শিক্ষা যেকোনো দেশের জাতি গঠনে ও জাতীয় উন্নয়নে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে হলে শিক্ষার উৎকৃষ্ট সাধনের বিকল্প নেই। শিক্ষার অগ্রগতি মানেই দেশের উন্নয়নকে সম্মুখগামী স্রোতে এক ধাপ এগিয়ে নেওয়া। দেশের সার্বিক স্বার্থেই শিক্ষাকে ঝামেলামুক্ত ও পরিচ্ছন্ন গতিশীল রাখা প্রয়োজন। শিক্ষাই পারে দেশ, সমাজ, সভ্যতাকে অজ্ঞতা, কুসংস্কারসহ নানামুখী পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করে উন্নয়নের মহাসড়ককে তুলে দিতে।
বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার অচলায়তন ধীরে ধীরে কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। এ অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা কারো মধ্যে নেই। বিশেষ করে শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রবণতা যেমন প্রবল তেমনি লুটপাট ও মানহীন শিক্ষা প্রদান করে মুনাফা অর্জনের মহোৎসব চালানো একমাত্র লক্ষ্য।
এ অচলায়তনের পেছনে প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত হলেও প্রতিকারের কার্যকর ব্যবস্থা যেমন নেওয়া হয়নি তেমনি সেগুলোকে জনসম্মুখে এনে জনসচেতনা গড়ে তোলার আগ্রহ আরও কম। সাহিত্যে এ বিষয়টি আরও বেশি উপেক্ষিত। এ বন্ধ্যাত্বকে দূর করার প্রয়াস নিয়েছেন এ প্রজন্মের অন্যতম কবি, ঔপন্যাসিক ও গবেষক রকিবুল হাসান। তার ‘অগ্নিকা আঁধার’ বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার নামের যে হরিলুট চলছে এবং শিক্ষা নিয়ে কর্তাব্যক্তিদের হরিলুটের কাহিনিতে শিহরিত করা চিত্রের জীবন্ত প্রদর্শন।
নানাভাবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভয়াবহ অবস্থার ইঙ্গিত উঠে এসেছে। দেশ জাতি গঠনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার বাহিরে জাতিসত্ত্বার পরিচয় তথা ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-ধর্মীয় সম্প্রীতি-লিঙ্গ বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা-কুসংস্কারাচ্ছন্নমুক্ত জীবন ব্যবস্থা-দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনাচার শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ কাঠামো-আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক-মানব জীবনে আবেগ, প্রেম ও ভালোবাসার রূপ সব আলোচিত ও চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। এমনকি যে ভাষার ওপর ভিত্তি করে দেশ স্বাধীনতার দিকে হেঁটেছিল এবং লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে কারা এবং কেন কৌশলে অপব্যহার ও অবজ্ঞা করছে তার সুস্পষ্ট চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন এ উপন্যাসে। আর এসব বিষয়কে সম্মিলিতভাবে কথা সাহিত্যের মাধ্যমে ‘অগ্নিকা আঁধার’-এ শিল্পবোধ দিয়ে প্রকাশ করে উপন্যাসটির বহুমাত্রিক বৈচিত্রের স্বরূপ প্রকাশ ঘটিয়েছেন ঔপন্যাসিক রকিবুল হাসান।
॥২॥
মানব সভ্যতার গোড়া পত্তন হয়েছিল উচ্চশিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে। প্রাচীন সভ্যতার সব নিদর্শনগুলোর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিদর্শন উজ্জ্বলতম। বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকায় প্রাচীনকালে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এবং ইউরোপে মধ্য যুগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে।১ মরোক্কোর ‘আল-কারাউইয়িন’ ও মিশরের ‘আল-আজহার’ বিশ্ববিদ্যালয় আফ্রিকার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ এবং এদের মান বা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান নিয়ে কারও মনে এখনো সংশয় নেই। রাজা আলফ্রেডের মাহানুভবতায় ৮৭২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং ১০৭৯ সালে সপ্তম গ্রেগরির এক ডিক্রি জারির মাধ্যমে ইউরোপে শিক্ষা বিস্তার লাভ করে।২ শিক্ষা বিস্তারের শুরুতে ধর্ম ছিল অন্যতম অনুসঙ্গ। এদেশের কেউ কেউ ৩৮৭ খ্রিষ্টপূর্ব প্লেটোর অ্যাকাডেমি এবং এরিস্টটলের লাইসিয়ামকে জোর করে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে হাজির করেন। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান দর্শন চর্চার কেন্দ্র হিসাবে কাজ করতো এবং সবার কাছে সংশয়বাদী দর্শনের চর্চাস্থল হিসাবে পরিচিত হওয়ায় একসময় বন্ধ হয়ে যায়।৩ এগুলোকে কেন বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না তার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে।
শুধু মুখে বা খাতায় লিখিত থাকলে হবে না। শিক্ষককে গম্ভীর ও চিন্তাযুক্ত দেখালে শিক্ষার্থীরা তাকে কিছু জিজ্ঞাস করতে নিরাপদবোধ করবে না। শিক্ষককে হাস্যোজ্জ্বল, আনন্দিত, উৎসাহী ও আগ্রহী থাকতে হবে, ফলে শিক্ষার্থীদের সাথে চমৎকার সম্পর্ক বিরাজ করবে শিক্ষক-ছাত্র নিরাপদ সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেবে।
পৃথিবীর বুকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাল ও স্থান নিয়ে বিতর্ক বহু পুরনো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন মনে করেন, ‘য়ুরোপীয় ভাষায় যাকে য়ুনিভার্সিটি বলে প্রধানত তার উদ্ভব য়ুরোপে। অর্থাৎ য়ুনিভার্সিটির যে চেহারার সঙ্গে আমাদের আধুনিক পরিচয় এবং যার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষিতসমাজের ব্যবহার সেটা সমূলে ও শাখা-প্রশাখায় বিলিতি। আমাদের দেশের অনেক ফলের গাছকে আমরা বিলিতি বিশেষণ দিয়ে থাকি, কিন্তু দেশি গাছের সঙ্গে তাদের কুলগত প্রভেদ থাকলেও প্রকৃতিগত ভেদ নেই। আজ পর্যন্ত আমাদেরবিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে সে কথা সম্পূর্ণ বলা চলবে না। তার নামকরণ, তার রূপকরণ, এ দেশের সঙ্গে সঙ্গত নয়, এ দেশের আবহাওয়ায় তার স্বভাবীকরণও ঘটেনি।
