মোনাজাতে ঈমাম বলে যান সম্ভব-অসম্ভব আর্জি-অনুরাগ, তাতে আমিন আমিন বলে সমবেত কণ্ঠ মিলিয়ে নেয় যাবতীয় স্বর কিন্তু সাহিত্যকে সাধনার নামান্তর ডিসকোর্স হিসেবে মেনে নিলেও সাহিত্যকর্মীরা সব কিছুতে আমিন বলেন না কিংবা একই কাতার আর সময়ের বাসিন্দা হয়েও আলাদা হয়ে যান, নিজের একটা জগত নির্মাণ করার বাসনায়; গোপন কী প্রকাশ্য এই বাসনার দরুণ একেকটা কবিতা কী সৃজনকর্ম আলাদা রঙ পায়।
এখানে বহুবিধ প্রশ্ন সামনে আসা স্বাভাবিক, জসীমউদ্দীন আর জীবনানন্দ সমসাময়িক হয়েও মেরুদূর ব্যবধান কেন রচনারুচিতে? রবীন্দ্রনাথের সমকালে বা তার আগে-পরে অনেকানেক সাহিত্যিক সক্রিয় থাকলেও কতজনকেই বা আমরা মনে রাখি? অবশ্য মনে রাখার সঙ্গে রাজনীতির গন্ধ থাকে, যুগযুগে সাহিত্যের রাজনীতি বড় নিয়ামক ছিল ঢের। আজকের যুগেও, শুধু প্রযুক্তিবাহিত সক্রিয়তার দরুণ অনেককে কবি হতে দেখা যায় লাইক-কমেন্টের জোরে, কেউবা নিজের মাস্টারিকে সাহিত্যের পণ্ডিতি ফলাতে আসেন লাজের মাথা খেয়ে। অথচ আমরা বিপুল বিস্ময়ে দেখি, কোনো কোনো তরুণ ভেতরকার আলোটুকু সামনে নিয়ে আসেন সমানে। যেহেতু কবিতার কোনো সংজ্ঞাকেই আমরা আদি ও আসল হিসেবে মানতে চাই না, তার সবচে’ বড় বেনিফিশিয়ারি হচ্ছেন অকবিরা; সমূহ অত্যাচারে অতিষ্ঠ বেশুমার শব্দঝঞ্জাট দেখলে তা অনায়াসেই দৃশ্যমান হয়। কালের আর্বজনা হিসেবে সেসব ভাগাড়ে ফেলে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট উপলক্ষ দাঁড় করিয়ে দেন তরুণ কবিরাই। সবকিছুতে আমিন না-বলা উজ্জ্বল এক তরুণ একরাম আজাদ; এবারের গ্রন্থমেলার আগেই তার নিবেদন ‘নিষিদ্ধ নুন’।
আজাদের সহজাত প্রবণতা কবিতার শরীরেজুড়ে দেওয়া বিবৃতি; যা আগের দুই কাব্যের মতো বলবৎ থাকে বর্তমান কিতাবেও। এই বিবৃতির আবার বহুবিধ সৌন্দর্য আছে, যা একটানে পড়ার মতোন, গল্পের আলো-আধাঁরী তাতে খেলা করে, চিত্রকল্পের দারুণ সাক্ষাৎও হয়। এই মোলাকাতে পাঠক তুমুলভাবে দুঃখের সুষমা উপভোগ করবেন পরিপার্শ্বের ভণ্ডামি ও ভালোবাসাসমেত। আজাদ নিজেকে ক্ষয়ে এঁকে যান অনেকের মুখ, যেখানে সুখ থাকে বেশুমার, প্রশ্ন থাকে অনেকান্ত। যাবতীয় সিস্টেমকে আজাদ প্রশ্নবিদ্ধ করার সাহস দেখান, তুলে আনেন সতেজ সরল। কাব্যস্থিত প্রথম কবিতা ‘সাইজ’ পাঠ শেষে অনেকেই শ্লীলতার সীমা দেখাবেন অথচ আমরা প্রত্যেকেই কবিতার কথক কিন্তু মজা নেই ছলিম দর্জি