শিক্ষাবিদ ও বহুমুখী সৃজনকর্মের এক মহান কারিগর মুহম্মদ জাফর ইকবাল বাংলা ছোটগল্পেও রেখেছেন উজ্জ্বল স্বাক্ষর। তাঁর ‘নূরুল এবং তার নোট বই’ শীর্ষক গল্পগ্রন্থটিকে সামনে রেখে কিছু বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
বাংলা ছোটগল্প—কথার প্রবাহ বাঙালির জীবন বোধের নদীতে যে ঢেউ তোলে, তা কিছুটা কূলপ্লাবী, বাঁকিটা কূলছোঁয়া। কূলপ্লাবনের সঙ্গে সবকিছু বা অনেককিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা ব্যাপার থাকে। আর ছোঁয়াছুঁয়ির মধ্যে থাকে মিথস্ক্রিয়ার সূচনা-সম্ভাবনা। কূলপ্লাবন কিংবা কূলছোঁয়াছুঁয়ি যেটাই বলা হোক না কেন, এতে দৃশ্যমান হয় জীবনবোধ, বিচূর্ণ হয় প্রচলিত ধ্যান, বিস্তৃত হয় মানবিকতার সূত্রসমূহ, নাড়া দিয়ে যায়, ধাক্কা দিয়ে যায় জীবনের গভীর সঞ্চারণে। এগুলো থেকে লব্ধ ধারণার ফল নিয়ে যায় জীবন সংক্রান্ত সব তাৎপর্যের ধারাপাতে। এই ধারাপাত নিছক ধারাবিবরণী নয়। বরং ধারাভাষ্যের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে লেগে থাকে জীবনের ক্লেদ, গ্লানি, সংকট ও সম্ভাবনা। লেগে থাকে জীবনকে দেখার কিংবা উপলব্ধি করার ভিন্নতর বোধ। এই জীবন যখন ধ্বংস দ্বারা পরিব্যাপ্ত হয় রাষ্ট্রীয় কিংবা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের খামখেয়ালিতে, বিশেষত বৃহত্তর অর্থে রাষ্ট্রশক্তিনিয়োজিত পৃষ্টপোষিত কোনো বাহিনীর দ্বারা, তখন জাতিসত্তার ক্ষুদ্রতম একক ব্যক্তি মানুষের কী পরিণতি হয়?
ভাবতে গেলে তত্ত্বীয় অনেক কথা বেরিয়ে যাবে। বলতে গেলে বলা হয়ে যাবে অনেক কিছু। তাতে হয়তোবা কিছুই হবে না। যদি না ব্যক্তি মানুষের গোপন অন্দরের হাহাকারের ক্ষুদ্রতম জায়গাটিতে আলো ফেলা না যায়।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘নূরুল এবং তার নোট বই’ শীর্ষক ছোটগল্পের বইয়ের নয়টি গল্প পড়তে গিয়ে একথাটিই মনে হলো। মনে হলো, আমাদের সম্মানিত পূর্বতনদের ভিত্তি ও অবদানের বেদীপীঠে দাঁড়িয়ে আমাদের ছোটগল্প থমকে যায়নি। বরং চলিঞ্চু হয়েছে। রসায়িত হয়েছে, অনুকৃত হয়েছে, অনুসৃত হয়েছে, বর্জিত হয়েছে, নিরীক্ষিত হয়েছে। আর চলমান রেখেছে ধারা। আলোচ্য গ্রন্থের গল্পগুলো পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে—এই ধারা নিছক মৌহূর্তিক ভাবাবেগের নর্তন-কুর্দন নয়। বরং সমূহ সংকটের সংবেদনা। এ ধারা ও সংকট যেন উপর্যুক্ত আলো। না আলো নয় প্রিজম। এর ভেতর দিয়ে চলে গেছে আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। যার নাম মুক্তিযুদ্ধ।
গ্রন্থভুক্ত নয়টি গল্পের ছয়টিই মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক। মুক্তিযুদ্ধকে আমরা সাধারণত ভিন্ন ভিন্ন কৌণিক অবস্থান থেকে আলোকপাতের মাধ্যমে উপলব্ধির আওতায় আনতে চাই। কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থের গল্পগুলো পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে—প্রচলিত এই ধারণা ও প্রয়াস থেকে বের হয়ে ভিন্নতর উপলব্ধির জগতে নিয়ে যাওয়াই যেন লেখকের লক্ষ্য। না, এটা অতিকথন নয়। বিশাল আদর্শ ও ভাবাবেগ নিয়ে যেন গল্পকার গল্পগুলো লিখতে বসেননি। বিশেষ কোনো বক্তব্যও সুপ্রতিষ্ঠ করতে তিনি বদ্ধ পরিকর নন। তিনি যেন নিছকই ব্যক্তি মানুষের সাধারণ আবেগ ও কর্মপ্রয়াস নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে অবলোকন করতে চেয়েছেন। খুবই নির্মোহভাবে। মাধ্যম হিসেবে যে ভাষাটি তিনি ব্যবহার করেছেন, তাও মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতোই। এই প্রাঞ্জলতা গ্রন্থটিকে দিয়েছে একটি অন্যরকম মহিমা। আমার বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক কোনো গ্রন্থের এরকম মহিমান্বিত রূপ নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হওয়ার উদাহরণ তেমন নেই।
প্রথম গল্পটিই নামগল্প। গল্পের প্রধান চরিত্র নূরুল। আর লেখক নিজেই কথক। গ্রামের এক সাধারণ মধ্যবিত্তীয় পরিবারের যুবক যে কিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। খুবই সাদামাটা গা বাঁচানো চিন্তা-চেতনা আর নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে পছন্দ করে সে। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। তার আবহ লেগে আছে গ্রামে ও শহরে। বিশ্ববিদ্যালয়েও। নির্ঝঞ্ঝাটপ্রিয় এই যুবকের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বা স্বাধীনতার স্বাদটাই আসল। কিন্তু স্বাধীনতা প্রাপ্তির জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, সেদিকে সে উদাসীন। যুবকের বন্ধু নূরুল। এরকম সংকটময় মুহূর্তে সে সিদ্ধান্ত নেয় মিলিটারি নিয়ে যত জোকস বের হয়েছে, সেগুলোর একটা কালেকশান সে বের করবে। উদ্ভট ও হাস্যকর নিঃসন্দেহে। কিন্তু এর ভেতরেও একটা সূক্ষ্ম পরিহাস সুপ্ত রয়েছে। এই সূক্ষ্ম পরিহাস আর বন্ধুদের বিভিন্ন মন্তব্য নিয়েই গল্পটি এগুতে থাকে। মাঝে-মাঝে তার দুর্বল চিত্তের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় বিভিন্ন কথায়। যেমন ‘কোথায় থাকব, কী খাব, কী করব—এইসব ভেবে তখন গেলাম না। আবার ভয়ও লাগে যুদ্ধ-টুদ্ধ করে যদি মরেই গেলাম, তাহলে দেশ স্বাধীন হলেই কী আর না হলেই কী?’ একসময় এই জোকসের নোটসহ তারা মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে। মিলিটারি জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়—‘ইসলামিক হিস্ট্রি। মোঘল ডাইনেস্টি।’
একথা বলার জন্য তারা ছাড়া পায়। ছাড়া পেয়ে নীলক্ষেতের মোড়ে রিকশাটা ঘুরে যাওয়ার সময় পথে একটা ডাস্টবিন পড়লো, নূরুল নোট বইটি ছুড়ে ফেলে ডাস্টবিনে। ‘আমি না দেখার ভান করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।’ এভাবেই শেষ হয়ে যায় গল্পটি। বোঝা যায় মধ্যবিত্তীয় মানসিক টানাপড়েন। বোঝা যায় কী তীব্র শ্লেষ আর পরিহাস! দেখা যায় শেষ মুহূর্তে আশার আলো।
দ্বিতীয় গল্পটিও মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক। নাম ‘জনৈক অপদার্থ পিতা’। ম্যালেরিয়া আক্রান্ত ছোট অবুঝ শিশুকে নিয়ে বাবা আজাদ ময়মনসিংহ শহরে যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। পথিমধ্যে মিলিটারিরা বাস আটকায় তল্লাশির জন্য। অবুঝ শিশু বাবাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। বাবা আজাদ তার বোঝার উপযোগী করে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়। কথা বলে। শুধু বলে না, এই বাস আটকানো শুধুই তল্লাশির জন্য নয়, নয় শুধু গুলির বাক্স বহন করার জন্য। এটা যে অকারণ অনেক মানুষের জীবনকে পরপারে পাঠানোর একটা বাহানাও, সেটা আর বলতে পারে না বাবা। আজাদ জানে এখন তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে লাইন করে গুলি করার জন্য। অবুঝ শিশু জানে না সেটা। আজাদ জীবনের গল্প করে যাচ্ছে শিশুর সঙ্গে। শিশু মুগ্ধ আর আশাবাদী হচ্ছে। আর অপেক্ষা করছে কখন আম্মুর কাছে যাওয়া যাবে, তা নিয়ে। শুধু সে ভেবে পাচ্ছে না অন্য মানুষগুলো কেন অকারণে কান্না করছে! কারণ একটু পরই তো মিলিটারিরা ছেড়ে দেবে তাদের। ততক্ষণ তর সইতে পারে না শিশু কাজল। মিলিটারিরা রাইফেল ওপরে তোলে। শিশু কাজল জানে না কী হতে যাচ্ছে। বাবা বলেন ফিসফিস করে, কাজল, তুমি কি সেই বোকা রাজার গল্পটি শুনতে চাও? কাজল বলে, হ্যাঁ সে শুনতে চাই। আজাদ গল্প বলা শুরু করে। কাজল হাসিমুখে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে গল্পটি শোনার জন্য। অনেকবার শুনেছে সে গল্পটি। আজাদ জানে, পুরোটা শুনতে না পারলেও ক্ষতি নেই।
খুব সহজ সরল আর সাবলিলভাবে এগিয়ে যাওয়া একটি গল্প। অবুঝ শিশুর শাদা চোখ আর সরলতা। বাবা আজাদের বিপন্নতা আর করুণ আর্তনাদ।
আমার বিবেচনায় গ্রন্থটির শ্রেষ্ঠ গল্প ‘ওয়ার্কশপ’। সরকারি কলেজের ইংরেজির শিক্ষক মতিন উদ্দিনের ছোটগল্পের বই ‘নিঃশব্দ সারথী’ ডিসেম্বর মাসে জাতীয় পুরস্কার পেয়ে যাওয়ার পর তাকে নিয়ে মফস্বল শহরে তুমুল হৈ চৈ শুরু হলো। এরই অংশ হিসেবে তরুণ লেখকরা তাকে একটি ওয়ার্কসপের প্রধান অতিথি করে নিয়ে যায়। লেখককে অনুরোধ করা হয়, তিনি একটা গল্পের অর্ধেকটি বলবেন। বাকি অর্ধেক তরুণ লেখকরা তাদের কল্পনা ও সৃজনশীলতা দিয়ে লিখবে। পরে এগুলোর যুক্তিযুক্ততা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
