আধুনিক যুগের কথাকার উপস্থিত কালের সমাজবাস্তবতার আলোকে নিজের জন্য পথ তৈরি করেন। তবে এর সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন ও কল্পনার মিথস্ক্রিয়াও ঘটান। তার চোখে শিল্পসত্য ও বস্তুসত্যের আপাতবিরোধ থাকে না। পরন্তু একটি অন্যটির মধ্যে বিলীনও হয়ে যায়। এভাবে আধুনিককালের কথাকারের যুগমানস গড়ে ওঠে। অর্থাৎ এই সময়ের কথাশিল্পী যুগের ঘটনাপুঞ্জ, অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সমন্বয়ে একটি বিস্তীর্ণ পটভূমি তৈরি করেন। সে পটভূমি প্রথমে সম্পূর্ণ সাদা অর্থাৎ ধূসর কিংবা বিরানপ্রান্তরের মতোই রহস্যময় থাকে। কিন্তু সেখানে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব খালি চোখে দেখা যায় না।
লেখক সেই শূন্য স্থানে একে একে বসিয়ে দেন নানা রকমের প্রাণী, উদ্ভিদ ও বস্তুর অবয়ব। প্রাণীর অবয়ব আঁকার পরপরই তার পরবর্তী কাজ থাকে তাতে প্রাণ সঞ্চার করা। এই প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য স্বপ্ন-কল্পনা-রঙ-অনুভূতির মিথস্ক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। সেই মুহূর্তে এই অনুষঙ্গগুলোর সুষম বণ্টন-বিন্যাস-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনই কেবল তার কণ্ঠস্বর সাধারণ্যে ধ্বনিত হতে শুরু করে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কণ্ঠস্বর সাধারণ্যে শোনা না যায়, ততক্ষণপর্যন্ত ওই লেখকের রচনারাজি সমাদ্রিত হয় না। নিজের কণ্ঠস্বর সাধারণ্যে পরিচিত করানোর জন্য তাকে আমৃত্যু সাধনা করে যেতে হয়। এসব কথার অবতারণার লক্ষ্য ফারহানা রহমানের গল্পগ্রন্থ ‘শ্রেণিশত্রু’।
২০২০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত ‘শ্রেণিশত্রু’গ্রন্থে রয়েছে ৯টি গল্প। এসব গল্পে রয়েছে ব্যক্তির হাহাকার, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির কথাও। রয়েছে আর্থ-সামাজিক চিত্রও। একথা বলা অসঙ্গতা হবে না যে, তিনি জানেন, লেখককে রাজনীতি সচেতন হতে হয়। অবশ্য। সমাজের আচরণ তার মনে যে রেখাপাত করে, তার সঙ্গে কল্পনার সমন্বয়ে তিনি নিজের জন্য একটি বাস্তবসম্মত কল্পজগতও তৈরি করে নেন। আর ওই জগতে আপন রুচি ও মর্জিমতো সব দৃশ্য বিন্যাসও করতে চান তিনি। কিন্তু প্রায়ই সেটি সম্ভব হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে ব্যর্থ হতে হয়। তার এই সাফল্য-ব্যর্থতার চিত্রই তাকে আঁকতে হয়। এছাড়া ব্যক্তির একাকীত্ব, দ্রোহ, কাম-প্রেম, ভালোবাসা-বিদ্বেষকেও গল্পের অনুষঙ্গ করে তুলতে হয় তাকে। তেমনই একটি ‘দশ পয়সার ইট’। মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা এই গল্প ফারহানার অন্যতম ভালো লেখা। সিক্সে পড়া এক কিশোরের বয়ানে পুরো গল্প পাঠক শুনবেন। গল্প আসলে শুধু পড়ার বিষয় নয়। গল্প আন্তরিকতার সঙ্গে পড়তে গেলে দেখা যায়, পাত্রপাত্রীর সংলাপ শোনা যায়, দেখাও যায় সিক্সে পড়া এক কিশোরের বয়ানে পুরো গল্প পাঠক শুনবেন। গল্প আসলে শুধু পড়ার বিষয় নয়। গল্প আন্তরিকতার সঙ্গে পড়তে গেলে দেখা যায়, পাত্রপাত্রীর সংলাপ শোনা যায়, দেখাও যায়।
ছেলেটির নাম বাবু। আসল নাম হাবিব হোসেন। সে সিক্সে পড়তো। যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যাওয়ায় তার পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। সবাই বাসাবন্দি হয়ে যায়। তার জন্মগত হার্টে ছিদ্র। ফলে সে মাঠে ফুটবল খেলতে পারে না, পরিশ্রম করতে পারে না। শুয়ে-বসে দিন কাটাতে হয়। যাও স্কুলে যেতো, সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
