শিল্পের কোনো দাগটানা মাঠ নেই, মানুষের মনই শিল্পের মাঠ। ছোটগল্প লেখকের প্রস্তুতি ও অন্যান্য বিবেচনা বইয়ে এমন কথা বলেছেন এ সময়ের অন্যতম কথাকার-প্রাবন্ধিক হামীম কামরুল হক। প্রবন্ধগ্রন্থটির নাম শুনলেই আঁচ করা যায়, গল্প লেখকদের জন্য তার এই নিবেদন। শুধু গল্পের ওপর এমন সিলেকটেড বই বাজারে বেশি একটা নেই। আর থাকলেও সেটা এমন কেউ লিখেছেন, যিনি হয়তো গবেষণার জন্য, ডিগ্রি পাওয়ার জন্য বই করেছেন। তিনি হয়তো কখনো গল্প লেখেননি। অনেক দেরিতে হলেও গল্প লেখকরা একটা সুন্দর বই পেয়ে গেলেন।
বইটি হাতে নিয়ে ফ্লাপে চোখ আটকে যায়। সেখানে ঘুরে এলে কথা সহজ হয়ে দাঁড়াবে আশা করি। যারা ছোটগল্প লিখতে চান বা লেখেন; আর যারা ছোটগল্প পড়তে চান, বা পড়েন, তাদের জন্যই এ বই। তীব্র-তীক্ষ্ণ বোধের উদ্ভাস নিয়ে বাংলা সাহিত্যে লেখা হয়েছে অবিস্মরণীয় সব ছোটগল্প। এখনও হচ্ছে। বর্তমানে বিপুল পরিমাণ ‘অগল্প’র আড়ালে পড়ে থাকছে প্রকৃত ছোটগল্প ও ছোটগল্পকাররা। পাঠকেরা একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছেন প্রকৃত ছোট গল্পের কাছ থেকে। লেখকেরা বিভ্রান্ত ছোটগল্পের স্বরূপ নিয়ে। নানান মতবাদের নামে গল্প থেকে এর আসল রস বাদ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে ছোটগল্প। সেখানে না আছে গল্প, না আছে গদ্যের স্বাদ।
আদতে ছোট গল্পের বিষয় নিয়ে ছোটগল্প ছাড়া অন্য কোনো কিছু লেখা যায় না। তাহলে কেন চলছে ছোটগল্পের নামে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এমন মচ্ছব? বছরে হাজার হাজার ছোটগল্প ছোট-বড় নানান কাগজে প্রকাশিত হলেও সে তুলনায় ছোটগল্পের কদর কমেছে। বিক্রি হচ্ছে না ছোট গল্পের বই। কেবল ছোটগল্পে নিবিষ্ট থাকতে পারছেন না এর লেখক। এটি তাকে সেরকম পরিচয় দিচ্ছে না। যা আগে অনেকে দিয়েছিল। অনেকেই ছোটগল্প লেখেন উপন্যাস লেখার প্রস্তুতি হিসেবে। ছোটগল্প পড়া ও লেখার জন্য চাই বিশেষ মনোযোগ। কেন তা তৈরি হচ্ছে হচ্ছে না? তৈরি হলেও ধরে রাখা যাচ্ছে না? এমন নানান প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে এ বইয়ের প্রবন্ধগুলোতে।
এখন আমরা সরাসরি প্রবন্ধে ঢুকে যাবো। মাত্র চার ফর্মার বইটিতে লেখক ছয়টি প্রবন্ধ রেখেছেন। প্রথম প্রবন্ধ ‘ছোটগল্প-পাঠকের প্রস্তুতি’। ভিমরি খাওয়ার অবস্থা হলো! গল্প লেখকের বই হলেও প্রথমে পাঠকের প্রস্তুতি কেন? এমন প্রশ্ন অমূলক নয়। কিন্তু প্রবন্ধের শেষ প্যারায় তিনি লিখেছেন—ছোটগল্প পাঠক যত সমৃদ্ধ হবেন, ছোটগল্প লেখক ততটাই সর্তক হবেন। ইদানিং বাংলা ছোটগল্পের বইয়ের পাঠক কমে গেছে। লেখকরা অভিমানী হয়েছেন যে, আধুনিক গল্প পাঠকরা এখনো নিতে শেখেননি। পাঠকরা সেই মান নাকি অর্জন করতে পারেননি। লেখকও তাই উদ্ভট সব গল্প লেখার দিকে ঝুঁকছেন। এটা সাহিত্যের জন্য কল্যাণকর নয় মোটেও। সব মিলিয়ে ছোটগল্প লেখকরা নিজেদের বিছিন্ন করেছেন। এটি ঘটতো না, যদি পাঠকের প্রস্তুতিটা ঠিকমতো সম্পন্ন হতো। তাছাড়া তিনি পৃথিবী বিখ্যাত সব ছোটগল্পকারদের উদাহরণ দিয়েছেন এ প্রবন্ধে। তাদের গল্পবিষয়ক বই নিয়ে লিখেছেন। যেমন, রথীন্দ্রনাথ রায়ের ‘ছোটগল্পের কথা’ বা সরোজমোহন মিত্রের ‘ছোটগল্পের বিচিত্রকথা’ বা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছোটগল্পের সীমারেখা’র উল্লেখ করেন। এসব বই পাঠের মাধ্যমে পাঠকরা ভালো গল্প শনাক্ত করতে পারবেন। তাদের গল্পের ধরন, বৈশিষ্ট্য, ভাষা-ভঙ্গিমা, চরিত্র ও চিত্রিতকরণের নানা বিষয়। সমাজ বা রাষ্ট্রের ভিতর দিয়ে কিভাবে পাঠক গল্পের সাথে মিশে যাবে তার দিকনির্দেশনা আছে এ প্রবন্ধে। তিনি গল্পকারকে পাঠকের সঙ্গে সখ্য বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
