ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাসের দু’টি ধারা থাকে। এক, সময়টা ঐতিহাসিক, চরিত্রগুলো কাল্পনিক। দুই, সময় ও চরিত্র দু’টিই বাস্তব। এমরান কবির দ্বিতীয় ধারাটি বেছে নিয়েছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দ্বিতীয় ধারাটি নিয়ে কাজ করা বেশ কষ্টসাধ্য। কারণ তাকে একই সঙ্গে সময়, চরিত্র, ঘটনা ও ঘটনার পরম্পরার সমন্বয় সাধন করতে হচ্ছে। পাশাপাশি যেহেতু সাহিত্যকর্মটি উপন্যাস নামীয় পদবাচ্যের দাবিদার, সেহেতু সেখানে উপন্যাসের দায়ও মেটাতে হচ্ছে। একইসঙ্গে এই দুইয়ের সমন্বয় একটু কষ্টসাধ্য বৈকি।
কারণ লেখক যে উপাদান ব্যবহার করছেন, তা নন-ফিকশনাল। ইতিহাসের নির্জলা সত্য। সেখানে সন-তারিখ, সময়, পাত্রপাত্রী, পটভূমি সবই জানা। কিন্তু বিষয়টাকে উপন্যাসের মোড়কে উপস্থাপন করতে হবে। অর্থাৎ মূল উপাদানগুলো নন-ফিকশনাল কিন্তু লেখক কাজ করছেন ফিকশন নিয়ে। এই দুয়ের সমন্বয় সাধন করে, উপন্যাস যা যা দাবি করে, তা মিটিয়ে, ইতিহাসের সত্যের কাছে দায়বদ্ধ থেকেও যে সার্থক উপন্যাস লেখা যায়, তা আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে একেবারে বিরল নয়। সে ধারার আরেকটি সংযোজন এমরান কবিরের নীল বোতাম উপন্যাস।
পটভূমি হিসেবে লেখক বেছে নিয়েছেন তার নিজ জেলার বগুড়া শহরকে। পঁচিশে মার্চের পূর্বাপর ঘটনা থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধের কমান্ড কাউন্সিল গঠন, পরিকল্পনা এত নিঁখুতভাবে করা হয়েছিল ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের নেতৃত্বে যে, সারাদেশের পতন হলেও বগুড়া মুক্ত ছিল মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত। এরই মধ্যে কযেকটি সফল অপারেশন সম্পন্ন করা হয়। যেমন আড়িয়ার বাজার ক্যান্টনমেন্ট দখল, পাকসেনাদের গ্রেফতার, অস্ত্র উদ্ধার ইত্যাদি ছাড়াও বগুড়ার মূল শহরে প্রবেশের একাধিকবার ভয়াবহ যুদ্ধে পাকসেনাদের পর্যুদস্ত করে তাদের বগুড়া ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল।
এরপর শুরু হয় অন্য যুদ্ধ। ১৯ এপ্রিল কলকাতার লর্ড সিনহা রোডে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর কাছে গাজীউল হকের নেতৃত্বে এম আর আখতার মুকুল, খন্দকার আসাদুজ্জামান, মজিবর রহমান এমপি, ডাক্তার জাহিদুর রহমান এমপি বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন, অস্ত্র চান ও স্টেট ব্যাংক লুটের ব্যাখ্যা দেন।
বোঝা যাচ্ছে—এ উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছেন গাজীউল হক। আরও রয়েছে বগুড়া শহরতলীতে অবস্থিত এক সম্ভ্রান্ত পীরবাড়ির মর্মন্তদ কাহিনী। পীরবাড়ি হলেও প্রগতিশীল চেতনা এবং এই পরিবারের কয়েকজন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অপরাধে একরাতে সতেরোজনকে শহীদ করে দেওয়া হয়। এমনকি মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পীরসাহেব যখন ফজরের নামাজ পড়ার জন্য দুই মিনিট সময় চান, তখন মুসলমান নামধারী পাকিস্তানিরা সে সুযোগও দেয় না। লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে একইসঙ্গে তাদের শহীদ করে দেয়।
