গ্রামে ফেলে এসেছি ঝকঝকে রূপালি নদী, সবুজে মোড়া দিগন্ত বিস্তারী মাঠ; সোনালী ধানের মুল্লুকও। আর ওই লাল-সবুজ মরিচের ক্ষেত, রাস্তার মোড়ে-মোড়ে পান্থশালা—বটবৃক্ষ। এসব ফেলে একদিন জীবিকার টানে আমরা এসেছি এই দূষিত নগরে—ইট-কাঠ-পাথরের শহরে। এখন সবুজ আর মাটির অভাবে, মুক্তনিঃশ্বাস আর বিশুদ্ধ বাতাসের অভাবে আমরা হাঁফিয়ে উঠেছি। চারিদিকে হৃদয়হীন মানুষ। মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা দেখছি আর ফেলে আসা গ্রামের সহজ-সরল জীবন ফিরে পেতে হা-পিত্যেশ করছি। আমাদের মনে হতে থাকে শহর যেন মানুষের এক বৃহৎ অ্যাকুরিয়াম। শরাফত হোসেন এই বোধকেই শিল্পরসে ব্যঞ্জিত করেছেন তাঁর ‘ফিরে আসি কাচের শহরে’ কাব্যে।
এই কাব্যে মোট কবিতা সংখ্যা ৩৯টি। কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় শরাফত দেখিয়েছেন কবিকেও অন্যদের মতো সবুজ গালিচা, সোনাফলা উর্বর ধানীমাঠ ছেড়ে কাচের শহরে, সিসার শহরে আসতে হয়েছে জীবিকার টানে। বারবার গ্রামে ফিরে যেতে চাইলেও যেতে পারেন না। এক আধবার গেলেও থাকা হয়ে ওঠে না। তাকে ফিরেই আসতে হয় এই জীবিকার নগরে, সিসার শহরে। সেটা কারণে-অকারণে। তবে, অতি অবশ্যই অনিবার্যভাবেই। ফেলে আসা সবুজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনা তাঁকে কুঁকড়ে দেয়। তাই ‘রোদের শরীর’ কবিতায় কবির উচ্চারণ করেন—
আর এভাবে বিচ্ছিন্ন হলে নক্ষত্রও ঝরে পড়ে
ফিরে আসি আমরা আবার
এই সিসার শহরে মানুষের ভীড় ঠেলে-ঠেলে
জন্মভিটা এক ম্যাগনেটাতীত মন্ত্রক। এর টান থেকে কেউ কি মুখ ফিরিয়ে দূরে, কাচের শহরে পিছুটানহীন জীবন কাটাতে পারে? আর কবির পক্ষে কি আদৌ সম্ভব?
শহরের নিয়ন আলোয় কবি চাঁদের আলোকে ফিকে হতে দেখেন। কবি যখন হৃদয়হীন শহরের চাঁদ দেখেন, তখন স্মৃতির পাতা খুলতে থাকে তাঁর। আর তখন মনে থাকে গ্রামের অমলকান্তি চাঁদের যৌবন উপচানো রূপ—সেই অরূপ রতন। কিন্তু সে কেবল স্মৃতির জাবর কাটা। বাস্তবে কবি কিংবা আমরা সর্বোপরি গ্রাম ছেড়ে নগরে ছুটে আসা মানুষেরা উপায়হীন হয়ে বসে পড়ি পাথুরে শহরের ফুটপাতে, কেউ-কেউ বহুতল ভবনের ছাদে। তখনই হয়তো কবি দেখেন নগরতাপে পুড়ে যাওয়া বিবর্ণ চাঁদের ছবি।
তবে, এই দেখা, সবুজ স্মৃতিমন্থন কি কেবলই কবির একার মনোরাজ্যে ঘটে? জন্মভিটাপ্রেমী এ কবির মতো আর কারই-বা এমন শহুরে অনাঘ্রাত অভিজ্ঞান রয়েছে? বিশেষত কবি যখন উচ্চারণ করেন—
আলো-অন্ধকারে যারা হাঁটে, গান গায়
কথা বলে ফিসফাস
অনাকাঙ্ক্ষিত জন্মের দাগ মনে পড়ে তাদের কথায়।