যুদ্ধের সময় লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে এই কিশোরের স্বাভাবিক জীবনও নষ্ট হয়। তারা চার মাস পরিবারসহ একটা বাংকারে থাকে। ভয়াবহ যুদ্ধ লাগার পর নিজেদের জীবন বাঁচাতে বাড়ির সামনের উঠোনে ৭ ফুট গভীর ১০/১০ ফুট বাংকার তৈরি করে ফেলে। তার ওপরে নারকেল গাছ কেটে বিছিয়ে দেওয়া হয়। এখানেই বিছানা পেতে সারাদিন শুয়ে থাকে ছেলেটি। লেখকের এই বর্ণনায় দেখা যায় যুদ্ধের সময় মানুষ কিভাবে নিজেদের একটু লুকিয়ে রাখা যায়, সেই তরিকাই খুঁজতো। বাবু সারাদিন বাংকারে শুয়ে থাকে, শক্তি পায় না। মাঝে মাঝে খালের পাড়ে গিয়ে দাঁত মাজে। একদিন দাঁত মাজতে গিয়ে সে যা দেখে ফেলে, তা তার কিশোর মনকে পরিণত করে ফেলে। মনে মনে রাজাকার রজব আলীকে হাতে পেলে মেরে ফেলার ছক কাটে।
হার্টে ছিদ্র থাকায় যখন তার খেলা বন্ধ হয়ে গেছিল বা কেউ তাকে খেলতে নিতো না, তখন একদিন বাঁধন ভাই নিয়ম করলেন বাবু প্রথম কিকটা দেবে। অর্থাৎ বাবু প্রথম কিক দিলে খেলা শুরু হবে। সেই দিন থেকে বাঁধন ভাই হয়ে গেলো বাবুর হিরো। আদর্শবাদী মানুষ, ঢাকায় পড়াশোনা করে। বয়স ১৮ /১৯। ধবধবে তার গায়ের রঙ, ছেলেদের নিয়ে সে নজরুলের জাগানিয়া গান করে, কবিতা আবৃত্তি করে। এক সময় বাঁধন ভাই চুপচাপ মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। বাবু টের পায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের জবাই করে খালের পানিতে ফেলে দিতো রাজাকার রজব আলী। এই দৃশ্য সহ্য করা যায় না। বাবু একসময় খালের পাশে যাওয়াই বন্ধ করে দিলো। একদিন সে দেখতে পায়, আবছা আলোয় বাঁধন ভাইকে শুইয়ে দিচ্ছে রজব আলী। বাঁধন ভাইয়ের জন্য কাঁদতে থাকে বাবু। তার বড় ভাই বাবুকে জাপ্টে ধরে রাখে। রাজাকার রজব দা উঁচিয়ে বাঁধন ভাইয়ের গলায় পোচ দেয়।
যুদ্ধের পর রাজাকার রজব আলী ধরা পড়ে। গ্রামবাসী তার বিচার নিজেরাই করবে ঠিক করে। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ইটের টুকরা রজব আলীর মাথায় ছুড়ে মারতে থাকে। বাবু তার মায়ের কাছ থেকে দশ পয়সা চেয়ে নিয়ে আস্ত থান ইট কেনে। সেই ইট দিয়ে রজবের মাথা থেঁতলে দেয়। মাথার ঘিলু ফেটে বাবুর শার্ট প্যান্ট একাকার হয়ে যায়। বাঁধনের কথা মনে করে কাঁদতে থাকে সে। যুদ্ধে যে যেভাবে পেরেছে, অংশ নিয়েছে। রাজাকার বধে এই কিশোরের ক্রোধ এভাবেই দেখিয়েছেন ফারহানা রহমান। এই গল্প পুরো বইয়ের সব চেয়ে বড় গল্প। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা কিছুটা বিস্তারিত হওয়াই স্বাভাবিক। রাজাকারদের বিভৎসতার কোনো সীমানা ছিল না।
ফারহানা রহমানের গল্পের সাদা ক্যানভাসে পেলাম নানা রঙের জটলা। কখনো বর্ণিল, কখনো ফ্যাকাশে।
