‘শঙ্খের সমান বয়সী এক শীতকালে
কিছু গ্রন্থের পোড়া পৃষ্ঠা হাতে
সেই যে দাঁড়িয়ে ছিলাম একা!’
অথবা
‘জানি তুমি অন্তর্মুখী
হাসিমুখে পান করো চিতার জল’
পাঠ করছি জাহানারা পারভীনের ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’। চিরকাল একাই দাঁড়িয়ে থাকেন কবি। এই যে শীতকাল, পোড়া গ্রন্থের পৃষ্ঠা, একা একা দাঁড়িয়ে তিনি। আর এ কারণে অনেকের সঙ্গে মিলে একাকার হয় কবিতা। চিতার জলেও যিনি হাসিমুখ রাখেন জয় তো তার হবেই।
জনসনকে জিজ্ঞেস করলেন বসওয়েল—স্যার তাহলে কাকে বলে কবিতা? তিনিও উত্তর দিলেন সোজাসাপ্টা—কেন স্যার, কবিতা কী নয় সেটা বলে দেওয়াই তো সবচেয়ে সহজ। আলো কী জিনিস, আমরা সবাই জানি কিন্তু আলো কী সেটা বলা আদৌ সহজ নয়।’
প্রিয় পাঠক, কবিতা নিয়ে তাই বেশি কথা বলতে চাই না। জাস্ট কোথায় পাবেন কবিতার ঘ্রাণ, সেটার সন্ধান দিতেই ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’ নিয়ে দু’চার কথা।
‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’—জাহানারা পারভীনের পঞ্চম কবিতাগ্রন্থ। এর ভেতর কবিতা আছে। আছে আলোর প্রাণ। এর আগে তার কোনো কবিতার বই পড়ার সৌভাগ্য হয়নি আমার। তবে ছড়ানো ছিটানো এবং বিভিন্ন সংকলনে কিছু কবিতা পড়েছিলাম। ঢাকায় যখন প্রথম আসি, তখন কে যেন বলেছিলেন ‘জাহানারা পারভীন ভালো লেখেন’। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আমারও অনেক সন্দেহ ছিল নারী কবিদের নিয়ে। তবু খুঁজে খুঁজে জাহানারা পারভীনকে ফেসবুকে একটা রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখলেন। তার ওয়ালে গিয়ে ঘুরতাম। তিনি কবিতা পোস্ট করতেন না। হঠাৎ চোখে পড়লো ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’—তার নতুন কবিতার বই আসছে। বেশ আনন্দ পেলাম। তার কবিতা পড়ার সুযোগ পাবো। মেলা থেকে বইটা কিনে আনি। নতুন বইটা আমি সারারাত ধরে পড়ি। অবাক হই। বিস্মিত হই। আবার ধন্ধে পড়ি। বড় বড় কবিতা। কোথাও টানা গদ্য। কোথাও কাটা কাটা লাইন। এ যেন গল্পের চওড়া পিঠে কবিতার চুল এলানো। ছড়িয়ে পড়ছে তাবৎ ইন্দ্রে। এমন করেও কি বোনা যায় কবিতার জমিন?
কবিতাগুলো দিনে দিনে যত পড়ি। স্বাদ বদলে যেতে থাকে। সত্য বলতে কী কবিতাগুলোর প্রেমে পড়ে যাই আমি। বারবার পড়ি। একই কবিতার বই বারবার। কেন জানি না। ভালো লাগে বলে? ঠিক নিজেকে যেন খুঁজে পাচ্ছিলাম আমি এই কবিতার ভেতর। মনে হচ্ছিল আমি নিজের জীবনী পড়ছি। আমার জীবনী অন্য কেউ কিভাবে লিখবে? সেটাও সম্ভব না কি? একইসঙ্গে একজন শিল্পী অন্যের গল্প, অন্যের বেদনা, অন্যের ছায়া, অন্যের রোদ, অন্যের সঙ্গীত, অন্যের সুর নিজের করে কিভাবে গাইতে পারেন? আমি ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’তে বুঁদ হয়ে পড়ি। বন্ধু-স্বজন যারা ছিল, কয়েকজনকে এ কথাও শেয়ার করি। বইটা তখন ব্যাগে করে নিয়ে ঘুরতাম। কোথাও বেড়াতে গেলে বইটা সঙ্গে রাখতাম। কারও কারও তো বইটা বয়ে নিয়ে পড়তে দিয়ে এসেছি। আর দেয়নি ফেরত। কয়েকজন বলেছে—‘কবিতাগুলো গদ্যে না হয়ে যদি ছন্দে হতো মাইরি, ফাটাফাটি হতো’! কেউ কেউ আবার আগ্রহের মুখে চুনকালি দিয়ে বলেছে—‘ধুর মিয়া কী আছে ওর মধ্যে’? আর একজন ঠোঁট উল্টে বলেছিল, খারাপ না, কবিতা তো। বুঝিনি। তবে ভালো লেগেছে। আর কবিতা অত বোঝার বিষয় না! কয়েকজন বিখ্যাত কবির সঙ্গেও কথা হয়েছে। তারাও ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ ভালো কবিতা গো’ বলেছে। তখন ভেবেছি তাইলে আমি ঠকিনি। কবিতা পড়ে কেউ ঠকে না!
একটা সময় আমি দেখি ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’তে ঢুকে পড়েছি। আর বের হতে পারছি না। কবিতাগুলোর বয়ানের ঢঙ, শব্দের পাঁচমিশালি রঙ, বাক্যের গাঁথুনিতে স্মৃতির কষ এমনভাবে থরে থরে সাজানো যে, আমি তার লোভে পড়ে যাই। লোভে পড়া ভালো? লোভ আসলে মুগ্ধতা। যাকে আমি চিনি না। জানি না এটকুও। তার বইটা কিনেছি। এটা জানানোর পরও তিনি আমাকে একসেপ্ট করেননি। বুঝতে পারলাম তিনিই কবি। বহুদিন ভেবেছি বইটা নিয়ে লিখবো। এক প্যারা লেখার পর মনে হয়েছে ধুর! এ কবিতা নিয়ে লেখার চেয়ে বারবার পড়াইটাই জরুরি। যার প্রয়োজন হবে, সে পড়ে নেবে। কখনো কখনো লিখবো লিখবো বলেও আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আজ কবির জন্মদিন। সকালে মনে পড়লো। পুরনো যে খাতায় বইটা নিয়ে কিছু লিখেছিলাম, সেগুলোও টাইপ করতে আলসেমি লাগে। তবু আজ আর আলসেমি জয়ী হতে পারেনি। জয়ী হয়েছে ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’ বা কবি জাহানারা পারভীনের।
প্রথমে প্রশ্ন থাকে কেন বইটির নাম ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’? আমি কিন্তু এতদিন কবিতাগুলো পড়েছি কিন্তু এ প্রশ্ন মাথায় আসেনি। নামটার সার্থকতা নিয়ে আমি নিজে ভাবলাম। উত্তরও পেলাম। কী উত্তর? আমার উত্তর প্রিয় পাঠক আপনার সঙ্গে নাও মিলতে পারে। আবার পারেও হয়তো। জাহানারা পারভীনের ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’র মৌলিক স্তম্ভ চারটি। স্কুল ঘরটি চারটি দীর্ঘ খুঁটির ওপর দোচালা ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। একেকটি খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য স্মৃতির নদীর ভেতর। আর কলকল করে স্মৃতির স্রোত থেকে বেরিয়ে আসছে ব্যর্থতার মদ ও সাফল্যের মধু। এক একটি শিশিতে বর্ণময় বাল্য, স্বর্গীয় শৈশব, কল্যাণময় কাঁকর ছিটানো কৈশোর, জোছনামাখা যাপিত যৌবন ও বৈবাহিক ঘ্রাণ ছড়িয়ে দেয়। কখনো কখনো মনে হয়, জীবিত এই স্কুলটি অল্প বয়সেই পূর্ণ শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে চায়। এত এত অভিজ্ঞতা আর স্মৃতিই কবির কাছে হয়ে উঠেছে স্কুল। তাই তিনি ফেলে আসা অতিতের গলিতে বার বার ফিরে পেতে চান। যে শিক্ষা জীবন থেকে তিনি পেয়েছেন তাকেই কি স্কুল বলতে চেয়েছেন?
‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’ এত করে না বলে চলুন ঢুঁ মেরে আসি। আমার তো মনে হয় ঘুমের চেয়ে যেমন নামাজ উত্তম, তেমনি বুক রিভিউ-এর চেয়ে কবিতা পাঠ উত্তম। তো আর দেরি কেন?
