এক.
ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক বীক্ষার আলোকে রচিত চার শতাধিক পৃষ্ঠার উপন্যাস ‘সুদূরে দিগন্ত’। এটি লেখকের প্রথম উপন্যাস হলেও এর আঙ্গিক, প্লট-কাহিনী নির্মাণ, ভাষা ও পরিবেশ রচনা, চরিত্র-সৃজন দক্ষতা ও সংলাপ-বয়নের নৈপুণ্য সহজেই সব দুর্বলতা ও আড়ষ্টতাকে ছাপিয়ে যায়। এছাড়া লেখকের আত্মজৈবনিক জীবন-বীক্ষাও চমৎকারভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে উপন্যাসটিতে।
উপন্যাসে বাঙালি সমাজজীবনে দেশ, কাল, সমাজ-রাষ্ট্রের পরিবর্তন-বিবর্তনের ধারায় নারী-জীবনের সমাজ-ইতিহাস অনুপুঙ্খভাবে উঠে এসেছে। সুদীর্ঘকাল ধরে বাঙালি নারীদের পিছিয়ে পড়ার জন্য অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুপ্রথা-কুসংস্কারের মূলে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিঘাত প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে দায়ী। নারী যে ভোগ্য-পণ্য নয়, নারী যে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র নয়; বরং পরিপূর্ণ মানুষ, এই দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ও লালন অত্যাবশ্যক। এই বিষয়টিই এই উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে।
দুই.
উপন্যাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ নারী চরিত্র দুটি। এক. বুড়ি (যার অন্য নাম অরুন্ধতী); দুই. হরিদাসী বা আসিরন (যাকে বুড়ি পাগলী খালা বলে জানে)। দুটি চরিত্রই কেন্দ্রীয় চরিত্রের মর্যাদায় সমাসীন হওয়ার মতো তাৎপর্যবাহী। হরিদাসীকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে সন্দেহ নেই। তবে বুড়ির অভজারবেশন ও পরবর্তী সময়ে অরুন্ধতীর সম্প্রসারিত জীবনভাষ্য বুড়িকেও কেন্দ্রীয় চরিত্রের মর্যাদায় উত্তীর্ণ করে অনায়াসে। ঊনিশ শতকের বিপন্ন বাঙালি নারী জীবনের মূর্তমান প্রতিনিধি হরিদাসী। উন্মূল, অসহায়, বিধবা জীবনের করুণ কাহিনী বিধৃত হয়েছে হরিদাসী চরিত্রের সূত্র ধরে। হরিদাসীর বাবা বনমালী বারুই। যে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত উদার, মানবতাবাদী। স্বভাবে বৈরাগ্য ও উদাসীনতা থাকায় কৈশোরেই কাউকে না বলে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছিল সে। পথে দেখা হয় স্বদেশি আন্দোলনের মামলায় ফেরারি আসামি, তেজোদীপ্ত বিপ্লবী, বহুবিদ্যায় পারদর্শী তরুণপ্রাণ ধীমান ভঞ্জের সঙ্গে। ধীমান ভঞ্জের বহুমুখী বিদ্যা-বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে তাকে গুরু হিসেবে মেনে নেয় বনমালী। ধীমান ভঞ্জের কাছ থেকে চিকিৎসা বিদ্যাও শিখে নেয়। গুরু ধীমান ভঞ্জ মারা গেলে তীর্থে-তীর্থে ঘুরে বেড়ানোকেই বেছে নেয় বোহেমিয়ান বনমালী বারুই।
নিষ্ঠাবান সম্ভ্রান্ত হিন্দু কৈলাসবাবু তীর্থ-ভ্রমণে এলে বনমালীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। ঘটনাচক্রে বনমালী কৈলাসবাবুর লগ্নাভ্রষ্টা কন্যাকে বিয়ে করেন। বহু বছর পর নতুন বউ নিয়ে নিজের বাড়িতে গেলে সেখানে অনেক নাটকীয়তার পর রান্নাঘরে ঠাঁই পায় বনমালী। এ সময়ের পল্লী সমাজে বান্তবানুগ ঘটনা-প্রবাহ, নাটকীয়তা, পারিবারিক কলহ, হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মধর্ম সংস্কারের মধ্যকার বিরোধাভাস চমৎকারভাবে এঁকেছেন লেখক। বনমালী মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে। গ্রামে স্বোপার্জিত অর্থে শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। জনৈক জমিদারের পুত্রকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে ভালো করার বিনিময়ে বনমালী জমিদারের আনুকূল্য লাভ করে স্কুল পরিচালনা-কার্যে। নতুন বউ অর্থাৎ বনমালীর স্ত্রী একদিন দুর্যোগপ্রবণ রাতে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। বনমালী সেদিন বাড়ি ছিল না। বনমালী আর নতুন বউয়ের সেই দুর্ভাগা সন্তানই হলো হরিদাসী। প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে মাতৃহারা নবজাতক হরিদাসীকে তার নানা বাড়িতে রেখে আসতে বাধ্য হয় বনমালী। জমিদারপুত্র ছোটবাবুর দ্বিতীয় পক্ষ হিসেবে হরিদাসীর বিয়ে ঠিক হলে বনমালী মেয়ের এমন সম্বন্ধে প্রথমে রাজি ছিল না। পরে বনমালী নিজের অবস্থা ও অক্ষমতা বিচার করে চুপ করে থাকে। ছোটবাবুর সঙ্গে বিয়ে হলেও কোনোদিন একটি মুহূর্তের জন্যও স্ত্রীর মর্যাদা পায়নি হরিদাসী। মনিব-ভৃত্যের সম্পর্কের চেয়েও অমর্যাদাকর বৈবাহিক জীবনের এই সম্পর্কে হরিদাসী হাঁপিয়ে ওঠে। দাসী-বাঁদিদের মতো বেঁচে থাকা, স্বামীসোহাগহীন বেঁচে থাকা যে অগৌরবের, হরিদাসী তা মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে লাগলো। একে বৃদ্ধ স্বামী, তার ওপর কার্যত সম্পর্কহীন সম্পর্কে হরিদাসী কিছুটা দ্রোহী হয়ে উঠলো। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত অসংযমী, লোলুপ স্বামী কলকাতায় বাঈজীদের মহলে নির্মমভাবে আহত হয়ে মারা গেলে হরিদাসী বৈধব্য লাভ করে। বাবা বনমালী মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি না রেখে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। কিছুদিন পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হরিদাসীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয় বাবা বনমালী মারা গেলেন। হরিদাসী যেন অকূল পাথারে ভাসতে লাগলো! কোথায় যাবে সে? হিতাহিত ভেবে না পেয়ে হরিদাসী ও তরুণ রামু বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। একজন অকালবিধবা, আরেকজন অবিবাহিত তরুণ। তারা ভয় পেলো, এজন্য যে রাত পেরোলে তারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। রক্ষণশীল হিন্দু-সমাজ তাদের অপবাদ দেবে। কলঙ্ক রটে যাবে। এমন অবস্থায় তারা আশ্রয়ের খোঁজে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গের যশোর অঞ্চলের দিকে গন্তব্যহীন যাত্রা করলো। তারা লোকমুখে শুনেছে পূর্ববঙ্গের মানুষ এবং সমাজ-ব্যবস্থা তাদের সমাজ থেকে উদার। ঘটনাক্রমে বুড়ির নানা ফকির চাঁদের আশ্রয় লাভ করে হরিদাসী ও রামু। লোকগঞ্জনা ও সমাজের প্রতিকূলতাকে কাটাতে ফকির চাঁদ হরিদাসীকে কন্যারূপে গ্রহণ করলেন। পরে দুজনকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়ে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ে দিলেন।
