নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র একবার তার রাজসভার পণ্ডিতকূলের সামনে একটি পঙ্ক্তি উচ্চারণ করে সেই পঙ্ক্তিটিকে ধরে একটি শ্লোক লেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন। উপস্হিত পণ্ডিতরা নানারকম শ্লোক রচনা করে রাজার আহ্বানের সম্মান রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের কারও শ্লোক রাজার পছন্দ হয়নি। সেই সময় হরু ঠাকুর গঙ্গাস্নানে বেরিয়েছিলেন। রাজার আদেশে তিনি স্নানের পোশাকেই রাজসভায় এসে উপস্থিত হন। রাজা তার সামনে পঙ্ক্তিটি আরও একবার উচ্চারণ করে পঙ্ক্তিভিত্তিক একটি শ্লোক রচনার আহ্বান জানান। হরু ঠাকুর তাৎক্ষণিক প্রয়াসে তার কবি বৈশিষ্ট্যের পরিচয় রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের উচ্চারিত পঙ্ক্তিটি হচ্ছে ‘বড়শী গিলেছে যেন চাঁদে’। হরু ঠাকুর তথা হরেকৃষ্ণ দীর্ঘাঙ্গী (দিঘাড়ী) তখন তার স্বভাবকবিত্বের পরিচয় রেখেই বলেন:
একদিন শ্রীহরি মৃত্তিকা ভোজন করি
. ধূলায় পড়িয়া বড় কাঁদে
রাণী অঙ্গুলি হেলায়ে ধীরে মৃত্তিকা বাহির করে
. বড়শী গিলেছে যেন চাঁদে।
এই ধরনের কাব্যকৃতিকে বলা হতো পাদপূরণ। এ ধরনের পাদপূরণ কবি হরু ঠাকুরের নিকট অনায়াসসাধ্য বিষয় বলেই গণ্য হতো! কিন্তু আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয়টি হলো, চাঁদ যেন বড়শি গিলে ফেলেছে—এ ধরনের একটি শব্দচতুষ্ঠয়ের পাদপূরণের লক্ষ্যে কবি হরু ঠাকুর যে আবহ রচনা করলেন, তার নান্দনিকতা নিয়েই। এখানেই তো কবিতার সার্থকতা। ছোট্ট শ্রীহরি মাটি খেয়ে ফেলেছেন। ছোট্ট অবুঝ শিশুরা তাদের স্বভাবধর্ম অনুযায়ী সাধারণত যা করে থাকে। তারপর অসহায়ভাবে মাটিতে শুয়ে কাঁদছে, কেননা মাটি গলায় আটকে গিয়েছে! তখন ‘রাণী’ এসে সব দেখে বুঝে নিয়ে পরিত্রাতার ভূমিকা নেন এবং তার এক হাতের আঙুল বড়শির মতো বাঁকিয়ে তার গালের মধ্যে পুরে মাটি বের করে আনেন। এই আবহকে কবি দেখছেন শিশু শ্রীহরি যেন স্বয়ং চন্দ্রবদন আর তার মুখের ভেতর একটা বড়শি! লক্ষ্য করার বিষয় কবির মানসচক্ষে তখন শিশু শ্রীহরির আর কোনো অবয়ব নেই। ‘রাণী’রও কোনো পৃথক সত্তার উপস্থিতি নেই! শুধু শিশুর মুখ এবং পরিত্রাতার আঙুল, চাঁদবদন এবং বড়শি!
