‘সূর্যদীঘল বাড়ী’—কথাশিল্পী আবু ইসহাকের অমর সৃষ্টি। এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন গ্রামীণ জনপদের সরলতা, কুটিলতা। ভিলেজ পলিটিক্সের সঙ্গে গ্রামীণ সারল্য যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি তুলে ধরেছেন এর কুসংস্কারাচ্ছন্নতাকেও। ফলে এই উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে আবহমান গ্রাম বাংলার একটি নিখাদ প্রামাণ্য চিত্রও।
লেখক দেখিয়েছেন, সূর্যের উদয়াস্তের দিকে প্রসারিত বাড়ি ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’। এ বাড়ির ইতিহাস মোটেও সুখকর নয়। গ্রামে নানা রকম কুৎসা রটনা তো আছেই, তাই ভয়ে এ তল্লাটের কেউ তেমন ভেড়ে না কিন্তু যে লম্বা তালগাছটা আছে, যা পুরো গ্রাম থেকে চোখে পড়ে, তাকে আবার গ্রামবাসী গর্বেরও মনে করে। জীবনে বাঁচার তাগিদ আর মাথা গোঁজার সব আশ্রয় হারিয়ে জয়গুন এ বাড়িতে ঢোকে দুটো ছেলে-মেয়ে আর ভাইপো ও ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে। কারণ ভাইয়ের বউ-ভাইপোও আট আনার অংশীদার।
কিন্তু এই ভিটায় উঠতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাদের একমাত্র ফকিরের ভরসায় এই বাস্তুভিটায় বাতি জ্বলছে থাকার আশ্রয়ের সঙ্গে-সঙ্গে চলে অবিরাম সংঘর্ষ দুমুঠো ভাতের জন্য।
জয়গুন তার সমস্ত লজ্জা বিসর্জন দিয়ে সস্তাদরে চাল কিনে এনে বিক্রি করে। মেয়ে মায়মুনের হাতে সংসারের তদারকির ভার। ছেলে হাসু মোট বয়ে যা আনে তা দিয়ে সংসার চলে তাদের। আর তার ভাইয়ের বউ ও ভাইপো ভিক্ষা করে সংসার চালায়। গ্রামের সব পুরুষ এটা ভালো চোখে নেয় না। তাই জয়গুনকে তারা ‘বেপদ্দা’ মেয়েমানুষ হিসেবেই গালি দেই, তাতে জয়গুনের কিছু যায়-আসে না। বিষয়টিকে লেখক আন্তরিক দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে কারও প্রতি তাঁর কোনো পক্ষপাত পাঠক হিসেবে দেখি না।
জয়গুনের জীবনটাও সহজ নয়। প্রথম স্বামী জব্বর মুনশী মারা যাওয়ার পর হাসুকে নিয়ে করিম বকশকে বিয়ে করে। সেখানেও তার কপালে সুখ হয়নি। মায়মুন, আরেক কোলের মেয়ে যে দুর্ভিক্ষের আকালে প্রাণ হারিয়েছে, আর আছে এক ছেলে কাসু। যাকে সে তিন বছর বয়সে ছেড়ে চলে এসেছে বললে ভুল হবে, করিম বকশ তালাক দিয়ে যখন জয়গুনকে তাড়িয়ে দেয়, তখন কাসু থেকে যায় বাবার কাছে।
নিঃসন্তান ফুপু মারা যাওয়ায় কাসুর ঠাঁই হয়েছে এই বাড়িতে, সৎ মায়ের সংসারে সঙ্গে একটা বোনও আছে এ তরফের। করিম বকশ সবসময় চোখে-চোখে রাখে কাসুকে। কাসু অবশ্য জানত তার মা মারা গেছে। কারণ তাকে সে রকমই বুঝিয়েছিল তার সৎ মা। করিম বকশ তার প্রথম স্ত্রীকে লাঠি পেটা করে মেরে ফেলেছে সে পক্ষের ছেলেকেও বাড়ি ছাড়া করেছে, তার ব্যবহারের গুণে। জয়গুন এভাবেই অভাব আর অনটনে, বৃষ্টি-বর্ষাতে ভিজে সংসার চালায়। তার লড়াই শুধু দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার, ছেলে মেয়ের কোনো আবদার পূরণ করার ক্ষমতা তার নেই, রাত দুপুরে এই কষ্টগুলো তাকে যন্ত্রণা দেয়, কাঁদায়; আরও সে কাঁদে কাসুর জন্য। কাসু দেখতে কেমন হয়েছে এটা মনে হলে তার বুকের কষ্টটা অবচেতন মনে কষ্ট দেয়। কিন্তু জয়গুন নিরুপায় কাসুর কাছে গিয়ে মমতায় জড়িয়ে ধরার অধিকার তার নেই।
__________________________________________________________________________________________________
নিয়মের দুনিয়ায় অনেক অনিয়ম আছে। যা উদ্ধার করা সহজ কথা নয়। মায়মুনের জায়গা হয় না শ্বশুরঘরে সেযে ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র মেয়ে যেখানে যায় সেখানে কোনো কল্যাণকর কিছু হয় না। মায়মুনের স্বামীর আবার বিয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
__________________________________________________________________________________________________
জয়গুনের কাছে কচি দুটো মুখের কাছে ধর্মের অনুশাসন মিথ্যা ও তুচ্ছ মনে হয়, এই বিষয়টা গ্রামের মাথা- মাতব্বরের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও পায় না, তবে তার অন্য কারণও আছে মাতব্বর গদু প্রধান তো জয়গুনকে বিয়ের করার প্রস্তাব পাঠায় জয়গুন তাতে রাজি হয় না। এতে মনে মনে ক্ষুব্ধ গদু প্রধান, নানা পাঁয়তারাও আঁটে জয়গুনকে জব্দ করার জন্য। হঠাৎ করেই জয়গুন হাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে করিম বকশের ডিঙ্গিতে ছোট ছেলেকে দেখতে পায়, জয়গুনের বুঝতে বাকি থাকে না এটাই তার বুকের ধন কাসু যাকে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে থাকে।
