‘শের-এ মানিক বৈরাগী’ কবি মানিক বৈরাগীর ৬ষ্ঠতম গ্রন্থ ও কাব্যগ্রন্থের মধ্যে চতুর্থ। এছাড়া সম্প্রতি আগামী প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে ৫ম কাব্যগ্রন্থ ‘ছাইস্বর্ণ অম্লজলে’। আমরা জানি স্বরবৃত্ত ছন্দ ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দ কাব্যিক নান্দিকতা প্রকাশে উদার জমিন। তবে কাব্যগাথায় যদি ছন্দের মিলে অনুপ্রাসের অনুরণনে গীত কবিতার মতো অনুরণিত হয়, স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের স্বরের বিন্যাসে ত্রুটিহীন ছন্দ মাধুর্য ফুটে উঠে তখন তা স্বার্থকতার পর্যায় পেরিয়ে হয় প্রাণবন্ত।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলা সাহিত্যের গীতি কবিতা ও সতেরো-আঠারো শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে যে সব কবি কাব্যচর্চা করে গেছেন এরমধ্যে হাফিজ, রুমি ও মির্জা গালিব, বার্মায় নির্বাসিত সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর অন্যতম। আরও উল্লেখ্য, ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে অখণ্ড বঙ্গদেশসহ আরাকান রাজ্যে যে সব কবিরা (আলাওল, দৌলত কাজী, কোরেশি মাগন ঠাকুর, আবদুল হাকিম, নসরুল্লাহ খোন্দকার, কাজী শেখ মনসুর প্রমুখ) কাব্যচর্চা করেছেন, তারা মূলত আরবি ফারসি ও আরবি ফারসির মিলনে দোভাষী পুঁথির রচনা করেই গেছেন। আজকের আলোচ্য কবি মানিক বৈরাগীর কাব্যগ্রন্থ ‘শের-এ মানিক বৈরাগী’ অন্যান্য আধুনিক কবিতার মতো নয়। তার এ কাব্যে ‘কলবে অমর্ত্য সুবাস’, ‘জীবনবৃক্ষের রঙ, চৈতন্যে সুখ শরাব’ নামক তিনটি পর্বে মানবজীবনের সম্পর্ক, চরিত্র, দারিদ্র্য, আধ্যাত্মিকতা ও আত্মদর্পণের চরিত্র চিত্রণ করেছেন।
‘কলবে অমর্ত্য সুবাস’ পর্বে কবির চেতনা আধ্যাত্মিকতার উচ্চমার্গে উচ্চারিত হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। মানুষের জীবন সত্য জন্ম ও মৃত্যুতে। এই অমোঘ সত্য ধারণাটি তার প্রথম উচ্চারণে বাকময়তা পেয়েছে। ‘যদি ডাক আসে যেতে হবে/ মোহময় মর্ত্য ছেড়ে অমর্ত্যলোকে।’ (পৃ.১১) এ বিশ্ব তথা ধরিত্রী মাতার ওপর পরম সৃষ্টিকর্তা তথা কোনো এক রাজন্যবর্গ যেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকেও ছাড়িয়ে গিয়ে আমাদের মতো নরাধমের বসতি দুনিয়া শাসন করে যাচ্ছে। এ যাওয়াকে কবি মানিক বৈরাগী স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছেন, ‘অমর্ত্যলোকে বসে আছেন এক রাজাধিরাজ/ হুকুম তামিলে প্রস্তুত সেপাই সেনা বরকন্দাজ।’ অথবা ‘কলবে যদি খোদা না থাকে তবে/ লোক দেখানো নামাজে কী হবে!’ (পৃ.১২) এখানেই কবি মানিক বৈরাগীর আধ্যাত্মিকতা ও মানবিকতার পরিচায়ক। আমরা সাধারণত লোক দেখানো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এমনকি খোদার সঙ্গে পর্যন্ত প্রতারণা করি। ভেকধারী পোশাকে আমরা খোদা ও রাসুল বলে বলে চিল্লায় কিন্তু অন্তুরে এবং খোদার নামে ভণ্ডামি করি।
