২০২৩ সালের বইমেলাকে সামনে রেখে প্রকাশিত হয়েছে মাসুদ আনোয়ারের কিশোর কবিতাগ্রন্থ মায়াবী দিনের খাতা। চাররঙা প্রচ্ছদ আর দুই রঙা অলঙ্করণে চার ফর্মার বইটিতে স্থান পেয়েছে ৩৬টি কিশোর কবিতা।
সেবা প্রকাশনীর লেখক তালিকায় মাসুদ আনোয়ার ওয়েস্টার্ন জনরার লেখক হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও মৌলিক সৃজনশীল লেখক হিসেবেও রয়েছে স্বচ্ছন্দ উপস্থিতি। গল্প, কবিতা, ছড়া ও ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজের শক্তিমত্তার জানান দিয়েছেন তিনি। তার রয়েছে ছড়াগ্রন্থ, কিশোর উপন্যাস, কিশোর গল্প সংকলন ও উপন্যাস। সেবা থেকে তার প্রকাশিত ওয়েস্টার্নের সংখ্যা ১৮টি।
আলাদা করে স্বীকৃত না হলেও সাহিত্যে বড়দের কবিতার পাশাপাশি কবিতার একটা ধারা রয়েছে সেটা হলো বারো থেকে আঠারো বয়সীদের উপযোগী কবিতা। কিশোর মানসের সুখ-দুঃখের বোধ, রহস্যময়তা নিয়েই মূলত কিশোর কবিতার শরীর ও আত্মা গড়ে ওঠে। পরিপার্শ্ব, সমাজ সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয় কিশোর মনে যেভাবে এসে প্রতিভাত হয়, কিশোর কবিতায় তারই প্রতিফলন ঘটে।
মায়াবী দিনে খাতা মাসুদ আনোয়ারের প্রথম কিশোর কবিতা গ্রন্থ হলেও এ অঙ্গনে তিনি নতুন নন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কিশোরোপযোগী কবিতা লিখে আসছেন। মায়াবী দিনের খাতা তার কিশোর কবিতার মলাটবদ্ধ প্রকাশ। কবিতাগুলো আমাদের কিশোর কবিতাঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে নির্দ্বিধায় বলা যায়।
তাঁর কিশোর কবিতার প্রথম পাঠক হিসেবে সে সময়ের স্মৃতিগুলো আমাকে ভীষণ নাড়া দেয়। নিজ যাপিত জীবনের নির্যাস থেকে ছেঁকে তুলেছেন প্রতিটি কবিতা।
নব্বই দশকের শুরুতে কিশোর কবিতার ভুবনে এসে মাসুদ আনোয়ার সবাইকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সরে পড়েছিলেন। তিনি জানতেন, এ অঙ্গনে তাঁকে মেনে নিতে সময় লাগবে। আবার ফিরে আসার যে গ্যাপ, এ সময় তিনি বসে থাকেননি। ঝুঁকে পড়েছেন ওয়েস্টার্ন লেখক হিসেবে। অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন সেবা প্রকাশনীর লেখক তালিকায়। দীর্ঘ বিরতির পর আস্তে আস্তে ফিরে এসেছেন কিশোর কবিতায়। আদিগন্ত প্রকাশন থেকে ২০২৩ এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করেছেন অন্যরকম ৩৬টি কবিতার সমন্বয়ে ‘মায়াবী দিনের খাতা’।
এবার তাঁর অন্যরকম কিশোর কবিতার প্রসঙ্গে আসা যাক।
নাম তার সুরবানু এ গাঁয়ের মেয়ে সে
এ গাঁয়ের মায়া যেন বাড়িয়েছে সে এসে
পুঁইপাতা রঙ আর
লাউলতা ঢঙ তার
বাতাসের সাথে দোলে যেন দোলা পেয়ে সে
নাম তার সুরবানু এ গাঁয়ের মেয়ে সে।
(সুরবানু-১, পৃষ্ঠা- ৯)
পুরো কবিতাটাই উদ্ধৃতি দেয়ার মত। কিশোর কবিতার শরীরে রয়েছে গাঁয়ের সোঁদা গন্ধ। চঞ্চলা হরিণী সুরবানুর আলতামাখা পায়ের ছন্দিত নৃত্য দোলা দিচ্ছে কৌতূহলী পাঠককে। এ দোলা আপনা আপনি চলে আসে। চাপিয়ে দেয়া কোন শব্দ তাঁর কবিতাকে আড়ষ্ট করেনি। কবিতার প্রতিটি শব্দ, উপমা, ছন্দ, চিত্রকল্প পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখে। এমন জাদুকরী ক্যারিশমায় চমক ভাঙে পাঠকের।
আবার বলছেন-
তার মুখ পানপাতা, শিশিরের টলমল
তার পায়ে নদী বাজে কলকল কলকল
তার কথা দোয়েলের মোলায়েম শিসটি
তার অভিমান ভরা আষাঢ়ের বৃষ্টি
সাতরঙা রঙধনু এ গাঁয়ের মেয়ে সে
তার হাসিখুশি আহা, কেড়ে নেয় কে এসে?
