যৌনতা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে খোলামেলা আলোচনা সম্পূর্ণ নতুন নয়। অহরহই দেখা যায়। তবে বেশিরভাগই রগরগে বিবরণ মাত্র। যৌন বিশ্লেষণ তেমন চোখে পড়ে না। যৌনতাও মৌলিক চাহিদাগুলোর একটি, এটি আমাদের স্বীকার করতেই হবে। সে প্রচেষ্টাটাই করেছেন ঔপন্যাসিক মাসউদ আহমাদ। তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘রূপচানের আশ্চর্য কান্না’য় আমরা যৌনজীবনের জটিলতার বিবরণ পাই। যদিও তিনি কোনো সমাধানে আসেনি। একটি অমীমাংসিত সত্যকে চাপা দিয়েই কাহিনির যবনিকা টেনেছেন।
‘রূপচানের আশ্চর্য কান্না’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বা নামচরিত্র রূপচান। তাকে ‘রূপু’ বলে ডাকে সবাই। উপন্যাসে রূপচানের ব্যক্তিসত্তা, সামাজিক অবস্থান, গ্রামীণ অবকাঠামো, জীবনসংসার, দাম্পত্যজীবনে হতাশা, যৌনকর্মে অক্ষমতা প্রভৃতি তুলে ধরা হয়েছে। এরফলে ব্যক্তি রূপচান ধীরে ধীরে মিইয়ে যেতে থাকে। এ থেকে উত্তরণের কোনো পথ আমরা খুঁজে পাই না।
উপন্যাসে বিবৃত গ্রামের নাম রসুলপুর। সেই গ্রামের সামান্য দিনমজুর রূপু। হেমন্তের এক শেষরাতে একবুক হতাশা নিয়ে ঘুম ভাঙে তার। তখন ‘বউটা পাশে ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্ত-নির্ভার ও প্রশান্ত।’ রূপু অনুভব করে— ‘জীবন থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা খোয়া গেছে তার; এমন কিছু, যা না থাকলে জীবন অর্থহীন, অকেজো এবং মূল্যহীন হয়ে পড়ে।’ এখানে রূপচান আসলে তার যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। সেই যৌনশক্তি হারানোর দুশ্চিন্তা দিয়েই শুরু হয় ‘রূপচানের আশ্চর্য কান্না’। লেখকের ভাষায়, ‘যে ঘটনা সত্য ও অকাট্য।’
রূপচান সামান্য মানুষ—‘রূপুর মুখের মানচিত্রে কঙ্কালসার ও অনুজ্জ্বল এক মানুষের ছবি ফুটে থাকে।’ রূপু যে গ্রামে বাস করে, সেগ্রামের অবস্থা তেমন মর্যাদাপূর্ণ নয়। এখানে অভাবী ও খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। আর সেই খেটে খাওয়াদের মধ্যে রূপু হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণীর।
এটি একটি আটপৌরে জীবনের গল্প। রূপচান দারিদ্র্য, পারিবারিক দুর্যোগ, স্ত্রী-বিয়োগের বিষণ্নতা, বিরামহীন উদ্বেগ, আত্মীয়ের সম্পর্কত্যাগ—সবই বহন করে গেছে নিঃশব্দে এবং একা। প্রথম স্ত্রীর বিয়োগের পর কুসুমকে সে বিয়ে করে। প্রথম কিছুদিন কবুতর প্রেম চলতে থাকে তাদের। কিন্তু একসময় হঠাৎ ‘বিশেষ অঙ্গটি সামান্যতর সাড়াও দেয় না’। তাই উপন্যাসের শুরুটা যৌন-মনস্তাত্ত্বিকতায় রূপ নিয়েছে। শারীরিক অক্ষমতা না-কি মানসিক বিধ্বস্ততা—তা বুঝে ওঠার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। তার প্রথম স্ত্রীর ঘরের মেয়ে মরিয়ম দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে সুখে আছে। ছেলে শাওন পড়াশোনায় মনোযোগী নয়; এ বয়সেই মোবাইল ফোনে ফেসবুকে ব্যস্ত থাকে। ক্লাস এইট পর্যন্তই যার দৌড়। এই ষাটোর্ধ্ব বয়সে এসে রূপচানের যৌনবৈকল্য সত্যি বেকায়দায় ফেলে। দ্বিতীয় স্ত্রী কুসুম যখন বলে, ‘কাজের লোকের অভাবেই মুনে হয় বিহ্যাডা কইরিছিল?’ তখন ব্যর্থতার কথা মনে পড়লেও বউকে ধমকায়। পুরুষোচিত মনোভাব তো আর দমন করা যায় না। রূপু তাই ভাবে— ‘সে তো নপুংসক নয়। আবার স্ত্রীকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। বাকি জীবন কিভাবে পার করবে সে?’
