বাংলা সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে নদী একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাংলার রূপ বর্ণনায় নদী উঠে এসেছে চিত্রকরের তুলিতে, সাহিত্যিকের কলমে এবং চলচ্চিত্রকারের ক্যামেরায়। নদীকে কেন্দ্র করে এদেশের মানুষের জীবন সংগ্রাম কখনো কখনো হয়ে উঠেছে শিল্পকর্ম। কিন্তু তৌকির আহমেদের ‘হালদা’ আগের সব প্রথা ভেঙে নদীকে নায়কের ভূমিকায় শুধু অধিষ্ঠিত করেইনি, নদীর প্রেমিক ও শত্রুদেরও চিহ্নিত করেছে। বাংলা চলচ্চিত্রে এমন পরিবেশবাদী উচ্চারণ আজ এর আগে আর কেউ সৃষ্টি করতে পারেননি।
‘হালদা’ তৌকির আহমেদের পঞ্চম চলচ্চিত্র। গত বছর মুক্তি পাওয়া তার ‘অজ্ঞাতনামা’ চলচ্চিত্রটি বোদ্ধা শ্রেণীর দর্শকসহ আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছিল। চলচ্চিত্রটিতে ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয় ব্যাপক প্রসংশিত হয়েছে। ‘অজ্ঞাতনামা’র মতো ‘হালদা’য়ও ফজলুর রহমান বাবু আছেন। সঙ্গে মুখ্য চরিত্রগুলোয় আছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা, জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিমের মতো খ্যাতিমান অভিনেতারা। এ কারণে ছবিটি নিয়ে সবার একটা প্রত্যাশা ছিল। ‘হালদা’ সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে সমর্থ হয়েছে, তা ভাবার বিষয়।
হালদা একটি নদীর নাম
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত একটি নদীর নাম হালদা। নদীটির দৈর্ঘ্য ১০৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৩৪ মিটার এবং এর প্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটি এশিয়ার বৃহত্তম মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। ‘অজ্ঞাতনামা’র সফলতার পর তৌকির আহমেদ ঠিক করেন দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ নদীকেন্দ্রিক একটি সিনেমা নির্মাণ করবেন।
হালদার গল্প ও চিত্রনাট্য
প্রতিটি চলচ্চিত্রের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর গল্প। হালদার গল্প সরলরৈখিক। মূলত নদী ও নদীতীরবর্তী দুটি পরিবারের গল্প সফলভাবে উপ্পস্থাপন করা হয়েছে এতে। চৌধুরী পরিবার ও একটি জেলে পরিবারের জীবনের কথা বলা হয়েছে হালদায়।
বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের নানা অসৎ কর্মকাণ্ডের ফলে নদীটি পরিবেশ সংক্রান্ত ঝুঁকির মুখে পড়ে। এর ফলে হালদা পাড়ের সাধারণ জেলেদের জীবনে নেমে আসে কালো ছায়া। হালদার বুকে হেসে খেলে বেড়ে ওঠা হতদরিদ্র জেলে মনু মিয়ার মেয়ে চঞ্চলা হাসু ঘটনাচক্রে প্রেমে পড়ে যায় সহজ-সরল বদির। কিন্তু তার বিয়ে হয়ে যায় পরিবেশবিদ্বেষী নাদের চৌধুরীর সঙ্গে। এরপরই শুরু হয় গল্পের আরেক অধ্যায়।
হালদার গল্প ও চিত্রনাট্যের কতগুলো বিশেষ দিক বিদ্যমান। প্রথমত, চলচ্চিত্রটির সংলাপে চাটগাঁইয়া ভাষার সফল প্রয়োগ। শুধু তাই নয়, সূক্ষ্ণভাবে যেখানে মানভাষা প্রয়োজন, সেখানে তার প্রয়োগ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, নদীকেন্দ্রিক সিনেমায় পরিবেশবিষয়ক বিষয়াদি সংযোজন। তৃতীয়ত, গল্পে নাটকীয়তার আধিক্যের পরিবর্তে বাস্তবতার দিকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। চতুর্থত, লোক-সংস্কৃতি উপস্থাপনায় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এতকিছুর পরেও হালদার গল্প আপনাকে খুব বেশি মুগ্ধ নাও করতে পারে। গল্পের সরলরৈখিক উপস্থাপনার কারণে, শেষের ক্লাইম্যাক্সও পানসে লাগতে পারে।
নদী ও নারীর রূপকতা
