রকিবুল হাসানের ‘অগ্নিকা আঁধার’ সম্প্রতি রচিত ভিন্নধারার উপন্যাস। চার শত পৃষ্ঠার বৃহৎ কলেবরের এই উপন্যাসে কাহিনিবিন্যাসে আনয়ন করা হয়েছে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা। বাংলা উপন্যাসে এতকাল ধরে যে গঠনরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। প্লটবিন্যাস, চরিত্রায়ণ বলতে যা বোঝানো হয়েছে, সেসবের গণ্ডিবদ্ধ সনাতনী রীতি পরিবহার করে এ উপন্যাস ঔপন্যাসিক স্বসৃষ্টরীতি প্রয়োগ করেছেন।
সাহিত্যে অনুকরণবাদের যে রীতি আমাদের চেতনায় খেলা করে, তা তিনি সম্পূর্ণভাবে পরিহার করেছেন। পুরনো রীতি ও স্টাইল ভেঙেচুরে লেখক যে স্টাইল নির্মাণ করেছেন, তা স্বসৃষ্ট ও গভীরবোধের পরিচায়ক। ব্যক্তিচরিত্র এই উপন্যাসে নায়ক হয়ে ওঠেনি। সময় ও চেতনাই নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। উপন্যাসে কাহিনিবিন্যাসে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে নির্বাচন করা হয়নি। সামগ্রিক জীবনাভাবনাই মৌলবিষয়।
উপন্যাস শুরু হয়েছে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চিফ অডিনেটর আবদুল করিমের সঙ্গে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ফারজানার ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরে। উপন্যাসের শুরুতে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যলয় নামটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এই বাঘা যতীন নামটি বিশেষ অর্থজ্ঞাপক। বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে ঊধ্বর্তন ও অর্ধস্তনের মধ্যকার দূরত্বের বিষয়টিও উচ্চশিক্ষার পরিবেশের রূঢ়বাস্তবতার চিত্রায়ণ।
এসব অপঘাত অভিঘাতগুলো অত্যন্ত সাহসিকতায় তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। রকিবুল হাসানের এটি দুঃসাহসিক প্রকাশ। এমন সত্য কথা এমন সাহসিকতায় এই পর্যন্ত বলার সাহস আমরা দেখতে পাই না।
ঔপন্যাসিক মূলত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উচ্চ শিক্ষিত মানুষের ভেতরের পাশবিক রূঢ়রূপ রূপায়ণে বদ্ধপরিকর। এই রূপায়ণ করতে গিয়ে লেখক স্বদেশি আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, দেশভাগা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সাম্প্রতিক মহামারী করোনার ছোবলে বিপণ্ন পৃথিবীর পরিচিয় চিত্রায়ণ করেছেন।
বাঙালির জীবনের দীর্ঘ পরিক্রমায়, রাজনীতি, অর্থনীতি, ঐতিহ্যপ্রীতি, লোকসাহিত্য, শোষক-শোষিতের মধ্যকার সংকট, উচ্চবিত্তের সঙ্গে মধ্য ও নিম্নবিত্তের দ্বন্দ্ব, দেহাশ্রিত কামনা-বাসনাজাত লিবিডো ভাবনা, উচ্চশিক্ষিত উচ্চবিত্তের অন্দরমহলে কদর্য কদাকার রূপ, শিক্ষা ব্যাবস্থায় অভ্যন্তরে অক্টোপাসের মতোন আঁকড়ে থাকা নগ্নতার অশালীন চিত্রসহ সমাজবাস্তবতার রূঢ়সত্যের রূপায়ণ আছে ‘অগ্নিকা আঁধার’ উপন্যাসে। এতে যে মানুষগুলো চিত্রিত তারা এই জনধারাস্নাত; এই দেশেরই সংস্কৃতির কর্ণধার। এখানে সত্য সুন্দরের মানুষের রূপায়ণ যেমন আছে, তেমনি আছে কুৎসিত কদার স্থূলকামরুচিসম্পন্ন মানুষও। এই মানুষগুলো