মানিক বৈরাগী এসব সামাজিক চিত্র তুলে ধরেছেন ‘শের-এ মানিক বৈরাগী’ কাব্যে। এ কাব্যগ্রন্থটির অধিকাংশ দুই লাইনের হলেও অনেক বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি চিত্রিত করেছেন ধর্মান্ধ ভণ্ডবাদী এবং ধর্মের নামে মিম্বরে উঠে খোতবায় অন্য ধর্মের কবর রচনা করে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, অন্য ধর্মের কবর রচনা কিংবা সমালোচনা করার জন্য রাসুল (স.) মিম্বরের ধারণা পোষণ করেননি। কবির ভাষায়, ‘ওহে ইমাম খুতবায় খুঁড়ো অন্য ধর্মের কবর/ জুমার হজ নষ্টের জন্য নবিজি করেননি মিম্বর।’ (পৃ-১৫) এই পর্বে খোদার আসনে বসা সৃষ্টিকর্তার কাছে কবির আরাধনা এ রকম, ‘পরস্পরের তলোয়ার আর বোমার আঘাতে/ মানুষই যদি না থাকে দুনিয়ায়/ খোদার গুণকীর্তন জিকির-আজগর কেরামতি/ কে চেনাবে হায়!’ (পৃ – ১৯)
গালিবের গজলের স্পন্দন ও ব্যাকরণ নামাঙ্কিত লেখার এক পর্যায়ে কবি শ্রীজাত উল্লেখ করেছেন, কোন শিল্পই কেবল আঙ্গিক বা ব্যাকরণ নির্ভর নয়, তার বোধ তার ব্যাপ্তি, তার দর্শন তাকে টিকিয়ে রাখে যুগের পর যুগ, যেমন আছে গালিবের গজল।
তার দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম ‘জীবনবৃক্ষের রং’। এখানে উল্লেখ্য যে, জীবনবৃক্ষের উদার নৈতিকতা। অবুঝ বৃক্ষের মতো জীবনবৃক্ষ যদি উদার না হলে কী স্যার জগদীশ বসু কিংবা কবি জীবনের সবুজ সমারোহ নিয়ে…. কী কবিতায় বাক-প্রতিমায় উচ্চারণ করতে পারেন ! আসলেই জীবনবৃক্ষ ও সবুজের সমারোহের মতো জীবনের বাঁচার জন্য দরকার অক্সিজেনসমূহের মহিমায় তৈরির জন্য প্রয়োজন উদার নৈতিক মেটাফিজিক্যাল ফিলসপি বা দর্শনগত ভাবনার বাগ্ময়তা। এটা অবশ্যই শুদ্ধতম কলবের উৎসারণ হবে। তবে এ পর্বের গাঁথাগুলো প্রকৃতপক্ষে প্রবাদ বচনের মতো। যেমন, ‘রক্তের বাঁধন যায় না অস্বীকার/ চুন থেকে পান খসলেই পাবে তিরস্কার।’ (পৃ-২৮) বংশগত দরিদ্র লোক যদি হয় ধনী/ অহংকারে প্রতিবেশী পিষ্ট হয় জানি।’ (পৃ.২৯) ‘পিতা অর্বাচীন পুত্র শিক্ষিত হলে/ শ্বশুর-শাশুড়িকে চাকর বলে।’(পৃ-৩০)
উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার দ্বিতীয় কন্যা মাধুরী লতার শ্বশুরবাড়ি কবি বিহারী লাল চক্রবর্তীর ব্যারিস্টার সন্তান শরৎ চক্রবর্তীর (যাকে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং আমেরিকাতে ব্যারিস্টারি পড়ার খরচ যুগিয়েছিলেন) বাড়িতে যাওয়া আসা করতেন। কারণ মেয়ে মাধুরী লতা ক্যান্সার জাতীয় রোগে অসুস্থ ছিলেন। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের বাসায় সকালে যেতেন আর সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতেন। এভাবে যাওয়া আসার ফাঁকে তাদের বাসায় জামাই শরৎ চক্রবর্তী শ্বাশুরের সামনে টেবিলের ওপর পা উঠিয়ে বসে থাকতেন। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র কিংবা ব্যারিস্টার জামাই অর্বাচীনভাবে শ্বশুরের সাথে অসৎ আচরণ করেছে। এ জাতীয় ঘটিত বাস্তব ঘটনাকে মানিক তোলে ধরেছেন তার আধুনিক প্রবচনে। আধ্যাত্মিক চেতনাকে ধারণ করে জীবনের বৈচিত্র্যময় রং ছড়ানো যায় বটে, কিন্তু এ জাতীয় গ্রন্থ রচনার মাঝে প্রমোদ বালককে নিয়ে লেখাটি আমাদের ভাবায় । ‘প্রমোদ বালকের নিতম্বে মেদের লাবণ্য/ বিকিয়ে জনে জনে সে হয় ধন্য।’ (পৃ-৩৪) মানিকের এ প্রবচনটিকে সম্পূর্ণ প্রতীকি বলে মনে হয়। সমাজে অনেক গুরুত্বহীন ব্যক্তি আছে, যারা নিজের ঢোল নিজে পিটিয়ে আপনাকে জাহির করে। মানিকের এ বচনটি যেনো তারই আদিরসাত্মক রূপ। ঐসব ব্যক্তিদের হীনমন্য রূপটিকে হাফিজ, রুমি, গালিব, বাহাদুর শাহ কিংবা হাজার বছরের চৈতন্যকে ধারণ করে আরো একধাপ ধরিয়ে দিয়েছেন মানিক। প্রমোদ বালকরূপী ছদ্মবেশীদের সাহিত্যের বাজারে চিহ্নিত করা মোটেও দুষ্কর নয়। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এ রকম ব্যতিক্রমধর্মী গাঁথা হলো ‘শৈর-এ মানিক বৈরাগী’।
তৃতীয় পর্ব ‘চৈতন্যে সুখ শরাব’। এ পর্বে কবি প্রেম, গজল লিখিয়েদের ঐতিহ্য অনুসরণ, ব্যক্তিগত দুরাবস্থায় পতিত হলে আত্মীয় স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবদের অট্টহাসি উপহাস, চলমান অপরাজনীতি, ধর্মান্ধ এবং স্বৈরাচার মনোভাব বিষয়ে আলোকপাত পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। মানিক বলেন, ‘নিজেই নিজের কাছে বিরক্তিকর উপদ্রুব/ কেন পেতে চাও এই ছোঁয়াচে সংশ্রব!’ (পৃ-৪৫) ‘অযুত বেদনার বরপুত্র আমি, নাম মানিক বৈরাগী/আড়ালে সাইফুদ্দিন আহমদে মানিক-সুখের শরাবি।’ (৪৬) এককথায় মানিকের চিন্তা চেতনার ফল্গুধারা হাফিজ রুমি, বাহাদুর শাহ কিংবা গালিবের জমানার বাস্তুভূমি থেকে উৎসারিত হলেও আঙ্গিক ও বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে মানিক নিঃসন্দেহে স্বতন্ত্র।। এখানেই মানিকের বিশিষ্টতা একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার দৃষ্টিতে মানিকের দুই চরণের গাথাগুলো যদি ছন্দের অনুপ্রাসে অনুরণন সৃষ্টি করে আরেকটু উন্নত পর্যায়ে উন্নীত হতো তাহলে দেশ পত্রিকায় (মার্চ ২০২১ সংখ্যা) গালিবের গজলের স্পন্দন ও ব্যাকরণ নামাঙ্কিত লেখার এক পর্যায়ে কবি শ্রীজাত উল্লেখ করেছেন, কোন শিল্পই কেবল আঙ্গিক বা ব্যাকরণ নির্ভর নয়, তার বোধ তার ব্যাপ্তি, তার দর্শন তাকে টিকিয়ে রাখে যুগের পর যুগ, যেমন আছে গালিবের গজল। তেমনটিই পাওয়া যাবে মানিকের ‘শের-এ-মানিক বৈরাগী’ গ্রন্থে।
শের এ মানিক বৈরাগী
মানিক বৈরাগী
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
মূল্য: ১৫০ টাকা
প্রকাশক: বর্ণচাষ।