হাসু ও হালদা একাকার হয়েছে হালদায়। চলচ্চিত্রটির প্রধান নারী চরিত্র হাসুকে নদীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে হালদা চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রটি মুক্তির আগেই তৌকির আহমেদ বলেছিলেন, হালদায় নদী ও নারীর গল্প বলা হয়েছে। মূলত হালদায় একটি নদী ও একজন নারী চরিত্র সমান্তরালে অগ্রসর হয়েছে। নারীকে নদীর সঙ্গে তুলনা করাটা নতুন নয়। তবে কিভাবে এবং কতটা সফলভাবে তৌকির আহমেদ এটি করলেন, এটিই মূল প্রশ্ন। নদী ও নারীর রূপক বোঝাতে তিনি নদীর দূষণকে তুলে এনেছেন। নদীকে দিয়ে প্রতিশোধ নেওয়াতেও ভোলেননি তিনি। অর্থলোভী মা-মাছশিকারি নিবারণের মৃত্যুকে যদি নদীর প্রতিশোধ ধরা হয়, তবে নারী হাসুও তার প্রতিশোধ নিয়েছে সীমিত সময়ের ব্যবধানেই।
যাদের প্রচেষ্টায় হালদা
তৌকির আহমেদ পরিচালক হিসেবে ক্ল্যাসিক মননের। তাঁর বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি বাংলার মানুষের গল্প সহজ-সরলভাবে উপস্থাপন করেন। অজ্ঞাতনামাতে তিনি যেভাবে গল্প বলেছেন, হালদাতেও তার ব্যতিক্রম নেই, আসলে এমনই তার স্টাইল। তবে রূপকের দিক থেকে অজ্ঞাতনামাকেও ছাড়িয়ে গেছে হালদা। হালদার গল্প লিখেছেন আজাদ বুলবুল ও চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক নিজেই। চিত্রনাট্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি দেখা যায়। যেমন, ‘সুরত বানু’ নাম নিয়ে নাটকীয় মুহূর্তের অনবদ্য দৃশ্যের অবতারণা। চলচ্চিত্রের সিনেমাটোগ্রাফি বাস্তবসম্মত ও মনোরম। দৃশ্যধারণের স্থান নির্ধারণে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন চিত্রগ্রাহক ও পরিচালক। নদী, বৃষ্টি কিংবা সমুদ্রের সৌন্দর্য ফ্রেমবন্দি করা হয়েছে দক্ষতার সঙ্গে। মিউজিকে পিন্টু ঘোষ দারুণ কাজ করেছেন। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং গানগুলো যেন চলচ্চিত্রটির সঙ্গে মিশে গেছে।
যারা যে চরিত্রে করেছেন অভিনয়
হালদা চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র হালদা। তবে হালদার গল্প বলতে গিয়েই বিকশিত করা হয়েছে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে। হালদা বাদে হালদার প্রধান দুই চরিত্র হাসু আর নাদের চৌধুরী। হাসু চরিত্রে অভিনয় করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। তিশাকে এই মুহূর্তে বাংলা চলচ্চিত্রের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অভিনেত্রী বললে কি ভুল বলা হবে? আর এটি প্রমাণ করার জন্য হালদাতে পর্যাপ্ত স্পেসও পেয়েছেন তিশা। হাসু চরিত্রটি রোমান্টিক, চঞ্চলা ও প্রতিবাদী। অন্যদিকে জাহিদ হাসান চলচ্চিত্রের খলচরিত্র নাদের চৌধুরীকে অলঙ্কৃত করেছেন। জাহিদ হাসানকে আমরা যেভাবে সাধারণত দেখি, হালদার জাহিদ হাসান একদম অন্যরকম। জাহিদ হাসান যে আসলেই ঝানু অভিনেতা, সেটি তিনি আবারও প্রমাণ করেছেন। হালদায় জাহিদ হাসান সিরিয়াস চরিত্রে দারুণ অভিনয় দেখিয়েছেন। বদি চরিত্রে মোশাররফ করিমও তার সচরাচর গণ্ডির বাইরের রূপ দেখিয়েছেন। হাবাগোবা সহজ-সরল এক যুবক ও প্রেমিকের চরিত্র চিত্রায়ণে তাকে সফলই বলতে হবে। এছাড়া ফজলুর রহমান বাবুর কথা না বললেই নয়। মনু মিয়া চরিত্রে একজন জেলে হিসেবে তিনি যেটুকু অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন, সেখানে তিনি তার ছাপ রেখেছেন। এছাড়া সুরত বানু চরিত্রে দিলারা জামান, জুঁই চরিত্রে রুনা খান, নিবারণ চরিত্রে শাহেদ আলী প্রশংসনীয় অভিনয় করেছেন।
শেষ কথা
হালদা নির্দিষ্ট শ্রেণীর দর্শকদের জন্য বানানো একটি চলচ্চিত্র। এতে চাটগাঁইয়া ভাষা ব্যবহারের জন্য বাংলার অধিকাংশ মানুষের কাছে এটি দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। তবে এটি ঠাণ্ডা-শীতল একটি ভালো সিনেমা। গল্পটা সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ একটি গল্প। নদী ও নারীর রূপকতার এই প্রচেষ্টার কথা অনেকেই ভুলে যেতে পারবেন না বহুদিন। সাধারণ এই সিনেমাটি তাদেরই ভালো লাগবে যারা সাধারণের পূজারী। অসাধারণ অন্বেষীদের জন্য তৌকির আহমেদের হালদা নয়।