আমার মনে হয়, যে কবিতা পড়লে অন্তরে কাব্যিক অনুভূতি জাগে, সেটাই কবিতা। সবার কাছে আবার তা মনে না-ও হতে পারে। কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দ প্রথম শর্ত হতে পারে কিন্তু একমাত্র শর্ত নয়। তাই তো ছন্দের জটিল মারপ্যাঁচ এড়িয়ে প্রতীক মাহমুদ শব্দের গাঁথুনিতে কাব্যিক অনুভূতি দিতে পেরেছেন। তাই আমার কাছে তার কবিতা ভালো লেগেছে।
সম্প্রতি পড়া কবি প্রতীক মাহমুদের ‘শূন্যের শহরে বায়স্কোপের ভোর’ কবিতাগ্রন্থটিকে আমার কাছে মনে হয়েছে কবিতায় গদ্যের অভিনব সংস্করণ। ছন্দ-মাত্রা-অন্ত্যমিলের চাতুর্য যদিও কবি এড়িয়ে গেছেন। উপমা, অলঙ্কারের ক্ষেত্রেও জটিল আবর্ত নেই। তবে একটা নিবিড় ঘোর লক্ষ করা যায়। এসবে অবশ্য আমার আপত্তি নেই। আমার দরকার পোয়েটিক ফিল, যা পড়ে আমার হৃদয়ে ছাপ লেগে থাকবে অনেকক্ষণ।
কবিতাগ্রন্থটিতে মোট কবিতা আছে ছেচল্লিশটি। যার অধিকাংশই উড়ন্ত বলাকার পাখায় ভর করে আসা মৃদু সমীরণ। চলে গেছে অনুভূতির গভীরে অতল স্পর্শ দিয়ে। তার কবিতার বক্তব্য জটিল হলেও দুর্বোধ্য নয়। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে আলাদা জগত তৈরি করেছেন। হয়তো অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। এই দুর্বোধ্যতা আমার অক্ষমতাও হতে পারে।
আক্ষেপ, অভিযোগ, জীবনবোধ, মনুষ্যত্ব, প্রেম, দুঃখবোধ, আবেগ, মৃত্যু আর অভিমানের মহড়া নিয়ে দাঁড়িয়েছে বইটির অবয়ব। তার কবিতার চরণ বিষয়ের গভীরতা ও উপস্থাপনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। বেশ কিছু কবিতা তাই ভালো লেগেছে। এমনই একটি কবিতা ‘মৌলিক মানুষ-১’। প্রকৃত মানুষের স্বরূপের নমুনা কাব্যিক ঢঙে কবি হাজির করেছেন এ কবিতায়। তিনি শব্দের খেলায় বলতে চেয়েছেন, একজন মৌলিক মানুষ কে বা কারা? মৌলিক মানুষগুলো কেমন? কেমন তাদের বৈশিষ্ট্য? কবিতাটির শুরুতেই কবি অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে বলেন—
গোপনে জীবনের আস্তরণ নিয়ে বেড়ে ওঠা
বিশ্বাসী মানুষগুলোই মৌলিক মানুষ।
কবিতাটিতে মৌলিক মানুষ বলতে সত্যবাদী, শান্তিপ্রিয়, শ্রমিকশ্রেণীর মানুষদের ইঙ্গিত করা হয়েছে। যারা সভ্যতার নির্মাণ ও অগ্রগতিতে রেখেছেন বিরাট অবদান।
কবির তালিকায় আছে সৃজনশীল মানুষের কথাও। যাদের প্রতিনিধি হিসেবে এনেছেন বাউলের কথা। কবিতায় খেটে খাওয়া মানুষের দুঃখবোধ ও তাদের প্রতি কবির মমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কবিতায় পাওয়া যায় নির্মম সত্যের বয়ান—
যে কুমার মাটি ছেনে সুখি সংসারের পুতলা বানায় অবিচল—
অথচ তার ঘরেই সুখের আকাল,
যে কামার লাঙ্গলের ফলায় ধার শানায়,
অথচ সে জানে না মাটির গভীরে বীজের সুখ মানেই পৃথিবীর সুখ,
কবির ভাষ্যমতে, মৌলিক মানুষের শত্রু চারদিকে। তাদের জন্য এ পৃথিবী সর্বদাই প্রতিকূল। যেন মৃত্যুর কাছাকাছি। সত্য, সুন্দর জীবন নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বরাবরই চ্যালেঞ্জিং। তাদের শত্রু থাকে বেশি। ফলে জীবন সংকটে পড়ে মৌলিক মানুষদের। ‘মৌলিক মানুষ-২’ কবিতায় পাই—
লাশ ঘরে যিনি পড়ে আছেন তাকে হত্যা করা হয়েছে
তাকে হত্যা হয়েছে কারণ, তিনি ছিলেন মৌলিক মানুষ।
যদিও মৌলিক মানুষদের হত্যা করে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা যায় না। তারা পৃথিবীর নদী, ঘাস, জলে ও বাতাসে টিকে থাকেন নিজের সৎ কর্মের মাধ্যমে। একই কবিতায় আছে—
কী আশ্চর্য! তাঁকে হত্যা করা হলেও
তার নখ বাড়ছে, চুল বাড়ছে, চোখের পাপড়িও পরিবর্তিত হচ্ছে,
বইটিতে বেশ কিছু ভালো লাগার মতো চরণ খুঁজে পেয়েছি। যেমন—
১.
