বীরেন মুখার্জী একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। তিনটি শাখাতেই সমান পারঙ্গমতা ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। একজন কবির চোখে দেখা বিষয়গুলো উঠে এসেছে তার গল্পে। উঠে এসেছে মানবিকতা। শহুরে কিংবা গ্রামের যেকোনো প্রেক্ষাপটেই ঝংকৃত হয়েছে মানবিকতার সুর। আধুনিকতা বা পশ্চাৎপদতা যেকোনো অঙ্গনেই মূর্ত হয়ে উঠেছে মানুষের কথা। মানবিক অবক্ষয়ের কথা।
তার গল্পে অতীত ও ভবিষ্যতের নিটোল চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সমাজের গভীর থেকে উঠে আসা কাহিনী সমৃদ্ধ করেছে তার গল্পগুলোকে। তিনি যে প্রচুর পর্যবেক্ষণ করেছেন, তা সহজেই অনুমেয়। তার নিরীক্ষায় মানুষের সুক্ষ্ণবোধ, দহন, পীড়ন, মমতা, গ্লানি প্রতিটি গল্পেই উজ্জ্বল হয়েছে। গল্পের কাব্যময়তা পাঠক হৃদয় আকর্ষণ করে। কাহিনী চিত্রায়ণও এক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হিসেবেও সমাদৃত হতে পারে।
বীরেন মুখার্জী তার গল্প সম্পর্কে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, তারাশঙ্কর, কমলকুমার থেকে শুরু করে সমসাময়িকদের গল্প পাঠ করেছি আর একটি মিশ্র অনুভবে আমার গল্পগুলোর জন্ম হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কাব্যিক ফর্মের লেখাগুলো আমাকে বেশি টানে। গল্প লেখার ক্ষেত্রে আমি গুরুত্ব দিয়েছি বাস্তবতা ও কল্পনার সংমিশ্রণে গল্পটা ঠিক যেন গল্প হয়ে ওঠে।’ বীরেন মুখার্জীর গল্পে সমাজ-রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতি, টানাপড়েন, জীবনযাপন, দারিদ্র্য, হ্যালুসিনেশন, দাম্পত্য সংকট, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নির্বাচনোত্তর সহিংসতা ও মনস্তত্বসহ অনেক বিষয় উঠে এসেছে।
‘পাগলি ও বুড়ো বটগাছ’ তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গল্পগ্রন্থ। এ গ্রন্থের গল্পগুলো হচ্ছে: ‘প্রত্যাগমন’, ‘স্বাপ্নিক’, ‘সাদা শাড়ির জলকন্যা’, ‘বীরাঙ্গনা কিংবা একটি শিমুল গাছ’, ‘স্বীকারোক্তি’, ‘শোন অন্ধ অন্ধকার’, ‘রইচ মিয়ার আত্মদর্শন’, ‘মস্তকহীন ঘোড়সওয়ার’, ‘সার্কাস বালিকা’, ‘নূরালীর অন্তর্ধান’, ‘পাগলি ও বুড়ো বটগাছ’ ও ‘মেয়েটি সংসার চেয়েছিল’।
আগেই বলে রাখা ভালো, কবিদের হাতে গল্পের জন্ম হলে সেখানে কবিতার ছোঁয়া থেকেই যায়। হোক কবিতার চরণ, কবির নাম, কবিতার নাম, কিছু না কিছু থাকবেই। গল্পে কবির প্রভাব থাকবেই। ‘প্রত্যাগমন’ গল্পে লেখক বলেছেন, ‘আমাদের চ্যাট মূলত কবিতাকেন্দ্রিক।’ তার ‘প্রত্যাগমন’ গল্পটি ফেসবুকীয় প্রেমকেন্দ্রিক। অপরিচিত নারীর সঙ্গে ফেসবুকে কথোপকথন, অবশেষে সাক্ষাৎ, সাক্ষাৎ থেকে বিয়োগান্তক পরিণতি। গল্পটিতে লেখক কথকের ভূমিকায় উপস্থিত হয়েছেন। লেখক বলেন, ‘আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সারথি পথে নেমে পড়ে। আমার পাঁজর মাড়িয়ে ক্রমশ দূরে সরে যায় সারথির পা-যুগল। আমি দাঁড়িয়ে থাকি হতবিহ্বল। তার চলে যাওয়া পথে জোনাকির মিটিমিটি বাড়তে থাকে।’
