বাড়ি বদলের দুটো বড় ঘটনা এই উপমহাদেশে ঘটেছে। একটি দেশভাগ, অন্যটি মুক্তিযুদ্ধ। এই বাড়ি বদল শুধু এপারের মানুষের ওপারে যাওয়া নয়, সঙ্গে মাটির সঙ্গে সম্পর্ক, মানুষের সম্পর্কও সম্পৃক্ত। আবার যোগ হয়েছে নতুন মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার নতুন আরেক বিড়ম্বনা। এই বিড়ম্বনা এমন; বেলে মাটির সড়কে যদি এঁটেল মাটি পড়ে, তাহলে যা হয়, মিলমিশ তো ঠিক হয়ই না বরং ভাঙনের সুরটাই বেশি থাকে। এই দুই ঘটনার ফলে দুই পাড়ের যা হয়েছে,ত তা মানবীয় সাহিত্যে বেদনার একটি বড় অধ্যায়।
হরিশংকরের বাড়ি গল্পটি সমকালের শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকী কালের খেয়ায় পড়েছিলাম। আবার যখন মলাটবন্দির পর পড়লাম, তখন মনে হলো—সামনে তো আমার আর দুজন জীবন্ত উদাহরণ আছেন। একজন শওকত আলী, অন্যজন হাসান আজিজুল হক। তারা দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির ফসিল। দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের এই দুই সময়ে হাজার হাজার শংকরের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া ও আসা হয়েছিল। দেশভাগ সত্যিই একটি অপূরণীয় ক্ষতি। এসব এমন ক্ষতি, যা দেশ, রাষ্ট্র, রাজনীতির দর্শনে উপলব্ধি করা যায় না। এই ক্ষতের ব্যথা ক্যানসার কোষের মতো আর সারে না। বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এক প্রজন্মের মানুষ থেকে নতুন উত্তরাধিকারে। মূলের খোঁজে তাই এখনো ওপারের মানুষ এপারে আসে; এপারের মানুষ ওপারে যায়। খারাপ ফল ভোগ করছে দুপারের মানুষ আর ভালো ফল নিয়েছে চলে যাওয়া কাঁচি চালানো রেডক্লিফদের দেশের মানুষ। মলাটবদ্ধ বইয়ের প্রতিটি অক্ষরের শব্দে দেশভাগের আগের টান বা শেকড়ের কথা মনে পড়বে। ওই সময়ে যারা বসতবাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন বা এলেন ভিন্ন একটি পরিবেশ সমাজ প্রতিবেশী নিয়ে যে অভিব্যক্তি, তা সত্যিই অবর্ণনীয়ই বটে।
দেশভাগের প্রাথমিক আলোচনার দিকে কলকাতা শহরে একটি আধুনিক অসাম্প্রদায়িক পরিবারের তিন সদস্যের তিন ধরনের টানাপড়েনের নিরেট কথামালা—‘মহানগরী’ গল্পটি। ‘মহানগরী’ পড়তে-পড়তে কলকাতায় মানিকতলা, সোহরাব; কল্যাণী ও আঞ্জুমান মিত্রের মুখের অবয়বের সঙ্গে জীবনে নতুন একটি অনিশ্চয়তার ছাপ পাঠকের চোখে প্রতিভাত হবে।
পুড়তে পুড়তে সোনা খাঁটি হয়। চাপে চাপে খনিজ হীরা হয়; সৎসঙ্গে স্বর্গযোগ হয়। সোনার মানুষ তেমন একটি গল্প। যা জীবন্ত রবীন্দ্রনাথকে তার একজন পাগল ভক্ত—আমিনুল ইসলামকে নিয়ে। যার ধ্যানজ্ঞানে গুরুদেব। মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি! লালনের গানের মতোই এই আমিনুল আজীবন কবি গুরুর আদর্শ মেনে তার জীবনের সব আয় দিয়ে একটি আশ্রম বানিয়ে গেছেন, নিজ বাড়ি প্রান্তিককে। গল্পটির নামের সার্থকতা এখানেই। সত্যিই তিনি সোনার মানুষ।
এপার থেকে পশ্চিমবঙ্গে পড়তে যাওয়া এক ছেলেকে নিয়ে সুন্দর বয়ানে নাগরিক পঞ্জির একটি নোংরা দিক পরিস্ফুটন করেছেন লেখক পলাশ মজুমদার।
মানুষ মাত্রই শেকড়সন্ধানী। দুজন মানুষের ভিন্ন রকমের আত্ম জখমের গল্প এই ‘সহোদর’। কিন্তু বাস্তবতা একই। একটি ঘটনার করাল গ্রাসে তলিয়ে যায় দুটি পরিবারের কতগুলো মানুষের জীবন। দেশভাগের পরে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আলাদা হলেও ফল বরাবরই সমান—বাস্তুচ্যুতি ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের পরম্পরা। রক্তের বাঁধন যায়না খণ্ডন। সীমানা পিলারে দুই দিকে দুই ভাই ভিন্ন জাতীয়তায় পরিচিত হলেও মনে তারা একজাত—ভাই। ষাট বছরের বিছিন্ন জীবনে ভাইয়ের প্রতি কলিজার টানে ঢাকায় এসে ভাইকে খুঁজে না পেলেও তাদের রক্তের উত্তরাধিকারকে পেয়ে যায়। ছায়ায় ও মায়ায় জীবন কাটাতে সবার প্রাণান্তকর চেষ্ঠা। তেমনি আবার উদ্বাস্তু গল্পটিতে চরিত্রের দৃঢ় সংলাপ এমন যে উদ্বাস্তু হওয়ার চেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়া অনেক ভালো।
অহিংসা পরমধর্ম। গান্ধীজির এই বাণী চির শাশ্বত। মানুষের ওপরে কিছুই নেই। ভারতবর্ষের বহু সংস্কৃতির একটি মানবিক সভ্যতা সুপ্রাচীন। তা উৎসব ও পার্বণ দেখলে বোঝা যায়। সহযোদ্ধা গল্পে দুই জন—মুক্তা মণি ও নিখিলেশের গান্ধী আশ্রমে সেবার দায়িত্ব পালন। দেশভাগের ফলে নিখিলেশ পশ্চিম বাংলায় চলে যায় আর মুক্তামণি পূর্ববাংলায় রয়ে যায়। পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাদের হাতে মুক্তা মণি নির্দয়ভাবে ধর্ষণের শিকার হয়। দূষিত রক্তের বীজ গর্ভে ধারণ করাসহ মৃত সন্তান প্রসবের ফলে নিজেকে অভিশাপ মুক্ত মনে করে সে। কিন্তু নিখিলেশের মারা যাওয়ার খবর পেয়ে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া মুক্তা মণি জানান যে—আদর্শের সঙ্গে না থাকলে এই জীবনের কোনো মানেই হয় না। এরাই প্রকৃত জীবন সহযোদ্ধা। গল্পটি হৃদয়বিদারক ও মানবিক আদর্শের বটে।
রবীন্দ্রনাথের গান—‘জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ ধন্য হলো, ধন্য হলো মানব জীবন।’ রাজনীতি বরারই চক্রান্তের খেলা। যে দল যেভাবে পারে খেলে ও খেলবে। নাগরিকত্ব ও রাষ্ট্রব্যবস্থা রাজনীতির মূল বিষয়। অর্ঘ পাঠকও তাই এই চক্রান্তের শিকার। তব, এও নতুন কিছু নয়। সে বাংলাদেশে হোক, পশ্চিমবঙ্গে হোক। ক্ষমতার জন্যে অনেক কিছুই ঘটছে বা ঘটানো হয়ে থাকে। অর্ঘ তেমনি নাগরিক পঞ্জিকার নামে ব্যক্তিগত চক্রান্তের শিকার। পরে অর্ঘ হত্যাকে একটি জাতীয় ইস্যু করে মোড় ঘুরিয়ে মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করার চরম চক্রান্ত। এপার থেকে পশ্চিমবঙ্গে পড়তে যাওয়া এক ছেলেকে নিয়ে সুন্দর বয়ানে নাগরিক পঞ্জির একটি নোংরা দিক পরিস্ফুটন করেছেন লেখক পলাশ মজুমদার।