তখন আমাদের বুক হুহু করে ওঠে। মন দ্রোহ করে, বলে, ফিরো চলো মাটির টানে। যদিও এই হুবহু এই ফিরো চলো মাটির টানে কথাটি রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু আমরা যারা নাড়ির বন্ধন ছিঁড়ে সিসার শহরে এসেছি, আমাদের মনে হয়, কথাগুলো আমাদের, একান্তই আমাদের। তবে, আমরা সাধারণ মানুষ কিংবা এক-আধ পঙ্ক্তি কবিতা আওড়ায় তারা কবির মতো নিজের উপলব্ধি প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু কবি পারেন। আর প্রকাশ করতে পারেন বলেই এভাবেই প্রকাশ করেন—
ফেলে আসা জন্মভিটা—ভেসে ওঠে স্মৃতির পাতায়
তবু ফিরে যেতে চাই না সেখানে
ডুবে থাকি এইখানে—বিষণ্ন শহরে,
সিসার মতন তপ্ত চাঁদ, জন্মদাগ দেখে দেখে।
শরাফত প্রায় প্রতিটি কবিতার দেহ-প্রাণ নির্মাণ করতে গিয়ে কোনো না কোনোভাবে বিষণ্ন শহরের মেকি আলো-অন্ধকারেজন্মভিটার সবুজস্মৃতিতে ডুবে গেছেন। এখানেই শরাফতকে মনে হয়, একা এবং স্বতন্ত্র। তাঁর কবিতায় নাগরিক জীবন ও জন্মভিটার সবুজস্মৃতির ঘোর জাগে।
‘সব কিছু খালি হয়ে যায়’ কবিতায় দেখতে পাই, শরাফত কতটা গ্রামমগ্ন, কতটা নগর-পর্যবেক্ষক। একইসঙ্গে কতটা সময় সচেতন। আসুন মিলিয়ে দেখি—
শহুরে নিয়ন আলো নানা রঙের প্রলেপে
গ্রামীণ সারল্য নগ্ন করে
…
দোয়েলের শিস আজ খাঁচাবন্দি
বন্দি শান্তিপ্রিয় পায়রার সঙ্গমের রাত
…
রাতগুলো ফেরি করে মৃত্যুগন্ধ দুঃসময়।
নগর মানুষকে কী দিয়েছে? যতটা জীবিকার নিশ্চয়তা দিয়েছে, তারও বেশি কেড়ে নিয়েছে তার বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। আর্থিক তুচ্ছ আর্থিক স্বচ্ছলতা দিয়েছে ঠিকই; কিন্তু কেড়ে নিয়েছে তার ব্যক্তিগত রুচি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তাই কবির মনে হয়, এই শহরের ‘রাতগুলো ফেরি করে মৃত্যুগন্ধ দুঃসময়।’ এটা শরাফতের উচ্চারণ স্পষ্ট।
_________________________________________________________________________________________________
শেষ পর্যন্ত এই কবি নিরাশাবাদী নন। তিনি আশাবাদী। তাই ‘আলোর দিকে’ কবিতায় বলেন—‘তিতাসের এলোচুলে বিলি কাটে সোনালি সকাল।’ আর তখনই তাঁকে আমাদের মনে হতে থাকে, মানবজাতির জন্য আশার বার্তাবাহক। যিনি সমস্ত দুঃখকষ্টকে স্বীকার করেও স্বপ্ন দেখেন মঙ্গলময় ভবিষ্যতের। জীবন কঠোর সংগ্রামের অধিক্ষেত্র, শরাফত হোসেন সে জীবনের একজন একনিষ্ঠ বাহক—‘ফিরে আসি কাচের শহরে’র ছত্রে ছত্রে তার উজ্জ্বল উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে।