অথচ এই য়ুনিভার্সিটির প্রথম প্রতিরূপ একদিন ভারতবর্ষেই দেখা দিয়েছিল। নালন্দা বিক্রমশিলা তক্ষশিলার বিদ্যায়তন কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার নিশ্চিত কালনির্ণয় এখনো হয়নি, কিন্তু ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, যূরোপীয় য়ুনিভার্সিসিটির পূবেই তাদের আর্বিভাব। তাদের উদ্ভব ভারতীয় চিত্তের আন্তরিক প্রেরণায়, স্বভাবের অনিবার্য আবেগে। তার পূর্ববর্তী কালে বিদ্যার সাধনা ও শিক্ষা বিচিত্র আকারে ও বিবিধ প্রণালীতে দেশে নানা স্থানে ব্যাপ্ত হয়েছিল, এ কথা সুনিশ্চিত। সমাজের সেই পরিকীর্ণ সাধনাই পুঞ্জিভূতকেন্দ্রীভূত রূপে এক সময়ে স্থানে স্থানে দেখা দিল।’৪
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা যদিও শত শত বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে তথাপি মোটা দাগে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বোঝায়, এমন এক শিক্ষায়তন যেখানে বিজ্ঞান এবং ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি মনের উদারতা বৃদ্ধিকারী জ্ঞানশিক্ষা লাভ করা যায়। তবে জার্মান দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ উইলহেলম ভন হামবল্ট এক মেমোরেন্ডামে ‘শিক্ষণ-গবেষণা, শিক্ষার স্বাধীনতা ও স্বাশাসন’-র সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয় বলেছেন।৫
বার্লিনের হামবল্ট বিশ্ববিদ্যালয় এর অন্যতম নির্দশন। এর পাশাপাশি নিউম্যান ও নিউম্যান The Idea of University গ্রন্থে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার তিনটি শর্ত জুড়ে দেন। এক. চূড়ান্ত লক্ষ্য (vision); দুই. আশু কর্তব্য (mission) এবং তিন. মৌলিক মূল্যবোধ (core values)। এ তিনটি শর্তের ব্যাখ্যায় নিউম্যান বললেন, চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ক. বিশ্বমানের পাঠদান এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুনিয়াজুড়ে কেমব্রিজের খ্যাতি বৃদ্ধি করা; খ. উদ্ভাবন, আবিষ্কার, উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে সারা পৃথিবী থেকে সেরা অধ্যাপক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা। আশু কর্তব্য হলো পাণ্ডিত্য ও গবেষণা দ্বারা নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা; খ. কার্যকর ও সময়োপযোগী শিক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞানের আলো চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া; গ. জনসেবার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের প্রয়োগ করা। এবং মৌলিক মূল্যবোধ সম্পর্কে বললেন, ক. চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা; খ. সব ধরনের বৈষম্যহীন পরিবেশ বজায় রাখা।৬
অন্যদিকে বিখ্যাত শিক্ষাবিদ বার্ট্রান্ড রাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারন করে বললেন, ‘the educational system …must aim at producing in the future is one which gives to every boy and girl an opportunity for the best that exists. The ideal system of education must be democratic, although that ideal is not immediately attainable.”৭
বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তার উক্তিটি প্রণিদানযোগ্য: We have therefore to ask on what principle we are to select those who should go to the university. At present they are in the main those whose parents can afford to send them, though this principle of selection is being increasingly modified by the scholarship system. Obviously, the principle of selection ought to be educational, not financial.৮
আর এ শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মানুষের কি পরিবর্তন আসতে পারে বা আসা উচিত, এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘To take a purely imaginary example, a learned man may improve his financial position by teaching brewing instead of organic chemistry; he gains, but learning suffers. If the learned man had a more genuine love of learning, he would not be politically on the side of the brewer who endows a professorship of brewing. And if he were on the side of democracy, democracy would be more ready to see the value of his learning.’৯
বার্ট্রান্ড রাসেল কতক্ষণ পর্যন্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয় টিকে থাকবে এবং তাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে তা উল্লেখ করে বললেন, ‘universities exists for two purposes: on the one hand, to train men and women for certain professions; on the other hand, to pursue learning and research without regard to immediate utility.১০
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মাধ্যমে সনদ নয় দক্ষতা অর্জন করে মারুষের সেবা করতে হয়। দক্ষতা সম্পর্কে বার্টান্ড রাসেল বললেন, first, that no one shall be allowed to undertake important work without having acquired the necessary skill; secondly, that this skill be taught to the ablest of those who desire it, quite independently of their parents’ means. It is obvious that these two rules would enormously increase effectively.১১