তার আগে বলে নেই—জ্যাঁ ককতোর কথা। তিনি বলেছেন, ‘লেখা, বিশেষ করে কবিতা, অনেকটা ঘেমে ওঠার মতো, কবিতা হলো ঘাম, কেউ স্বাস্থ্যবান হওয়ার জন্য হাঁটছে, দৌড়াচ্ছে, খেলছে অথচ তা ঘটছে না। এটা খুবই অস্বাস্থ্যকর।’ কিন্তু জাহানার পারভীনের কবিতা সত্যিই ঘাম। যেন গলগল করে ঘাম পড়ছে তার কবিতা থেকে। আমরা তার গন্ধ পাচ্ছি। পাঠ করতে করতে ভিজে যাচ্ছি সেই কবিতার ঘামে। পাঠ করুন—
ছুঁড়ে ফেলা পানের পিক থেকে
কুঁড়িয়ে নেয়া সুপারির কথা,
গিলে ফেলা থুতুর কথা;
খুব কি বেশি ছিল চাওয়া? জলপাই পাতার ঘুম। খইয়ের ওজনের কাছাকাছি
কিছু মুহূর্ত। তবু চিটেধানের ভেতর গেল আদিগন্ত ফসলের জেদ।
এটুকুন লিখে কবি কী বলতে চান? পাঠক হিসেবে সেটুকু বোঝার দায় নিশ্চয় আপনার ওপর বর্তায়। এই যে পান-সুপোরি আর পিকের থুথু কি আমাদের জীবনের গ্লানির কথা বলে না? নাকি পাঠ করতে করতে আপনি আরেক নিয়তে দাঁড়িয়ে যান। গেলে ভালো। কবিতার অর্থ ও বোধ একেক জনের কাছে একেকভাবে ধরা দেয়। একই কবিতা পাঠ করে ভিন্ন ভিন্ন পাঠক নানান জায়গা ভ্রমণ করে আসে। এটাই সফল কবিতার সার্থক দান।
পল ভ্যালেরি বলতেন, ‘কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি আসে স্বর্গ থেকে, বাকিটা, তুমি গড়ে তোলো।’ আমারও তাই মনে হয়। কবিতা ঐশী। আকাশ থেকে তা আসে। আসে শূন্যতা থেকে। ইচ্ছে করলেই তাকে ধরা যায় না। ধরা সে দেবে যে তাকে পেতে ব্যাকুল তাকেই। পড়ুন—
এই তবে তুমি?
সামান্য দেখায়, অদেখার সংকোচ!
ঠাণ্ডা ভাত তোলে কাঁচা মরিচের দাবি
আরও চাই এক চিমটি নুন
অসামান্য অসুখের মা, সামান্য মন
আমি, চন্দ্রাবতীর বোন!
এই তবে ধর্ম কৃষকের?
শস্যের চারা তুলে আগাছার পরিচর্যা!
মহান শিল্পী রদাঁ একদা বলেছিলেন, নিরন্তন কাজ করে যাওয়া, যা দ্যাখো লিখে ফেল। তবে আবেগকে আকৃতি দেওয়া নয় শরীরময় করে তোলা শিল্প। আবেগশাসিত শরীরময় কবিতা যেন লিখেছেন জাহানারা পারভীন। চলুন পাঠ করা যাক—
বুঝতে পারিনি ডাবের নরম শাঁসের মন। বাদামি পালের বাতাসে কতদূর
ভেসে যাবে কসম-কাটা নাও? সেই শালিকের বোন যে নামতা পড়তে
গিয়ে ভুলে যায় সংখ্যার হিসেব। তাকে বলো, জীবনের লসাগু না মেলা
মানুষেরা ইউরেনাসের ভাই। নেপচুনের বোন। বৃহষ্পতি কেউ হয় না
তাদের। খাতা থেকে কেটে দিও নাম যেন আমি কেউ নই, ছিলাম না
কোনোদিন। নিয়ে যেও মধ্যমায় লেগে থাকা করুণার তিল।
ইয়েটস কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘কবিতা হলো রক্ত, কল্পনা আর বোধের যৌথযাত্রা। জাহানারার কবিতা তা বরাবরই মেলে। পাওয়া যায় রক্তের দাগ। কল্পনার উড়োজাহাজে উঠিয়ে তিনি আমাদের হাওয়ার ভেতর ঘুরিয়ে বেড়ানো শেখান। বোধের ব্যবচ্ছেদ ঘটানোই যেন তার আসল কাজ। আসুন আবার পাঠ করি:
কথার পলিতে গুঁজে দিয়েছ বীজধান
আমি সেই ধান থেকে জন্ম নেয়া প্রথম চারা
চোখ খুলে দেখি বিরান কাৎলাহার বিল
পূর্বপুরুষের মুখ পড়ে মনে।
মালার্মে যথার্থই বলেছেন। তিনি কবিতা সম্বন্ধে বলেছেন, কবিতা রচিত হয় শব্দে, আইডিয়ায় নয়। অবিকল জাহানারা পারভীনের কবিতা সেটা প্রমাণ করে। শব্দের সঙ্গে শব্দকে তিনি এমনভাবে বিনিসুঁতোয় গেঁথেছেন যে, কবিতার মালা তাকে হতেই হবে। যখন তিনি বলেন—
মসজিদের ট্যাপকলে প্রার্থনার জল। পাকা মেঝেতে বর্ণমালা দিন। আলিফ-লাম-
মীম। আমি তখন মানাচত্রের দক্ষিণে, তীরে বসে দুঃখিত মাহুতের সাথে দেখেছি
চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া হাতির মৃত্যু। শোকের তাবিজ দেখেছি রাজলক্ষ্মীর গলায়।
এই যে শব্দের গলায় কল্পনার দড়ি পরিয়ে পাঠককে নিয়ে যান কত কত চিত্রের দেশে। পাঠক তখন বলে ফেলেন—আহ্। এই যে ধর্ম, প্রার্থনা, বর্ণমালা, চোরাবালি, হাতির মৃত্যু, শোকের তাবিজ। আমরা যেন পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। আঙুলের ইশারায় দেখে ফেলি সবটুকু।
বহুযুগ আগে সূর্যমুখীর হলুদ সকালে সে নিচতে পারেনি শব্দের সংকেত।
তার পূর্বপুরুষেরা আলতামিরার গুহা থেকে নির্বাসনে এসেছে এশিয়ার
গ্রামে। গুহাচিত্রের ভাঁজে ভাঁজে রেখে আসা বেদুঈন নারীর পায়ের ছাপ
তারা বিক্রি করেছে উঠতি শহরে। জলপ্রপাতের জলের শক্তিকে বশ করা
মানুষ ঠেকাতে পারেনি ফলের পতন। পতন না বিচ্ছেদ বলি একে?
এসব গল্প ডানায় নিয়ে রানওয়ে থেকে উড়ে গেছে ব্যক্তিগত পানকৌড়ি।
এখানে আপনাকে ইতিহাসের গুহায় ফিরে যেতে হবে। মানুষের উৎস তার উত্থান আর পতনের সব ইতিহাস যেন কবি হাতের তালুতে দাগ কেটে চিহ্নিত করে দেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন আমরা কারা। কোথা থেকে আমাদের যাত্রা। আমাদের সভ্যতাও বা কী? নারীকে যে পদে পদে ঠকিয়েছে পুরুষ তার চোহারাও বর্ণনা করতে ছাড়েননি তিনি। দেখিয়েছেন সেই সব ফলের পতনও। ফলে কবিকে থাকতে হয়েছে ব্যক্তিগত পানকৌড়ির মতো।
সেবার নির্বাচনের বাতাস কোনদিকে গেছে মনে নেই। শুধু মনে আছে,
রোদ পোহানো কুমিরের পিঠ, স্বাধীন জলে পরাধীন মাছের সংসার।
জাহানারা পারভীনের স্কুল বলতে তোমাকে বুঝিতে যেমন আছে ইতিহাসের লাল কাপড়ের পতাকা উড়ানোর দৃশ্য। তেমনি আছে গরম রাজনীতি। স্বাধীন বলে বলে আসলে আমাদের পরাধীন থাকাই যেন কপাল।
রসুন উৎসবে এই মিথুনজাতক
কী উত্তর যাব রেখে?
বাদামি তামাকপাতার প্রসঙ্গ,
প্রীতিলতার আত্মহনন?
নাকি ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন
যারা দেশ দেশ করে পান করেছে
অমরতার শরবত
জাহানারা কবিতায় শুধু ইতিহাস না। ইতিহাসের নায়কদেরও স্থান দিয়েছেন। স্যাটায়ার করেছেন তথাকথিত ‘দেশ’ বন্দনাকারী মুখোমধারী রাজনীতিবিদদের। শাসকরা আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়ে আসলে পরাধীনতাই উপহার দেয়।
এখনো আস্থা আছে বামনের দেশে খনিজের সম্ভাবনায়।
আবার এলে, নিয়ে এসো মাদুলির মতো দিন। হয়তো
আমি তখন ব্যবহারের অযোগ্য মুদ্রা। হয়তো তখনো তুমি
আত্মঘাতী। গান শেখাচ্ছো ফুটপাতের পাখিদের; মুখস্ত
করছ পরস্ত্রীর শেখানো স্লোক; হয়তো তখনো তুমি মিথ্যাবাদী
রাখালের ভাই, অনাস্থা ভোটে হেরে যাবে প্রকৃত বাঘের প্রসঙ্গ;
ইবনে বতুতার জুতো পায়ে হেঁটে যাচ্ছ অসুস্থ দেশে
প্রত্যেক কবি বা শিল্পী তার দেশ খোঁজেন। সেই দেশ কি তিনি খুঁজে পান আজীবন? স্বপ্ন আর সম্ভবনার মুকুর তিনি ফলাতে চান। সোনালি দিনের ভেতর তিনি একেকটা সূর্যকে বসিয়ে দেন স্বপ্নের মতো। সবকিছুর পরও তিনি চান সুন্দর হোক তার দেশ। মানুষ হোক সুখী। অন্তত একটু হাসুক মানুষ। সে যেন ব্যর্থ না হয়। কারণ মানুষের ব্যর্থতা সে একজন কবি কখনো মানতে পারেন না। নিজে তিনি মাদুলির মতো দিন ভিক্ষা চান। নিজে অব্যবহার যোগ্য হবেন কিন্তু আত্মঘাতী গান তিনি শুনাবেন চিরদিন। জানেন তিনি এসবই মিথ্যেবাদী রাখালের ভাই তবু তার কাছেই তিনি আশা খুঁজে যান। অনাস্থা ভোটে যে প্রকৃত বাঘ। সেটা আসলে কী? ইশারায় কবি বলে যান তার সত্য-বাণী।
‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’ পড়তে পড়তে আমাদের প্রেমে পড়তে হয়। বিরহ যাপনও করতে হয়। কখনো কখনো আমাদের হাঁটতে হয়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। উঁকি দিতে হয়েছে ঐতিহ্যপীড়িত এই বাংলা কৃষকের বীজধানের দিকে। হাঁটুমুড়ে বসতে হয়েছে হরপ্পার যুগে। সভ্যতার উন্নতির গল্পের ফাঁদেও কেন আটকে আছে মানুষ। কবির এ নিয়ে আসে বিষণ্নতা। তিনি চিন্তামগ্ন এ কারণে যে ডাইনির হাতের মুঠোয় ডালিমকুমারের মুখ। কাজলরেখার সূঁচ নিয়েও ব্যথিত কবি। তার কবিতার যেভাবে ধরা দিয়েছে প্রকৃতি, রীতিনীতি ঠিক সেইভাবে রাজনীতি ও শোষকের কথাও বলেছেন। স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে আনা প্রমিথিউসকে যেভাবে দেখেছেন ঠিক সেভাবেই তিনি এ দেশের কৃষকের কথাও ভেবেছেন।
আছে মসজিদ আর মন্দিরের কথা। মৌয়াল আর সুন্দরবনের কথা। কবিতার নায়ক হয়েছে ওঝা ও মাঝিও। তিনি নিজাম ডাকাতের সঙ্গে সঙ্গে বায়েজীদ বোস্তামীকেও তুলে ধরেছেন কবিতার মিথ রচনায়। বলেছেন আলীবর্দী ও ঘষেটির কথাও। যেমনি প্রাচীনের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন তেমনি মুখ ঢেকেছেন নির্যাতনে। পাহাড়ের সঙ্গে সঙ্গে আছে রাইফেলের গল্প। সীমান্তের সঙ্গে পাখির আর আলাদীনের প্রদীপ নিয়েও জ্বেলেছেন আলো।
স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি
জাহানারা পারভীন
মূল্য: ২৫০ টাকা
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশ: নালন্দা, বইমেলা-২০১৫।