অবশেষে কাসু ও জয়গুনের সাক্ষাৎ হয় কিন্তু করিম বকশের চিৎকারে জয়গুন সম্বিত ফিরে পায়, সেখান থেকে একরকম কিছু নাবলেই প্রস্থান করে। করিম বকশ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, জয়গুনকে অভিশাপ দিতে থাকে।
হঠাৎ করেই মায়মুনের বিয়ে ঠিক হয় ২৫ বছর বয়সী ওসমানের সঙ্গে যার প্রথম পক্ষ গত হয়েছে কিছুদিন আগে। করিম বকশ মেয়ের বিয়ের দাওয়াত পেয়েও যায় না যদি কাসু কে জয়গুন রেখে দেয়। মায়মুনের বিয়ে তে গ্রামের গণ্য-মান্য সবাই উপস্থিত হয় কিন্তু বিপত্তি বাঁধে জয়গুনকে তওবা করতে হবে সে যেন আর বেপদ্দা হয়ে হাট-বাজারে ঘুরে না বেড়ায়। মেয়ের সুখের জন্য জয়গুন রাজি হও যদিও সে জানে এর পরিণাম সুখকর হবে না, তাকে ও তার ছেলেকে না খেয়ে মরতে হবে। কাসুর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় জয়গুনই তার আসল মা এক্ষেত্রে তার সৎ-মা অবশ্য যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে সেটা কাসুর জন্য নয়, তার মেয়ে ফুলির জন্য।
কাসু জয়গুনের কাছে যাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠে করিম বকশ ও হার মানার লোক নয়, সেও নানা প্রলোভনে কাসুকে নিজের কাছে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় মত্ত থাকে কিন্তু কাসুর মায়ের কাছে যাবার স্বতঃস্ফূর্ত আকাঙ্ক্ষার কাছে হার মানে সবকিছু। সময় এগিয়ে চলে সময়ের মতো করে। নিয়মের দুনিয়ায় অনেক অনিয়ম আছে। যা উদ্ধার করা সহজ কথা নয়। মায়মুনের জায়গা হয় না শ্বশুরঘরে সেযে ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র মেয়ে যেখানে যায় সেখানে কোনো কল্যাণকর কিছু হয় না। মায়মুনের স্বামীর আবার বিয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কাসুর অবস্থা বেগতিক দেখে জয়গুনের ডাক পড়ে করিম বকশের বাড়িতে, জয়গুন নিজেকে ধরে রাখতে পারে না কাসুর কাছে ছুটে যায়।
জয়গুন তার সব সম্বলের বিনিময়ে ডাক্তারের চিকিৎসা ও তার সেবা দিয়ে কাসুকে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরিয়ে আনে। হঠাৎই করিম বকশের মনে জয়গুনের প্রতি অনুরাগ জেগে ওঠে, সে আবার জয়গুনকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চায়, জয়গুন তাতে সায় দেয় না। কাসুকে সুস্থ করেই তাই একরকম কাউকে নাজানিয়ে কাসুকে রেখে চলে যায়। কাসুর জেদের কাছে হার মেনে নিয়ে করিম বকশ্ কাসুকে জয়গুনের কাছে রেখে আসে।
আবার শুরু হয় জয়গুনের ভাতের লড়াই, সে তওবার কথা ভুলে পথে নামে সন্তানদের মুখে খাবার জোটাতে এতে বেজার গ্রামের মাথা-মাতব্বর। জয়গুনকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র ভূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, জয়গুনের বাড়ির চালে ঢিল পড়ে সারারাত ভয়ে কুঁকড়ে থাকে জয়গুন তার বুকের মানিকদের নিয়ে। করিম বকশ্ যেন জয়গুনের হাহাকারে দিশেহারা, তাই জয়গুনকে রক্ষা করতে সে বদ্ধ পরিকর হয়ে মন্ত্রপূত গজাল রাখতে যায় কিন্তু করিম বকশ্ নিজেই বলি হয় হিংসার। এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় তাকে।
এরপর জয়গুন ’সূর্যদীঘল বাড়ী’র মায়া ছেড়ে আবার পথে নামে অজানায়। ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ তাই সবসময় পাওয়া যায় না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলা সারাদিনের কর্মফল বড় সামান্য, পরোপকার তাই প্রায়ই বিফলে যায়। সেকর্মে যদিও ফল ফলে তা তিক্ত, বড় বিষাক্ত। এভাবেই সর্বহারা মানুষগুলো সর্বস্ব হারিয়ে পথে নামে, সমাজের কুসংস্কার আর কুপ্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না। ভবিতব্য ভেবে মেনে নেয়। বয়ে বেড়ায় আজীবন। পেছনে পড়ে থাকে না-পাওয়া কিছু স্মৃতি, সুখ, দুঃখ, বেদনা, আর মাথা গোঁজার দুটো ঘর মাঝে আঙিনা আর কালের সাক্ষী হয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ।
কোনো সাধারণ তালগাছ নয়! এযে সূর্যদীঘল বাড়ী’র সাক্ষী! আর আবু ইসহাকেরও এখানেই কৃতিত্ব।