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ কি হওয়া উচিত এই প্রসঙ্গেও তার দর্শন বা চিন্তা প্রাসঙ্গিক। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘every university teacher should be himself engaged in research and should have sufficient leisure and energy to know what is being done in his subject in all countries. In university teaching, skill in pedagogy is no longer important; what is important is knowledge of one’s subject and keenness about what is being done in it. This impossible for a man who is overworked and nervously exhausted by teaching. His subject is likely to become distasteful to him, and his knowledge is almost sure to be confined to what he learnt in youth. Every university teacher ought to have a Sabbatical year (one in every seven) to be spent in foreign universities or in otherwise acquiring knowledge of what is being done abroad…. A teacher should not be expected to work long hours at teaching, and should have abundant leisure for research; but he should be expected to employ this leisure wisely.’১২
অধ্যক্ষ গোলসান আরা বেগম শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীকে দক্ষ ও কর্মমুখী করে তোলার দশটি উপায় বললেন। তার মতে পাঠদান মূল্যায়নের জন্য পরিমাপকগুলো হলো: ১. উপস্থিতি; ২. শ্রেণি ভিত্তিক মূল্যায়ন; ৩. এসাইনমেন্ট (একক ও দলীয়); ৪. আচরণ, মূল্যবোধ, সততা; ৫.বক্তব্য উপস্থাপন (একক, দলভিত্তিক, আলোচনা), ৬. নেতৃত্বের গুণাবলী; ৭. নিয়মানুবর্তিতা; ৮. সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ; ৯. খেলাধুলায় কৃতিত্ব এবং ১০. উন্মূক্ত চিন্তার মাধ্যমে মেধার সঠিক ব্যবহার করা।১৩
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম কাজ হলো দেশিয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে বিদেশি এবং আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের শাখাসমূহকে চর্চা করে দেশের সার্বিক কল্যাণে ভূমিকা রাখা। যে শিক্ষা কেবল দেশিয় উপাদান বা বিদেশি তথ্যের উপর নির্ভরশীল তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতামত হলো, ‘অসভ্যেরা যেমন গায়ে রঙ মাখিয়া, উল্কি পরিয়া, পরম গর্ব অনুভব করে-স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের উজ্জ্বলতা এবং লাবণ্য আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে, আমাদের বিলাতি বিদ্যা আমরা সেইরূপে গায়ের উপর লেপিয়া দম্ভভরে পা ফেলিয়া বেড়াই, আমাদের যথার্থ আন্তরিক জীবনের সহিত তাহার অল্পই যোগ থাকে। অসভ্য রাজারা যেমন কতকগুলো সস্তা বিলাতী কাঁচখন্ড পুঁতি প্রভৃতি লইয়া শরীরের যেখানে সেখানে কুলাইয়া রাখে এবং বিলাতি সাজসজ্জা অযথাস্থানে বিন্যাস করে, বুঝিতেও পারে না কাজটি কিরূপ অদ্ভুত এবং হাস্যজনক হইতেছে, আমরাও সেইরূপে কতকগুলো সস্তা চক্-চকে বিলাতি কথা লইয়া হয়তো সম্পূর্ণ অযথাস্থানে অসংগত প্রয়োগ করি; আমরা নিজেও বুঝিতে পারি না অজ্ঞাতসারে কী একটা অপূর্ব প্রহসন অভিনয় করিতেছি এবং কাহাকেও হাসিতে দেখিলে তৎক্ষণাৎ য়ুরোপীয় ইতিহাস হইতে বড়ো নজির প্যয়োগ করিয়া থাকি।’১৪
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ছিলেন উদ্ভিগ্ন। সে উদ্ভিগ্নতা আজও কাটেনি। বরং এর কালো মেঘ আরো ঘনীভূত হয়েছে। এ ব্যবস্থার ভয়াবহতা হলো ‘সমস্ত জীবনের শিকড় যেখানে সেখান হইতে শত হস্তে দূরে আমাদের শিক্ষার বৃষ্টিধারা বর্ষিত হইতেছে; বাধা ভেদ করিয়া যেটুকু রস নিকট আসিয়া পৌছিতেছে সেটুকু আমাদের জীবনের শুদ্ধতা দূর করিবার পক্ষে যথেষ্ট নহে। আমরা যে শিক্ষার আজন্মকাল যাপন করি সে শিক্ষা কেবল যে সিন্দুকের মধ্যেই যে আমাদের সমস্ত বিদ্যাকে তুলিয়া রাখিয়া দিই, আটপৌরে দৈনিক জীবনে তাহার যে কোনো ব্যবহার নাই, ইহা বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীগুণে অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠিয়াছে।’১৫ তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে কখনো ‘বিদ্বানের আসন চিরপ্রসিদ্ধ’ বলেছেন আবার কখনো ‘একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র’১৬ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
কাজী নজরুল ইসলামও উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষকের করণীয় ও শিক্ষার লক্ষ্য নিয়ে কথা বলেছেন। তার ‘জাতীয় শিক্ষা’ প্রবন্ধে শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেছেন, ‘এখন যে পদ্ধতিতে জাতীয় শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যৎ আশা-ভরসার স্থল নব উদ্ভাবিত জাতীয় বিদ্যালয়ে দেওয়া হইতেছে, তাহাও ঠিক ঐ রকম বিলিতি শিক্ষায় ট্রেড মার্ক উঠাইয়া ‘স্বদেশী’ মার্কা লাগাইয়া দেওয়ার মত।’১৭ এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্য প্রধান অন্তরায়কে চিহ্নিত করে ’জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘এই জাতীয় বিদ্যালয়ে কাঁচা অধ্যাপক নিয়োগ লইয়া যে ব্যাপার চলিতেছে তাহা হাজার চেষ্টা করিলেও চাপা দেওয়া যাইবেনা; মাছ দিয়ে শাক ঢাকা যায় না। কাঁচা অধ্যাপক মানে বয়সে কাঁচা নয়, বিদ্যায় কাঁচা।’১৮
শিক্ষক নিয়েগের এ হরিলুট গাধা মার্কা কাজ আজও চলমান। ফলে প্রায়ই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক নিয়ে নানা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক নিয়ে মাসুম বিল্লাহর পর্যবেক্ষণ যুক্তিযুক্ত। তিনি মনে করেন ‘বন্ধুত্বের সম্পর্ক বলতে এখানে নিরাপদ সম্পর্কই নির্দেশ করে। একজন শিক্ষার্থী যাতে অ্যাকাডেমিক এবং নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রশ্ন ও আলোচনা শিক্ষকের সাথে করতে পারে। শিক্ষককে দেখে যাতে শিক্ষার্থী ভীত না হয়, ইতঃস্থত না করে, সত্য গোপন করার চেষ্টা না করে সেই বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা শিক্ষককে কাজে প্রমাণ করতে হয়। শুধু মুখে বা খাতায় লিখিত থাকলে হবে না। শিক্ষককে গম্ভীর ও চিন্তাযুক্ত দেখালে শিক্ষার্থীরা তাকে কিছু জিজ্ঞাস করতে নিরাপদবোধ করবে না। শিক্ষককে হাস্যোজ্জ্বল, আনন্দিত, উৎসাহী ও আগ্রহী থাকতে হবে, ফলে শিক্ষার্থীদের সাথে চমৎকার সম্পর্ক বিরাজ করবে শিক্ষক-ছাত্র নিরাপদ সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেবে।’১৯