এখানে লক্ষণীয়, হরিদাসী জীবনের জন্য, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য কত সহজে ধর্মান্তরিত হলেন। নিজের নাম পাল্টে আসিরণ নামটিকে গ্রহণ করতে দ্বিধা করলেন না! এমনকি হবিবরকে (রামুর মুসলিম নাম) স্বামীরূপে সারাটি জীবন মেনে চললেন। তার কোনো সন্তান হলো না। ফকির চাঁদের সংসার ও তার সন্তানদের জন্যই নিজের প্রাণপাত করলেন। কেবল বেঁচে থাকার কাছে সমর্পিত হলো একজন নারী হরিদাসীর জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা। হরিদাসী চরিত্রে প্রখরতেজী মনোভাবটি আমরা দেখেছি। তার দ্রোহী চৈতন্যটি চকিতে উঁকি দিয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া স্বামীর বিপরীতে। কিন্তু সেই দ্রোহ, সেই অমিত সম্ভাবনা সমাজ, সংস্কার, প্রথার বেড়াজাল ডিঙিয়ে বিকশিত হওয়ার পথ পেলো না। তবে হরিদাসীর এই দ্রোহী ভাবনার রূপায়ণ দেখি উপন্যাসের আরেকটি নারী চরিত্রে। সেটি হলো হরিদাসীর ভূতিদি। সে সুন্দরী, যৌবনবতী। ভূতির স্বামীর বয়স, রুচিবোধ তার সঙ্গে যায় না। ফলে তার দ্রোহ আরও চরমে ওঠে। একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে যাওয়া ও ঝুমুরবালা নাম ধারণ করে বাঈজী-জীবন বেছে নেওয়া স্বেচ্ছাকৃত হলেও, এর পেছনে বাঙালি নারী-জীবনের শাশ্বতকালের সামূহিক বঞ্চনাবোধের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী চেতনা ক্রিয়াশীল। ভূতিদি নারী-জীবনের অপ্রাপ্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। অন্যদিকে হরিদাসী প্রতিবাদী হতে চেয়েও জীবনের সঙ্গে আপস করেছে। ঊনিশ শতকের বাঙালি সমাজে বাস্তবধর্মী নারী জীবনের দৃষ্টান্ত ভূতি আর হরিদাসী।
অন্যদিকে বুড়ির দৃষ্টিতেই পুরো উপন্যাসের ঘটনা-পরম্পরা বর্ণিত হয়েছে। কৃষিভিত্তিক সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতর দিয়েই বেড়ে ওঠে বুড়ি। বুড়ির দেখা বাঙালি মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষিভিত্তিক জীবন ও সমাজের নিখুঁত বাস্তব-চিত্র ফুটে উঠেছে উপন্যাসটিতে। পাশাপাশি বাঙালি কৃষি-পরিবার অথবা মধ্যবিত্তের সংসারে পুত্র-সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা এবং পুত্র-সন্তানের প্রতি প্রবল পক্ষপাত একজন কন্যা-শিশুর বিকাশমানতার পথে যে কতটুকু প্রতিবন্ধক, তার নির্মোহ পর্যবেক্ষণ রয়েছে গ্রন্থটিতে।
খুব ছোটবেলায় বুড়ির একটি ভাই হয়। বুড়ির বাবা-মা অর্থাৎ উপন্যাসের চরিত্র মেজমিয়ার ও মেজবউয়ের একটি পুত্রসন্তান হয়। সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, অধিকতর সমৃদ্ধ জীবনের প্রত্যাশায় মেজবৌয়ের ক্রমাগত তাগিদ ও তাড়নায় অনেকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেজমিয়া গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। চলেও যায়। বাসা-ভাড়া ও সংসার পরিচালনার উচ্চখরচের চাপ বইতে না পেরে মেজমিয়া শিক্ষকতা ও টিউশনে অধিক ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার ওপর মেজ বউয়ের শহরে একটি বাড়ি করার স্বপ্ন এবং ক্রমাগত তাড়া মেজমিয়াকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। গ্রামের নিজের ভাগের সম্পত্তি বিক্রি করে এনে ( মেজ বউয়ের প্ররোচনায়) শহরে জমি কিনে মেজমিয়া। এভাবেই বাঙালির আবহমানকালের গ্রামজীবনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অন্তর্লীন সত্যভাষণ বিধৃত হয় উপন্যাসে। যৌথ পরিবার ভেঙে এভাবে অণু পরিবার তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটি তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে।
মানুষ বস্তুত সুখী হতে যায়। মেজ বউ, মেজমিয়ারাও সুখী হতে চেয়েছে। নিজেদের সুখ যখন সন্তানদের ঘিরে, তখন পুত্রসন্তান বাবুর পড়াশোনায় অনীহা, বখাটেপনা, বেপরোয়া জীবন-যাপন তাদেরকে উদ্বিগ্ন করে। অন্যদিকে, কন্যাসন্তান বুড়ি পড়াশোনায় ভালো ফল করলেও, তাকে নিয়ে অভিভাবকদের জোরালো কোনো আশাবাদের চিত্র আমরা দেখি না। এর তলদেশের সূক্ষ্ন কারণটি লেখকের দৃষ্টি এড়ায়নি। সামাজিক স্তরবিন্যাসের দিক থেকে বাঙালি নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারে কন্যা-সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার মতো মনোভঙ্গি বা মানসিকতা কয়েক দশক আগেও সৃষ্টি হয়নি। এখনো যে খুব একটা হয়েছে তা নয়। এক্ষেত্রে অধিকাংশ অভিভাবকের সাধারণ ধারণাটি হলো, কন্যাসন্তান শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। তাকে এত পড়ালেখা করিয়ে কী হবে! এমন সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিকূল পরিস্থিতিকে পাশ কাটিয়ে বুড়ি (অরুন্ধতী) মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় চলে আসে ইন্টারমেডিয়েট পাস করে। আর পুত্রসন্তান বাবু ব্যর্থ হয়ে পড়াশোনা ছাড়ে। কন্যাসন্তান বুড়ির ভালো রেজাল্ট বাবা-মায়ের সম্মতি লাভে সহায়ক হলো ঢাকায় এসে কোচিং করার। বুড়ির আত্মপ্রত্যয়, জীবনকে বদলে দেওয়ার নিবিড় প্রেরণা তাকে সামনের দিকে তাড়িত করতে লাগলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয় সে। ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হতে থাকে বুড়ি। গভীর জীবনবোধ, সংবেদনশীলতা, প্রখর প্রজ্ঞার দীপ্তি আমরা তার চরিত্রে খুঁজে পাই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেক বন্ধু-বান্ধব জুটে যায় তার। এই পর্বে এক পরিণত আধুনিক নারী অরুন্ধতীকে পাই বুড়ির চৈতন্যের ক্রমবিবর্তনের ধারায়। আধুনিক কিংবা নাগরিক জীবনে সম্পর্কের বিচিত্র রূপ-রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করি বুড়ির বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন ও পরবর্তী বৈবাহিক জীবনে। আদর্শিক গরমিলের জন্য অরুন্ধতী প্রথম জীবনের পুরুষটিকে গ্রহণ করতে পারলেন না। ফলে বন্ধুদের অনেকে তাকে ভুল বুঝে দূরেও সরে গেছে। কিছুকাল পরে নতুন বন্ধু হৃদ্যকে ভালোবাসা এবং পড়াশোনা শেষে হৃদ্যকে বিয়ে করে সংসার পাতা অরুন্ধতির কোনো ভুল সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নয়। তাদের সংসার আলোকিত করে জন্ম নিল সন্তান অনো। রোমান্টিক ভাবালুতার মধ্যে থাকলেও অরুন্ধতীর সুখের সংসারে শাশুড়ি, ননদের আক্রমণাত্মক ভূমিকা তার স্বপ্ন সাজাতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এই চিত্র বাংলার ঘরে ঘরে এক নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা।