__________________________________________________________________________________________________
জীবনের নশ্বরতার মধ্যে ডুবেও যে মানুষ প্রচণ্ড স্বপ্নবান, তিনি কবি। তাঁর উপলব্ধি তাই আমাদের উপলব্ধি—‘ ডুমুরের ডগায় লেপ্টে থাকা জীবনের স্বাদ-গন্ধ ভুলে/বাঁশের ফোকরে চোখ মেলে দুজন স্বাপ্নিক।’ ‘সময় ফুরিয়ে গেলে’ কবিতায় কবির আক্ষেপ, প্রকটিত। নগরে এসেও শৈশবস্মৃতি তাকে বেসামাল করে দেয়। তাই নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেন, প্রবোধ দেন নিজেকে নিজেই। বলেন—
মাথার ভেতর ডাংগুলি, গোল্লাছুট, লাইখেলা
বানের পানিতে দাপাদাপি—হইয়া লো, পুঁটি লো
মাছ ধরার কৌশল মুখিয়ে তোলে কাচের শহরে
বাস্তবতায় ফেরি হয়ে যায় স্পর্শিক শৈশব
বেঁচে থাকার সহজ নিয়ম রপ্ত হয় না
কেবলই সময় ফুরিয়ে যায়।
এই কেবলই সময় ফুরিয়ে যাওয়া কি শুধুই ব্যক্তিকবির আক্ষেপ? না কি আমাদের সামষ্টিক বেদনারও অংশ? কেন বেঁচে থাকার সহজ নিয়ম রপ্ত হয় না তার— এই দুঃখ একা কবিরই নয়, আমাদেরও। এই আক্ষেপ নিয়েই কবি নগরের ঘুড়িজীবন কাটান। আর হারিয়ে যাওয়া মারবেল শৈশবের দৃশ্য ধারণ করেন। শরাফত হোসেনের জন্মভিটাপ্রেম ভৌগলিক সীমান্তের বেড়া ঠেলে ঢুকে পড়ে পরদেশি ললনার ঠোঁটে। সেখানে আঁকেন এক নতুন মানচিত্র। তার দেশপ্রেম অবশেষে বিশ্বপ্রেমে উপনীত হয়। এই জন্মভিটাপ্রেমীর মতো নগরজীবনে কে আর এমন সহজে খাপছাড়া জীবন নিয়ে রেলপথে হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে যায় সমুদ্রের তলদেশ! নগরের পথে চলতে চলতে কবির উপলব্ধি—‘ও পথে গেলেই দুঃখ ধরে চেপে।’ কবি খুব দুঃখ করে বলেন, ‘ভুলে যাচ্ছি সব’। বলেন—
আমাদের নগরে সবুজ ঘাস আজ বিলীন
ঘামের দামে রাত্রি কেনে প্রহরী ফুৎকারে, চিৎকারে
বের হতে হতে ক্রমশ ভেতর ভুলে যাচ্ছি
ভুলে যাচ্ছি দিন আর রাতের ফারাক।
সিসার শহরে এসে কবি ক্রমাগত উপলব্ধি করেন ধাতব যন্ত্রণা। তার প্রকাশ করেন—‘অস্তিত্বে মিশে যাওয়া ধাতব যন্ত্রণা বিশেষ /তীব্র চিৎকারে বেরিয়ে আসতে গিয়ে ভেতরেই আটকা পড়ি /কেবলই দূরত্ব বেড়ে যায় তোমাদের সঙ্গে।’ আহা জীবিকা তাড়িত এই জটিল-নিষ্ঠুর নগরীর প্রতি কবির যেমন ক্ষোভ রয়েছে রয়েছে নিজের প্রতি অভিমানও। আর রয়েছে স্বজনদের সঙ্গে অনিবার্য দূরত্বের বেদনাও। তবে, শেষ পর্যন্ত এই কবি নিরাশাবাদী নন। তিনি আশাবাদী। তাই ‘আলোর দিকে’ কবিতায় বলেন—‘তিতাসের এলোচুলে বিলি কাটে সোনালি সকাল।’ আর তখনই তাঁকে আমাদের মনে হতে থাকে, মানবজাতির জন্য আশার বার্তাবাহক। যিনি সমস্ত দুঃখকষ্টকে স্বীকার করেও স্বপ্ন দেখেন মঙ্গলময় ভবিষ্যতের। জীবন কঠোর সংগ্রামের অধিক্ষেত্র, শরাফত হোসেন সে জীবনের একজন একনিষ্ঠ বাহক—‘ফিরে আসি কাচের শহরে’র ছত্রে ছত্রে তার উজ্জ্বল উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে।