হ্যান ক্যাংয়ের কোরিয়ান ভাষায় লেখা ‘দ্য ভেজেটেরিয়ান’ উপন্যাসটি ‘ম্যানবুকার পুরস্কার’ পায় ২০১৬ সালে। দক্ষিণ কোরিয়ার ঔপন্যাসিক হ্যাং-ওয়ানের কন্যা হ্যান ক্যাং কোরিয়ান সাহিত্যে লেখাপড়া করেন, ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে তার জন্ম। ছোট ভাই হ্যাং ডং রিমও একজন লেখক। লেখালেখির জগতে প্রবেশের শুরুটা কবিতা দিয়েই এবং ‘উইন্টার ইন সিউল’ বা ‘সিউলের শীত’ নামে পাঁচটি কবিতা ছাপার পরেই কোরিয়াবাসীর দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হন নিজের দিকে।
কোরিয়ানদের টানটান মনোযোগ পড়ে হ্যানের দিকে এবং ঠেসে বর্ণনার উপন্যাসটি ‘রেড অ্যাংকর’ কোরিয়ান অন্যান্য লেখকের নাকে টোকা দিয়ে ‘সিউল শিনমান স্প্রিং লিটারেরি’ পুরস্কার বাগিয়ে নেন। এরপর আর তাকে আর কে আটকায়? যত লিখছেন, তত পথ প্রশস্ত হতে শুরু করেছে। যত শব্দ বসিয়ে যাচ্ছেন, ততই মসৃণ ও আরামদায়ক পথ উৎকীর্ণ হচ্ছে সাহিত্যের ভুবনে। কোরিয়ার কয়েকটি সাহিত্যপুরস্কার তালুবন্দি করে ২০১৬ সালে বগলবাজিয়ে নিয়ে নিলেন ম্যানবুকার পুরস্কারটিও। ‘দ্য ভেজেটেরিয়ান’-এর চমৎকার অনুবাদের কাজটি কিন্তু তিনি করেননি; করেছেন অন্য একজন—ডেবোরা স্মিথ। এ তো গেলো বন্দনা, এবার বইটির মূল বিষয়ে ফিরে আসা যাক।
ভেজেটেরিয়ান উপন্যাসটি ১৮৩ পৃষ্ঠা দখল করে তিনটি পরিচ্ছদে মুদ্রিত হয়েছে। জীবনের তিনটি খণ্ড বা খণ্ডাংশের সাদামাটা একটি পারিবারিক জীবনের মনস্তাত্ত্বিক জটিল অথচ ক্ল্যাসিক্যাল উপন্যাসের তিনটি অংশের আস্বাদনও ভিন্ন ভিন্ন। উপন্যাসের প্রচ্ছদে উৎকীর্ণ হয়েছে আইয়ান ম্যাকইভানের একটি বাক্য। যাকে বলা যায় স্টোরি লাইন বা শাঁস। নারিকেলের খোসা ছিঁড়ে খোল ভাঙার পরে যেমন শাঁসের সন্ধান মেলে, ঠিক তেমনই উপন্যাসটি পড়ে শেষ করার পরে এমনই সন্ধান মিলবে, A novel of sexuality and madness that deserves its great success. এই উপন্যাস সম্পর্কে পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত পত্রিকায় মন্তব্য ছাপা হয়েছে। প্রতিটি মন্তব্যই পাঠককে আকৃষ্ট করার মতো এবং আচ্ছন্ন করার মতো। ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর মতে, A darkly beautiful moderns classic about rebellion, eroticism and the female body. One of the most extraordinary books you will ever read.
বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য এই উপন্যাসে রয়েছে নানা রকম ব্যঞ্জনা। একটু সাধারণ ও বাস্তবতার বলয়ের বাইরে অবশ্যই বলা যায়। হয়তো লেখক অন্যদের মতো উপন্যাসের জন্য বাস্তব প্রেক্ষাপটকেই আঁকড়ে ধরে না থেকে বেছে নিয়েছেন কোরিয়ানদের সামাজিক কাঠামোর রূঢ় বাস্তবতার মোড়কে পরাবাস্তবতা ও মনোজগতের অনধিত রূপকল্প। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত রিভিউয়ের চুম্বকীয় অংশটি পাঠককে আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট জোরালো, রসদপূর্ণ এবং রুচিসম্মত।
‘Surreal…[A] mesmerizing mix of sex and violence…vivid, chiseled…Like a cursed madwoman in classical myth, Yeong-hye seems both eerily prophetic and increasingly unhinged.’—Alexandra Alter, The New York Times.