সেজে। এই সভ্যতা, অতদূরে না গেলেও, এই রাষ্ট্রযন্ত্রে কে তবে কার অধিকার পেয়েছে বিনা যুদ্ধে? এই না পাওয়া একজন কবি শব্দকে তীর বানিয়ে ছুড়তে পারে; নিজেকে প্রেমিক বানিয়ে অনর্গল সত্য বলা ছাড়া আর কী করার থাকে কবির? আজাদের বলার ভঙ্গিটি অদ্ভূত, দ্রোহে ভরা, এটাকে ভালোবাসা ছাড়া উপায় থাকে না।
এখানে আরেক সত্যকে কবুল করতে হয়, বর্তমান কবিতা-গল্প কিংবা নাটকেও প্রচলিত টোনের বহুল ব্যবহার দেখা যায়, যা মূলত হৃদয়জাত; এই শতাব্দীরই কবিতাস্বর হিসেবে মোটাদাগে যেটা চিহ্নিত করা যেতে পারে, এটা আত্মস্থ করেছেন আজাদ; কথার সপক্ষে প্রথম কবিতারই দুটো লাইন পড়া যাক, ‘দেশে এত এত প্রেমিক থাকতে অই বুড়া ছলিম দর্জিই ক্যান/ জানবে আপনার অ্যাকুরেইট সাইজ? আমারে পোড়াইতে?…’ এমনতর ভাষাবিন্যাস আজাদের কবিতায় ঢের দেখা যায়। একরাম আজাদের কবিতাপাঠে পাঠক খুব বিশ্বাস করবে তিনি মারাত্মক প্রেমের কবিতা পাড়ছেন, উত্তাল প্রেমের স্রোতে কবি দিশেহারা। আমাদের মনেহয়, আজাদ সময়ের হিসেবে গরমিল পেয়েই প্রেমিক সেজে যায়! রাষ্ট্রকে, সিস্টেমকে প্রেমিক বিনে আর কে আঘাত করতে পারে? প্রেমহীনে কিভাবে বাড়িয়ে দেবে মমতাময় দৃষ্টি? ‘অভাব’ কবিতার প্রথম প্যারাটা পড়া যাক, ‘অমীমাংসিত সুসাইড নোটের মতোন/ ভাঁজকরা বাজার-তালিকা নিয়ে রোজ হেঁটে আসছি সমস্ত শহর;/ আমার বাজেট ও প্যাকেট শূন্যই থেকে যায়।’ আড়াল দিয়ে কবি আমাদের শোনান রূঢ় বাস্তবতার কথা। নিজেকে কবি প্রকাশ করতে গিয়ে ব্যক্তিত্বহীন, স্ববিরোধী বক্তব্যে ভরা সময়ে আজাদ নিজেকে কেবলই প্রকাশ করে যান শব্দে, কবিতার মায়াজালে।
আজাদের প্রেম কখনো বা উৎসারিত হয় প্রকৃতি থেকে, দেশজ হালহকিকত থেকে; অনেকাংশে থাকে কামের তীব্র বাসনা। কামবিনে প্রেমের অস্তিত্বে অবিশ্বাসীরা কবির ‘কাতেল’ কবিতাটির কয়েক ছত্র পড়তে পারেন, ‘উরুর ভাঁজে গিয়ে আমি শহিদ হলাম/ নির্মম খুনি ছাড়া তবে তুমি আর কে হতে পারো?…মূলত প্রত্যেক প্রেমিকাই একেকজন কাতেল, যে রক্ত নয়, আয়ু নিয়ে খেলে আশেকের।’ পরস্পরের এই আকর্ষণে আশেকের কামনাকে কবি সাহসের সঙ্গে তুলে আনেন ‘ঈশ্বর সমীপে’ কবিতায়, ‘অতঃপর ঈশ্বর,/ হয় তোমার পৃথ্বী নারীশূন্য,করো…নয় আমার পাপকে জায়েজ করে দাও।’