লেখক যে গল্পটি বললেন, তা রীতিমতো এক নৃশংস চিত্র। তরুণ লেখকদের কাছে যেন সেটা এক নিদারুণ মাইন্ড গেম। লেখক বললেন, স্ত্রী ও দুই সন্তান হাসু ও নিসুকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যায় একজন মানুষ। দিনে দিনে অনেকদিন যায়। লোকটা ফিরে আসে না। চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ। একদিন গ্রামের মানুষ আতঙ্কে নীল হয়ে দেখলো, তাদের গ্রামে এসে জড়ো হয়েছে একদল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তাদের পথ দেখিয়ে আনছে একজন এই দেশীয় অনুচর। অনুচরটি পথ দেখিয়ে দেখিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নিয়ে আসে হাসু আর নিশুর বাসায়। দেশীয় অনুচর হাসু নিশুর মাকে দেখিয়ে বলে এই মেয়েটির স্বামী পাকিস্তানের শত্রু। ইসলামের শত্রু। মানুষটি মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি মেজরটি মেয়েটিকে দেখে বলে লাহোরে ফেলে আসা তার প্রেয়সীর কথা মনে পড়েছে। এজন্য মেয়েটির শাস্তি লঘু করে দিতে চায় সে। মেজর বলে, তার স্বামী যে অপরাধ করেছে, তার শাস্তি হিসেবে আমি তার মাত্র একজন সন্তানকে হত্যা করব। আমি সেই সিদ্ধান্তটি এই মেয়েটির হাতে ছেড়ে দিতে চাই। সে নিজেই ঠিক করুক তার দু’জন ছেলের মাঝে কাকে সে বাঁচিয়ে রাখতে চায় আর কাকে সে মেরে ফেলতে চায়। যাকে যে আমার হাতে দেবে তাকে আমি এই গাছটার সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারব। গুলি করার ঠিক আগের মুহূর্তে সে অবাক হয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে—কী চমৎকার হবে না ব্যাপারটা?
এইটুকু বলে লেখক মতিন উদ্দিন চুপ করে রইলেন। তার কথা বলার ভঙ্গি ভালো। সবাই যেন দৃশ্যটি চোখের সামনে দেখতে পেল। শ্রোতদের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তারা যেন এক ধরনের আঘাত পেয়েছে। যখন মিলিটারি এসেছে তখন তাদের মুখে হাসি নেই। তারা ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছে। ছোট হাসুকে বুকে চেপে ধরে রেখেছে মা। নিশুকে ধরে রেখেছে এক হাতে। হাসু আর নিশুর চোখে মুখে যত না আতঙ্ক তার চেয়ে বেশি বিস্ময়। কাকে বেছে নেবে তার মা?
শেষোক্ত প্রশ্নটি রেখে লেখক মতিন উদ্দিন তার গল্পের অর্ধেকটুকু শেষ করেন। তার পর বলেন উপস্থিত তরুণ লেখকদের। তোমাদের বলতে হবে মা কাকে বেছে নেবেন।
একধরনের অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে চারিদিকে। যুক্তিতর্ক চলতে থাকে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো উপসংহারে আসতে পারে না কেউ। আসলেই কি কেউ সুনির্দিষ্ট উপসংহারে আসতে পারবে উল্লিখিত বিষয়টি নিয়ে!
মুহম্মদ জাফর ইকবাল এভাবেই মর্মমূলে আঘাত করেন। দেখিয়ে দেন মুক্তিযুদ্ধের নির্মম বাস্তবতাটুকু। আলোকপাত করেন এর সংবেদনা নিয়ে। এই সংবেদনার কোনো সংজ্ঞা হয় না। এই সংবেদনার কোনো সংজ্ঞা নেই। এর কোনো মাপকাঠিও নেই। তবে বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত রূপরস ও সংকটের উপলব্ধির ক্ষেত্রে এক সূক্ষ্মতর অনুভূতির প্রলেপ রয়েছে। কতিপয় মানুষের ব্যক্তি-উপলব্ধিকে সংশ্লেষ করতে গিয়েই তিনি জড়িয়ে দেন পরিব্যপ্তির মহাজালে। এই মহাজাল ছিন্ন করা খুব কঠিন।