলতে চাই। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন যে, চলতি বছর লেখকের ১০৮তম জন্মদিন-স্মারক উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে তার ‘গল্পসংগ্রহ’। এতে তার দশটি গল্প স্থান পেয়েছে। তিতাসের এই লেখক এ গল্পগুলোয়ও সমধিক উজ্জ্বল। আলোকিত করেছেন ছোটগল্পের জগত। সমৃদ্ধ করেছেন ছোটগল্পের সম্ভার।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘গল্পসংগ্রহ’টি সম্পাদনা করেছেন কবি ও প্রাবন্ধিক সৌম্য সালেক। এতে স্থান পেয়েছে—‘বন্দী বিহঙ্গ’, ‘সন্তানিকা’, ‘কান্না’, ‘স্পর্শদোষ’, ‘সাগর তীর্থে’, ‘বিস্ময়’, ‘জাল ফেলা-জাল তোলা’, ‘তমোনাশের মন’, ‘আশালতার মৃত্যু’ ও ‘সাঁঝের মজলিস গানের মূল্য’। অদ্বৈতের দশটি গল্পের মধ্যে পাঁচটি গল্প বিভিন্ন গ্রন্থ ও রচনাবলিতে সংকলিত আছে। বাকিগুলো বিভিন্ন সাময়িকী বা পত্রিকা থেকে বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার করা হয়েছে।
বইটির ভূমিকা সৌম্য সালেক বলেছেন, ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ সযত্নে তাঁর লেখাপত্র সংরক্ষণ করেননি, তাঁর জীবনকালীন সময়ের সাময়িকপত্রগুলো ঠিকভাবে পরীক্ষা করা হলে এমন আরও দু-একটি গল্প হয়তো পাওয়া যাবে। এই দশটি গল্পের মধ্যেই বিষয় নির্বাচন, ভাষাশৈলী, দৃষ্টির সম্পন্নতা ও চরিত্রচিত্রণে লেখকের স্বাতন্ত্র্য দৃশ্যমান।’
সবশেষে গল্পগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন শান্তনু কায়সার, হরিশংকর জলদাস, ফেরদৌস আরা আলীম, মাসউদ আহমাদ ও মো. সাহাবউদ্দিন। আমার বিশ্বাস, তার গল্প পাঠ, মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ পাঠককে নবতর অনুভূতি দান করবে। লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণকে জানতে সহায়তা করবে। পাঠকের সামনে ভিন্ন এক অদ্বৈত মল্লবর্মণ হাজির হবেন।
আমরা জানি, অদ্বৈত মল্লবর্মণ ১৯১৪ সালের ০১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাঙালি ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। পেশায় সাংবাদিক ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার গোকর্ণঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস লিখে তিনি বাংলা সাহিত্যের চিরস্মরণীয় ও অমর প্রতিভা হিসেবে সবিশেষ স্বীকৃতি লাভ করেন। উপন্যাসটি সর্বপ্রথম ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
দরিদ্র ধীবর পরিবারে জন্মগ্রহণ করা অদ্বৈত মল্লবর্মণের বাবার নাম অধরচন্দ্র। শৈশবেই তিনি বাবা-মাকে হারান। গ্রামের মালোদের চাঁদার টাকা দিয়ে তার লেখাপড়া চলতো। ১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সদরে অবস্থিত অন্নদা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে কিছুদিন আইএ ক্লাসে অধ্যয়ন করেন। তবে মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক সঙ্কটের কারণে পড়াশোনা বেশি দূর এগোয় না।
১৯৩৪ সালে কলেজে পড়া বাদ দিয়ে শুধু অর্থ উপার্জন ও জীবিকা নির্বাহের তাগিদে কলকাতা চলে যান। সেখানে মাসিক ‘ত্রিপুরা’ পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ১৯৩৬ সালে ক্যাপ্টেন নরেন দত্ত পরিচালিত ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় যোগ দেন। পত্রিকাটির সম্পাদক কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহকারী হিসেবে সহ-সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন।
নবশক্তির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার সম্পাদকের সহকারী হিসেবে যোগ দেন। তিন বছর এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন তিনি। এ ছাড়া নবযুগ, কৃষক ও যুগান্তর পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমৃত্যু এ পদে বহাল ছিলেন। আয় বাড়ানোর জন্য বিশ্বভারতীর প্রকাশনা শাখায় খণ্ডকালীন চাকরিও করেন।
