মহামতি অ্যারিস্টটল এর বাণীটি দিয়েই লেখাটি শুরু হতে পারে, ‘No one will dare maintain that it is better to do injustice than to bear it.’ সমাজ তো তাই কিন্তু তাই বলে এত অবিচার! চারপাশে এত হাহাকার! চোখ মেললেই দেখি শশ্মান শূন্যতা! কোথাও কোনো আলো নেই, ভালোবাসার স্পর্শ নেই, কোনো আশার বাণীও কেউ দেয় না। সময়টাই বুঝি এমন! অবশ্য ভালোই বা কবে ছিল? বৃষ্টির আশায় নির্মেঘ আকাশে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তামাটে আকাশে ক্লান্ত ওড়াউড়ি করা ছাড়া আর কী করার আছে! সমাজে দলবেঁধে বসবাস করে মানুষ নামের শকুনের দল, শেয়ালের দল, হায়েনার দল। এই সমাজে শেয়াল বসবাস করে, সুযোগ বুঝে তারা হুক্কাহুয়া ধ্বনি তোলে। না, তখন ইশ্বর কোথায় থাকে তা কেউ জানে না। কিন্তু ধ্বংস হয় মা-মেয়ের সুন্দর সাজানো লতাপাতা দিয়ে বানানো সাজানো সাধারণ সংসার। ধ্বংস হয় আশাবাদী জীবনের মাঠ। হাসান আজিজুল হকের গল্পের বৈশিষ্ট্যই এমন। পড়লে মনের মধ্যে এসব ভাবনা বাসা বাঁধবে এই স্বাভাবিক!
হাসান আজিজুল হকের গল্প ভালো লাগার নানান কারণ আছে। সবচেয়ে বড় কারণ হলো তার গল্পে মানুষকে দেখতে পাই, একটি ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ, একটি বিপন্ন সময় যেন তখন পিঠ উঁচু করে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দেখতে পাই, সমাজে ঘাপটি মেরে বসবাস করা শেয়ালদের, দেখতে পাই কচ্ছপের মতো মাথাগুঁজে রাখা ভণ্ডদেরও। তার গল্প ‘মা-মেয়ের সংসার’ ঠিক এমনই একটি গল্প। গল্পের জমিনে বুনন হয়েছে আমাদের গ্রাম-বাংলার খুব সাধারণ একটি চিত্র! যে চিত্রটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। পত্রিকার পাতা খুললেই তাদের খবরে দেখি, অন্তর চোখ দিয়ে তাদের আর্তনাদ শুনি আর চর্ম চোখ দিয়ে হজম করি সমাজে ঘটে যাওয়া সব অনাচার। হাসান আজিজুল হক তার এই গল্পে সুঁচের মতো এমন কিছু ধারালো শব্দ ব্যাবহার করেছেন, সেসব তখন একেকটি বল্লমের মতো বুকে গিয়ে বিঁধতে থাকে।
খুব সাধারণ গল্পের প্লট অথচ অসাধারণ তীর্যক ব্যঙ্গময় সেই গল্পের আর্তি! গ্রামের নীরিহ মা-মেয়ে থাকেন গ্রামের প্রান্তে ছোট এক বাড়িতে। খুব সাধারণ তাদের জীবন আর সংসার। প্রতিদিন তাদের ভোর হয় সোনালি স্বপ্ন চোখে নিয়ে। হাঁস-মুরগি পোষে আর লতাপাতা খেয়েই মা-মেয়ের সংসার চলে। কিন্তু সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই হাঁস-মুরগির ওপর আক্রমণ চালায় ধূর্ত শেয়ালের দল। নিরীহ মুরগিগুলোকে তারা হুল্লোড় ছড়িয়ে খায়। একদিন এভাবেই ধূর্ত কয়কেটা মানুষরূপি শেয়াল ঝাপিয়ে পড়ে নিরীহ মা-মেয়ের ওপর। তারপর জীবনের সব শেষ অথবা সব শুরু হতে থাকে। মা-মেয়ে দুজনই একদিন তাদের পেটে জ্যান্ত শেয়ালের অস্তিত্ব টের পায়। গল্প এগিয়ে চলে। গ্রামের মানুষের কাছে ঘটনা জানাজানি হয়ে। মা-মেয়ে প্রথমে আত্মহত্যার কথা ভাবে। কী হবে এই দুরূহ জীবনটাকে কাঁধে বয়ে? তারা দুজনই আক্ষেপ করেন। মৃত্যু কেন তাদের নিয়ে যায় না। জান কেন কবচ হয় না! মা বিড়বিড় করে নিজেই বলেন, ‘আমাদের আল্লাও নেই, আজরাইলও নেই, জান কবচ করবে কেডা?’
ঈশ্বরের সময় নেই লাঞ্চিতদের বাড়িতে ঢুঁ দেওয়ার। লজ্জা, অপমান আর বেদনাহত হয়ে দরিদ্র লাঞ্চিত ধর্ষিত মা চিৎকার দিয়ে তার মেয়েকে সান্তনা দেন, ‘আল্লা নেই, দোজখ নেই, ব্যাহেস্ত নেই, কি জন্যি চিল্লাচ্ছিস?’