এমন মনোহারী চিত্রকল্পে তিনি কবিতা সাজিয়েছেন , যা পাঠকের অন্তরে গেঁথে যায়। কবিতা পাঠ শেষে তার রেশ থেকে যায় দীর্ঘক্ষণ। সুরবানু শিরোনামে দুটি কবিতা রয়েছে গ্রন্থে। সুরবানু-১ ও সুরবানু-২। এবার সুরবানু-২ কবিতায় আসা যাক।
এতক্ষণ সুরবানু ছিল গ্রামে। এখন সে শহরে চলে এসেছে ।
নাম তার সুরবানু যে গাঁয়ের মেয়ে সে
সে গাঁয়ের হাসিখুশি কেড়ে নেয় কে এসে ?
দুই চোখ জলে ভরে
আঁকাবাঁকা পথ ধরে
একদিন একঘুম ভাঙা ধলপহরে
সূরবানু গ্রাম ছেড়ে চলে এল শহরে।এইখানে বাঁশপাতা কাঁপে না তো তির তির
বটপাতা মোলায়েম বাতাসের ঝিরঝির
শব্দের শিহরণে হয় না তো উন্মন
নেই বুনোফুলে নীল ভোমরার গুঞ্জন
সোনারঙ ধান ক্ষেতে ঘাস ফড়িঙের ঝাঁক
গুনগুনে মৌমাছি , টুপটুপে মধুচাক।
.. .সাতরঙা রঙধনু জ্বলে উঠে নিভে যায়
ডাকে যেন সুরবানু, আয় বাছা ফিরে আয়
ফিরে যাবো ? সুরবানু ভাবে না না যাব না
এ শহর ছেড়ে গেলে খাওন যে পাব না।
(নাম তার সুরবানু-২, পৃষ্ঠা- ১১)
সুরবানু শহরে এসে ধন্দে পড়ে যায়। একদিকে গ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য নাড়ির টান, অপরদিকে গ্রামের অভাব অনটন। ‘খাওন’ না পাওয়ার বেদনা তাকে যন্ত্রণাকাতর করে তোলে। এ দ্বন্দ্ব তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। অবশেষে কঠিন বাস্তব, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নেমে সে শহরেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। দুই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এখানে প্রকট হয়ে উঠেছে। বাস্তব জীবন থেকে ছেঁকে তোলা এমন প্রাণসঞ্চারী কবিতায় কবি পাঠকের মন নাড়িয়ে দেন।
‘যে তুমি কিশোর’ কবিতায় কিশোর মনের খুব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আবর্তিত হয়েছে।
কবি বলেন-
মেঘনা পাড়ের উদাসী বটের ছায়ায়
যে তুমি বাজাও বাঁশিতে গহীন সুর
সে তুমি জান না কেমন মোহিনী মায়ায়
হাতের মুঠোয় ভরেছ সারা দুপুর
যে তুমি নিজেকে উজাড় করেছ
মাঠে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়েছ
মুখরিত করে বাতাসের গতি
পরিয়ে পায়ে নূপুর
সেই সে নূপুর নিক্বনে বাজে নদী ও সমুদ্দুর।
(যে তুমি কিশোর, পৃষ্ঠা- ১৬)