সময় ও সমাজের প্রতিনিধি। সময়ই নিয়ন্ত্রণ করে তাদের নিয়তি। কামপ্রবণতা মানুষ মাত্রেরই কিংবা প্রাণমাত্রেরই থাকে। কিন্তু সে প্রবণতারও শালীন রূপ থাকে। খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত ও শ্রমের বিনিময়ে যে সভ্যসমাজ নির্মিত, সেই সমাজ তাদের কী দেয়। বিনিময়ে দেয় অপমান কিংবা অপঘাত। এসব অপঘাত অভিঘাতগুলো অত্যন্ত সাহসিকতায় তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। রকিবুল হাসানের এটি দুঃসাহসিক প্রকাশ। এমন সত্য কথা এমন সাহসিকতায় এই পর্যন্ত বলার সাহস আমরা দেখতে পাই না।
‘অগ্নিকা আঁধার’ উপন্যাসে রকিবুল হাসান প্রকরণরীতির গণ্ডিবদ্ধ বৃত্ত যেমন ভেঙেছেন, তেমনি তিনি বিষয়বিন্যাসের নতুনরীতির উদ্ভাবক। গত দু্তিন দশক ধরে উপন্যাস সাহিত্যে যে বন্ধ্যাত্ব দেখা যাচ্ছিল, এই উপন্যাস সেই বন্ধ্যাত্ব দূরীভূত হয়েছে। সাহিত্যের প্রবহমান ধারার মৌলিক রীতিপদ্ধতির ফর্ম ভাঙার কাজটি সহজ নয়। সৃষ্টিশীল কারিগর তা ভাঙতেই পারেন, কিন্তু সেই প্রচেষ্টার জন্য শিল্পীকে পূর্বতন নিয়মশৃঙ্খলাকে যেমন আত্মস্থ করতে হয় নিরন্তর, তেমনি নিজকে নির্মাণ করতে পাড়ি দিতে হয় বহুদূরের পথ। রকিবুল হাসান এই উপন্যাসের শিল্পস্বাতন্ত্র্য প্রয়োগে তাই অক্লান্ত অভিযাত্রী।
প্লটবিন্যাসে স্বাতন্ত্র্যিকরীতি, চরিত্র রূপায়ণে ভিন্নতর শৈল্পিকপ্রয়াস, বিষয়ানুগ পরিবেশ নির্মাণ ও চরিত্রানুগ ভাষারীতি সর্বোপরি জীবন রূপায়ণে উচ্চতর দৃষ্টিভঙ্গি অগ্নিকা আঁধারকে কালজয়ী শিল্প-হিসেবে পরিণত করেছে।
বাংলায় যত উপন্যাস লিখিত হয়েছে, তন্মধ্যে কোনোটার সঙ্গে এই উপন্যাসের মিল বা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। উপন্যাসের গঠনরীতি যে এমন ভিন্নতর ও অভিনব হতে পারে, তা এই উপন্যাস পাঠ না করলে তা জানার উপায় নেই। আবার বিষয়বিন্যাসে এতসব বিষয় যে একত্রীকরণ করা যায়, তারও দালিলিক প্রমাণ ‘অগ্নিকা আঁধার’।
ঘটনার মধ্যে যে কত ঘটনা থাকে, চরিত্রের মধ্যে যে কত বোধের সঞ্চার, ভাষারীতির মধ্যে এতসব কারুকাজ; এই উপন্যাস তার উৎকৃষ্ট দলিল। উপন্যাসটির ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনার বুননে আদি-মধ্য-অন্ত সমন্বিত এক মহাকাব্যিক রূপায়ণ। বাঙালি জীবনের ধারাবাহিক রূপায়ণের সমান্তরালে এতে আরও স্থান পেয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী বাঘা যতীন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন ফকির, মীর মশাররফ হোসেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
‘অগ্নিকা আঁধার’ ভিন্নধর্মী মৌলিক শিল্পনির্মাণ। সাম্প্রতিক সাহিত্য শুধু নয়, গত কয়েক দশকেও এমন শিল্প রচিত হতে দেখা যায়নি। প্লটবিন্যাসে স্বাতন্ত্র্যিকরীতি, চরিত্র রূপায়ণে ভিন্নতর শৈল্পিকপ্রয়াস, বিষয়ানুগ পরিবেশ নির্মাণ ও চরিত্রানুগ ভাষারীতি সর্বোপরি জীবন রূপায়ণে উচ্চতর দৃষ্টিভঙ্গি অগ্নিকা আঁধারকে কালজয়ী শিল্প-হিসেবে পরিণত করেছে।
আরও পড়ুন: মা-মেয়ের সংসার: আত্মায় বল্লমের মতো গেঁথে যাওয়া কথাচিত্র ॥ আদনান সৈয়দ