সমাজের লেজ মোটা শেয়ালের দল সমাজের পাক পবিত্রতার দোহাই দিয়ে নিজেদের বংশ বিস্তার করে বেড়ায়। এই তো সমাজের কাজ! অত্যাচারিতদের কান্না সমাজ শুনতে পায় না, কোনোদিন পায়নি। বিচারের নামে তারা যা পায় তা শুধুই প্রহসন। সমাজে লোকদেখানো কিছু অভিনয়! এই প্রহসন তৈরি করতে সমাজ সিদ্ধহস্ত। যুগ যুগ ধরে সমাজ তাই করে আসছে। সে কথা মা-মেয়ে দুজনেই জানে। এদিকে শরীর তো আর লুকিয়ে রাখা যায় না! যে শরীর একদিন কিছু ধূর্ত শেয়াল খুবলে খেয়েছিল, সেই শেয়ালগুলোর পক্ষ নিয়ে সমাজপণ্ডিতের দল তখন প্রশ্ন তোলে, ‘এতদিন লুকায়ে রাখিছিলে, এখন তো পেট বেরোয়ে পড়িছে। আল্লাহর আইন মানতি হবে সগগলের।’
শেয়ালদের মুখে আল্লাহর আইনের কথা শুনে সহজ সরল মা আর মেয়ে আরও অবাক হয়! কারণ তারা আল্লাহকে চেনে না। তাদের পাশে আল্লাহ তো কখনো সাহস দিয়ে দাঁড়ায়নি! তাই মা আবার বোকাসোকা প্রশ্ন করে পণ্ডিত শিয়ালদের, ‘আল্লাহর সঙ্গে তোমাগে কথা হয়?’ প্রশ্ন শুনে সমাজের শেয়লপণ্ডতের দল আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা মারমুখ হয়ে ওঠে। সমাজের পবিত্রতা রক্ষা করতে তারা মরিয়া। গ্রাম বাংলার এক ধর্ষিত মায়ের ক্রন্দনে তেমন কী আর আসে যায়! উল্টো তারা প্রশ্ন করে মাকে শাসায়, ‘খবরদার ছিনাল মাগী, মুখ সামলে কথা কবি। সে বিটা কি কয় জানা নেই না? কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতি পাথর ছুড়ে খতম করতি হবে তোদের।’
এই খতম চর্চা বাংলার মাটিতে আর নতুন কী? এই চর্চা যুগ যুগ ধরে হয়ে এসেছে। খতম হয়েছে সাধারণ সহজ সরল মানুষ। খতম করেছে মানুষ রূপধারী কিছু শেয়াল। এভাবেই সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। এভাবেই সমাজ এগিয়ে চলে। কিন্তু ধর্ষিতা মা-মেয়ের কথা আর কে ভাবে? তাদের জীবনের কথা তাদেরই ভাবতেই হয়। তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক তারাই। সমাজ তাদের পোছে না, রাষ্ট্র তাদের দেখভাল করে না, এমনকি ঈশ্বর পর্যন্ত তাদের চেনে না। তখন তাদের মরণ ছাড়া আর কী করার থাকে? সদ্য ভূমিষ্ট জারজ সন্তানকে মেয়ের হাতে তুলে দিয়ে ধর্ষিতা মা কত কষ্ট করেই না বলেন, ‘এইবার ওঠ্ মা, দানোটারে বাইরে শেয়ালের মুহে দিয়ে আয়।
জ্যোৎস্নার মধ্যে মেয়ে উঠে দাঁড়ায়, চাঁদের পাওয়া নিশির ঘোরে সে খোকাটাকে দুই হাতের ওপর শুইয়ে একটু একটু দোলায়। তারপরে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে জ্যোৎস্নার সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে আকাশপ্রমাণ মেয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।’
এই সমাজ আসলে কার পক্ষ নেয়! কারা এই সমাজ! কারাই বা দলিত আর প্রান্তিক? কে তাদের তৈরি করে? কারাই বা সেই কারিগর! কেনই বা সমাজের এত এত ভাগ, এত শ্রেণী আর বিভেদের দেয়াল! এত এত শেয়ালের দল খামছে ধরে বসে আছে সমাজের সর্বত্রই! তারা কথায় কথায় ধর্মের দোহাই আর খোদার ভয় দেখিয়ে সমাজ চালায় আবার নিজেরাও সেখান থেকে ফায়দা তোলে। সেখানে ঈশ্বর চুপ হয়ে বসে থাকে। বঞ্চিত আর লাঞ্চিতদের পক্ষ নিয়ে কথা বলার সময় তার কোথায়? ঈশ্বরের সময় নেই লাঞ্চিতদের বাড়িতে ঢুঁ দেওয়ার। লজ্জা, অপমান আর বেদনাহত হয়ে দরিদ্র লাঞ্চিত ধর্ষিত মা চিৎকার দিয়ে তার মেয়েকে সান্তনা দেন, ‘আল্লা নেই, দোজখ নেই, ব্যাহেস্ত নেই, কি জন্যি চিল্লাচ্ছিস?’
‘মা মেয়ের সংসার’ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের অপূর্ব একটি গল্প! আত্মায় বল্লমের মতো গেঁথে আছে সেই গল্পের পুরোটা। হাসান আজিজুল হকদের মৃত্যু কি হয় কখনো? না হয় না।
আরও পড়ুন: লাল রাত্রির গান: প্রাজ্ঞ আঁধারের যাত্রীর বয়ান ॥ আজিজ কাজল