॥৩॥
শিক্ষার মূল কাজ হলো একজনকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাওয়া। এ আলোর পথে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক প্রস্তুতি পর্ব এবং বিশ্ববিদ্যালয় হলো বাস্তবরূপদানের চর্চা কেন্দ্র। এখানে প্রতিটি ব্যক্তি মানুষ হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের কৌশল ও কারণ উপলব্দি করে এবং মানব রহস্যের সৌন্দর্যকে বিকশিত করে। এ বিকাশধারার রূপ ও স্বরূপ নিয়েই আলোচনা করেছেন রকিবুল হাসান অগ্নিকা আঁধার-এ। এ রূপ উন্মোচনের প্রধান লক্ষ্য হলো দেশাত্ববোধকে জাগিয়ে তোলা এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির দীর্ঘ ইতিহাসকে চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য অর্জনে ঐক্যবদ্ধ কাজের জন্য অনুপ্রেরণা ও দিক নির্দেশনা দেয়া। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত ছাড়া স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে গল্প, উপন্যাস, নাটক যেমন লেখা হয়নি তেমনি কোন সিনেমাও তৈরি হয়নি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামও কেবল প্রবন্ধ লিখে ক্ষান্ত ছিলেন। ফলে একটি জাতি দিনে দিনে শিকড়ের সন্ধান না করে পরচর্চায় ধাবিত হতে থাকে। আবার আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত কেবল শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সংকুচিত ছিল। ফলে শিক্ষা অর্জনের মূল বা অভিষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কেও পাঠকের সব ধারণা লাভ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এ প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস কবি ও ঔপন্যাসিক রকিবুল হাসান ‘অগ্নিকা আঁধার’ লিখে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে একজন কিভাবে পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারে তা জীবন্ত করে তুলে এনেছেন।
তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি প্রাপ্তি বা টিকিয়ে রাখতে যদি অস্বভাবিক যৌনাচারে লিপ্ত হতে বাধ্য করা হয় তখন সেখানে আর শিক্ষার পরিবেশ থাকে না। এসব যেন স্বাভাবিক ও সহনীয় হয়ে ওঠে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এ অনৈতিক কর্মকাণ্ড কেবল পুরুষরাই করেন বা ফাঁদ তৈরি করে শিকার করেন তাও নয়। অনেক ক্ষেত্রে নারীও তার স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য অনুরূপ কৌশল নিয়ে থাকেন।
উপন্যাসের সবচেয়ে স্বার্থক দিকটি হলো বিষয়বস্তুর পাশাপাশি নতুন নতুন চরিত্র তৈরি করা যা বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রার সংযোজন করেছে। যেমন বেসকাররি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি ও চেয়ারম্যানের মাঝখানে অর্ধমুর্খ ‘সিসি’ (চিফ কোঅর্ডিনেটর) এবং ‘বুড়োর বউ’ চরিত্র দু’টি পাঠক চিত্তে এমনভাবে নাড়া দেয় যার মাধ্যমে প্রকৃত বার্তা গ্রহণে সবাই উদগ্রীব হয়ে ওঠে। আবার অস্বাভাকি প্রেমের কাহিনী যেন মানুষকে বিরক্তির দিকে ঠেলে না দেয় সেজন্য লেখকের কলমে কৃষ্ণার মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা মানবীয় প্রেমের প্রকাশ ঘটিয়েছেন যেন মানুষ তার প্রকৃত জায়গা চিনে দিতে পারে।
এ উপন্যাসটি প্রচলিত ধারার বাহিরে নতুন আঙ্গিক তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে। ‘চেয়ার ও মধুমক্ষিকা’, ‘সাধকের সাজা’, ‘নষ্টরাজের ফাঁদ’, ও ‘তবু আলো’ শীর্ষক পাঁচটি উপশিরোনামে বিভক্ত করে গল্পকে শব্দমালা দিয়ে গেঁথেছেন। এ গাঁথুনির ফলে প্রত্যেকটি আখ্যানকে আলাদা করে পড়লেও নতুন বার্তা পাওয়া সম্ভব যা প্রচলিত উপন্যাসে খুব একটা দেখা যায় না। উপন্যাসটির মূল উপজীব্য বিষয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হলেও বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, বৃটিশ উপনিবেশবাদ ও পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ এবং নব্বইয়ের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জাতির সংগ্রাম এবং অর্জনও নির্ভুলভাবে রচিত হয়েছে। এখানে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও কেয়া, গগণ হরকরাসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অবস্থা ওঠে এসেছে যেন বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তব অবস্থান মূল্যায়ন করা যায়। লেখকের মধ্যে ব্যক্তিত্ব, দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে হার না মানা লড়াই করার প্রবনতা এবং ঐতিহ্যপ্রীতি ও ইতিহাসপ্রেম ছিল অকল্পনীয় মাত্রায় যা তিনি ড. অনিন্দ্য অর্ঘের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। তিনি উপন্যাসে লালন ফকির, হাছন রাজা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, মীর মোশাররফ হোসেনসহ সকল মৌলিক সাহিত্যিকে যেমন তুলে এনেছেন তেমনি অনেক বিস্তৃত হয়ে যাওয়া মোহাম্মদ নজিবর রহমান ও আকবর হোসেনের মত ঔপন্যাসিক ও সাহিত্যিকদের কথা জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন। তেমনিভাবে কাঙাল হরিনাথকে টেনে এনেছেন প্রাসঙ্গিকভাবে। তিনি উপন্যাসে টেনে এনেছেন শহরের চোখজ্বলসানো প্রতারণার ফাঁদ ও গ্রামীণ সহজ সরল জীবানাচার। পুরো উপন্যাসের কোথাও ধর্মীয় বিভেদ, বর্নবাদী চিন্তা, লিঙ্গ বৈষম্য ও শ্রেণি বৈষম্যকে স্থান না দিয়ে বরং বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের পথ তৈরি করে দেখিয়েছেন।