কৈশোর এক অবারিত বিস্ময়ের নাম। নিষেধ না মানার বয়স। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ভেসে বেড়ানো এমন রাজকুমারের ছুটে চলার কোন সীমা পরিসীমা নেই। অচেনাকে চেনা, অদেখাকে দেখার অদম্য বাসনায় এই কৈশোরের এগিয়ে চলা। সব বাধা বন্ধন ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে চলার নাম কৈশোর। এমন কৈশোর নিয়ে কবিতা লেখা এক দুঃসাধ্য কাজ। সেই অভিযানের এক সমরনায়কের নাম মাসুদ আনোয়ার। প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে এসে নিজস্ব ঢঙে সাজিয়েছেন তার কাব্যগ্রন্থ ‘মায়াবী দিনের খাতা’। তিনি স্বীকার করেছেন, এসব কবিতা লেখার আগে তিনি সমসাময়িক বা সিনিয়র কারো কিশোর কবিতা পড়েননি। তাই অন্য কারো কবিতার ছাপ তার কবিতায় পড়েনি।
তাঁর আর একটি কবিতা –
যে তুমি আদর করে কাছে ডেকে নিতে পার আমাকে
সোনায় রাঙাতে পার আমার যে কষ্টের তামাকে
সে তুমি আপন তাই আমার এই মন ভারী মনোরম
ছন্দে সাজিয়ে নেয় তাঁর বেদনার ওঠা নামাকে
যে তুমি আদর করে কাছে ডেকে নিতে পার আমাকে।
…
সবাই বাইরে থেকে উদ্ধত কিশোরকে দেয় অপবাদ
তুমিই শাসনে তাঁর সোহাগে ঘু্চিয়ে দাও
আমার সকল অপরাধ।
(যে তুমি আদর করে- পৃষ্ঠা- ৩১ )
এখানে মাকে নিয়ে তাঁরই সরল স্বীকারোক্তি প্রকাশ পেয়েছে। শৈশবে মাকে হারিয়ে মায়ের আদর ভালবাসা বঞ্চিত হয়ে সৎ মায়ের বিমাতা সুলভ আচরণ তাঁকে বিদ্ধ করেছে। সেই দুঃখে এক সময় পনের বছর বয়সে নিরুদ্দেশ হয়ে যান কবি। নিরুদ্দেশ কবির জীবনে মায়ের অভাব তাঁকে বার বার তাড়া করেছে। সেই হার না মানা কিশোরের আকুতি পাঠককে ভাবিয়ে তোলে। তার আরেকটি কবিতা :
ঘুমের চাদর সরিয়ে কিশোর চোখ মেলে জেগে ওঠে
মহুয়ার বনে বাতাসে নাচের নিটোল মুদ্রা ফোটে।
ভোরের পাপিয়া নিপুণ সুরের
সুরভী ছড়ায় নদী নুপুরের
মতন জাগায় জলতরঙ্গের নিক্বন দুই তীরে
জাগল কিশোর মায়াবী সুরের চাদর সরিয়ে ধীরে।
…
মায়াবী সুতোর চাদর সরিয়ে ঘুমের বিছানা হতে
সূর্য সাথী এ পৃথিবীর ছেলে কিশোর নেমেছে পথেপথ চলে গেছে সীমানা ছাড়িয়ে স্বপ্নের সৈকতে।
(কিশোর নেমেছে পথে: পৃষ্ঠা- ২৫)
এখানেও কিশোরের স্বপ্নযাত্রার কথা প্রকট হয়ে উঠেছে। যেই স্বপ্ন হার না মানা কিশোরকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। তাঁর প্রতিটি কবিতায় এমন হার না মানা প্রত্যয় মূর্ত হয়ে উঠেছে।
শুকতারা উঠে বলল, ‘হে রাত শোনো
তোমার ময়লা চাদর গুটিয়ে নাও
সোনালি সূর্য ফোটার সময় হলো
এইবার তুমি চলে যাও চলে যাও।
চলে যাও তুমি উঠুক পাখিরা জেগে
কই গো পাখিরা এখনো ভাঙেনি ঘুম?
