বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দের পর মহীবুল আজিজ সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই বিচরণ করেছেন; নিজের অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সামর্থ্য দেখিয়েছেন তার সৃষ্টিকর্মে। তিনি ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের ভেতরে ঢুকে ময়নাতদন্ত করে দেখিয়েছেন ভেতরের ক্ষত ও বাস্তবতা; ভণ্ডামির শরীরে লেপ্টে দিয়েছেন তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ। তার সাহিত্যের একটি মৌল প্রবণতা হলো মুক্তিযুদ্ধ। লিখেছেন যুদ্ধভিত্তিক দুটি উপন্যাস বাড়ব ও যোদ্ধাজোড়, রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের গল্পের সংকলন; ৭টি গল্পের বইয়ের (একটি প্রকাশিতব্য) প্রত্যেকটিতে রয়েছে একটি করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প।
তিনি কেবল যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে গল্প ভরে রাখেননি, প্রচলিত পথ ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের গভীর ও তাৎপর্যময় বিষয় নিয়ে লিখেছেন গল্প; মুক্তিযুদ্ধ জাতির জীবনে বা ব্যক্তি জীবনে কী অভিঘাত তোলে, এর প্রতিক্রিয়া কত গভীর, ব্যঞ্জনা কত দীপ্তময়—এসব বিষয়ই মুখ্য হয়ে উঠেছে তার সাহিত্যে। যাদের জীবনের ওপর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বয়ে গেছে, তাদের পরবর্তী জীবনের প্রতিচ্ছবি ও প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে তার গল্পে।
মহীবুল আজিজকে নিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিষয়ক কাগজ ‘পাতাদের সংসার’ এভাবেই তাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। কবিতা বিষয়ে সমালোচক বেগম আকতার কামাল বলেছেন, ‘১৯৯৪ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দীর্ঘ কবিতাযাত্রায় মহীবুল আজিজ উত্তরোত্তর ভিন্নতা খুঁজেছেন, ব্যতিক্রম হওয়ার প্রয়াসও লক্ষ করি। বিশেষ করে, বাংলাদেশের নব্বইয়ের দশকের কবিদের চরিত্রবল ও কবিতার মায়াবল—দুই-ই তার মনোভঙ্গির সঙ্গে হুবহু মিলে যায় না, তিনি আত্মস্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছেন কবিপ্রাণের সহজাত স্বভাবেই।’
সময়কে যে লেখক ধরতে পারেন, তিনিই তো প্রকৃত লেখক; আর সেই লেখকই টিকে যায় তার লেখনীর মধ্য দিয়ে। সমকালীন কোনো ঘটনা কালোত্তীর্ণ করে উপস্থাপনাই একজন লেখকের প্রধান কাজ, যা লেখকের অবস্থানকে সুদৃঢ় করে। তাকে শক্ত ভীতের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়। আর এ কাজটি মহীবুল আজিজ নিপুণভাবে লেখায় তুলে ধরতে পেরেছেন। এখানে তিনি দক্ষ কারিগরের আসনে নিজেকে পাকাপোক্ত করতে পেরেছেন। তেমন একজন লেখক মহীবুল আজিজকে নিয়ে সম্পাদক হারুন পাশা তার কষ্টলব্ধ ও নান্দনিক সৌন্দর্যের কারুকার্যময় একটি উপস্থাপনা করেছেন এ সংখ্যাটিতে।
সংখ্যাটিতে মহীবুল আজিজের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদক নিজেই। সাক্ষাৎকারে মহীবুল আজিজ বলেছেন, ‘আমি শুধু লিখে যেতে চেয়েছি।’ কী অসাধারণ কথা। আসলে তো তাই। একজন লেখক তো শুধু লিখে যেতেই চাইবেন, আর তার মূল্যায়ন করবেন তার বোদ্ধা পাঠকরা। সাক্ষাৎকারে লেখকের ভাবনার খোরাক নিয়ে কথা বলেছেন, বলেছেন তিনি যে একজন কবিও বটে। তার কবিতা ও গল্প কিভাবে রোপিত হয়, তার সবিস্তার বর্ণনা দিয়েছেন দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। পাঠক বিশেষ করে লেখকরা তা থেকে কিছু রসদ পেয়ে যাবেন।