উপন্যাসটির আঙ্গিক, ভাষা, লেখার ধরন-ধারণ বিবেচনা করলে ‘ভেজেটেরিয়ান’ বা ‘নিরামিষভোজী’ শিরোনামের উপন্যাসটিকে ক্ল্যাসিক বলা চলে। গল্প তো খুব দীর্ঘ নয়। কিন্তু গল্পের অনিবার্য উপাদান হিসেবে পরিবেশ-প্রতিবেশের নিখুঁত বর্ণনা, চরিত্র চিত্রায়ন, প্রেক্ষাপট, মনোজগতের ক্রমপরিবর্তন, সংলাপ, বর্ণনার ধারাবাহিকতা, গল্পের রস, বাস্তবতা ও পরাবাস্ততার মধ্যে নিখুঁত সেতুবন্ধ নির্মাণ উপন্যাসটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। লেখিকার পর্যবেক্ষণ ও অন্তর্দৃষ্টির শাণিত ছাপ রয়েছে উপন্যাসের প্রতিটি পাতায়।
তিনটি অংশে বিভাজিত উপন্যাসটির প্রথম অংশ ‘দ্য ভেজেটেরিয়ান’ উত্তম পুরুষে বর্ণিত। অর্থাৎ ইয়োং-হাইয়ের স্বামী মি. চেয়ংয়ের কথনে বর্ণিত, দ্বিতীয় অংশ ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’ এবং তৃতীয় অংশ ‘ফ্ল্যামিং ট্রিজ’ তৃতীয় পুরুষের কথনে বর্ণিত। সাধারণত একই উপন্যাসে কথকের পরিবর্তন খুব বেশি দেখা যায় না। ‘ভেজেটেরিয়ান’ উপন্যাসটির তিনটি পরিচ্ছদ যেভাবে রচিত হয়েছে, তাতে এটিকে ‘মিনি ট্রিলজিও’ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। যদিও এমন কোনো আভাস সাহিত্যবোদ্ধাদের অভিমতে পাওয়া যায়নি। নতুনভাবে ভাবতে দোষ কোথায়?
দ্য ভেজেটেরিয়ান
এই অংশে মি. চেয়ং একজন কাজপাগল যাকে ইংরেজিতে ওয়ার্কহোলিক উদীয়মান খ্যাতিমান ব্যবসায়ী যিনি ব্যবসা প্রসারে নিমজ্জিত। তার স্বপ্নালোকে কোরিয়ান একজন সাদামাটা সংসারী সুন্দরী স্ত্রী যিনি কিনা একটি পরিপাটি সংসার তাকে উপহার দিতে পারবেন। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইয়োং-হাই সে ধরনেরই পরমা সুন্দরী ফুটফুটে একটি মেয়ে, যাকে নিয়ে স্বামীর সংসারজীবন ভালোভাবেই চলছিল। তাদের মনের অমিল ছিল না কখনোই। কিন্তু হঠাৎ করেই ইয়োং-হাই কয়েকটি স্বপ্ন দেখে যে স্বপ্নগুলো ছিল তার শৈশব জীবনের বিভিন্ন পশু হত্যার বিস্মৃত স্মৃতিরই প্রতিফলন। বিশেষ করে, তার বাবা তাদের পোষা কুকুরটির গলায় দড়ি বেঁধে মোটর সাইকেলের সঙ্গে বেঁধে যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হত্যা করে সেই কুকুরের মাংস দিয়ে বাসায় অতিথি আপ্যায়ন করে ভোজের আয়োজন কয়েছিল, সেই স্বপ্নটিই তার মনোবৈকল্যের সূত্রপাত হয়। এখানে জাগতিক ও অজাগতিক দ্বান্দ্বিক সংকটে একাকী বাসায় থাকা ফুটফুটে বধূটি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন থেকে অস্বাভাবিক জীবনের দিকে এগিয়ে যায়। তার মনোজগতের অস্বাভাবিক পরিবর্তনের রহস্যও পূর্ণভাবে উদঘাটিত হয়নি বরং মানসিক চাপে তাকে আরও কঠিন সংকটের দিকে নিয়ে যায়। সেই সংকট থেকেই ইয়োং-হাই মাংস খাওয়া বর্জন করে নিরামিষভোজী হওয়ার জন্য মনস্থির করে ফ্রিজে সংরক্ষিত বিভিন্ন পশুপাখির সব মাংস ফেলে দেয়। মি. চেয়ং বাসায় ফিরে এই দৃশ্য দেখে স্ত্রীর প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ বর্ষণ করতে শুরু করলে স্ত্রী অকপটে জানিয়ে দেয় যে, সে আর কখনো মাংস খাবে না। নিরামিষ খাবে।
ক্ষিপ্ত স্বামী এত মাংস ফেলে দেওয়া এবং নিরামিষভোজী হওয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। স্বামী আমিষভোজী আর স্ত্রী নিরামিষভোজী, এক ছাদের নিচে থেকে, একই চুলোয় রান্না করে দুজন দুমেরুর মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা থেকে শুরু করে সংসারজীবনে জটিলতা শুরু হয়। তাদের গাঢ় প্রেমের দাম্পত্যজীবনে ক্রমে ফিকে হয়ে আসে আর বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। স্ত্রী যেমন সিদ্ধান্তে অটল ঠিক তেমনি স্বামীও স্বীয় সিদ্ধান্তে অটল যে নিরামিষভোজীর সংকল্প থেকে ইয়োং-হাইকে সরে আসতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, ইয়োং-হাইয়ের এই সংকল্পের অন্তর্নিহিত বিষয়টি অনুসন্ধান বা অনুধাবন না করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কঠিন বাস্তবাতায় বেড়ে ওঠা স্বামীর প্রবল মানসিক চাপ সৃষ্টি করেই যেতে থাকে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের মধ্যেই ইয়োং-হাই ঠিক থাকেনি; তার মানসিক প্রতিক্রিয়া আরও বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রতিফলিত হতে শুরু করে। মি. চেয়ংয়ের একটি ডিনার পার্টিতে স্ত্রী ব্রা পরে না যাওয়ার কারণে নিজেকে অপদস্ত মনে করে, হালকা স্কার্টের ওপর দিয়ে স্ত্রীর স্তনের বোঁটার দিকে কামাতুর দৃষ্টির নিক্ষেপ তাকে আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে। কিন্তু স্বামীর কোনো কথাই স্ত্রী আমলে নেয় না। বরং সে অজানা নিগূঢ় মোহাচ্ছন্নতার নিতল স্তব্ধতায় ঘেরা জগতে প্রবেশ শুরু করে। ক্রমে তাদের দাম্পত্য কলহ শুধু একটি ছাদের নিচেই আর বন্দি থাকেনি, গড়ায় ইয়োং-হাইয়ের বাবার বাড়ি পর্যন্ত।
শুধু বাবা নয়; ইয়োং-হাইয়ের আচরণে তার পরিবারের সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এমনকী মা ও বড় বোন ইন-হাইও। ইয়োং-হাইয়ের জেদের অবসান ঘটানোর জন্য বাবার পরিবারে একদিন মাংসের নানা রকম তরকারি রান্না করে বড় ভোজের আয়োজন করে মেয়ে ও মেয়ের স্বামীকে নিমন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু ইয়োং-হাইয়ের জেদ কোনো রকমেই ভাঙাতে না পেরে উত্তেজিত বাবা মেয়েকে মারধর করাতে ইয়োং-হাই টেবিলে রাখা ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়ে মনোজগত থেকে শরীরবৃত্তীয় জটিলতার শিকার হয়।
কোরিয়ায়ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আবাস মিলে ইয়োং-হাইয়ের বাবার রূঢ় ও নির্মম আচরণে। বাবা যেন এক রাজা আর অন্যরা হুকুমের প্রজা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষদের যে দাপট, মোড়লি-স্বভাব থাকে তার স্বরূপ বাবার চরিত্রে পরিস্ফুটিত হয়েছে। এই ঘটনা থেকেই তার চরিত্রের নানা রকম মানসিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে একের পর এক। ঘটনা প্রবাহিত হয়ে রূপ নেয় পরিপূর্ণ উপন্যাসের। আসলে স্বপ্নটি তার শৈশবের একটি নিষ্ঠুর ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয় এবং সেই নিষ্ঠুর ঘটনার প্রেক্ষিতেই মাংস খাওয়ার প্রতি তার অনীহা, শুধু অনীহা নয়, বলা যায় ঘৃণাই সৃষ্টি হয়। শৈশবে বাবার দ্বারা পোষা কুকুরটি মৃত্যুদৃশ্যই তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে এবং এই বিপর্যস্ত মানসিক বৈকল্যের ঘটনা পরম্পরায় উপন্যাসটি এগিয়ে যায়।