একলব্যের একমাত্র নিশানায় যেমন ছিল পাখির চোখ, তেমনই কবিদৃষ্টির একমাত্রিকতা একটি নির্দিষ্ট নান্দনিক আলোকবিন্দু রচনা করে সমস্ত পাঠককে সেই লক্ষ্যে সম্মোহিত করেছে। কবিকল্প এবং কবিদৃষ্টির এই যুগলবন্দিত্বই কবিতাকে সার্থকতার মাত্রাভূষিত করে। আর এরই মাহেন্দ্রক্ষণে সৃষ্টি হয় কবিতার রূপ ও রস।
কবিতার কাজ তো একটা নির্দিষ্টের সর্বজনীনকরণ। ত্রিকালকে এক স্থানিক বন্ধনে গ্রথিত করে এক সম্পূর্ণ অন্য মাত্রাভূষণে ঋদ্ধ করা। কবি শেলি যখন অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে একবিন্দুর সিন্ধুতে এনে লেখেন, আমরা একবার পেছনের দিকে তাকাই, একবার সামনের দিকে তাকাই; আর কী পাইনি তাই নিয়ে হা-হুতাশ করি—তখন অতীত (পেছন), সামনে (ভবিষ্যৎ) এবং উপস্থিতকালের হা-হুতাশ (বর্তমান) একাকারপ্রাপ্ত হয়ে ওঠে। এক আধারের বিন্দুতে সিন্ধুর বিশালত্ব এক সম্পূর্ণ অন্য আকাশের উন্মিলন ঘটায়। কিংবা ‘পরাভূত বন্দি’ প্রমেথিউসের বিপ্রতীপে এই কবি শেলিই আবার যখন ‘জয়ী মুক্ত’ প্রমিথিউসের কাব্যরচনা করতে প্রবৃত্ত হন তখন তাঁর এই দ্রোহীচিত্ততা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে আবার একসূত্রে গ্রথিত করে এক অন্য স্বপ্ননির্মাণের প্রয়াসী স্বাক্ষর রাখেন। তার ‘জয়ী মুক্ত’ প্রমিথিউস অবশ্যম্ভাবীরূপেই অতীতের ‘পরাভূত বন্দি’ প্রমিথিউসের আবহকে সামনে নিয়ে আসে। শুরু হয় এক নতুন স্বপ্নের অপ্রতিরোধ্য উড়ান। এখানেই তো কবিকর্মের, কবিচিন্তার সার্থকতা।
কবি তো এক নিটোল স্বপ্নময় বার্তাই দিতে চান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে। কবিরাই তো আসলে সঙ্গীত রচয়িতা এবং স্বপ্নের ফেরিঅলা। হ্যামেলিনের বাঁশিঅলার বাঁশির মোহিনী সুরের আহ্বান শুনে সাড়া দেয় হাজার হাজার মানুষ। একসময় শ্যামের বাঁশি রাধার মন উচাটন করে তাঁকে ঘর ছাড়তে প্ররোচিত করতো, আর এই হ্যামেলিন একক কোনও রাধাকে নয়, সদলবলে মানুষকে স্বপ্নদর্শী করে ঘর ছাড়তে আহ্বান জানায়।
এক নতুন আলোপৃথিবী, এক নতুন স্বপ্নগ্রামের অভিযাত্রায় ডাক দেয় কবির কবিতা। সেখানে কোনও সংস্কীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধতার অন্ধকার নেই। আছে এক উদ্দীপন আর উজ্জীবনের মন্ত্রদীপ্ত গান।
দুই.
মাত্র নয় মাস আগে প্রকাশিত ‘সূর্যাস্তের স্বরলিপি’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে কবি স্বরূপ মণ্ডলও এক মন্ত্রদীপ্ত গান বুকে বেঁধে নিয়ে এক অন্য আলোর স্বপ্নের সওয়ার হয়েছেন। তিনি অবশ্যই পেছন দিকে ফিরেছেন, সামনের দিকে দুচোখ মেলে তাকিয়েছেন এবং পথ চলতে গিয়ে হিসাব করেছেন কী পেয়েছেন আর কী পাননি! হতাশ হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন, দুঃখে দীর্ণ হয়েছেন তবু থেমে যাননি। কেননা তিনি জানেন যে থেমে যাওয়া কবিধর্ম নয়। নিজেকে বারবার ভেঙেছেন, টুকরো টুকরো করেছেন, আবার নতুন মাটি দিয়ে প্রতিমা নির্মাণের মতো নিজেকে পুননির্মাণ করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তবে একথা ঠিক যে কবি স্বরূপ এক এবং সার্ব-এর সমন্বয় ঘটাতে সবসময় প্রয়াসী হননি, তবে তার অভিযাত্রায় কোনো রকম ব্যবচ্ছেদের সুযোগ রাখেননি। কবি তো সূর্যের মতো সাহসী এবং চাঁদের মতো নরম মেদুর স্বভাবী। কবি স্বরূপ এই সাহসের ডানায় ভর করেই এই গ্রন্থের শুরুতেই রাধার অবতারণা করে প্রশ্ন তুলেছেন, বলেছেন:
আমরা মোহিত হই রাধাকৃষ্ণ নামে
আমাদের আশীর্বাদ—লক্ষ্মী মেয়ে হও
আমাদের আশীর্বাদ—সরস্বতী হও
বলিনি কখনো কারো মাথায় রেখে হাত
রাধা হও…রাধা হও…রাধা হও…
অত্যন্ত সঙ্গত প্রশ্ন। রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে কত মধুর কাব্যকৃতি আমরা পেয়েছি, বৈষ্ণব সাহিত্য আমাদের বাংলা শিল্পসাহিত্যের অঙ্গনে এক অমূল্য সম্পদ। অজস্র পদকর্তা তাদের অসংখ্য কাব্যকৃতির পরিচয় রেখেছেন রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনি নিয়ে। কিন্তু পরস্ত্রী (আয়ান ঘোষের স্ত্রী) রাধাকে নিয়ে আমাদের সমাজে কেচ্ছাচর্চাও কম হয়নি। কৃষ্ণ অবশ্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে মান্যতা পেয়েছেন, তাঁর দেবত্ব পূজিত হয়েছে, তাঁর রাধাচর্চা ‘লীলা’ হিসেবে আখ্যাত হয়েছে। তাঁর এই ‘লীলা’সঙ্গিনী রাধা কিন্তু কলঙ্কভাগিনী হয়েছেন! পুরুষতান্ত্রিক সমাজ রাধাকে সাদরে গ্রহণ করতে কুণ্ঠা দেখিয়েছে। গ্রামের এক চায়ের দোকানদারের মুখে আমি নিজে বলতে শুনেছি, ‘কিষ্ণ করলে লীলা আর আমরা করলে বিলা’?
আসলে রাধা শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে আরাধনা। এই দিক দিয়ে দেখলে রাধা হচ্ছে আরাধনার প্রতিমূর্তক। কৃষ্ণের সংগে রাধা নামোচ্চারণের অর্থ রাধার মাধ্যমে কৃষ্ণের আরাধনা। আর গীতগোবিন্দের কবি জয়দেব সম্ভবত এই চিন্তাচর্চা থেকেই রাধার মাধ্যমে কৃষ্ণের আরাধনার কথা বলতে চেয়েছিলেন। স্বভাবতই তাঁর কাব্যে চর্চিত রাধাকৃষ্ণের প্রেম আসলে আধ্যাত্মিক প্রেম! এর ফলে পুরুষশাসিত সমাজে পূজ্য হিসেবে আসন অধিকার করেছেন কৃষ্ণ স্বয়ং, রাধা নন। রাধা তাঁর অজস্র গোপিনীদের মধ্যে একমাত্র লীলাসঙ্গিনী! শ্রীকৃষ্ণের চাইতে বয়সে বড়ো রাধা তাই সমাজে নন্দিত হননি, নিন্দিতই হয়েছেন সাধারণ্যে। আর বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে তিনি একটি ভাব প্রকাশক, তাঁর মাধ্যমেই কৃষ্ণের আরাধনা করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে রাধাকে বলা হয় কৃষ্ণের ‘নাদশক্তি’।—সে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের অধিক সংখ্যক নারীগমন যেমন অপরাধ বলে গণ্য হয়না, তেমনই বিপরীতে কৃষ্ণের বিলাসসঙ্গিনী রাধা কিন্তু অনরপরাধযুক্তা নন। ফলে আমাদের সমাজে তিনি নন, বন্দিত হন স্বয়ং কৃষ্ণই।
এই পুরুষশাসন তার আধিপত্যের দর্শনেই ‘রাধা হও’ বলতে বাধা দিয়েছে। রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী পূজ্য হয়েছেন, তাঁদের মতো রূপবতী এবং গুণবতী হওয়ার আশীর্বাদ করলেও, রূপগুণে তুলনারহিতা হওয়া সত্ত্বেও রাধা গ্রহণযোগ্যতার ছাড়পত্র পাননি। স্বভাবতই ‘রাধা হও’ বলা তো ভ্রষ্টাচারের সমর্থন!
কিছু বানান ভুল কিংবা মুদ্রণ প্রমাদ বড়ো পীড়াদায়ক হয়েছে। অনুভবকে অশালীন প্রক্রিয়ায় আক্রমণের স্পর্ধা দেখিয়েছে। যেমন ‘মিথ্যাচার’ শীর্ষক কবিতায় ‘প্ররোচোনা’। ‘দাহ-২’-এ ‘উপুর’। ‘হনন পর্ব-২’-এ ‘তমিশ্রে’। আর ‘সখ্যতা’ শব্দ ঠিক নয়, ‘সখ্য’ যথার্থ।
কবির কবিতা যদি চিন্তার উদ্রেক ঘটাতে না পারে, তবে তা ব্যর্থতার নিয়তিকে এড়াতে পারেনা। কবি স্বরূপ এক্ষেত্রে সফল। তাঁর এই ‘রাধা’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রথম কবিতাটিই এক্ষেত্রে চিন্তার একটি পুরানো চর্চাকে নতুন প্রেক্ষিতে জীবন্ত করে তুলেছে।
তিন.
স্বরূপ সঠিকভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন ‘ভালোবাসা যদি পাপ হয়’ তবে ‘পুণ্য’সন্ধান নিরর্থক। ভালোবাসা কখনও ‘পাপ’-এর সমার্থবাচক নয়। এই ভালোবাসার জন্যেই তো জীবন। এই ভালোবাসাই তো স্বপ্নের নির্মাণ করে, ব্রতবদ্ধ হয়ে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে প্রেরণা যোগায়। কবি ছাড়া ভালোবাসার গান কে গাইবে? নতুন স্বপ্ননির্মাণ কে ঘটাবে? আর এই একইসঙ্গে এই কবি ছাড়া আমাদের জয়ও তো বৃথা। মানুষ আসলে ‘মোহগামী’ কবি স্বরূপের উপলব্ধি। এই উপলব্ধিতে প্রমাদ নেই। মোহ আছে বলেই তো মোহমুক্ত হওয়ার প্রশ্ন আসে। অন্ধকার আছে বলেই তো আলোর সন্ধান। মিথ্যার কারণেই তো সত্যের অনুসন্ধান। এই কবিই তো স্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণের মতো ঘোষণা করেন ‘সূর্যাস্তে পেয়েছি প্রাণ শিশিরে শিশিরে’। অর্থাৎ আসন্ন অন্ধকার তাঁকে নিষ্প্রাণ হতাশায় নিবদ্ধ করেনি, বরং নতুন অভিগমনের লক্ষ্যে প্রাণিত করেছে নিপতিত শিশিরের গানে। এই কবিই তো লিখেছেন:
কী এমন করেছি ভুল
মানুষের হাতে আগুন তুলে দিয়ে…
আমি সেই প্রমিথিউস
যে তোর অভিশাপে আজও লালন করি
ভয়ংকর ঈগলের থাবা…
মানুষের হাতে আগুন তুলে দিয়ে কি কবি কোনও ভুল করতে পারেন? এটাই তো তাঁর কবিধর্ম। এই কবিধর্মে যদি কবি ব্রতবদ্ধ না থাকেন তবেই তো হবে কবির ধর্মচ্যূতি। স্বভাবতই ‘ভয়ংকর ঈগলের থাবা’র সামনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কবি দৃঢ়চিত্তে মানুষের হাতে আগুন তো তুলে দেবেনই। কাব্যগ্রন্থের নামকবিতায় কবি লিখেছেন:
জিরাফের মতো—
তন্ন তন্ন খুঁজি ভালবাসার ঘাস
লক্ষণীয় যে কবি এখানে জিরাফের অনুকল্প হাজির করেছেন। উচ্চগ্রীব জিরাফ তার গ্রীবা অনেক অনেক নিচু করেই ঘাস সন্ধান করে। আর কবিও তেমনি প্রভূত পরিশ্রম করেও ভালবাসার ঘাস অনুসন্ধান করে থাকেন। এই ভালোবাসাই তো আমাদের চরৈবেতির গান গাইতে প্রাণিত করে।
কবির কয়েকটি কবিতার কিছু পংক্তি নিচে উদ্ধৃত করছি কবিদৃষ্টির তাৎপর্য বোঝাবার জন্যে—
১.
কষ্টের রহস্যময়তায়
কাঁদে ভালোবাসার উঠোন…
(অন্তেষ্টিক্রিয়া)২.
সামান্য নাগরিক আমরা
ভেঙে দিলো আমাদের সংসার
নগর কোটাল…
(নোম্যানস ল্যান্ড-৪)৩.
কাঁটাতারের বসবাস বড়ো উচুতে
বোঝেনি কখনো মৃত্তিকার স্বরলিপি
(নোম্যানস ল্যান্ড-৩)৪.
চপারের ওপরে নাও হৃদ
পড়ে থাক পিণ্ড
(হৃদপিণ্ড)৫.
হাঁটু মুড়ে কাঁদে আমাদের অর্থনীতি
(অসামাজিক)৬.
কান্নায় ভেঙে পড়েন গীতগোবিন্দ
বিপন্নতায় ভোগেন আমার জয়দেব
(নষ্টরাগ)৭.
ঝাউগাছ শেখালো আমাকে
নিঃসঙ্গ যাপন…
(একা)৮.
আমাদের হৃদয় ধুলো খায় গোগ্রাসে…
(প্রতিরূপ)৯.
দেখেছি জ্বলন্ত কাঠেদের হাস্যরোল
পোড়া শবের নিস্পৃহতা…
(দাহ-৩)১০.
খিদে পেলে চলে যাবো বোষ্টুমি তোমার আখড়ায়
রাধে রাধে বলে ডেকে নেবো প্রাণের অঙ্গনে
(মধ্যবিত্ত)
এভাবে দেখা যায় কবি স্বরূপের কবিতার অঙ্গনে ভালোবাসার উঠোন, সংসার-ভাঙা নগর কোটাল, কাঁটাতারের বসবাস, মৃত্তিকার স্বরলিপি, আমাদের অর্থনীতি, হৃদয়ের ধুলো খাওয়া, খিদে পেলে বোষ্টুমির আখড়ায় চলে যাওয়ার অনুষঙ্গগুলি এক অভিন্নসূত্রতায় গ্রথিত হয়ে একটা আস্ত বাস্তব পৃথিবীর সামনে এনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। আর এইখানেই কবি শেলির মতোই আমরা জীবনের কণ্টকশয্যায় শায়িত থেকে ক্রমাগত রক্তাক্ত হই। স্বরূপের কবিতায় হতাশা আছে, আক্ষেপ আছে, আছে অভিমান—তবে এই কণ্টকিত অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া নেই, ডাকঘরহীন অনির্দেশ্য ঠিকানায় নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার অভীপ্সা নেই। তাঁর চিন্তাচর্চিত কবিতায় যৌনতার স্খলিত ঘূর্ণির আবর্ত আছে, ‘নপুংশক’ শব্দের বাহুল্য আছে। আছে, তবে তা সর্বগ্রাসী প্রভঞ্জনের রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি। কবিতার মানবিক চেতনার বিস্তৃত অঙ্গনে তা বিলীয়মান কুয়াশার মতো লীন হয়ে গিয়েছে। তাঁর কবিতায় আমি থেকে আমরার চেতনার দৃপ্ত অঙ্গীকার অনুপস্থিত, শপথের স্পন্দনে সৈনিকবৃত্তির অভিলাষ নেই, তবে নতুন এক আকাশের স্বপ্নের অভিযাত্রা আছে।
স্বদেশ, স্বকালের এই অন্ধকারদীর্ণ আবহাওয়ায় কবি যে সুখী নন, তিনিও যে এই দমবন্ধ পরিবেশের অবসান চান, নতুন আলোপৃথিবীর সন্ধানে সন্ধিৎসু হতে আগ্রহী তার সাক্ষ্য এই ‘সূর্যাস্তের স্বরলিপি’তে দেদীপ্যমান। তাঁর ‘দাহ’ সিরিজের দু’নম্বর কবিতায় কবি লেখেন :
বেদনার সব সুর পরাভূত জানে সুরকার
আছে বিরহ আছে বিরহের কাতরতা
তবু নিজেকে বিরহী ভাবি না কখনো
বিরহ প্রেমের চেয়ে নীচ নয়
কবির স্বস্বীকৃতিতে তাঁর জীবনদৃষ্টি এখানে প্রস্ফুটিত হয়েছে। বেদনাহত হয়েও তিনি নিজেকে বিরহী ভেবে নিয়ে উদাস বাউল হয়ে যাওয়ার বাসনাকে পৃষ্ঠপোষণা দেন নি। বরং তিনি তাঁর ‘জোনাকি প্রণয়’ সিরিজের দু’নম্বর কবিতার শুরুতেই লিখেছেন :
এখন তুমি অন্য আলোয়
আলোর বিচ্ছুরণে—
সামলে এসো এসো মোহমুক্ত সংসারে
তারপর বসি মুখোমুখি
এ যেন দিনের ক্লান্তি শেষে আর এক আরম্ভের কবিতার শুরুতে অন্ধকারে মুখোমুখি বসবার বনলতা সেন-এর আবহকেই ফিরিয়ে দেয়। এক সাবেকি হিসেব নিকেশের পালা শেষ হলে শুরু হবে আরও এক অন্য স্বপ্নের মেঘমালায় উজ্জ্বল উড়ান।
পরিশেষে বলতেই হবে বেশ কিছু বানান ভুল কিংবা মুদ্রণ প্রমাদ বড় পীড়াদায়ক হয়েছে। অনুভবকে অশালীন প্রক্রিয়ায় আক্রমণের স্পর্ধা দেখিয়েছে। যেমন ‘মিথ্যাচার’ শীর্ষক কবিতায় ‘প্ররোচোনা’। ‘দাহ-২’-এ ‘উপুর’। ‘হনন পর্ব-২’-এ ‘তমিশ্রে’। আর ‘সখ্যতা’ শব্দ ঠিক নয়, ‘সখ্য’ যথার্থ। আশা করি আগামী সংস্করণে এইসব প্রমাদ দূরীভূত হবে। কবি স্বরূপের কবিতা আশার ঠিকানা দিয়েছে। কবি আমাদের প্রত্যাশাবর্ধন করেছেন। অপেক্ষায় থাকছি নতুন সৃজনের।
সূর্যাস্তের স্বরলিপি
স্বরূপ মণ্ডল
প্রকাশক: বেহুলাবাংলা
মূল্য ১৭৫ টাকা।