জীবনভর পথ। নিঃসীম অন্ধকার। কবিতা এখানে আলোর ইশারা হতে উদগ্রীব। পথিকের মনে ও জীবনে অস্বস্তি, আগুন। কবিতা চায় স্বস্তি দিতে, শান্তি দিতে। কিন্তু কবিতা কেবল স্বস্তি ও শান্তি নয়। সে জ্বালায়, পোড়ায়, কাঁদায়, হাসায়, ভাসায়। সে নিজেই হয়ে ওঠে তপ্ত মরুর রাগী রক্ত, সাগরের দুঃসহ ক্রোধের চিৎকার। সে তা হয়, কিন্তু হয় জীবনের পক্ষ নিয়ে, বিনাশ ও পতনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। এখানেই তার জীবনময়তা, ধ্বংস ও বিপন্নতা উজিয়ে সৃজনের উজ্জীবনেই তার অঙ্গীকার!
আপনি জীবনের যাত্রী। আলো দরকার। কবিতা আপনার অন্তর্লোকের পরম গভীরতা ছেনে আপনার হাতে ধরিয়ে দিতে চায় আলোরূপী আপনাকে। আপনাকে দেয় নিজের আটপৌরে সীমানা পেরিয়ে যাবার প্রেরণা।নিজের মধ্যে খাবিখাওয়া আপনাকে বলে মানব-সংলগ্ন হতে। আবার একাত্ম হতে বলে মাটির সাথে, যেখানে অগণন প্রাণের মহফিল। যেখানে জীবন নিজের ধুলি দিয়ে সাজায় ধুলিময় বীজাণু।কবিতা কথা বলছে। অন্তর্গত জলপ্রবাহের তরঙ্গ নিনাদিত হচ্ছে। দু’টি প্রকৃতির মাতৃভাষা উচ্চারিত হচ্ছে। এক প্রকৃতি নিসর্গের,আরেক প্রকৃতি মানুষের। এই যে দুই প্রকৃতি, তার সঙ্গে আত্মীয়তার জোরে কবি লাভ করেন সার ও সুর। সেই সার যদি না থাকে, সুর আসবে কোথা থেকে?
কবি শামস আরেফিনের কবিতায় যখন সেই সুর শুনলাম, বোঝাই গেলো সার আত্তীকরণ না করে পারেন না এ কবি। আমার সামনে তার সদ্যজাত কাব্যগ্রন্থ নবজাত স্বপ্নরা। স্বপ্নগুলো বৃক্ষতলে ঝরে পড়া ভালোবাসার ঘ্রাণে উদ্বেল। বইটি দেখায় কবির ডুবসাঁতার। সাঁতার শেষে কবি আবিষ্কার করেন—‘মনকে মন দিয়ে অনুভব করার বাস্তবতা ভুলেছে সভ্যতা।’ ‘চাঁদের পরকীয়ামাখা সূর্যগ্রহণ’ তার দৃষ্টি এড়ায় না। কবি দেখেন, ‘শহরের গাছেরাও ফরমালিন জ্বরে ভোগে ক্লান্ত।’ ‘জীবিকার নির্মম বাস্তবতায় যে শহরে মন বিক্রি হয় এবং যেখানে স্বপ্নকে ছিনতাই করে ছেলেধরা সভ্যতা’, সেই শহরকে শামস আরেফিন বাইন তালাক দিয়ে দেন!
মনের শুকিয়ে যাওয়া দেখে বর্ষায় তার স্নান ও সতেজতার আয়োজন ও আহবানে প্রবুদ্ধ তার কবিতা। কবির দরকার প্রেম। কিন্তু এ প্রেম মানুষ হওয়ার তাড়নায় কাতর।
দুর্গত মানুষ ও প্রকৃতির গোঙানির শব্দে কাতর এবং জীবনের উত্থানের মন্ত্রে মুখর এক কাব্যগ্রন্থ নবজাতক স্বপ্নরা। উভয়ের যৌথতার এমন উচ্চসুর ও প্রণয়ের এমন স্ফূর্তি আজকালের কবিতায় খুব কমই চোখে পড়ে। শামসের কবিতা চিত্তপ্রকর্ষে বিত্তবান। তার শব্দ সংযমী, উচ্চারণে কিন্নরকণ্ঠী। কিন্তু সোচ্চার মনোভাব তার চারুতা ও মৃদুতার শরীরে মিশে আছে রোদের মতো। চিত্রধর্মিতা এ কবির অন্যতম কৃতী। যখন তিনি বলেন,
নৈরাশ্যের বোঝা বহন করা নদীমাতৃক স্মৃতি;
ঘুমিয়ে পড়ো গ্রীষ্মের সাহারা মরুভূমির তোষকে-
তখন আনকোরা এক দৃশ্যচিত্র প্রকৃতির দুর্গত বাস্তবতায় নিজেকে উন্মোচন করে। যে বাস্তবতায় মরুঝড়ের গোঙানিতে উপভোগ করতে হয় আর্সেনিক আহার! বাস্তবতার এ ছবি ভুলে যায় না রাজনীতির চেহারা, ক্ষতবিক্ষত সময় ও সমকাল। ফলে সে দেখে ও দেখায় সেই ক্ষমতাকে, যে,
তিস্তার সেচে স্বপ্ন না রুয়ে খরায় দৃঢ় করবে মসনদ
শকুনের খামচিতে ছিনতাই হতে দেবে মায়ের আঁচল।
মানুষ ও দেশের দুর্গতদশা তাকে করে বিচলিত। যেখানে ‘ক্ষমতার পা চাটতে চাটতে খসে যায় বিবেকের জিব, নকশিকাঁথার বদলে ক্ষমতার চাদর বোনা হয় কৃষকের হাড়ে’, সেখানে কবির আক্ষেপ, তিরস্কার ও আহবান বাতাসকে আন্দোলিত করে,
হায় দেশপ্রেম,
মরার আগে অন্তত একবার নেড়ি কুত্তার মতো কাঁই কাঁই কর !
শামস আরেফিনের দৃষ্টি একচক্ষু হরিণের মতো নয়। সে দেখে যা দেখার, যা প্রকাশ্য। সে দেখে যা দেখানো হয় না, আড়াল করা হয় যাকে। ফলে ‘বিরাজনীতিকরণের সুতো কীভাবে বুনছে আগামিকে’, সে জানান দেয় তার। উচ্চারণ করে সেই ভীতিকর স্তব্ধতাকে, ‘যেখানে স্বপ্ন দেখতে চোখের চেয়ে ঘুমের প্রয়োজন।’
তার এই দ্রষ্টব্যদ্রষ্টা চোখ এড়ায় না ধর্মবিক্রিকে, বিকৃতিকে। যা ‘বিবেকের প্লেটে উৎকোচের ঝোলে রান্না করা সততাকে খেয়ে ফেলে। যার পেছনে আছে ‘স্বপ্নখেকো ভূরাজনীতি’। শামস লেখেন,
আল্লাহু আকবার শব্দটাকে কতো সস্তায় বিকালে জবান
তুমি তো ইসলামের নতুন পাইকারি সবজি বিক্রেতা
তোমার বিশ্বাস যেনো গণিকাদের আদরমাখা সোহাগ
(স্বপ্নখেকো রাজনীতি)
শামস সামনে অগ্রসর হয়ে আরও খোলামেলা হন। প্রশ্ন করেন, আর কত টয়লেট পেপারের মতো ধর্ম ব্যবহার রাজনীতিতে? অতঃপর কবির তীব্র ও তীক্ষ্ম উচ্চারণ,
স্বপ্নখেকো ভূরাজনীতি তোমাকে বলি শোনো—
ধনতন্ত্র, জায়নবাদ, আইএস ও স্কাল অ্যান্ড বুন
এই সবই একে অপরের পরিপূর্ণ সমার্থক শব্দ।
এর মানে পরিষ্কার। শামসের কবিতায় বর্তমানের ছাপ স্পষ্ট। কবিতায় যদি সমকাল না থাকে, কবিতা যদি ব্যক্তিগত সমস্যা ও পুনরোক্তিপ্রবণ প্রেমের জোয়ার হয়, তাহলে তার জীবনীশক্তি হয় সীমিত। কবিতা যেমন সংবাদের শিরোনাম নয়, তেমনি কবিরাও কবিতা লেখেন না গুহায় বন্দি হয়ে। বহু মানুষের বহু আয়তনিক বেঁচে থাকা কবিতার রসদ। তা গ্রামীণ মানুষের জীবনে যেমন হতে পারে, নাগরিক যান্ত্রিক জীবনের জটিলতায়ও হতে পারে। কবি জীবনের সেই রসদকে উপেক্ষা করলে নিজেকেই উপেক্ষা করলেন। কবিতার দখলে আছে গোটা সমাজ, জীবন, সময়, ঘটনা, ইতিহাস, রাজনৈতিক ওঠা-নামা, প্রচার ও প্রতারণা। শামস আরেফিনের কবিতা সেই দখলিকৃত বিশালতায় ভ্রমণমত্ত।
ফলে তার সঞ্চয়ে আছে চিরকালীন উপাদানও। শাশ্বত চিত্তবৃত্তির রক্তমাংসের উপজীবক হয়ে শক্তিসঞ্চয় করেছে তার কবিতা। চিরায়ত প্রেম-বিরহ, স্মৃতি-বিস্মৃতির জীবিকা গ্রহণ করেছেন কবি। মনের শুকিয়ে যাওয়া দেখে বর্ষায় তার স্নান ও সতেজতার আয়োজন ও আহবানে প্রবুদ্ধ তার কবিতা। কবির দরকার প্রেম। কিন্তু এ প্রেম মানুষ হওয়ার তাড়নায় কাতর। যদিও কবি জানেন—মানুষের জন্য মানুষ হওয়ার মতো কঠিন কাজ আর নেই।
প্রতিদিন ও প্রতিটি জন্মই যেহেতু নতুন, ঐতিহ্যও তাই নিজের পুনরোৎপাদন কামনা করে। শামস আরেফিন সেই ঐতিহ্যের অনুরাগী। কিন্তু আশার ব্যাপর হলো, ঐতিহ্যের নিছক ভাষিকতায় কবি তৃপ্ত নন, এর পুনর্গঠনে প্রয়াসী। অতএব ‘কেয়াবনে কবি জীবনের তাফসীরে’ হন মুখর।