কোরিয়ানরা কুকুরের মাংস খায় সেটি এখানে বিবেচ্য নয়; বিবেচ্য হলো হত্যার দৃশ্যটি। কুকুরের মৃত্যুর আগের বমি করার দৃশ্যটি ইয়োং-হাই মন থেকে সরাতে পারেনি বলেই মাংস খেতেই তার অরুচি হতো।
পরিণামে ইয়োং-হাইয়ের সঙ্গে স্বামীর চিরস্থায়ী বিচ্ছেদের মাধ্যমে এক সময়ে গভীর ভালোবাসার একটি ছোট্ট সংসারের অবসান ঘটে।
মঙ্গোলিয়ান মার্ক (জন্মদাগ)
ইয়োং-হাইয়ের বড় বোন ইন-হাইয়ের স্বামী একজন ব্যর্থ চিত্রশিল্পী ও ভিডিও মেকার। তার খায়েশ হয়েছে প্রকৃতিসঞ্জাত, প্রকৃতির মতোই সরল ও স্বাভাবিক প্রেমের দৃশ্য চিত্রায়ন করবে, যেখানে রতিক্রিয়াকে স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করা হবে। ইন-হাইয়ের স্বামী আকাক্সক্ষার কথা জানালে ইয়োং-হাইও ভিডিওতে মডেল হতে রাজি হয়। হয়তো ব্যর্থ চিত্রশিল্পী ও ভিডিও মেকার এই দৃশ্যের মাধ্যমে ব্যর্থতা ঢেকে সাফল্যের স্বপ্ন দেখেছে। উপন্যাসের এই অংশটি অতিবাস্তবতার দিকে মোড় নেয়। ভিডিওমেকারের অতিকল্পনার সঙ্গে মিলে শ্যালিকার শরীরের একটি জন্মদাগ। ফুলের পাপড়ির মতো ইয়োং-হাইয়ের শরীরে একটি জন্মদাগ আছে আর এই পাপড়িটির মতোই নগ্ন শরীরে সে শৈল্পিক ফুলের ছবি আঁকে। একটি নারীর শরীরকে সে প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে একাকার করার জন্য প্রয়াসী হয়। ইন-হাইয়ের স্বামী একটি স্টুডিও ভাড়া নেয় এবং সেখানে একজন আর্টিস্টকেও নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই স্টুডিওটি তখন হয়ে ওঠে নগ্ন নর-নারীর রুদ্ধ প্রকোষ্ঠ।
প্রকৃতিবাদীর মতো নগ্নতা যেন তাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। ভাড়াটে বন্ধুর নগ্ন শরীরে অপরূপ ফুলের পাপড়ি চিত্রিত হলে ইয়োং-হাই যার প্রকৃতির মতো, বৃক্ষের মতো হওয়ার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা বাসনার টগবগ করে ফুটে ওঠে। যদিও এখানে কামোত্তজনা কথা বলা হয়েছে কিন্তু এখানেও অতিপ্রাকৃতিক অবচেতনার অঙ্কুরের খোসা ফাটার আভাস মেলে। এরপর ইন-হাইয়ের স্বামী ইয়োং-হাইয়ের সঙ্গে ভাড়াটে শিল্পীর সঙ্গে সঙ্গমের কথা বললে যে সঙ্গমের ভিডিও ধারণ করা হবে বলে জানালে লজ্জায় আরক্ত সে পালিয়ে বাঁচে। কিন্তু অতিরিক্ত উচ্ছ্বসিত ও কামোত্তেজিত ইয়োং-হাই তখন ভগ্নিপতির শরীরেও ফুলের ছবি আঁকিয়ে সঙ্গমের দৃশ্য ধারণ করার জন্য বললে। ওরা সঙ্গমে প্রবৃত্ত হয়। দৈবক্রমে এই দৃশ্য দেখে ফেলে বড় বোন ইন-হাই। মোড় নেয় জীবনের নতুন মোড়। ইন-হাই জরুরি বিভাগকে খবর দিয়ে জানায় ওরা উভয়ই পাগল হয়ে গেছে।
ইন-হাইয়ের স্বামী জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে ব্যালকনিতে আত্মহত্যা করার জন্য। ব্যর্থ মানুষরা হয়তো সব জায়গাতেই ব্যর্থ। এখানেও সে ব্যর্থ। মরতে পারেনি। বেঁচে যায়। কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ে সোপর্দ্দিত হয় হাসপাতালে।
ফ্ল্যামিং ট্রিজ (প্রোজ্জ্বলিত বৃক্ষরাজি)