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হলেও সিসি, ড. ফারজানা, এডমিন অফিসার ফারিহা, পিয়ন আরিফুল ও বিওটি অফিসের সমন্বয়ক এম. জামাল খান এমনভাবে পটভূমিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন যা উপন্যাসটিকে সার্থক জায়গায় স্থান করে দিয়েছে। উপন্যাসে সবচেয়ে বেশি স্থান জুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের হালচাল, বাংলার শিক্ষকদের যোগ্যতা, তাদের নিয়ে কর্তৃপক্ষের চিন্তাভাবনা ও দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত খ্যাতিমান শিক্ষক ও সাহিত্যিকদের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার অপকৌশল ঠাই পেয়েছে সঙ্গত কারণে। এমনকি দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্বদ্যিালয়ের অযোগ্য শিক্ষক ও কর্মকর্তারা নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে চরিত্র বিকিয়ে দেওয়া ও হরণের মতো পথকে অবলীলায় বেছে নেন কিভাবে তার এক জীবন্ত ক্যানভাস তুলে ধরেছেন এখানে।
উন্যাসের শুরুর অংশে চোখ রাখলে একটি ভয়ঙ্কর চিত্র অনুধাবন করা সহজ হয়ে যায়। যেখানে শুরু হয়েছে “বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চিফ কো-অর্ডিনেটর অব্দুল করিম হুট করেই বাংলা বিভাগের চেয়ারপারসন সুদর্শনা ড. ফারজানার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কে একটা দূরত্ব তৈরি করে ফেললো। ইচ্ছে করেই। …নাকি ড. ফারজানার সর্বস্ব পাবার পর তার মোহ্ শেষ হয়ে গেছে-দুপুরের তাতানো রোদ্দুর সরে নিস্তেজ বিকেল নেমে এসেছে।…ড. ফারজানা ভাবনায় কোন কূলকিনারা খুঁজে পায় না। কেমন যেন ভয় হয়-শেষপর্যন্ত আমার চাকরিটা থাকবে তো! চাকরিটা তো ওনার হাতে। …ড. ফারজানা সে গল্পে আবেগময় চমৎকার শব্দ ও বিশেষণ প্রয়োগ করে আরো প্রাণবন্ত করে তোলে। প্রায় দিনই দুপুরে দুজনে এক সাথে খায়। … উপাচার্য ড. শাহেদ ফারজানা তার বিশেষ অনুগত। দু’জনের অন্তরঙ্গ গভীর সম্পর্ক রয়েছে।”২০
এখানে কয়েকটি অস্বাভাবিক বিষয় ওঠে এসেছে। এক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালনা পরিষদের বাহিরে সিসি নামক পদে আসীন ব্যক্তিরা কিভাবে একটি সুন্দর ব্যবস্থাকে কুখ্যিগত করে। দুই, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যবৃন্দ কেন নপংশু হয়ে যান। তিন, একজন শিক্ষক নিজের চাকুরি বাঁচানোর জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে হলেও সমাজে সম্মানের আসনের টিকে থাকার অপচেষ্টায় কিভাবে লিপ্ত হয়ে পড়েন। চার, সমস্ত অপকর্ম দিবালোকের মত প্রকাশ পেলেও কেন না দেখার মত করে সবাই এড়িয়ে যান। এবং পাঁচ, চাকরি হারানোর ভয় নিয়ে প্রতিনিয়ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করলে জাতির উপকার কতটুকু হবে। এসব প্রশ্নকে ঘুরে ফিরে নানা ঘটনার মাধ্যমে তুলে এনেছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসির ক্ষমতা ও চরিত্র ভিসির মুখে তুলে এনে বললেন, “একটা বিশ্ববিদ্যালয়; সেখানে ভিসির কোন ক্ষমতা নেই! বিদেশে পড়ালেখা করে, দামি দামি ডিগ্রি নিয়ে, সারাজীবন শিক্ষকতায় কাটিয়ে, এখন ভিসি হয়ে তার ফাইল অনুমোদনের জন্য পড়ে থাকে অবসরপ্রাপ্ত এক মেজরের টেবিলে! ট্র্যাজেডি! আসলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির কোন ক্ষমতা নেই। বোর্ডের কেরানির দামও আমার থেকে অনেক বেশি।”২১ “আসলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির কোন ক্ষমতা নেই।”—এ উক্তিটি চারজন ভিসির মুখ দিয়ে পাঁচবার বলিয়েছেন যেন প্রকৃত চিত্র ওঠে আসে।
ভিসি ড. শাহেদ জাহান দায়িত্বপালনে প্রতিবন্ধকতা কেবল সিসিরাই নয়। নিজের নৈতিক স্খলন ও আখের গোঁচানোর মনোভাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বারোটা বাজিয়ে দেন। ড. ফারজানার সাথে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উপনীত হলে ভিসিকে বলতে পারেন, “আমি তো ওখানে [হোটেল ব্লুবার্ড] আপনার সাথে বছরখানেক যাচ্ছি। তার আগে অন্য আরও কাউকে নিয়ে যেতেন নাকি?… আপনি ভিসি স্যার-কতো ক্ষমতা আপনার-দেখতেও সুপুরুষ-নামের সাথে বিদেশী কতো বড়ো ডিগ্রি। প্রতিদিনই কতো সুন্দরী ললনা আপনার সাক্ষাতপ্রার্থী হয়ে থাকে, চাতক পাখির মতো।… আপনি ভিসি স্যার হলেও পুরুষ মানুষতো! আমার মতো কত ড. ফারজানা আপনার বাহুলগ্না হয়েছে কে জানে!”২২ এটি প্রতিকী সম্পর্ক। কেননা, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পর সময় কাটানোর জন্য মূলত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে যোগদান করেন। ফলে মালিক পক্ষ বা তাদের নিয়োগকৃত এজেন্টরা কখন কি করে তা নিয়ে মাথা ঘামান না। বরং তারা যা করেন তাই চোখ বন্ধ করে করে জ্বি হুজুর বলে যান। তাই অনিন্দ্য অর্ঘ বললেন, “বিওটি অফিসের পিয়নও অনেক ক্ষমতার মালিক। তাকেও অনেকে সমাদার করে চলে। সেখানে বিওটির চিফ কোঅর্ডিনেটর মানে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অনেকটা ঈশ্বরের মতো।”২৩
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও কর্মরত শিক্ষকবৃন্দের একটি বড় অংশের যোগ্যতা ও নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এ বিতর্কের কারণও ওঠে এসেছে সুন্দরভাবে ড. ফারজানার মুখ দিয়ে। তিনি বললেন, “এতো পড়ালেখা করে, এমফিল, পিএইচডি করে চাকুরি পাইনি। চাকুরি পেতে হয়েছে ভিসি স্যারের বিশেষ প্রস্তাবে। কেউ জানে না কী সেই প্রস্তাব। কেউ জানে না কিভাবে আমার চাকরি হয়েছে! সবাই জানে আমার যোগ্যতায় চাকরি হয়েছে। কিন্তু আমি তো জানি যোগ্য ব্যক্তিকে চাকরি না দিয়ে চাকরিটা দেয়া হয়েছে আমাকে। আমি তো জানি যে ছেলেটাকে বাদ দেয়া হয়েছে , সে কত বেশি যোগ্য ছিল আমার চেয়ে। যোগ্যতায় চাকরি হলো নাতার, চাকরি হলো আমার; শাহেদ জাহান স্যারের বিশেষ অনুকম্পায়; উনি যখন যেভাবে আমাকে চাবেন, আমাকে তখন তার জন্য সকালের তাজা পুষ্প হয়ে ফুটে উঠতে হবে। হায় চাকরি! সেই চাকরি এখন তো আমাকে রীতিমতো রক্ষিতা বানিয়ে ফেলেছে। তারপর ক্ষমতার তরবারি আমার গলায় ঠেকিয়ে আব্দুল করিমও খেলছে। …সমাজে সবাই ড. ফারজানাকে কতো সম্মান করে, কতো আদর্শবতী নারী মনে করে! সত্যিকারের ড. ফারজানা যে পতিতার থেকেও জঘন্য-আমি এই সত্য কিভাবে বলি-কাকে বলি!… আমি এই সমাজকে; সমাজের মানুষকে কিভাবে বলি ভগবানের মতো এই সব মানুষ; যাদের আমরা পুজো করি; এরা শয়তান।”২৪ এসব ঘটনা ব্যক্তি বিশেষে নয়। হরহামেশাই ঘটে, যা আমাদের আড়ালে থেকে যায়।