অবিবাহিত নিঃসঙ্গ অদ্বৈত মল্লবর্মণ বহু কৃচ্ছ্রসাধন ও উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যতটুকু আয়-উপার্জন করতেন; তার বেশিরভাগই ব্যয় করতেন দুস্থ পরিচিতজনের মাঝে। বইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অসাধারণ। নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যেও যথাসম্ভব বই কিনে পড়তেন। আর্থিক সঙ্গতি কম থাকা স্বত্ত্বেও কলকাতার মালোপাড়ার শিশু-কিশোরদের ঘরোয়া বিদ্যালয় পরিচালনায় নিয়োজিত উপেন্দ্রবাবুর স্বল্পশিক্ষিত বিধবা প্রফুল্লকে নিয়মিতভাবে আর্থিক সাহায্য করতেন। পরোপকারী মানুষটি মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার নারকেলডাঙ্গার ষষ্ঠীপাড়ার নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।
তার মৃত্যুর এত বছর পর মাত্র দশটি ছোটগল্প উদ্ধার হলেও বিষয় নির্বাচন থেকে আরম্ভ করে গল্পের আঙ্গিক, ভাষাশৈলী, সমাজবোধ ও বহমান জীবনের অকৃত্রিম উপস্থাপনায় নন্দিত প্রতিটি ছোটগল্প। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে তিনি যেমন স্বতন্ত্র ও সমুন্নত; তেমনই ছোটগল্প লেখার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাই জোরালোভাবে বলা যায়, অদ্বৈতের গল্পগুলো নিঃসন্দেহে বহুল পাঠের দাবি রাখে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ তার সীমিত কাজেই অসীমের মাঝে বিরাজ করছেন। তার গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সব গল্প পাঠের এ সুযোগ পাঠকের জন্য আনন্দের। এমন মহতী কাজের জন্য প্রকাশক ও সম্পাদক ধন্যবাদ পেতেই পারেন। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।
আমি যে বইটি নিয়ে আলোচনা করছি, সেটির প্রথম গল্প হচ্ছে ‘বন্দী বিহঙ্গ’। এটি অদ্বৈত মল্লবর্মণের বহুল পঠিত একটি ছোটগল্প। এটি সাপ্তাহিক খবরের কাগজের এক সহকারী সম্পাদকের প্রত্যহিকতার বৃত্তান্ত। এ গল্পে বারবার সন্তানের প্রতি পিতৃস্নেহের গভীরতা লক্ষ্য করা যায়। অদ্বৈতের এই একটি গল্পের মধ্যেই কেবল মুসলিম সমাজের দৃশ্যপট এবং ঈদসহ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। এমনকি এখানে মধ্যবিত্তের করুণ আর্তিও ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি ব্যক্তি অদ্বৈতের প্রতিচ্ছবিও যেন ফুটে উঠেছে। নিজের গল্পটিই যেন তিনি অন্যের মাধ্যমে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন।
‘সন্তানিকা’ বইয়ের দ্বিতীয় গল্প। গল্পটি নিরুপায় এক বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষকের শেষ জীবনের অনিশ্চয়তা ও আশ্রয়হীনতা নিয়ে লেখা হয়েছে। শেষপর্যন্ত বীরেশ-পরিবার তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে। বৃদ্ধ মানুষের একাকিত্ব, অসহায়ত্ব এ গল্পে গভীর আবেগে উঠে এসেছে। লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষ শেষ বয়সে নিশ্চিন্তে, নিরাপদে, স্বাভাবিকভাবে মরতে চায়। এই গল্পের প্রতিপাদ্য আসলে তা-ই মনে হওয়া স্বাভাবিক।
তৃতীয় গল্প ‘কান্না’ শেষ হয় গুরুদয়ালের অরণ্যে রোদনের মতো নিষ্ফল ক্রন্দনের মধ্যদিয়ে। তার এই রোদনের মধ্যেও যে চাতুরি থাকতে পারে, সে বিষয়ে পাঠকের বেশ সন্দেহ আছে। তাই তো গল্পের শেষ বাক্যটি এমন, ‘গুরুদয়াল আঁখির জলে ভিজিয়া ভিজিয়া যেন বলিতে থাকে, মরিল তো কিন্তু আর কটা দিন আগে কেন মরিল না।’
‘স্পর্শদোষ’ বইয়ের চতুর্থ গল্প। এর মধ্যে দুঃখপীড়িত মানুষ ও প্রাণির অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। মন্বন্তরকালীন দুঃখ-যন্ত্রণার আরেক মর্মান্তিক অধ্যায় এ গল্প। দুঃখ ও দারিদ্র্য সম্পর্কিত অভিব্যক্তির মাধ্যমে সূচনা হয় গল্পের। তবে সরকার যে মন্বন্তরের সময় মৃত মানুষের সংখ্যার হিসেবও ঠিকভাবে প্রচার করতে দেয়নি, সেই ইঙ্গিত করে গল্পটি শেষ হয়।