ক্রমে ইয়োং-হাইয়ের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হলে তার জীবন থেকে সবাই সরে গেলে পাশে থেকে যায় একমাত্র বড় বোন ইন-হাই। ইন-হাই বোন ও নিজের একমাত্র সন্তানের জন্য বাঙালি মহৎ নারীদের মতোই সেবার মানসিকতা নিয়ে প্রতিকূল স্রোতে সাঁতরাতে থাকে। ইয়োং-হাইকে মানসিক হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু ক্রমান্বয়ে তার আচরণ আরও খারাপ হতে থাকে। না খাওয়ার জন্য শরীরও ভেঙে যায় চরম মাত্রায়। মনে হয় সে উদ্ভিদের মতো আচরণ করছে। তার মনের বাসনা সে উদ্ভিত হতে চায়। বৃক্ষরাজির মতো অরণ্যে চলে যেতে যায়। একদিন বৃষ্টিস্নাত দিনে সে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায় এক অরণ্যে। হাসপাতালে তাকে খুঁজে না পেয়ে অরণ্যের গভীরে খোঁজ মিলে অন্য বৃক্ষরাজির মতো সেও বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। ইন-হাই হতাশাগ্রস্ত জীবন নিয়ে একদিকে বোনের প্রতি মমত্ববোধ অন্যদিকে সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় ইয়োং-হাইকে কিছু খাওয়ানো যায় না।
একদিন ডাক্তার-নার্সরা ইয়োং-হাইকে জোর করে খাওয়াতে গেলে সে বমি করে ফেলে দেয়। কেন এতো জোরাজুরি, এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে ইন-হাই নার্সকে কামড়ে প্রতিশোধ নেয় এবং বোনকে নিয়ে অন্য হাসপাতালে চলে যায়।
যদিও আইয়ান ম্যাকইভান সেক্সুয়ালিটির নোভেল বলেছেন, দ্বিতীয় পরিচ্ছদে ইয়োংয়ের মানসিক বিপর্যয়ের কারণে যৌনতার সুড়সুড়ি সব পাঠককে দেবে বলে মনে হয় না; কোনো কোনো পাঠককে হয়তো দিতে পারে। উপন্যাসের পাতায় পাতায় একটি মেয়ের জীবনের যে করুণ পরিণতি চিত্রিত হয়েছে, সেখানে মেয়েটি নগ্ন হলেও সুস্থ পাঠককে যৌন সুড়সুড়ি দিতে পারে কিংবা যৌনাবেদনে সিক্ত হবে তা মনে হয় না। এখানে মনোবৈকল্যের লক্ষণই পরিস্ফুটিত হয়েছে যা পাঠককে ভাবান্তরের ডুবে যাওয়ার জন্য সহায়ক।
আবার পেছনে ফিরে যেতে হচ্ছে, ইয়োংয়ের মাংস না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা করার পরে তার শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়, অতৃপ্তিকর সঙ্গম, ডাক্তারের কাছে না যাওয়ার জেদ ইত্যাদি জটিলতায় যখন তার স্বামী ইয়োংয়ের পরিবারের কাছে নালিশ করে তখন বাবা-মা-বোন বাসায় মহাভোজের আয়োজন করে তাকে মাংস খাওয়ার জন্য বাবা-মা পীড়াপীড়ি করার পরেও তার অনড়তার কাছে হেরে যায় পরিবারের সবাই। তখন বাবার থাপ্পড় খেয়ে সে ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করতে উদ্যত হলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ফলে যমদূত নাখোশ ফিরে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু যমদূত নাখোশ হওয়ার পাশাপাশি পরিবারের সবার চক্ষুশূল হতে হয় তাকে। জীবনের স্বাভাবিক সাধ-আহ্লাদ থেকে নিজে যেমন বঞ্চিত, তেমনি তার স্বামীও বঞ্চিত।
লেখক উপন্যাসে চরিত্রটি এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে, মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, মেয়েটির কোনো যৌনানুভূতি ছিল না। ভাবাবেগ ও যৌনাবেগ যে চরিত্রের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয় সে চরিত্রের প্রতি সুস্থ মানুষের যৌন সুড়সুড়ি কিংবা কামনা রসে সিক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে ধারণা করা যায় না।
এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইয়োং-হাইয়ের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের মতো জাপানের জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখক হারুকি মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘কিজুকি’র মনস্তাত্ত্বিক সংকটের মিল পাওয়া যায়। যৌন অক্ষমতার কারণে মানসিক বিপর্যয় ঘটেছিল কিজুকির জীবনে এবং শৈশবের প্রেমিকার জীবন থেকে সরে যাওয়ার জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অন্যদিকে নায়ক নওকোর দ্বিতীয় প্রেমিকাও মানসিক রোগী ছিল যাকেও একসময় ত্যাগ করতে হয়েছে। বিষাদের ছায়াবারণে ঢাকা উপন্যাসটিতে মূলক মানসিক বিপর্যয়ের চমৎকার চিত্র চিত্রিত হয়েছে।
হারুকি মুরাকামির আরেকটি গল্পগ্রন্থ ‘আফটার দ্য কোয়েক’ রচিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালের জাপানের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ওপর। প্রতিটি গল্পেই লেখক সরসারি ভূমিকম্পের কল্পচিত্র অঙ্কন না করে বরং ভূমিকম্পের মানুষের ওপর নেতিবাচক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত শিল্পিত চিন্তায়। গল্পের প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনযাপন দেখা গেলেও মূলত প্রত্যেকের মনে দহন আছে এবং প্রায় সবারই মনোজগত বিধ্বস্ততা প্রকাশ করেছেন। ভেজেটেরিয়ান উপন্যাসেও ইয়োং-হাইয়ের অস্বাভাবিক আচরণ পাঠককে বিষাদগ্রস্ত করে এবং হৃদয়ে দাগ কাটে যেমন করে নরওয়েজিয়ান ‘উড’ ও আ‘ফটার দ্য কোয়েক’ করে থাকে।
সম্পূর্ণ উপন্যাস পাঠে পাঠক একপ্রকার মানবিক সম্মোহনে আচ্ছন্ন ও ভারাক্রান্ত থাকবে বলে বিশ্বাস যা আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে। একটি চমৎকার মেয়ে অল্প সময়েই জীবন হারায়। এ রকম বেদনা পাঠক তো অনমনীয় সমাজকে দায়ী করতে পারে? পিতার রূঢ় আচরণের জন্য তো সমাজ কাঠামোই দায়ী। না-হয় হতে তো পারত মেয়েকে না মেরে তখনই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। লেখক এই চরিত্রটি সৃষ্টির মাধ্যমে পুরুষের আধিপত্যের দিকে কি ইঙ্গিত করেন না? মি. চেয়ং কেনই বা স্ত্রীর সঙ্গে নিজের শক্ত মনোভাব প্রকাশ করে গেল? সেও তো পারতো মেয়েটির পাশে থেকে তাকে উপলব্ধি করতে, তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। এই চরিত্র দিয়েও কি লেখক সমাজ কাঠামোর দিকে বিরূপ ইঙ্গিত করেননি? সহজেই লেখক পৌনপৌনিকভাবেই ভাবাবেগ ও আকাঙ্ক্ষার উষ্ণতা ও হতাশার হিমেল বাতাবারণে ঢেকেছেন কাহিনীকে। এখানে ইয়োং-হাইয়ের ব্যর্থতা চেয়ে তার পাশে থাকা একমাত্র বড় ছাড়া অন্যান্য মানুষের চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে।
বিবেককে জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন লেখক। তৃতীয় অধ্যায়ে ইন-হাই তার বিধ্বস্ত পরিবার থেকে নিজের জীবনকে টেনে বের করতে চেয়েছে ঋজু হয়ে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছে। কিন্তু সমাজের কাঠামোর সমাজে সেও বিমূঢ়। কাহিনী শেষপর্যন্ত বিষাদের ছায়ায় ঢেকে যায়। দুটি দাম্পত্য জীবনে ভাঙনের স্রোতে দাঁড়ায় এবং ইয়োং-হাইয়ের মৃত্যু নয়; তবে মৃত্যুর কাছাকাছি এসে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে। বেদনাকাতর দৃশ্যে এসে থামে, The look in her eyes is dark and insistent.