২০১৮ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে কবি জাহাঙ্গীর ডালিমের কবিতা গ্রন্থ ‘বৃষ্টি ভেজা কবিতা’। জাহাঙ্গীর ডালিম লিখছেন অনেকদিন ধরে। সেটাও নানান মাধ্যমে। কবিতার পাশাপাশি ছড়া ও ছোটগল্পেও তার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। করছেন সাংবাদিকতাও।
চর্চা গ্রন্থ প্রকাশ থেকে প্রকাশিত এই বইটি ছোট কলেবরের। তিন ফর্মার বইয়ে কবিতা আছে চল্লিশটি। সেখানে ছয়টি কবিতা ছাড়া বাকি চৌত্রিশটি কবিতাই গদ্য ফর্মে লেখা।
সম্প্রতি তরুণ কবিদের মধ্যে সাধারণত গদ্য কবিতার প্রতিই ঝোঁক বেশি লক্ষণীয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জাহাঙ্গীর ডালিমেরও এই ঝোঁক থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এই ঝোঁকের প্রতি অনেক খ্যাতিমান কবিদেরই উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায় । যেমন কবি আল মাহমুদ একবার ক্ষোভের সঙ্গেই বলেছিলেন, কবিতার ছন্দ সম্পর্কে ব্যর্থ হয়েই তরুণ কবিরা দেদারসে গদ্য কবিতার চর্চা করে যাচ্ছেন, কিন্তু প্রকৃত কবিদের উচিত ছন্দজ্ঞান অর্জন করে নেওয়া এবং জেনে না মানার রাস্তায় পা বাড়ানো বা গদ্য কবিতার চর্চা করা।
অথচ এই ব্যাপারটিতে জাহাঙ্গীর ডালিমকে বলা যায় ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম এই কারণে যে, পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, তার গদ্য কবিতার চেয়ে ওই অল্প কয়েকটি ছন্দবদ্ধ কবিতাই অনেক বেশি কবিতা। এটাই কবি জাহাঙ্গীর ডালিমের শক্তির জায়গা।
একজন কবি বা শিল্পীই শুধু নয়, যেকোনো মানুষেরই প্রথম মনোযোগী হওয়া দরকার তার ভেতরের শক্তি ও সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করতে পারায়। আমার ব্যক্তিগত পর্যেবক্ষণ জাহাঙ্গীর ডালিম তার কবিতার শক্তির জায়গাটা ধরতে নিজেই ব্যর্থ হয়েছেন। কিংবা এমনও হতে পারে যে, তিনি নিজেকে নিয়ে এক ধরনের পরিকল্পিত নিরীক্ষায় নেমেছেন। সেটা হলে তার প্রতি আমার অভিনন্দন রইলো এই জন্যে যে, প্রতিটি শিল্পীরই উচিত নানান ফর্মে কাজ করে নিজেকে মাঝে মাঝেই চ্যালঞ্জের মধ্যে ফেলা। সবশেষে বারবার নিজস্ব শক্তির জায়গায় ফিরে আসা।
‘কালস্রোত’ শিরোনামে জাহাঙ্গীর ডালিমের একটি ছন্দবদ্ধ কবিতায় চোখ রাখিছ
এমন করেই হাজার বছর পর
অথবা তার একটু আগেপরে
যেমন ধরো জীর্ণ আশার ঘর
দাঁড়িয়ে কাঁপে কালের খুঁটি ধরে।
এটি স্বরবৃত্তের। অথচ বিষয়ের গভীরতা আর শব্দের ব্যবহারে স্বরবৃত্তের সরলতাকে ছাপিয়ে গভীর এক দ্যোতনা তৈরি হয়েছে। এই কবিতারই শেষ পঙ্ক্তি এমন—
এমন করে রাতের পরে রাত
হারিয়ে যাবে স্বপ্ন নিরুদ্দেশ
কল্পলোকে হাজার ঈদের চাঁদছাড়িয়ে যাবে দগ্ধ আশার রেশ।
এই পঙ্ক্তিগুলো পাঠ শেষে পাঠক হিসেবে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে—বাহ! এবার ‘জলকন্যা’ শিরোনামে ছন্দবদ্ধ আরেকটি কবিতা থেকে চার পঙ্ক্তি উদ্বৃত করি—
জলকে চলো বলে জলেই ডুবে গেলে
তখন আশ্বিন ভাদ্র
ঋতুর মীমাংসা রোদে ও কাশফুলে
খানিক শুষ্ক বা আর্দ্র ।
এইখানে এসেও জাহাঙ্গীর ডালিমের শক্তির দিকটা স্পষ্ট হয়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রতি পর্বে সাত মাত্রার এই কবিতায় দক্ষতা লক্ষণীয়। তবে এর অর্থ এই নয় যে, গদ্য কবিতায় তিনি পুরোপুরিই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। বরং মাঝে মাঝেই কিছু কবিতার কিছু কিছু লাইন কবিতার নিবিঢ় পাঠককেও তৃপ্তি দিতে সক্ষম। একটি কবিতার কথা না বললেই নয়, সেটি ‘নির্জন পর্ব’। কবিতাটি ছোট বলে পুরো কবিতাটাই তুলে দিচ্ছি-
ভালোবাসি তার চেয়ে বেশি
যতটা বাসলে ভালো পরিপূর্ণ নিঃস্ব হওয়া যায়।কেন যে জোছনা ওঠে, এই চরাচরে মেলে দেয়
আকাশ তার চন্দ্রচূড় শাড়ি
কেন যে অমল আলোর ঢেউ এসে খেলা করে
নারিকেলের পাতায়?আমার একটা বাড়ি আছে—পাখি বাড়ি
আমার একটা আকাশ আছে-অসীম আকাশ।
আমি কবি জাহাঙ্গীর ডালিমের এবং তার ‘বৃষ্টি ভেজা কবিতা’ গ্রন্থের সাফল্য কামনা করছি।