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা কল্পনাও করা যেতো কি না, প্রশ্ন থেকে যায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। জাতীয়তাবাদের পরিচয় নিহিত আছে। স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা সগৌরবে হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে অন্তর থেকে চর্চা করা এবং এর মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে আত্মপরিচয়কে সুসংহত করার নামে যে নেংরা মানিসক সকল পর্যায়ে কাজ করে তার মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে এখানে। সিসি আব্দুল করিমসহ বেশ কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকতার মুখ থেকে বেরিয়েছে “বাংলায় তো কেউ পড়ে না রে ভাই। আর বাংলায় পড়েই বা কী হয়! বাংলায পড়ে কোর্স চাকরি হয়? আপনিই বলেন বাংলায পড়ে কী চাকরি হয়?” প্রচণ্ড শ্লেষাতত্মক কথায় নিহিত আছে অজ্ঞতার ষোলকলা। যার ফলে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগেরর জন্য কোন বরাদ্ধ থাকে না এবং শিক্ষকের বেতন সর্বন্মি নির্ধারণ করা হয়। এমনকি এসব বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে নিম্নগামী হয় এবং ইনপেরিয়র কমপ্লেক্সিটিতে ভোগতে থাকেন।
অর্ধশিক্ষিত অবসর প্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পদে আসিন হয়ে আসেন এবং সত্যিকারের শিক্ষকবৃন্দের সাথে অমানবিক র্দূব্যবহার করেন তখন তাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় কিনা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি প্রাপ্তি বা টিকিয়ে রাখতে যদি অস্বভাবিক যৌনাচারে লিপ্ত হতে বাধ্য করা হয় তখন সেখানে আর শিক্ষার পরিবেশ থাকে না। এসব যেন স্বাভাবিক ও সহনীয় হয়ে ওঠে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এ অনৈতিক কর্মকাণ্ড কেবল পুরুষরাই করেন বা ফাঁদ তৈরি করে শিকার করেন তাও নয়। অনেক ক্ষেত্রে নারীও তার স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য অনুরূপ কৌশল নিয়ে থাকেন।
কিন্তু কারও কারও মাঝে উপলব্ধি আসে। কিন্তু ফিরে আসার সুযোগ থাকে না। তেমনি একবার ড. ফারজানার মুখে শোনা যায়, “একসময় কতো স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হবো। হলামও। কখনো কি ভেবেছি ভেতরে এত জঘন্য কদর্যরূপ! অথচ বাইরে থেকে মানুষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মন্দির মসজিদের মতো পবিত্র মনে করে।”২৫
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ গল্পের কথা সবার মনে আছে। যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘যে তৈল দিতে পারিবে, তাহার বিদ্যা না থাকিলেও প্রফেসর হইতে পারিবে।”২৬ ঠিক এমন চিত্র বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে দেখা যায়। আর ভয়াবহ কৌশল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দেশে সার্বিক অবস্থা ধীরে ধীরে কত নাজুক হতে পারে তা বুঝা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তৈল মর্দন করে চাকরিটা করা কি সত্যি জরুরি! যতটা জরুরি তার চেয়ে মানসিক বিকৃতির কারণে এমন মিথ্যাচার ও অস্বাভাবিক যৌনাচারে লিপ্ত হয়ে ওঠেন। উল্লেখ্য “ফার্স্ট ক্লাস পেতেই কতো জলে কতো কাপড় ভেজাতে হয়েছে, কতো জনকেই তো কত জলে নামতে দেখেছি, কাপড় ভেজাতে দেখেছি। আর চাকরি, সেটা তো আরো বড়ো ব্যাপার!”২৭-এমন ভয়ানক তথ্যের পর যখন ড. ফারজানা সিসিকে বলেন “আমার তো ভিসি স্যারকে দরকার নেই। আমার জন্য আমার সিসি স্যার আছেন; যে আমার দেবতা; যে আমার ভগবান।”২৮
তখন বিকৃত মস্তিষ্কের অন্দর মহলের নোংরামোকে পরিমান করা যায় না। এ নষ্টামি কেবল শিক্ষাঙ্গনে নয়, সাহিত্যাঙ্গানেও ব্যাপকভাবে ঢুকে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সাহিত্য পুরষ্কার নিয়ে যে তুঘলকি কারবার হচ্ছে তা এর জলন্ত উদাহরণ। ড. ফারজানার স্বামী কবিতা লিখেন। তাই মুখ দিয়ে বলালেন, “কবিখ্যাতির জন্য মরিয়া হয়ে থাকে। একটা রাজনৈতিক দলের সাথেও লেগে আছে; নেতাদেরপিছেনে ঘোরে; একটা বড় পুরস্কার নিয়েই ছাড়বে; এরকম ভাব!”২৯
সত্যিকারের গবেষক হিসেবে শিখালেন গবেষণাপত্র কিভাবে লিখতে হয়, অনুষ্ঠান কিভাবে করতে হয়, জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলে সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন পদ্ধতি এবং মানুষকে ভালবাসার সহজ উপায় শিখালেন। সে মানুষটির প্রতি প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়েছে অনেকে এবং শত অপকৌশল ব্যবহার করে তাকে অপদস্থ করার চেষ্টাকে নৎসাৎ করে দৃঢ় চিত্তে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হলেন সবার কাছে।