এরপর ছোটগল্পের প্রবণতা ও প্রয়াসের একটি তদন্ত চালান। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কথা উদ্ধৃত করে বলেছেন, ছোটগল্পই হলো বাঙালির মহাভারত। সমাজ, রাজনীতি, অর্থ, ধর্ম থেকে শুরু করে বিকার ও প্রতিকারের বিরাট বিপুল ক্ষেত্র নিয়ে এর বিস্তৃতি। এ প্রবন্ধে কিভাবে ছোটগল্পকার তার গল্প বানাতে শিখবেন, আর পাঠকও তা বিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করবেন, নিজের অনুভূতি আর কল্পনাকে অন্যের সঙ্গে কিভাবে লেখক বিনিময় করবেন, সেসব ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ-মোপাসাঁ-চেখভ-ও হেনরি—এই চারজনকে নিয়ে বিশ্ব ছোটগল্পের একটা জমিন তৈরি করেন। গল্পকারদের প্রবণতা ও প্রকরণ নিয়ে আলোচনা করেন। এ প্রবন্ধে তিনি টমাস হার্ডির গল্প সম্পর্কে করা উক্তি দিয়েছেন। হার্ডি বলেন, ‘গল্পকার যদি সেই অ্যানসেন্ট মেরিনারের মতো লোক ডেকে এনে তাকে গল্প শুনিয়ে স্তব্ধ করে দিতে না পারে, তাহলে তার তো গল্প বলার দরকার নেই।’ এ প্রবন্ধে গল্পকার নিজেকে বাদ দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলা পর-কাহিনীর কথা বলেছেন। যেখানে লেখক নিজের সময়কে অবিরত মোকাবিলা না করে পর-গল্প বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছে বলে মন্তব্য করেন।
ছোটগল্প বনান খাটোগল্প প্রবন্ধে ইলিয়াসের ‘মরে যাচ্ছে কিনা’ ও হাসানের ‘ছোটগল্প আছে ছোটগল্প নেই’ এই রকম দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব দিয়ে শুরু করেছেন। গল্প নিয়ে ফেঁদেছেন আরেকটি গল্প। তিনি ফাঁসিয়ে দেন লেখক ও পাঠককে। কোন ধরনের ছোটগল্প শুনতে চান? এ রকম একটি প্রশ্ন করেন তার চরিত্রের কাছে। চরিত্র তাকে বলছে—যে গল্প টাচ (স্পর্শ) করে। তো তিনি চরিত্রের কাছে জিগাসা করেন, টাচ বিষয়টা কেমন? চরিত্র বলছে, মনে ও শরীরে আলোড়ন বা শিহরণ তোলার মতো ব্যাপার। তো আবার প্রশ্ন শিহরণটা ঠিক কেমন। তখন চরিত্র একটা গল্পের মুখ ও লেজ একটি লাইনে শুনিয়ে দেয়। সেই গল্পটি এমন—‘একটা ছেলে পানির বিশ ফুট নিচ থেকে মাছও ধরে পাশাপাশি মাটিও জোগাড় করে এনে কী সব কাজে লাগায়। এই কাজ করতে গিয়ে ছেলেটি মারা যায়।’ ব্যস শেষ। এটা চরিত্রের পড়া টাচ করা একটি গল্পের কাহিনী না, গল্পটা যেভাবে, যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে সেটার কলা। তার মানে বর্ণনা, ভাষা, চরিত্র, পরিবেশ, মন-প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা-ক্ষরণ-পূরণ ইত্যাদি নিয়ে আসতে হবে একটা গল্পে। তারপর তিনি চরিত্রকে প্রশ্ন করেছেন ‘বিভূতিভূষণ?’ তার গল্প তার উপন্যাসের মতো জমে না। আবার প্রশ্ন ‘মানিক?’ তিনি খুব চিন্তাশীল, মনননির্ভর। অনুভব পাই না। রবীন্দ্রনাথ? সে তো বলাই বাহুল্য। তারা আর রবীন্দ্র-ই কেবল টাচ করে। এই হলো হামীম কামরুল হকের গল্প নিয়ে গল্প। দীপেন্দ্রনাথ দেবেশ রায় বলেন, আমরা তো এখনো ছোট গল্পের গদ্যটাই তৈরি করতে পারলাম না। লিও তলস্তয় বলেন, গল্প তার কাছে অনুভূতির সঞ্চারণ। অ্যালডাস হাক্সলির মতে, কেউ যদি লেখায় যৌন সম্ভোগের চেয়ে আনন্দ না পান তার দ্বারা লিখে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। সমরেশ বসু লেখার মাধ্যমে অন্তরের মুক্তির কথা বলেন।