কিন্তু বগুড়া মুক্ত হলো কিভাবে? সেই পরিকল্পনা যখন শুরু হয়, তখনই উপন্যাসের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি শুরু। শুরু হয় কৌতূহল।
কলকাতা থেকে ফিরে পীরবাবার ছদ্মবেশে ভাষা আন্দোলনের নায়ক গাজীউল হক ঢুকে পড়েন বগুড়া শহরে। মহাস্তান মাজার থেকে তিনি যখন বের হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকেন, তখন তার সঙ্গে একটি কুকুর আসতে থাকে। তিনি ডিসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। এক বিহারীকে তিনি বশ করেন নিজেকে পাকিস্তানপন্থী বলে। তারা হাঁটতে থাকেন বগুড়া শহরে। হাঁটছেন গাজীউল হক। বিহারী কালাজি। তাদের পেছনে পেছনে একটি অজ্ঞাত কুকুর। একাত্তরের আগস্টে তাদের ভেতরে রচিত হয়ে গেছে কোনো না কোনো সম্পর্ক। পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে বগুড়া শহর। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে গুলির শব্দ। বাতাসে লাশের গন্ধ। পদে পদে মুত্যুর ঝুঁকি। এরকম এক পরিস্থিতিতে কী সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে এই তিন ধরনের প্রাণীর ভেতরে! এমরান কবির নীল বোতাম উপন্যাসে সেই সম্পর্কের সন্ধান করেছেন।
হৃদয়ে কবিতার পেলব মাখা পীরবাড়ির তরুণ ছেলে জিন্নাহ। ভারতীয় মেজর ইন্ধুর সিং-এর কাছে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে তিনি হয়ে গেলেন শোয়েব শাহরিয়ার। ইতোমধ্যে বগুড়ায় ঘটে গেছে নৃশংসতর এক গণহত্যা। তিনি জানেন না, একসঙ্গে সতেরজনকে শহীদ করে দেওয়া হয়েছে। সতেরজনের এগারোজনই তার পরিবারের।
পঁচিশ বছর পর পীরবাড়িতে এক তরুণী আসে। শহীদ জননী তরুণীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। বলেন, তোমাকে দেখতে জলিলের মতো লাগে কেন?
অকুতোভয় গাজীউল হক এগিয়ে যান। তিনি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোর তথ্য নেন। বিহারী একজন তাকে বিশ্বাস করে অনেক তথ্য দিচ্ছে। তিনি কখনো কখনো আনন্দিত হচ্ছেন। আবার বাঙালি নিধনের কথা শুনে ব্যথিত হচ্ছেন। তার জোব্বা থেকে খসে পড়ছে এক একটি নীল বোতাম। সে নীল বোতাম গড়িয়ে গড়িয়ে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকছেন গাজীউল হক। কেউ দেখছে না বোতামগুলো মাঝে মাঝে হেসে উঠছে। মাঝে মাঝে জোসনার আলো ছড়াচ্ছে।
শহীদ জলিলের রেখে যাওয়া ডায়রি পড়ছে তার মেয়ে পঁচিশ বছর পর। বুকে আগলে রেখে শুয়ে থাকছে। ঘুম লাগছে না। ডায়রি থেকে না-দেখা বাবার গয়ের গন্ধ পাচ্ছে যে। বাবার রেখে যাওয়া একমাত্র শার্ট, হাত রুমাল আর ডায়রি থেকে আসা গন্ধ যে একই। এমনকি পঁচিশ বছর পর বাবার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় গ্রামে ঢুকেও ওই একই গন্ধ। বাবা নেই। বাবার গায়ের গন্ধ নিয়ে এক সন্তান পঁচিশ বছর পার করছে। তাকে সারাজীবনই পার করতে হবে বাবার গায়ের গন্ধ নিয়ে।