মহীবুল আজিজকে নিয়ে মোট আটাশ জন মূল্যায়নধর্মী লেখা লিখেছেন। এর মধ্যেধ্যে ‘কথাসাহিত্য বিবেচনা’ নিয়ে লিখেছেন, মিল্টন বিশ্বাস, সমীর আহমেদ, চঞ্চল কুমার বোস ও আজহার ইসলাম। ‘উপন্যাস-ভিত্তিক আলোচনা’ করেছেন আহমেদ মাওলা, আউয়াল আনোয়ার ও মামুন আবদুল্লাহ। ‘গল্পগ্রন্থ-ভিত্তিক আলোচনা’ করেছেন, সৈয়দ আকরম হোসেন, শফিক আশরাফ, চন্দন আনোয়ার, গওহর গালিব, সোলায়মান সুমন, হারুন পাশা ও দীপিন্তি হাসান। ‘মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক গল্প মূল্যায়ন’ নিয়ে আলোচনা করেছেন, আহমেদ মাওলা ও মোস্তফা তারিকুল আহসান। ‘কবিতায় মহীবুল আজিজ’ শিরোনামে আলোকপাত করেছেন, বেগম আকতার কামাল, অনু হোসেন, হারুন পাশা, গাউসুর রহমান ও নাজিয়া ফেরদৌস। ‘প্রবন্ধ মূল্যায়নে’ লিখেছেন, রহমান হাবিব ও মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন। মহীবুল আজিজের ‘অনুবাদ’ বিষয়ে আলোচনা করেছেন, হামীম কামরুল হক। শরদিন্দু ভট্টাচার্য ‘সংগীতে মহীবুল’ শিরোনামে আলোচনা করেছেন। ‘ব্যক্তি ও শিক্ষক মহীবুল আজিজ’ বিভাগে লিখেছেন, শরিফা খাতুন, ভাস্কর চৌধুরী, কাজী শামীম সুলতানা, কাজী জিনাত হক ও মামুন আবদুল্লাহ।
মহীবুল আজিজকে নিয়ে আলোচ্য সংখ্যায় যারা তার প্রকাশিত উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, গান এবং শিক্ষকতা নিয়ে আলোকপাত করেছেন তাদের মূল্যায়ন থেকে ব্যক্তি ও সাহিত্যিক মহীবুল আজিজ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ সম্ভব।
মহীবুল আজিজ আশির দশকে লেখালেখি শুরু করলেও নব্বইয়ের দশকে নিজেকে ভালোভাবে মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন; সাহিত্যাঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। আগামীতে তিনি আরও পথ পাড়ি দেবেন, তা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়।
সাহিত্যের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় যার উজ্জ্বল উপস্থিতি তাকে নিয়ে তো এ ধরনের লেখা হবেই, আয়োজন হতেই পারে, আর তাই হয়েছে। তিনি যে শুধু গৎবাঁধা গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি; বৃত্ত পেরিয়ে নিজস্ব একটা স্টাইল নিয়েই লিখেছেন, তার লেখায় ফুটে উঠেছে।
সংখ্যাটিতে মহীবুল আজিজের জীবন ও রচনাপঞ্জি ছাড়াও নিয়মিত আয়োজনে জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়েছে শামসুজ্জামান খানকে। অত্যন্ত সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো প্রায় নির্ভুল সুখপাঠ্য পরিচ্ছন্ন ১৬৮পৃষ্ঠার ‘পাতাদের সংসার’ পত্রিকাটি পাঠকদের উপহার দেওয়ার জন্য সম্পাদককে ধন্যবাদ না দিলে কার্পণ্য করা হবে।
‘পাতাদের সংসার’ সাহিত্যকর্মীদের আলোকচ্ছটা রাঙিয়ে দিক, দিক থেকে দিগন্তে। পত্রিকাটির ব্যাপক প্রচার, প্রসার ও পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করছি।
পাতাদের সংসার
সম্পাদক: হারুন পাশা
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান
স্কেচ: গৌতম পাল
মূল্য: ২০০ টাকা।