প্রেমিকের সাহসকে কবি দ্রোহের পর্যায়ে নিয়ে যান অনায়াসে, বলে যান তাবত প্রেমিকের হৃদয়ের আর্তি। এর সঙ্গে যোগ হয় মিনতি। প্রেমের অমল ধবল রূপটির সঙ্গে রূঢ় তাচ্ছিল্যের সংযোগ হওয়া অস্বাভাবিক নয়, সেইহেতু আজাদ সচেতনভাবেই উচ্চারণ করেন, ‘বিশ্বাস করুন শায়লা, খোদার কসম, আজ কত বছর পর/ আমি আবার পুকুর ক্ষেত টিলা নদী জল জোঁক মাছ সবকিছু/ কত সহজে অল্প জমিনে খুঁজে পেয়েছি আপনার শরীরে!…একবার গ্রাম ঘুরাবেন, প্লিজ?’ মূলত আজাদের কবিতাভাষ্যেরই প্রতিরূপ যেন প্রাগুক্ত উদ্ধৃতি। আকুতির সঙ্গে আস্ত ভূগোল তুলে আনেন কবি। পাঠক হয়তো বলবেন, কবিরা প্রেমিক হলেই লাভ, এমনতর কবিতাভাষ্যে উজ্জ্বল হয় সময়ের অলিন্দ্য। ক্রমশ পুড়িয়ে, ক্রমশ নিজেকে জিজ্ঞাসার ভেতর নিয়ে এইরূপ কবিতাচর্চার মাধ্যমেই তরুণ শব্দশ্রমিকেরা তুলে আনছেন সময়ের মুক্তো। ‘নিষিদ্ধ নুন’ কবিতার শেষ চরণের শরণ নেওয়া যাক, ‘এখনই ভরা মৌসুম, চলো ফলাই ক’ফোঁটা নিষিদ্ধ নুন’। সেই হেতু কামার্ত মনোভাবের সমানে আজাদকে পাঠ নেওয়া যায় সত্য অথচ তার কবিতা দাবি করে আরও বেশি মনোযোগ, আরও বেশি সংশ্লেষমুখরতা।
‘কোটা’, ‘রাষ্ট্র’, ‘ঈশ্বর’ কবিতাত্রয়ী পাঠে পাঠকের স্মৃতিসংশয় হাতড়ে খুঁজতে পারে গালিব, নেরুদা কি হেলাল হাফিজের কবিতার পাঠবিভা। আজাদ নিজেকে উত্তরাধিকারের জাতক করেও এখানে একা হয়ে যান নিজস্ব ঢঙে। এমত বক্তব্যের সপক্ষে পড়া যাক তবে, ‘জুতোর ভেতর সেঁটে থাকা পা’র মতোন/ আমি জড়োসড়ো হয়ে আছি তোমার ভয়ে, স্বাধীনতা!’ কিংবা ‘ছাপ্পান্নো শতাংশের অলৌকিক অঙ্ক/ সেলাই করে দিলো তোমার ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল শরীর’ অথবা ‘ঈশ্বর বিষয়ক কথা আসলে আমার বাবার মুখটাই ভেসে ওঠে/ যিনি কি-না একজন বিত্তহীন মাঝি ছিলেন মাত্র!’ গরাদ কি তবে এজন্যই ডাকে কবিকে? এমনতরো সাহস আর বাস্তবতার সমীরণে আজাদের কবিতা দোলা দেয় তরুণের মনে। এক্ষণে স্মরণে রাখা যেতে পারে, প্রাগুক্ত কবির জন্ম মহেশখালীতে, জলহাওয়াশৈল মতিত এমন ভূগোল সাহস সঞ্চারে ভূমিকা রাখে বেশ, হয়তো এজন্যই অথবা কিছুই না, পাঠ আর বোধের সামিয়ানা। আজাদ ঘোরলাগা ভাষায় প্রশ্নের পর প্রশ্ন জুড়ে দেন দার্ঢ্য শব্দবন্ধে, যেখানে নিরন্তর সাঁতার কাটা যায়, পর্যটন সারা যায়। আচানক চিন্তাপুঞ্জের ঝিলিক কবিতায় পেয়ে পাঠক হয়তো নিজের অসহায়ত্বকেই ধিক্কার দেয় এই বলে, ‘মাঝেমাঝেই ভাবি, সমস্ত দৌড় তো ঘোড়াই দেয়, তবু রাশটা কত দরকারি।’