গান গেয়ে ওঠো পুবালি বাতাস এসো
ফুলকলিদের গালে এঁকে দাও চুম।
…
চুম্বনে শিহরিত হোক বনলতা
পুলকে কাঁপুক ঘাসের মিহিন পাতা
জাগুক নদীতে ঢেউয়ের লুটোপুটি
পৃথিবী মেলুক মায়াবী দিনের খাতা।
( মায়াবী দিনের খাতা, পৃষ্ঠা-)
শুকতারা ঘুম থেকে জেগে উঠে রাতের চাদর গুটিয়ে নিতে বলছে। আরও বলছে, সোনালি সূর্য ওঠার সময় হয়েছে। পাখিদের গান গাইবার জন্য পুবালি বাতাস অপেক্ষা করছে ফুলকলিদের গালে চুম এঁকে দেবে বলে। এই যে জেগে ওঠার তাগাদা, নতুনের আহ্বান। আলোকিত সূর্যের জেগে ওঠার হাতছানিতে এখানে রয়েছে আগামী সম্ভাবনার ইঙ্গিত। এ কবিতায় শৈশব কৈশোরের সম্ভাবনার মেসেজ রয়েছে, কিন্তু তা খুব আড়ালে। সরাসরি না বলে আকারে ইঙ্গিতে কবি কিশোরকে জেগে উঠতে বলছেন। এখানে কবিতার নান্দনিকতা ফুটে উঠেছে সুন্দরভাবে।
একজন লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থের সব লেখাই গুণেমানে উৎরে যাবে এ কথা ভাবা সমীচীন নয়। তেমনি মায়াবী দিনের খাতার দু’একটি লেখা নিয়ে আমি কথা বলতে চাইছি। ৬৪ পৃষ্ঠার শেষ লেখাটির কথায় আসা যাক। ‘ঢাকা’ শিরোনামে এ কবিতায় কবি বলছেন,
মরার মত ঘুমিয়েছে সারা রাত্রি
সকালে উঠেই গুলিস্তানের যাত্রী
শেওড়াপাড়ার বসতিবিহীন ভূত-প্রেত
অথবা মানুষ স্মৃতিহীন অনিকেত।
পরে বলছেন-
কত যেন নাম মেঘনা যমুনা শঙ্খ
এখানে তুরাগ শীতলক্ষ্যায় আতঙ্ক
আকাশ ওপরে আকাশ হয়েই আছে
সীসার কণারা গোপনে বাতাসে নাচে।
(ঢাকা, পৃষ্ঠা- ৬০)
এ কবিতায় উদ্ধৃত পংক্তির ১ম লাইনের শুরুতেই মাত্রা পড়ে গেছে , অর্থাৎ এক মাত্রা কম হওয়ায় পড়তে খটকা লাগছে। তদ্রুপ ৩য় ও ৪র্থ লাইনে মাত্রা কম বেশি থাকায় পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হচ্ছে। পড়ের পঙক্তির ২য় লাইনে এসে মাত্রা বেড়ে গেছে।
৬+৮ চালের মাত্রাবৃত্ত ছন্দের এ কবিতায় মাসুদ আনোয়ারের অসতর্কতা চোখে পড়ে। তাছাড়া, “অথবা মানুষ স্মৃতিহীন অনিকেত”, “সীসার কণারা গোপনে বাতাসে নাচে”, এ লাইনগুলো কিশোর কবিতায় মানানসই বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না ।
এই নদীকে কবিতায় শেষ লাইনে এসে কবি বলছেন,
দুঃখ দিয়ে বুক ভাসিয়ে কাঁদায় এখন
এই নদীকে আমি ভীষণ ঘৃণা করি।
নদীকে ঘৃণা করার কথা না বলে এখানে অন্যভাবে বলতে পারতেন। যেমন- কবি বলতে পারতেন, ‘নদী এমন কঠোর কেন, ভেবে মরি’। এমন একটি প্রশ্নবোধকে কবি পাঠকের ওপর ছেড়ে দিতে পারতেন। তবে হ্যাঁ, গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই মানসম্পন্ন। যেখানে কবির নান্দনিকতা ফুটে উঠেছে প্রবলভাবে।
বইয়ের প্রচ্ছদে খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী উত্তম সেনের নান্দনিক কারুকাজ খুব ভালো লেগেছে। পাতায় পাতায় চমৎকার অলংকরণ মন কেড়ে নেয়ার মতই। মাসুদ আনোয়ারের কিশোর কবিতার বই ‘মায়াবী দিনের খাতা’ পাঠক নন্দিত হোক এটাই প্রত্যাশা করছি।