‘সাগর তীর্থে’ গল্পটিতে উঠে এসেছে তীর্থ দেখতে এসে বহু লোকের অপমৃত্যুর কথা। জাহাজে ও বিভিন্ন বাহনে চড়ে সেবার বহু মানুষ জড়ো হয়েছিল ডায়মন্ড হারবারের জাহাজ ঘাটে। মানুষের ভিড় ও হুড়াহুড়ির মাঝে জেটি ভেঙে বহু মানুষ সেখানে নিহত হয়। লেখকের ও তার সহগামীদের তীর্থ দেখার ইচ্ছে একেবারেই দমে যায় এ দুর্ঘটনায়।
‘বিস্ময়’ এবং ‘তমোনাশের মন’ গল্প দুটোকে বিপ্রতীপ গল্প বলা চলে। বিস্ময় গল্পের নায়ক ‘শ্রীপতি’ আর তমোনাশের মনের ‘তমোনাশ’। বিস্ময়ের শ্রীপতি বিপত্নীক কিন্তু তমোনাশ অবিবাহিত। দুটো গল্পেরই নায়িকা বিনোদিনী। দুটো গল্পেই দেখা যায়, সে পুরোনো দিনের বিচ্ছেদী গান করে আপনমনে। দুটো গল্পের নায়কই রেলের টিকিট কলেক্টর। তাদের মনের গতি ও পরিবর্তন প্রবণতা এবং দ্বন্দ্ব প্রায় একই।
‘জাল ফেলা-জাল তোলা’ গল্পটিকে অদ্বৈত মল্লবর্মণের আরেকটি শ্রেষ্ঠ গল্প বলা যায়। এ যেন এক করুণ ব্যথাতুর জীবনের গল্প। জীবনের মধ্যে বেদনার অবস্থিতি এখানে জান্তব হয়ে উঠেছে। এখানে মনে হবে না যে, কোনো কিছু আরোপিতভাবে যুক্ত হয়েছে। কোমলভাবের মানুষ এ গল্প পড়ে অশ্রু ঝরাবে। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।
নবম গল্প ‘আশালতার মৃত্যু’ অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি নিরীক্ষাধর্মী কাজ। আশালতা নামের তিন নারীর মৃত্যু ও আত্মহত্যার তিনটি কাহিনি আছে এ গল্পে। অনেকটা সংবাদ প্রতিবেদনের মতো। এ তিন আশালতারই সুখের শৈশব ছিল। তাদের বিয়েও হয়েছিল ধুমধাম করে। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরই দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ। একজন না খেতে পেয়ে মারা যায়। একজন কাপড়ের অভাবে আত্মহত্যা করে। তৃতীয় আশালতাও তার শিশু সন্তানদের দুরবস্থা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে।
তিনটি খবরই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এখানেই বোঝা যায়, একটি সংবাদ প্রতিবেদনও একজন দক্ষ গল্পকারের হাতে সার্থক হয়ে উঠতে পারে।
বইয়ের শেষ বা দশম গল্প ‘সাঁঝের মজলিস গানের মূল্য’। এটি একটি হাস্যরসাত্মক গল্প। এক জোলা বাজার থেকে পাঁচ টাকা দিয়ে গান কিনে আনতে যায়। লোকে তাকে বলে, গান পয়সায় বাজারে বিকোবার জিনিস নয় রে বোকা। কিন্তু অন্য এক চতুর দোকানি তাকে একবারের জন্য মুখে মুখে অদ্ভুত কিছু ছড়া শিখিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সেও সেসব দ্রুত মুখস্থ করে বাড়ি আসে। এ গল্প আমাদের শৈশবে শোনা রূপকথার গল্পের; খোদ-নাকি, লাল মিয়া নাকি, দমুর দিলা নাকি—সেই মজার গল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
গল্পগুলো পাঠ শেষে তার লেখার ধরন বোঝাতে এখানে সামান্য কিছু তুলে ধরছি, ‘পল্লীর যে বধূ শাশুড়ির গঞ্জনা মাত্র ভক্ষণ করিয়া পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত উদরটাকে দিনের পর দিন শূন্য রাখিয়া নির্বিবাদে চলে তাহাকে দেখিয়া যতটা ব্যথা পাই না, যে বৌ শাশুড়ি রক্ষিত সুখাদ্য চুরি করিতে গিয়া ধরা পড়ে, সে আমাদের সহানুভূতি আকর্ষণ করে বেশি।’ (স্পর্শদোষ) এ ছাড়া অন্যত্র দেখা যায়, ‘একাকী কেমন করে মরিবে! আর মরিলেই বা কি তাহার অসহায় অসার দেহটাকে লইয়া শৃগাল কুকুর শকুনিতে টানাটানি করিবে। একটা ভারী বিশ্রী ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইবে যে…।’ (সন্তানিকা)