‘ভেসে যাওয়া তরী’ বর্তমান অর্থলোভী স্বল্পশিক্ষিত মায়ের হাতের বলি হওয়া একটি অস্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক মেয়ের গল্প। যার নাম রমা, যে আর দশটা মেয়ের মতো সাধারণ জীবন চেয়েছিল। সে অসম্ভব সুন্দর ছিল। পড়াশোনায়ও খুব মেধাবী। কিন্তু মায়ের তার উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। এই মেয়ে বেশি পড়াশোনা করে ফেললে তাকে আর ইচ্ছেমতো বশ করা যাবে না। পাখা গজিয়ে যাবে। একদিন পীর সাহেবের কাছে দোয়া পড়াতে নিয়ে যাবে বলে মা মেয়েকে জোর করেই সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে রমা যাকে দেখে, তাকে পীর ফকির কিছুই মনে হয়নি তার। রমার মা চোখের ইশারা দিয়ে ওই লোকের সঙ্গে ঘরে যেতে বলে। রমা বাধ্য হয়ে পেছন পেছন যায়। এর পরের ঘটনা বেশ বোঝা যায়। লোকটা বেডরুমের দরজা আটকে দেয়। রমা ভীত আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার দিতে গেলে লোকটা শান্তভাবে জানায়, তার মা সন্ধ্যায় আসবে তাকে নিতে। তার মাকে দশ হাজার টাকা এই কয়েকঘণ্টার জন্য দেওয়া হয়েছে। রমা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
এই যে রমা এখন হাইপেইড কলগার্ল এবং তার জীবনে ঠিকঠাক প্রেম আসার আগেই তার মা এই ব্যবসায় তাকে নামিয়ে দিলো। এ যেন আমাদের সমাজের অবক্ষয়ের এক চূড়ান্ত নিদর্শন, অসামঞ্জস্যতা। রমার মাকে নিয়েও ছিল চারিত্র্যিক গুজব। রমার জন্মের ঠিক ছিল না বলে শোনা যায়। কিন্তু রমার মা লোভী না হলে রমা অন্য জীবন পেতে পারতো। সব মা’ই ‘মা’ নয়।
ফারহানা রহমান তার গল্পের নারী চরিত্রদের ওপর ঘটে যাওয়া নানা অঘটন, অনাচার, অত্যাচার, এমনকী নারী স্বয়ং ক্রিমিনাল; তাও দেখিয়েছেন। তার ভাবনা বহুমাত্রিক। ‘অতীতের কাছে যখনই ফিরে যাই’ গল্পে এক অসুখী নারী তার ছাব্বিশ বছরের বড় স্বামীকে, প্রেমিকের সাহায্যে খুন করতে গিয়ে নিজের মেয়ের কারণেই ধরা পড়ে। সারাজীবনের জন্য একঘরে তাকে বন্দি থাকতে হয়। কিন্তু এই অনাচারের পেছনে যে অনাচার, সেটা সমাজ খুব কমই দেখে। টাকা তাদের সত্য দেখতে দেয় না। সমাজ খুব সহজেই আঙুল তোলে নারীর দিকে। একটি মেয়ের গায়ে কাদা ছিটানো যেন শিশুর খেলা। একটি খারাপ চরিত্রের মেয়েকে নিয়ে গল্প করা দারুণ হট টপিক। কিন্তু গল্পের পেছনেও গল্প থাকে, তা ফারহানার লেখায় পরপর উঠে এসেছে।
‘
‘শ্রেণীশত্রু’ গল্পটিও সুলিখিত। ফারহানার পরিশ্রম এই গল্পে সহজেই অনুমেয়। ঘটনার ভিন্নতা গল্পটিকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। তাক লেগে গেছে ‘দৃশ্য ছাপিয়ে যায়’ গল্পে। আমি ঠিক এই ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। লেখকের সঙ্গে ট্রেনে জাহ্নবীর পরিচয় হয়। দিল্লি থেকে কোলকাতা আসার পথে সারা রাস্তা কথা বলতে বলতে দুই নারী বন্ধু হয়ে যায়। কিছু দিন আগেই জাহ্নবীর সঙ্গে তার ফিওন্সের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। লেখক প্রশ্ন করেন, ‘তোমার বয়ফ্রেন্ড কোথায় আছে এখন?’জবাবে জাহ্নবী জানায়, ‘আমার গার্ল ফ্রেন্ড।’ পুরো গল্পের এখানেই মোড় নেয়।
সাদা চোখে যা দেখা যায়, তা অনেক সময় ঠিক হয় না। ক্লাস সিক্সের পর থেকেই জাহ্নবীর অস্বাভাবিক জীবন শুরু হয় তার অজান্তেই। সে মায়ের কাছেও শেয়ার করতে পারেনি। ‘বান্ধবী নিকিতার সঙ্গে যখন ব্যাপারটা শেয়ার করে আর তখনই বান্ধবীর চরম রিঅ্যাকশনে ও প্রথম বুঝতে পারে বিষয়টির অবৈধতা। বুঝতে পারে কতটা অস্বাভাবিক একটা জীবন কাটাচ্ছে ও দিনের পর দিন ধরে।’লেখক বলছেন, ‘জাহ্নবীর মা ছিলেন ক্যান্সারের রোগী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মা’কে কথাগুলো বলতে পারেনি ও। তবে মায়ের বিষণ্ন, দুঃখী আর গভীর দৃষ্টি দেখেই বোঝা যেতো, তিনি হয়তো একসময় সবই বুঝতে পেরেছিলেন।’
ফারহানা রহমানের গল্পের সাদা ক্যানভাসে পেলাম নানা রঙের জটলা। কখনো বর্ণিল, কখনো ফ্যাকাশে।