পরের প্রবন্ধে ছোট গল্পের সংস্কার ও পালাবদলে কারা কারা অবদান রেখেছেন তাদের নাম নিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরী, অমিয়ভূষণ, রবীন্দ্রনাথ, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, হর্থন, পো, ও হেনরি, হেনরি জেমস, বালজাক, মোপাসাঁ, চেখভ, নিকোলাই গোগল, সমারসেট, ক্যাথরিন, ইভান বুনিন, ও কোনরে, কাফকা, বোর্হেস, শেরউড, ফকনার, হেমিংওয়ে, হুলিয়ো, ফুয়েন্তেস, মার্কেস, জয়েস, অস্কার ওয়াইল্ড, ভার্জিনিয়া উলফ, লরেন্স, টমান মান, ইভান তুর্গেনেভ, গোর্কি, তলস্তয়, নবকভ, মিখাইল, ম্যালামুডের, হেনরিশ বোল, জন চিভার, ডোনাল্ড বার্থ, অ্যালিস মুনরো, হারুকি মুরাকামি, পথ থেরো, হানিফ কুরাইশি, রোহাল ডাহল, ভৈকম মুহাম্মদ বশির, মুলক রাজ আনন্দ, আর কে নারায়ণ, রাস্কিন, শরৎ, প্রভাতকুমার, প্রেমেন্দ্র, বনফুল, সুবোধ, নরেন্দ্রনাথ, বিমল কর, কমলকুমার, সন্দীপন, উদয়ন ঘোষ, অরুপতনু, সুবিমল মিশ্র, সতীনাথ ভাদুড়ী, আশুতোষ, মাহমুদুল হক, রশীদ করীম, আবু রুশদ, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ূন, বুলবুল পর্যন্ত বাংলা ও বিশ্বা সাহিত্যের সব ছোটগল্পকারের পালাবদলে কীসব বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করেছেন, তার উদাহরণ দিয়েছেন। কেউ কেচ্ছাকাহিনি, কেউবা অদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি, কারও মানবিক আবেদন তৈরি, কেউ সভ্যতা ইতিহাস পুরানে গড়াগড়ি করে, কারও বেদনাবোধ কারও আনন্দধাম, কেউ বাইরে, কেউ অন্তরমুখিতাকে গ্রহণ করে ছোটগল্পের রসদ জুগিয়েছেন বলেই লেখক তুলে ধরেছেন।
এরপর তিনি আসেন ছোটগল্প লেখকের প্রস্তুতিতে। বলেন, লেখাও এক খেলা। যেমন মাঠে নামার আগে লাগে দিনভর অনুশীলন। সেটাও আবার হুবহু কাজে নাও লাগতে পারে। লেখা তো এক ধরনের যুদ্ধও। বলেন, অপেক্ষা ও উপেক্ষা-ই এ ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ। স্বীকৃতির বিচারে নিজের লেখার বিচার করা বোকামি। বাঙালি লেখকদের স্বভাবকে ‘বাঙালি নারী’ বলেও তিনি উদাহরণ টেনেছেন। যেটা স্বাদে টক হলেও বাস্তবে সত্যি। দিয়েছেন কিছু ভালো গল্পবিষয়ক বইয়ের তথ্য। দিয়েছেন আরেকটি গল্পের গল্প। সমরেশ বসুকে অন্নদাশংকর রায়ের স্ত্রী লীলা রায় জিজ্ঞাসা করেন, কেন তুমি লেখো? জানার জন্য লিখি। কী জানার জন্য? মানুষকে জানার জন্য। নিজেকে জানার জন্য নয় কেন? সমরেশ সচকিত হয়ে ওঠেন। এমন প্রশ্ন তাকে এর আগে আর কেউ করলো না কেন? এমনি সুন্দর সুন্দর সব গল্পের প্রসঙ্গ টেনে হামীম লিখেছেন তার প্রবন্ধগুলো।
শেষ প্রবন্ধ গল্পকারের পথ ও প্রতিজ্ঞা।এই প্রবন্ধে লেখক যেন গল্পের ব্যঙ্গবিদ্রূপ, রসিকতা, রহস্য, ট্র্যাজেডি, নাটকীয়তা, বাস্তবতা, সংকেত, প্রতীক, রূপক চিনতে ও বুঝতে হাতে ধরে শিখিয়ে দেন। এ যেন লেখক-পাঠক তৈরির কোষ।
ছোটগল্প লেখকের প্রস্তুতি ও অন্যান্য বিবেচনা
লেখক: হামীম কামরুল হক
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
মূল্য: ১০০ টাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৭