বীরেন মুখার্জীর প্রতিটি গল্পেই মানবতার সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে। মানুষের অমানবিকতাও তুলে ধরেছেন লেখক। ক্ষমতা, অনৈতিকতা, স্বেচ্ছাচারিতা মানুষকে যে অমানুষ বানাতে পারে, তারও প্রকৃষ্ট উদাহরণ তার কয়েকটি গল্প। তার প্রতিটি গল্পই মানবিক। প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা, সন্তানের প্রতি মমত্ব, দেশের প্রতি আস্থা, সবকিছুতেই মানবিকতা ফুটিয়ে তুলেছেন। জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েও তার চরিত্ররা মানবিক থাকার চেষ্টা করেছেন। তার গল্পে ধর্ম ও মানবিকতা পাশাপাশি অবস্থান করে আছে। ‘প্রত্যাগমন’ গল্পে লেখক বলেন, ‘তার ধর্ম ইসলাম, সে কি যাবে মন্দিরে? বুকে সাহস নিয়ে আমি তাকে দেবী দর্শনের আমন্ত্রণ জানাই। সে যেতে রাজি হয়।’ অন্যত্র বলেন, ‘আমি মানুষ- এটিই মানুষের প্রকৃত পরিচয় হওয়া উচিত, আমার তা-ই মনে হয়।’
বীরেন মুখার্জীর ‘স্বাপ্নিক’ গল্পে নারীর প্রতি পুরুষের নোংরা মানসিকতা ফুটে ওঠে। লেখকের ভাষায়, ‘একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় তাকে নির্জন পথে একাকী পেয়ে তাদের গ্রামেরই একটি বয়সী ছেলে তার বুক টিপে দিয়েছিল।…এ ঘটনার পর অন্য পুরুষদের দেখলেই গা গুলিয়ে বমি আসতো তার।’ আবার অন্যত্র দেখি, ‘সে ভাবে মানুষের মন থেকে এখনও মানবিকতা উবে যায়নি।’ অন্যদিকে ‘সাদা শাড়ির জলকন্যা’ গল্পে বিধবা ভাবির মানবিক বোধ আমাদের চমকে দেয়। লেখক বলেন, ‘কায়েস দেবর হলেও সে তাকে ছোট ভাইয়ের মতো জানে। হোক সে সমবয়সী, তাই বলে তাকে বিয়ে করা! না, না, এ কিছুতেই সম্ভব নয়।’ ‘প্রত্যাগমন’ এবং ‘স্বাপ্নিক’ গল্প দুটি একটি আরেকটির ছায়া মনে হয়েছে। যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। দুটি গল্পেই মুঠোফোন, ফেসবুক, প্রেমালাপ, অনেকটা রং নম্বরে প্রেমের মতো। ‘সাদা শাড়ির জলকন্যা’ গল্পে নিম্নবিত্তের জীবন যাপন, প্রেম, সংসার, সংগ্রাম, দ্বিতীয় বিবাহ; নানাবিধ বিষয় তুলে আনা হয়েছে। বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ভাবির বিবাহ চিরাচরিত বিধানের মতোই। তবে বৈধ সম্পর্কের দিকে না গিয়ে লেখক শারীরিক সম্পর্কেই সমাপ্তি টেনেছেন।
বীরেন মুখার্জীর গল্পগুলো মূলত মানবিক বিপর্যয়ের আখ্যান
‘বীরাঙ্গনা কিংবা একটি শিমুল গাছ’ গল্পে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীরাঙ্গনার মানবিক বিপর্যয়ের ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। লেখকের ভাষায়, ‘একসময় রাত গভীর হয়। নরপশুদের কালো থাবায় নবীরণের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। জ্ঞানহীন জড়বস্তুতে রূপান্তরিত হয় সে।’ অথচ গ্রামে ফিরে নবীরণ জানতে পারে তার স্বামীর জমি-জমা, বাড়ি-ঘর সবই দখল হয়ে গেছে। গল্পের শেষে জানা যায়, ‘পরদিন সকালে পথচারীদের মুখে মুখে প্রচারিত হয় ভিখারি নবীরণ মারা গেছে। নবীরণের শীর্ণ মৃতদেহের ওপর দিয়ে কয়েকটি শকুন বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে তখন।’
‘স্বীকারোক্তি’ গল্পে নিজ গ্রামের মানুষ দ্বারা ধর্ষিতা হওয়ার পর জমিলার পতিতাবৃত্তির নির্মম চিত্র দেখতে পাই। জমিলা ভাবে, গ্রামে ফিরলে তাকে নিয়ে তৈরি হবে মুখরোচক নানা গল্প। ধর্ষণের দংশনে মানবিক বিপর্যস্ত জমিলা ভাগ্যক্রমে ধর্ষককে খদ্দের হিসেবে পেয়ে একদিন খুন করে। আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়, ‘অই আমারে এই দেহ ব্যবসায় নামাইছে। আমারে সে ভালোভাবে বাঁচতে দ্যায় নাই, তাই তার লাল রক্তে আমি দু’হাতে মেহেদির রং লাগাইছি।’
সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন তার গল্পে মানবিক হাহাকারের অবতারণা করেছে। মা এবং ভাইয়ের সামনে সন্তান এবং বোনের সম্ভ্রমহানী শরীরে প্রতিবাদের রক্তস্রোত বইয়ে দিয়েছে। ‘শোন অন্ধ অন্ধকার’ গল্পে হরিপদের জীবন সংগ্রাম এবং সর্বস্ব বিলীন হওয়ার দৃশ্য ফুটে উঠেছে। লেখক বলেন, ‘জগদীশ দৌড়ে এসে খবর দেয় মালোপাড়ার পঙ্কজকে বেদম মারপিট করেছে নির্বাচনে বিজয়ী দলের সমর্থকরা।’ এরপর একদিন হরিপদের জীবনের ওপর ঘটে যায় এক অমানবিক ঘটনা। পিতৃহারা বোনটাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়। হরিপদের বিধাব মা কাতর কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘ও খুব ছোট, ওর খু-উ-ব কষ্ট হবে, তোমরা এক এক করে…।’ এর মধ্য দিয়ে মানবিকতার চরম পরাজয়ের ঝাণ্ডা উড্ডীন হয়ে ওঠে।
‘রইচ মিয়ার আত্মদর্শন’ গল্পটি মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগের। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর অকাতরে জীবন বিলীন হওয়ার দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে। একের পর এক মৃত্যু আমাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে দেয়। ঝড়ের তাণ্ডব শেষে দেখা যায়, রইচের পায়ের কাছে বিবস্ত্র সখিনা পড়ে আছে উবু হয়ে। গল্পের শেষে একমাত্র সন্তানের লাল জামা ও একটি বই পায়ের কাছে পড়ে থাকতে দেখা যায়। সর্বহারা রইচ যেন কাঁদতেও ভুলে যায়।
‘মস্তকহীন ঘোড়সওয়ার’ গল্পে নীলকরদের অত্যাচারের গল্প উঠে এসেছে স্মৃতির পাতায়। লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে সেই গল্প এখনো রমজানদের তাড়িত করে। সমকালে এসেও পঙ্গু রমজানের কাছ থেকে ক্ষুধার যাতনা কেড়ে নেয় প্রিয় পরীবানুকে। অনেকটা নীলকরদের মতোই টাকার বিনিময়ে পরীবানুর দেহভোগ করে অন্য কেউ। নিজের চোখে তা দেখতে হয় স্বামী হয়ে।
‘সার্কাস বালিকা’ গল্পটি সার্কাসের এক নারীর পরাজিত জীবনের আখ্যান। এখানেও সংসারের চাহিদা মেটাতে অর্ধ-নগ্ন হয়ে নাচতে হয়। স্বামীর কারসাজিতে দলনেতার শয্যাসঙ্গী হতে হয়। লেখক জানান, ‘নিজেকে মুক্ত করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েও কেরামতের অসুর শক্তির কাছে ব্যর্থ হয়ে হাউমাউ করে শিশুর মতো কেঁদে ওঠে সোহাগী।’ এছাড়া বীরেন মুখার্জীর ‘নূরালীর অন্তর্ধান’ গল্পটি মূলত হ্যালুসিনেশনের বহিঃপ্রকাশ। অবসাদ এবং বিষণ্নতা এর জন্য দায়ী। অনেকটা অলৌকিক মৃত্যুও বলা যায়। কিছুটা ভৌতিক বা পৌরাণিক গল্পের কাছাকাছি মনে হয়।
‘পাগলি ও বুড়ো বটগাছ’ গল্পে এক পাগলির মা হওয়া, সন্তান জন্মদান, নিজের সন্তানের মৃত্যুতে অস্বাভাবিক আচরণ তুলে এনেছেন লেখক। গল্পটি তিনি তুলে ধরেছেন একজন ভ্যানচালকের দৃষ্টির মধ্য দিয়ে। গল্পে ভ্যানচালক কায়েস মানবিক হতে চাইলেও সমাজের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তার মানবিকতায় বাধা দিয়েছে। আর ‘মেয়েটি সংসার চেয়েছিল’ গল্পটি একটি বঞ্চিত মেয়ের আখ্যান। শরীরের বিনিময়ে হলেও সে সংসার চেয়েছিল। কিন্তু তিনি হয়ে রইলেন ভোগের সামগ্রী। আশ্রয়হীন নারীর জন্য হয়তো আত্মহত্যাই অবধারিত হয়।
সব মিলিয়ে বীরেন মুখার্জীর প্রতিটি গল্পেই মানবিক বিপর্যয় লক্ষণীয়। প্রায় গল্পেই দুর্বলকে ধর্ষণ, বাধ্য হয়ে পতিতাবৃত্তি, অবৈধ উপায়ে জৈবিক চাহিদা পূরণ, বীরাঙ্গনার প্রতি অবজ্ঞা, পাগলির মানবেতর জীবন যাপনসহ ভাগ্যবিড়ম্বিত নারীদের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। ফলে স্পষ্টতই বলা যায়, বীরেন মুখার্জীর গল্পগুলো মূলত মানবিক বিপর্যয়ের আখ্যান। সহজ-সাবলীল ভাষায় উপস্থাপিত প্রতিটি গল্পই পাঠকের অন্তরে একটি গভীর বাস্তবসম্মত দৃশ্যকল্প স্থাপন করে দেয়। যা আমাদের শিহরিত করে। মানবিক হওয়ার আহ্বান জানায়।