একরাম আজাদের কবিতার বহুবিধ সৌন্দর্যের অন্যতম অলঙ্কার কবিতার ভেতর বাসরত গল্পগাথা। কথামৃতে এসব গল্প পাঠককে দ্বন্দ্বে ফেলে দিতে পারে, ঘুরিয়ে আনতে পারে ভিন্ন স্বাদের কোরাস। নানা ফিরস্তি নিয়ে এসব কবিতাশরীরে জীবনের আয়নায় যাপনকে দেখার সুযোগ আছে বিস্তর। ‘জুতো’ কবিতাটি পাঠে আমাদের মনে পড়ে যায় হেমিংওয়ের বিশ্বজয়ী এক গল্পের কথা। সে যাগগে, আজাদের কবিতা নিয়ে, সাম্প্রতিক কবিতাপ্রয়াস নিয়ে অনেকানেক কথা বলার সুযোগ থেকেই যায় শেষতক। অনেকেই নিজেকে স্বাতন্ত্র্য করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে নিজের শক্তিটুকু। আবেগের বাড়াবাড়িতে শক্তির অপচয়ও কম দৃশ্যমান নয় এই সময়ে। কখনো বা মুক্তগদ্য আর কবিতার ফারাকে ভিরমি খেতে হয় পাঠককে। মুক্তগদ্যের রসালো ঢঙকে কবিতার নামে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে অনেকে। মূলত এ জায়গাতেই আজাদের কাছে আমাদের চাওয়া অনেক। পাঠকের চিন্তা পরে, প্রথমেই রুচি আর পরম্পরার নিক্তিতে মাপা চাই; যতই বিচ্ছিন্ন আর পরিবর্তিত সংস্কৃতি ও মধ্যবিত্তীয় অনুরাগে ভরা থাক সময়, আমাদের কবিতার মূল সুরটি মাটিলগ্ন, মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে, মানুষেরই শ্রমঘামকে আঁতরে রূপান্তর করতে হয় কবিকে।
দীর্ঘকবিতা লেখার শক্তি আজাদের কব্জিলব্ধ, তুচ্ছ বিষয়-আশয়কে সেঁটে দেওয়ার শক্তিও দৃশ্যমান তার কবিতায়, ফলত পাঠক ‘নিষিদ্ধ নুন’-এর শরীরে নিবেদন করতে পারে নিজেকে। আবেগের ভরে কেউবা বিভ্রান্ত হতে পারে, এ সুযোগ কবিই রাখে হয়তো বা। ‘আর যদি একটা গুলি চলে’ কবিতার মতোন, ‘তলপেটের ক্ষুধা’ কবিতার মতোন সৃষ্টিতে আজাদকে নিয়ে নানা কথার সুযোগ থাকে কিন্তু কবিতাকে কবিতার বিচারে, সময় আর স্বকালের সোপানে রাখতে হয়। ‘এখনো কি হয়নি সময় আগুন ছোঁয়ার, কিশোরী?’ এমত শব্দবন্ধে আজাদ মূলত আধমরাদের গা মেরে জেগে ওঠার ইঙ্গিত দিয়ে নিজেকে জারি রাখে মিছিলের সমুখে। কবিতা নিয়ে, কথা নিয়ে আমাদের এই কলহাস্যে; রোদন আর অগ্নিতাপে মোড়া নাগরিক প্রলাপে ‘নিষিদ্ধ নুন’ হতে পারে তারুণ্যের বিধিবদ্ধ শাস্ত্র-সম্ভার।
প্রিয় পাঠক, একরাম আজাদের হৃদয়ের খোঁজ খোঁজ করতে করতে তবে প্রবেশ করুন ‘নিষিদ্ধ নুন’-এর সীমানায়।
নিষিদ্ধ নুন
একরাম আজাদ
মূল্য: ১১৫ টাকা
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশনী: ঘাসফুল