ড. এলিনা অন্য চরিত্র, “অর্ধনগ্ন বক্ষের এক সুন্দরী মহিলা”। সব বিকিয়ে দিয়ে পিইউচডি ডিগ্রি অর্জন করার পর, নিজের রূপকে পুঁজি করে অন্যকে আকৃষ্ট করা যার কাজ। সমাজে দ্বন্দ্ব তৈরিতে সিদ্ধহস্ত তিনি। এ দ্বন্দ্ব তৈরিতে প্রচলিত বাঙালি নারীর একটি কৌশল ব্যবহার করেন ড. এলিনা। বস্তা পচা কু-লেখক হয়েও রূপের কারণে সিসির আনুকূল্য লাভ করে ড. ফারজানাকে খোঁচা দিয়ে বললেন, “আমার নাম শোনেননি আপনি? অথচ বাংলা সাহিত্য পড়ান!”৩০ এ খোঁচার মাধ্যমে লেখকের সমাজ বিনষ্টকারীদের জন্য একটি সুন্দর বার্তা দিয়েছেন যা পরবর্তীতে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নোংরা পথে সবাই যেন উপঢৌকন আদান প্রদান কওে সমাজের উঁচু স্তরে বসবাস করতে চায়। মানসিক শান্তি বিসর্জন দিয়ে শারিরীক ও মানসিক সুখের পিছনে নিরন্তর ছুটে চলা যেন একমাত্র কাম্য। নিশ্চিত পতনের কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেও মানসিক রোগীর মতো বেল তলায় বার বার পা রেখে নিঃশেষ হয়েও নষ্ট পথেই সুখ খোঁজেন।
ভিসি বা সিসি নন এমনকি খ্যাতিমান শিক্ষক ও সাহিত্যিকরাও অপকর্মকে উপভোগ করেন। তেমনি এক চরিত্র প্রফেসর ড. তপোবন। এ তপোবন ক্লাস না নিয়ে বিল সাবমিট করা এবং বিশেস সুন্দরীদের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রধান করে রক্ষিতা বানিয়ে রাখার মত গর্হিত কাজও করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাংলা শিক্ষকের কুকর্ম ফাঁস হওয়ার পর এ বিষয়টি আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
লেখকের কলমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক পক্ষের মূল লক্ষ্যকেও তোলে এনেছেন যেন শিক্ষা ব্যবস্থার এ দূরাবস্থা থেকে জাতি মুক্তি পায়। তাই ভিসি ড. শাহেদ জাহানের মুখে বলালেন “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কিছু হিসেবে করে চলতে হয়। পালস্ বুঝে চলতে হয়। চেয়ারম্যান তো ব্যবসা করা লোক। উনি কি তোমার আমার মতো ডক্টরেট করা লোক! উনি কি পড়ালেখার ডিসিপ্লিন বুঝেন?বুঝবেন না। তাকে যা বোঝানো হবে, তাই বুঝবেন।”৩১
এমনকি নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যেও অস্বচ্চতা সর্বত্র। চেয়ারম্যান বা তার প্রতিনিধি সিসি ঠিক করেন কে বা কারা নিয়োগ পাবেন। কিন্তু এ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে ভিসি বলেন, “কিন্তু বোর্ডের কাছে এসবের কোন দাম নাই। বোঝ না ব্যবসা করে! এরা এসবের কী বুঝবে! এরা দেখবে কিভাবে টাকা আসবে, কিভাবে কত টাকা কম দিয়ে কাজ করানো যায়। এখানে তো বেতনের কোন অবকাঠামো নেই। যাকে যেমন পারে দিয়ে, চালাচ্ছে। একটা নিয়ম থাকবে না? আমি অনেকবার বলেছি । কাজ হয়না।… আর বাংলা বিভাগের কথা তো শুনতেই পারে না। …যদি হঠাৎ শোনো, ড. এলিনাকে চেয়ারপারর্সন করে তোমাকে বাদ দিয়ে দিযেছে অবাক হওয়ার কিছু নাই।”৩২
এমন মেরুদণ্ডহীন ভিসি নিয়োগ প্রাপ্ত হয় অবসার প্রাপ্তদের মাঝ থেকে। তারা কেবল সময় কাটিয়ে বাসায় চলে যান এবং মাস শেষে কোন ঝামেলা ছাড়া বেতন পেলেই খুশি। কিন্তু কেমন ভিসি নিয়োগ দেওয়া উচিৎ তার একটি রূপরেখা দাঁড় করিয়েছেন রকিবুল হাসান। নারী কেলেঙ্কারিতে চাকরি হারানো ড. শাহেদ জাহানের জায়গায় ড. সাদিক আহসান নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে অতি অল্প সময়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে কিভাবে অন্য উচ্ছতায় নেয়া যায় তা দেখিয়ে দিলেন। এর প্রধান কারণ তিনটি। এক, তিনি কোন অবসার প্রাপ্ত শিক্ষক নন। তিনি বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতার সাথে কর্মরত আছেন। দুই, তাঁর মাঝে দেশাত্মবোধ ও আগামী প্রজন্মকে দেশের সম্পদ বানানোর দৃঢ় অঙ্গিকার ছিল। তিন, তিনি দুর্নীতিকে ঘৃণা করেন।
তৈল মর্দন ও ব্যক্তি স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যারা সব সময় ব্যস্ত থাকেন তারা কখনো জ্ঞান চর্চায় নিয়োজিত হোন না। কিন্তু ড. সাদিক আহসান ব্যতিক্রম। তিনি প্রত্যেকের মাঝে ইতিহাস-ঐতিহ্যের চেতনা বোধ জাগ্রত থাকুক তা কামনা করেন বলেই সবার প্রতি উদ্বার্থ আহ্বান জানান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসু, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-নজরুল-জীবনানন্দ দাশ-জসীম উদ্দীনসহ সকল বিপ্লবী নেতা ও সাহিত্যিকদের বিষয়ে চর্চার তাগিদ অনুভব করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা ও চর্চার বিষয়ে বিশেষ জোর দেন এবং সকল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্চ ও যোগ্যদের স্থান দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। সত্যিকার অর্থে এসব রকিবুল হাসানের রূপরেখা।
বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষপট পরিবর্তনের সাথে সাথে অন্ধকার জগতে মানুষের যে বিচরণ বেড়েছে তা অনেকটাই দিবা লোকের মত সত্য। নারীবাদীরা যতই চিৎকার দিয়ে বলুক পুরুষরা কেবল নারী নির্যাতনে সিদ্ধ হস্ত। নারীরা নিষ্পাপ। কিন্তু রকিবুল হাসান দেখিয়েছেন নারীরাও কতটা নগ্ন হয়ে পুরুষের কামনা বাসনাকে সার্থক করে তোলে নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থকে চরিতার্থ করার লকেআষ্য। প্রয়োজনে অন্য নারীর প্রতি সহিংস হতে কুন্ঠাবোধও করে না। ড. ফারজানা. ড. এলিনা ও ড. ছবি সায়ন্তি কতটা নিলর্জ ও নিচু হতে পারে, তা তাদের কর্মকাণ্ড ও অসৎ উপায়ে ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
স্বর্বস্ব বিকিয়ে দেয়া মানুষেরা বহুগামী হতে সংকোচবোধ কওে না এবং নিজের ঘরের মানুষের প্রতি তৃপ্ত নয়। ড. ফারজানা ও ড. সায়ন্তি অনেক পুরুষের পাশাপাশি তুষার পারভেজকে সন্তোষ্ট করতে ব্যস্ত সব সময় তার ক্ষমতা ও অর্থের কারণে। একই দিনে দৈবক্রমে ড. ফরজানা ও ড, সায়ন্তি তুষার পারবেজকে সন্তোষ্ট করার চেষ্টা করলে বেরিয়ে আসে অন্ধকার জগতের খাতা। রকিবুল হাসান এ দৃশ্যকে তোলে আনেন অসাধারণ শব্দমালা দিয়ে। তিানি লিখলেন, “গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। ড. সায়ন্তি চমৎকার করে নিজেকে সাজালেন। তুষার পারভেজের পছন্দের শাড়ি পরলেন। তুষারের দেওয়া গহনায় নিজেকে আলিয়া ভাটের মতো করে সাজালেন। তারপর নীরবে সোনার তরী রিসোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। তুষার পারভেজকে বড় ধরনের সারপ্রাইজ দেবেন বলে নিজের মন পেখম মেলে খুশির পালে উড়তে থাকে।…নিজের চোখকে অবিশ্বাস্য মনে হয় তার; মনে হলো গোটা পৃথিবীটাকেই ভুল দেখছেন ড. সায়ন্তি। যেন কোথেকে মুঠোমুঠো আগুন তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। চিতার আগুনের মতো মন দাউ করে জ্বলছে।…ড. ছবি সায়ন্তি কোন রাগ নয়; কোনো ক্ষোভ নয়; কোনো কৈফিয়ত নয়; কোনো অভিযোগ নয়; একেবারে শান্ত নদীর মতো চোখভরা পানি চোখে; ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললেন, তুষার, তুমি আমাদের দু’জনের যে কোন একজন বেছে নাও; যদি মনে হয় তুমি ড. ফারজানার সাথে সম্পর্ক রাখবে, আমি একটুও বাধা দেবো না। আমি নীরবে তোমার জীবন থেকে সরে যাবো। তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটাও ছেড়ে দেবো। আর যদি আমার সম্পর্ক রাখতে চাও ড. ফারজানাকে চিরকালের মতো তোমাকে ভুলে যেতে হবে। তোমাকে জোর করছিনে। তুমি এক্ষনি আমাকে জানাবে। আমি এ জন্যই তোমাকে আসতে অনুরোধ করেছি।”৩৩
কিন্তু নষ্টদের ভিড়ে টিকে থাকা কঠিন। আর নষ্টদের লালন পালন করে ব্যবসা করা যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক পক্ষের লক্ষ্য তখন সত্যিকার অর্থে যোগ্যদের স্থান পাওয়া কঠিন। এর মধ্যেই ড. সাদিক আহসানের নেতৃত্বে বাঘা যতিন বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করেবাংলা বিভাগের দায়িত্ব দিলেন ড. অনিন্দ্য অর্ঘকে। যিনি সাহিত্যিক হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত এবং ব্যক্তি হিসেবে শ্রদ্ধেয়। অল্প দিনের মধ্যে তিনি বাংলা বিভাগকে যেমন সাজিয়ে নিলেন তেমনি আশা জাগানিয়া দেশ প্রেমে উদ্ধুদ্ধ কররেন সবাইকে। অনেককের হৃদয়ের গহীনে আগুন জ্বললেও তিনি নিজেকে সে আগুনে না জ্বালিয়ে ব্যক্তিত্বের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। সত্যিকারের গবেষক হিসেবে শিখালেন গবেষণাপত্র কিভাবে লিখতে হয়, অনুষ্ঠান কিভাবে করতে হয়, জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলে সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন পদ্ধতি এবং মানুষকে ভালবাসার সহজ উপায় শিখালেন। সে মানুষটির প্রতি প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়েছে অনেকে এবং শত অপকৌশল ব্যবহার করে তাকে অপদস্থ করার চেষ্টাকে নৎসাৎ করে দৃঢ় চিত্তে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হলেন সবার কাছে।
প্রধান চরিত্র ড. অনিন্দ্য অর্ঘ হলেও প্রথম দু’উপাখ্যানে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা কম। তবে অদৃশ্যভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন আদর্শিক কারণে। বিশ্বদ্যিালয়ের সার্বিক কর্মকাণ্ডকে ড. সাব্বির হোসেনের কথায় তুলে আনলেন। তার মতে, “বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে আসেছি, না বেশ্যাপাড়ার কীর্তিকলাপ দেখতে আসছি।”৩৪
উপন্যাসটির বহুমাত্রিক বার্তায় দেশ প্রেম ও জাতি গঠনের উপায় দেখানো হয়েছে। শিক্ষার মাধ্যমেই কেবল জাতির কাক্সিক্ষত মুক্তি আসতে পারে। আর সে কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিতরে অজানা কাহিনী তোলে ধরেছেন। বাংলা সাহিত্য কেন বিশ্ব সাহিত্যেও এমন সাহসী উচ্চারণ বিরল। রকিবুল হাসানের এমন সাহসী উচ্চারণ আগামী দিন জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে সত্য চর্চায়। টিকে থাকবে এ উপন্যাস যুগের পর যুগ। বিশেষ করে দেশের উচ্চ শিক্ষার মান নিম্নগামী হওয়ায় গবেষকদের তথ্য সংগ্রহে যেমন আলোক বর্তিকা হিসেবে কাজ করবে তেমনি উর্ধ্বগামী হলেও গবেষকরা এবং নীতি-নির্ধারকরা মনে রাখতে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া প্রতিবন্ধকতাগুলো। এখানেই রকিবুল হাসানের অগ্নিকা আঁধারের সার্থকতা।
তথ্যসূত্র:
১. আবু এন. এম. ওয়াহীদ, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কী এবং কেন?’, বণিক বার্তা, আগস্ট ০১, ২০২১।
২. প্রাগুক্ত।
৩. অনুপ সানি, ‘প্লেটোর একাডেমি ছিলো দার্শনিক আলোচনার একটি প্রতিষ্ঠান’, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ১৫ মার্চ ২০১৯।
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিক্ষা, প্যাপিরাস, আগস্ট ২০১০:১৭২।
৫. 5. John Henry Newman, The Idea of University, New Haven : Yale University Press, 1996
৬. প্রাগুক্ত।
৭. প্রাগুক্ত:14.
৮. প্রাগুক্ত195.
৯. প্রাগুক্ত: 196-7.
১০. প্রাগুক্ত: 198.
১১. প্রাগুক্ত:199.
১২. প্রাগুক্ত: 200-1.
১৩. অধ্যক্ষ গোলসান আরা বেগম, ‘বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সংকট ও সম্ভাবনা’, পালক পাবলিশার্স, সেপ্টেম্বর ২০০৯:২৩।
১৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রাগুক্ত:১৪।
১৫. প্রাগুক্ত, ১৫।
১৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রাগুক্ত:১৭২।
১৭. কাজী নজরুল ইসলাম, ‘জাতীয় শিক্ষা’,
১৮. কাজী নজরুল ইসরাম ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’,
১৯. মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষার চালচিত্র ও গবেষণা, মূর্ধন্য, ২০১৮:৫৪।
২০. রকিবুল হাসান, অগ্নিকা আঁধার, বটেশ্বর বর্ণন (প্রা.) লি., ফেব্রুয়ারি ২০২২:১৩।
২১. প্রাগুক্ত, ১৫
২২. প্রাগুক্ত, ১৫-১৬
২৩. প্রাগুক্ত, ১৯
২৪. প্রাগুক্ত, ২১-৩
২৫. প্রাগুক্ত, ২৯
২৬. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, তৈল’, https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/rumialam012/29640888
২৭. রকিবুল হাসান, প্রাগুক্ত, ৩০
২৮. প্রাগুক্ত, ৩০
২৯. প্রাগুক্ত, ৩৩
৩০. প্রাগুক্ত, ৪১
৩১. প্রাগুক্ত, ৪৩
৩২. প্রাগুক্ত, ৬৮
৩৩. প্রাগুক্ত, ১০৬-৮
৩৪. প্রাগুক্ত, ২৫৪