অরুন্ধতীর দাম্পত্য-জীবনে ‘মহুয়া’ নামের আরেক কালো অশুভ ছায়া নেমে। সে অরুন্ধতির স্বামী হৃদ্যের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। উদ্দাম, অসংবৃত-যৌবনা মহুয়ার প্রেম-ভালোবাসা শরীরসর্বস্ব। বিকৃত, পচনশীল, বেপরোয়া উচ্ছৃঙ্খল স্বভাবের মহুয়ার মধ্যে কোনো মানবিকবোধ কিংবা উচ্চতর আদর্শের ছিটেফোঁটাও পরিলক্ষিত হয় না। প্রবল আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন নারী অরুন্ধতী। সে হরিদাসী নয়। শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকা আর আশ্রয়ের জন্যই জীবন নয়। জীবনের বৃহত্তর-মহত্তর তাৎপর্য আছে। দাম্পত্যজীবন ব্যর্থ হলেই বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যায় না; জীবন মূল্যহীন হয়ে পড়ে না। সে শিক্ষিত, আত্মমর্যাদাশীল তেজোদীপ্ত নারী। সে জেনেছে প্রেম-ভালোবাসার অসারতার কথা। তার সত্যিকারের ভালোবাসা যখন উপেক্ষিত হয়েছে, তখন এই জোড়াতালির সম্পর্ক আর বিশাল ফাঁকির মধ্যে বাকি জীবনটা সে আর কাটাতে চায় না। সন্তানের দিকে চেয়েও নয়। অবশ্য তখন তার সামনে দুটো সুযোগ থাকে জীবনকে অর্থবহ করার। এক. চাকরির নিয়োগপত্র; দুই. বান্ধবীর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রকল্পে কাজ করা।
তিন
এ উপন্যাস পাঠের মধ্য দিয়ে পাঠকের মনে পড়ে যাবে ‘ঘরে-বাইরে’, ‘গৃহদাহ’, ‘রাত ভ‘রে বৃষ্টি’ উপন্যাস কিংবা ‘নষ্টনীড়’ গল্পের কথা। তবে ‘সুদূরে দিগন্ত’ পাঠকের কাছে মনে হবে উল্লিখিত কালজয়ী গ্রন্থগুলোরও সম্প্রসারিত ভাষ্য। দেশ-কাল ও জীবন-বাস্তবতার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে একুশ শতকের একজন দৃঢ়চেতা শিক্ষিত নারী মিথ্যা, ফাঁকি কিংবা অন্তঃসারশূন্য সম্পর্ককে আর স্বীকার করছে না। অসার সম্পর্কে কোনোভাবেই আর সে থাকতে চাইছে না। সে নির্দ্বিধায় স্বাধীন, মর্যাদাশীল জীবনের খোঁজে বেরিয়ে পড়ছে। জীবনে আত্মমর্যাদাশীল মানুষের মতো বাঁচতে চাইছে। পরাঙ্মুখ কিংবা পরগাছা নারী হয়ে নয়। নারী যে পরাশ্রয়ী নয়, তারও যে বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দ, সত্য, মর্যাদা ও স্বাধীনতা আছে মানুষের মতো; এই নির্মোহ অথচ নৈর্ব্যক্তিক সত্যভাষণটি দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে চূড়ান্তভাবে। কাহিনী কিংবা চরিত্রের পরিণতির দিক সাফল্য দেখিয়েছেনর লেখক। উপন্যাসের ভাষা ভাষা সহজ-সরল, প্রাঞ্জল ও গতিশীল। বিশাল কলেবরের উপন্যাসে অসংখ্য প্রধান-অপ্রধান পুরুষ ও নারী চরিত্র সৃজনে লেখক মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া লেখকের উদার-মুক্ত-মানবতাবাদী জীবন-দর্শন উপন্যাসটিকে বিশিষ্টতা দান করেছে।