বাস্তবতা কিন্তু উভয়ের এক। মূলের গল্প বলে যারা ঘটনার ভুক্তভোগী নন, তাদেরও একটি শক্ত বিবেকের বৈদ্যুতিক ধাক্কা দিয়েছেন লেখক।
‘যাযাবরদের কোনো দেশ থাকে না’—এই শিরোনামের গল্পটিতে যাদের কোনো দেশ পরিচয় নেই, তাদের নিয়ে নাগরিকত্বের নামে একধরনের রাজনৈতিক টানাটানি চলে। মানুষ প্রকৃত পক্ষে যাযাবর ছাড়া কিছুই না। গল্পে—তাপস ভৌমিক বলছে—‘মানুষের কি আসলে কোন দেশ আছে?’ দেশ নামক যে সত্তার বেড়াজালে মানুষ বন্দি, সে আসলে বালির বাঁধের মতো ঠুনকো। কখনো এক পুরুষে দেশ বদল হয়, কখনো বা কয়েক পুরুষ পর। এক ভিটেতে মানুষ বেশি দিন থাকতে পারে না। জীবন তো আসলে এক বহতা নদী। চলার পথে বাধা পড়লে গতিপথ পরিবর্তন করে হলেও নদী কেবল ছুটতে থাকবে। এটাই নদীর ধর্ম। সে থেমে থাকবে না কখনো। জীবনও থেমে থাকে না। ভাঙা-গড়ার মধ্যে নদীর যে খেলা—তা তো মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের মতোই।
সিরিল র্যাডক্লিফের পেন্সিলের আঁচড়ে আঁকা সামান্য একটি রেখা, যা শুধু রেখা নয়। এ রীতিমতো জীবন্ত একটা সত্তার ভেতরে করাত চালনার মতোই। বাঙালি গরম গরম এর তাপ ও ফল বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারে; এই রেখা বুকের ক্ষরিত রক্ত নিঙ্ড়ানো রঙ দিয়ে আঁকা সীমানা! দুই ভাগে বিভক্ত দুই পাড়ের মানুষের হৃদয়ে প্রতিনিয়ত একটি আক্ষেপের শূল বিঁধে থাকে নীরবে। বিছিন্ন পরিবারগুলোর আপনজন, প্রতিবেশী, স্বজন, বন্ধু, মাটির গন্ধ থেকে চিরবিচ্যুত হওয়ার কান্না আজও নীরবে এসে ঠেকে যায় এই লাইনে। হায়রে র্যাডক্লিফ লাইন! আর দেশভাগ। ‘হরিশংকরের বাড়ি’ বইটি মোট ১২টি নয়া দেশভাগের গল্প নিয়ে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ফলে নো ম্যান্স ল্যান্ডের দুই দিকে ছিটকে পড়া শত শত উন্মূল মানুষের ভেতরের গোপন ক্ষরণের ঠাস বুননে ভরা প্রত্যেকটি গল্প।
দেশভাগ একটি অতি অমানবিক বিষয় হিসেবে নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সম্প্রতি ভারতে একটি গবেষণা সংস্থাই দাঁড়িয়ে গেছে ‘১৯৪৭ পার্টিশন আর্কাইভ’ নামে। গল্পের ঢংয়ে লেখক বয়ান করে গেলেও চরিত্রগুলো কিন্তু এখনো এপার আর ওপারে না ডুবি না ভাসি, এমন করে খাবিখাচ্ছে নিজেদের পরিচয় সংকটে পড়ে। কেউ বলে, কেউ মুখ বুজে সহ্য করে আছে। বাস্তবতা কিন্তু উভয়ের এক। মূলের গল্প বলে যারা ঘটনার ভুক্তভোগী নন, তাদেরও একটি শক্ত বিবেকের বৈদ্যুতিক ধাক্কা দিয়েছেন লেখক।