রূপচানের ব্যর্থতার রেশ ধরেই আবির্ভাব ঘটে আরেকটি পরিবারের। কিন্তু সে পরিবারকে অতটা সপ্রতিভ হতে দেখা যায় না। তবে রসুলপুর গ্রামের সামাজিক অবস্থা ফুটে ওঠে বিভিন্ন চরিত্র, বর্ণনা বা কাহিনি চিত্রণে। রূপচানের জীবন যাপন বা পরিণতি নিয়েই আবর্তিত হয়েছে উপন্যাসের কাহিনিতে। রূপুর পরিবারের কথোপকথনে রাজশাহীর পুঠিয়া অঞ্চলের কথ্যভাষা এলেও সব চরিত্রে তা সমভাবে বিন্যাস্ত হয়নি। কখনো কখনো মিশ্র ভাষার ব্যবহার দেখা গেছে।
মধ্যবিত্ত সমাজের চিত্র দেখা যায় কাহিনিতে। গ্রামীণ আচার-অনুষ্ঠান সামাজিক মর্যাদার প্রকাশ ঘটায়। সেখানেও খাবারের জন্য অপেক্ষা। আসলে পৃথিবীটা তো কেবল খাবারের জন্যই। খাবারের আকাঙ্ক্ষা বা চাহিদা থাকলেও ফকির-মিসকিনের মধ্যেও আত্মসম্মানবোধ কাজ করে। রূপুর ছেলে শাওন তাই বলে, ‘চলো, শালার বিহ্যার দাওয়াত খাবোই না। গরিব বুইলি আমাহারে কি মান-সম্মান নাই আব্বা? লে শালা তুরাই খা।’
উপন্যাসে সমাজবাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি সচেতনতা লক্ষ করা যায়। কাহিনি পরম্পরায় শিক্ষক আর সাবেক ছাত্র হাসানের কথোপকথনে সে চিত্র ফুটে ওঠে। শিক্ষক যখন বলেন, ‘গোটা দেশ—বরং পৃথিবীজুড়ে অমানিশার ছায়া নেমেছে। বড় দুর্বিষহ সময়ের খাঁচায় মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছে’ তখন লেখকের রাজনৈতিক সচেতনার প্রমাণ মেলে।
উপন্যাসে কোনো পূর্বাভাস বা বর্ণনা ছাড়াই হঠাৎ করে বৃষ্টি চলে আসে। যে বৃষ্টিতে উঠানে পানি জমে যায়। উপমা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ‘নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ে’। ‘গলগল’ শব্দটা মনে হয়, তরল বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
উপন্যাসের কাহিনি সমসাময়িক। গল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দেখা যায়। রূপচানের ছেলে শাওন বলে, ‘আমি একটা ছবি পোস্ট করলে কয়ডা লাইক পড়ে, তুমি জানো?’ অথচ রূপচানের হাতে কোনো মুঠোফোন নেই। সে তার প্রয়োজনবোধও করে না।
গ্রামীণ যৌনাচার ঔপন্যাসিকের লেখনিতে নতুন মাত্রায় যুক্ত হয়েছে। পরকীয়া বা বিধবা নারীর প্রতি সুযোগসন্ধানী পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি ধরা পড়ে কাহিনিতে।
প্রাইমারি ডিঙানো কুসুমের মুখে আবার দার্শনিক টাইপের কথাবার্তাও শোনান লেখক। সে কথাগুলো যে লেখকের দর্শন প্রকাশ করে, তা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। তবে শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত হোক; সবার মধ্যেই দর্শন কাজ করে। একেকজনের প্রকাশভঙ্গি একেকরকম। কুসুম তাই বলে, ‘আনন্দকে ধইরতে জানতে হয়।’
রূপুদের জন্য সামাজিক অবস্থান সন্তোষজনক নয়। মানুষের অবহেলা, কটাক্ষ, অবমাননাই যেন তাদের প্রাপ্য। সে হোক ঘরে, চায়ের দোকানে, হাট-বাজারে কিংবা ধর্মালয়ে। তাই তো জুমার নামাজে গিয়ে খাবার না নিয়েই ফিরতে হয় রূপুদের।
বৃক্ষনিধনবিরোধী চিন্তা উঁকি দেয় রূপুর মনে। প্রতিবাদে সে ফস করে একটা বিড়ি ধরায়। রেগে গেলে তার হয়তো বিড়ি খাওয়ার নেশা চাপে। এছাড়া উপন্যাসে সমু পাগলা একটি রহস্যময় চরিত্র। ক্ষণিকের জন্য চরিত্রটি উদয় হয়।
জীবনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুতে বা অনুভূতিতে ভালোবাসা গাঢ় হয়। কুসুমের জন্য দুটি বক্ষবন্ধনী আর চুলের জন্য লাল ফিতা কিনে এমনটিই টের পায় রূপু। মাঝে মাঝে অভাব ও শরীরের অসামর্থ্য তাকে জীবনানন্দের কবিতা স্মরণ করিয়ে দেয়। যে কবিতা সে হাসানের মুখে শুনেছিল।
উপন্যাসে মানবিকতা উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। লেখকের ভাষায়, ‘চারপাশে শুধু মানুষ আর ক্ষমতা। মানবিক মানুষ পাওয়াই যায় না।’ আমরা প্রত্যেকেই মানুষ; কিন্তু মানবিক হতে পারিনি।
ঘাত-অভিঘাতের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলে জীবন। রূপুর জীবনও টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে চলে। কুসুমের সঙ্গে রূপুর বিবাহবিচ্ছেদ হতে হতেও আর হয় না। সামাজিক দায়বদ্ধতায় অমীমাংসিত সম্পর্ক এগিয়ে চলে নতুন মোড়কে। তবে সে সম্পর্ক নিস্পৃহ বা চেতনাহীন।
লেখক উপন্যাসের বিষয় নির্বাচনে নতুনত্ব দেখাতে পারেননি। শুধু যৌনতার বিষয়টি নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত হয়েছে। তবে একই বর্ণনা একাধিকবার আসায় কিছুটা বিরক্তির কারণও হতে পারে। সব মিলিয়ে ভালো লাগার মতো একটি উপন্যাস। আশাকরি উপন্যাসটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে।
রূপচানের আশ্চর্য কান্না
লেখক: মাসউদ আহমাদ
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
প্রকাশনী : সময় প্রকাশন
মূল্য : ১৫০ টাকা