এ থেকেই তার গল্পের চরিত্রদের সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ তার গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। নিম্নবিত্তের পাশাপাশি নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তও উঠে এসেছে পরম মমতায়। সমসাময়িক চিত্রপট নিপূণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। তার গল্পে জেলে, জোলা, সাংবাদিক, শিক্ষক, সন্ন্যাসী, ধীবর, মালো—শ্রেণির মানুষের জীবনের আখ্যান উঠে এসেছে। তারপরও কালে কালে অদ্বৈতকে জানার বাসনা আকুল পাঠকের মনে আকুপাকু করে ওঠে। তাকে জানার তৃষ্ণা যেন নিবৃত হতে চায় না।
তাই তো শান্তনু কায়সার ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণকে নিয়ে সাহিত্য পরিক্রমা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘১৯৭৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত চার দশকে আমার অদ্বৈতচর্চায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে অদ্বৈত মল্লবর্মণ নানা মাত্রায় পুনরাবিষ্কৃত ও পুনর্মূল্যায়িত হলেও এখনও এ বিষয়ে নানা বিভ্রান্তি ও ভুল ধারণা রয়ে গেছে।’
‘অদ্বৈত গল্পের ছেঁড়াখোঁড়া মানুষ’ প্রবন্ধে হরিশংকর জলদাস বলেছেন, ‘অদ্বৈত কালজয়ী কিন্তু ক্ষীণজীবী। মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের (১ জানুয়ারি ১৯১৪—১৬ এপ্রিল ১৯৫১) জীবন তাঁর। ক্ষীণ আয়ু বলে অধিক লিখতে পারেননি।’ তিনি এ-ও বলেছেন, ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর গল্পে ভাঙাচোরা সাধারণ মানুষের জীবনকথা শুনিয়েছেন। তাঁর চারটি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র পুরুষ এবং অতি সাধারণ মানের পুরুষ। এই সাধারণ ছেঁড়াখোঁড়া মানুষগুলোর মধ্যে লেখক যুক্ত করেছেন অসাধারণ মাত্রা।’
ফেরদৌস আরা আলীম তার ‘গল্পের অদ্বৈত মল্লবর্মণ’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘বাংলা ছোটগল্পে এ-কোনো অভিনব গাঁথুনিমাত্র নয়; এ এমন এক নতুন পথ, যে-পথে লেখকের এ-এক অসামান্য পদযাত্রা, শতবছরে যে-পথের ছায়া মাড়াতে আমরা আর কাউকে দেখিনি, এ-এক দুর্দান্ত সাহসের গল্প। তাঁর সততার, অভিজ্ঞতার ও উপলব্ধির সাহস। সেইসঙ্গে প্রকাশের সাহসও বটে। জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলি কতটা মুখব্যাদান করে থাকলে এমন গল্প হয়? শতবছরে মানুষের দুরবস্থা বা মর্মবেদনা তো শতগুণ বেড়েছে; কিন্তু এমন গল্প আর হয়েছে?’
মাসউদ আহমাদ ‘গল্পকার অদ্বৈত মল্লবর্মণ’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘মাত্র ৩৭ বছর বয়সে প্রয়াত হোন চিরকুমার অদ্বৈত মল্লবর্মণ, উত্তরাধিকারহীন। সময়ের জলছাপে মানুষ অদ্বৈতর পরিচয় তাই আড়াল হয়েছে। কিন্তু বংশের উত্তরাধিকার না-রাখলেও এমনকিছু তিনি রেখে গেছেন, মৃত্যুর ছয় দশক পরেও মানুষ তাঁকে প্রেম ও শ্রদ্ধায় সযত্ন স্মরণে রেখেছে; সোনার হরফে লেখা সোনালি মানুষের তালিকায় তাঁকে স্মরণে রাখবেও যতদিন বাংলা সাহিত্য বেঁচে থাকবে।’
মো. সাহাবউদ্দিন তার ‘অদ্বৈতের ছোটগল্প প্রকরণ’ প্রবন্ধে লেখককে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘অদ্বৈতের ছোটগল্পে কাহিনীর চেয়ে চরিত্রের প্রাধান্য বেশি। গল্পগুলোতে একটি করে যে নির্দিষ্ট ঘটনা রয়েছে তা মূলত চরিত্র উপযোগী পরিমণ্ডল সৃষ্টিতে প্রয়োগ করা হয়েছে।’
সব মিলিয়ে বলা যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ তার সীমিত কাজেই অসীমের মাঝে বিরাজ করছেন। তার গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সব গল্প পাঠের এ সুযোগ পাঠকের জন্য আনন্দের। এমন মহতী কাজের জন্য প্রকাশক ও সম্পাদক ধন্যবাদ পেতেই পারেন। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের গল্পসংগ্রহ
সম্পাদনা: সৌম্য সালেক
প্রকাশক: প্রকৃতি
প্রকাশকাল: ০১ জানুয়ারি ২০২১
মূল্য: ২৪০ টাকা