জোসনা রাতে বাবার ডায়রি খুলছে শহীদ কন্যা। সেখান থেকে খসে পড়া বোতামটিও কেন যে নীল! হাফেজ আশরাফ আলী গভীর চিন্তায় মগ্ন। গাজীউল হক তাকে কয়েকটি কাজ দিয়েছেন। তিনি কয়েকটি চিঠি দিয়েছেন বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। অভাবের সংসারে মন না দিয়ে তিনি চিঠিগুলো পৌঁছে দিচ্ছেন বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে। ধরা পড়ছেন। নির্যাতিত হচ্ছেন। ঘরে নতুন বউ ও বৃদ্ধা মা। নিরাপত্তাহীন। গাজীউল হক তাকে কয়েকটি বোতাম ও একটি ডায়রি দিয়েছেন। বলেছেন, পরে এগুলো নেবেন। কিন্তু বগুড়া শহরে দ্বিতীয়বার ঢোকার পর তাকে পাকিস্তানিরা মেরে ফেলেছে বলে শোনা যাচ্ছে। হাফেজ আশরাফ গভীর চিন্তায মগ্ন এই বোতামগুলো ও ডায়রিটা তিনি এখন কী করবেন!
উৎকণ্ঠা, রহস্য, ব্যাংক ডাকাতির ফলে নৈরাজ্য, স্থানীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব, কিন্তু গাজীউল হকের হস্তক্ষেপে এগুলো মুক্তিযুদ্ধের ব্যয়ে ব্যবহার, স্থানীয় নেতা, ছাত্র, কৃষক, সাধারণ জনগণ সবার অংশগ্রহণ এবং অবদান তুলে এনেছেন এমরান কবির। আরেকজন মহান ব্যক্তির কথা বিশেষভাবে তিনি তুলে এনেছেন। যিনি ডাক্তার কছির উদ্দিন তালুকদার। তিনি এ অঞ্চলের সবার অভিভাবক তুল্য। তার বাড়িতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। তার বাড়িটি হয়ে উঠেছিল আক্ষরিক অর্থেই এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের হেডকোয়াযর্টার। যা স্থানীয়ভাবে হোয়াইট হাউস নামে পরিচিত ছিল। মধ্য এপ্রিলে বগুড়ার পতনের পর পাকিস্তানীরা এ বাড়িটিসহ গাজীউল হকের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। এমনকি বয়োবৃদ্ধ এই মহান মানুষটিকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গিয়ে এক পুরাতন কবরস্থানে জীবন্ত শুয়ে দিয়ে সেখানে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। মৃত্যুর পর মানুষকে কবরে শুয়ে দেওয়া হয়, পাকিস্তানিরা কবরে শুয়ে দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে।
গাজীউল হকের মানসগঠনে বহুভাষাবিদ ডক্তর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিশেষ ভূমিকা ছিল। এ উপন্যাসে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর উপস্থিতি বাড়তি পাওনা হিসেবে বিবেচিত হবে।
ইতিহাস তো ইতিহাস, উপন্যাস তো উপন্যাস। দুটোর টেমপারমেন্ট আলাদা। কিন্তু একইসঙ্গে যদি উপন্যাস পড়তে গিয়ে ইতিহাসের অন্য সবকিছু উপন্যাসের মতো মনে হয়, তখন ইতিহাস পড়ার বাড়তি চাপ মনে হয় না। এমরান কবিরের এ উপন্যাসখানিতে এ দুই উপাদানের সুষম সমন্বয় সাধিত হযেছে, যা পাঠককে প্রকৃত ঐতিহাসিক সত্যনিষ্ট উপন্যাসের স্বাদ গ্রহণ করাতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস।
নীল বোতাম
এমরান কবির
প্রকাশক: বেহুলাবাংলা
প্রকাশকাল: এপ্রিল, ২০১৬
প্রচ্ছদ: মানব
মূল্য: ১৬৫ টাকা