এভাবে চলতে চলতে তুমিও একদিন
ঘাসপাতায় খুঁজে নেবে ফড়িংজীবন (সাময়িক বিরুদ্ধতা)
২.
ফিকে প্রতিবিম্ব দেখলেই মনে হয়
আমার বয়স বাড়ছে না
আয়নার বয়স বেড়ে চলছে (বয়স সমাচার)৩.
বাবা বলতেন, মোহ থাকলে ত্যাগের শর্ত পূরণ হয় না (শরীরে মায়ের তবন, মুখে বাবার বচন)৪.
শাড়ির উদরে হাত পুরে দেওয়া ভিখারি যুবক আর খাদ্য চায় না
চায় নরম মাংসল ভাঁজে জীবনের ওম। (বেঘোর জীবন)৫.
আজকাল অন্ধকার হলেই আমার মোহগুলো দারুণ ঘোড়া (দায়বদ্ধতা)৬.
নিজের ভেতর নিজেই কেন খুঁজে ফেরো ঘর,
ঘরহীন ঘরে কেউ খেলছে অন্যস্বর। (অযাচিত সংলাপ-৬)
বইটির কয়েকটি জায়গায় কিছু কিছু শব্দের ব্যবহার আমাকে ভাবিয়েছে। সেগুলো কারও কারও কাছে মনে হবে অসঙ্গতিপূর্ণ। যেমন: ‘আমি ফিরলেই’ কবিতায় ‘জলদ মেঘের কান্না’। জলদ আর মেঘ শব্দের অর্থ যেহেতু একই। তবুও কেন দুটি শব্দ পাশাপাশি বসালেন কবি? এর জবাব হয়তো তিনিই ভালো দিতে পারবেন। ‘সূর্য পাহারা’ কবিতায় ‘স্বৈরিণী সময়ের গোঁজ’। স্বৈরিণী শব্দের যতগুলো অর্থ আছে সেগুলোর সবই স্ত্রীবাচক অর্থ বহন করে। ‘সময়’ শব্দের আগে এমন শব্দের ব্যবহার কবির দৃষ্টিতে ভিন্নমাত্রা যুক্ত করতে পারে। যদিও শব্দ সৃষ্টি ও ব্যবহারে কবির স্বাধীনতা রয়েছে। কেননা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই ব্যবহার করেছেন, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’। এমন অনেক দৃষ্টান্তই উপস্থাপন করা যাবে।
কবি কিছু কঠিন শব্দ বা তুলনামূলক অপরিচিত শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন, উন্নিদ্র, ঊষর, স্বৈরিণী, রিঙর। এসব শব্দের কল্যাণে পাঠক কিছু শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারবেন। তাই কবির ‘ঘোর’ কবিতার শেষ লাইনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই—‘এটা তো বিমূর্ত ঘোরে জন্ম নেওয়া এক অস্বচ্ছ জীবন।’ আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।
শূন্যের শহরে বায়স্কোপ ভোর
প্রতীক মাহমুদ
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
প্রকাশনী: বাংলানামা
মুদ্রিত মূল্য: ২৭০ টাকা।