মানুষ হয়ে মানুষী জীবনের কঠিন এ রণাঙ্গণে কিভাবে জয় আসবে প্রেম ছাড়া? কবির চাই সঙ্গীনী, নারী। একদম জ্বলন্ত ও জীবন্ত প্রেমের নির্দেশে যার আশ্রয় তাকে দেবে প্রশান্তি। দয়িতাকাতরতা কি চিরকালীন সেই প্রশান্তিপিপাসার চিৎকার নয়, যার উচ্চারণ কালিদাসের মেঘদূত হয়ে আজকের কবিতেও মন্দ্রিত? কিন্তু সে পুরাতন হয়নি কখনো । না কাহ্নপার কাব্যে, না আজকের তাজাতরুণ কবির আকুতিতে। হ্যাঁ, আকুতিই আমরা শুনি শামসের কবিতায়। তিনি বলছেন,
বাহুডোরে পূর্ণিমা চাঁদ হয়ে স্বচ্ছ দুধের মতো যে নারী আসে
ভোরের শিশিরে ধোয়া পাকসাফ সবুজ ঘাসের মতো
অথবা প্রেমের জৈবসার হয়ে ভালোবাসার সবজি চাষ করে
কাগজের মতো স্বপ্ন মুচড়িয়ে হৃদয়ভাঙা মুচকি হাসি হেসে
এক চামচ সুখে মিষ্টি যেকরতেচায়বাস্তবতারচা
আমার স্বপ্নগুলো শান্ত হয়ে ঘুমাতে চায় তার জানুতে।
(প্রেমের জৈবসার)
শামস আরেফিন লিরিক মেজাজের মধ্য দিয়ে মৃত্তিকালগ্ন অনুভবের সবুজ হাসি দিয়ে গ্রামের ফসলের চাষ করেছেন রমনার বকুলতলায়। যেখানে ‘বাদামের বদলে হৃদয় চিবিয়ে খায় চাঁদমুখ—হাসি’। ভালোবাসা তার কাছে এসেছে বিচিত্র অর্থ নিয়ে। আফ্রোদিতির চোখ ও হাসি যদি না মিলে, শুধু বিরহে তিনি ভাজা হতে রাজি নন। ভালোবাসা চাই, চাই এর ফসল। ঘরকন্না। নবজন্ম। জীবনের নতুন উৎপাদন। প্রকৃতিতে কি সেটাই চলছে না? কবি দেখান,
মনের উঠানে ভালো লাগা জোছনায় পুড়ছে
তবু বৃষ্টি আছে বলে নদীরা পোয়াতি হয় মাছে
উর্বর মাটির বুক স্তন হয়ে শস্য বিলায়।
এই যে জীবনলগ্নতা, প্রকৃতিমগ্নতা, প্রেমলিপ্ততা; এই তিন প্রণোদনা শামস আরেফিনের চরিত্র নির্মাণ করে দিয়েছে। যদিও তার কবিতা আল মাহমুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে কোথাও এবং প্রায়ই তার শব্দব্যবহার ব্যাপক অর্থসম্ভাবনা দ্বারা অন্ত:সত্তা হয়নি, তবুও তার আত্মকথনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে সময়ের আত্মজীবনীর ধারাবর্ণনা। বিপুল মানুষের স্বপ্ন,বেদনা ও মগ্নতা-লগ্নতার কাব্যফিরিস্তি।
এটি সত্য যে, গতিহীন ঐতিহ্য বাসি খাবারে পরিণত হয়। প্রতিদিন ও প্রতিটি জন্মই যেহেতু নতুন, ঐতিহ্যও তাই নিজের পুনরোৎপাদন কামনা করে। শামস আরেফিন সেই ঐতিহ্যের অনুরাগী। কিন্তু আশার ব্যাপর হলো, ঐতিহ্যের নিছক ভাষিকতায় কবি তৃপ্ত নন, এর পুনর্গঠনে প্রয়াসী। অতএব ‘কেয়াবনে কবি জীবনের তাফসীরে’ হন মুখর। যদিও ‘তাহাজ্জুদে বেগুনা না হয়ে হতাশার জোনাকি উড়ান কবি, কিন্তু ধানের চারার মতো জনকের স্পর্শকে তিনি রুয়ে দিতে চান গোটা বাংলাদেশে!’
আলোচনা দীর্ঘ করার দরকার নেই আর। বুঝতেই পারছেন ঝিঁঝির ক্রেংকারের মধ্যে কবিতার এক গায়কপাখি হয়ে শামস আরেফিন হাজির হয়েছেন নবজাতক স্বপ্নদের নিয়ে। কাব্যগ্রন্থটি মনস্বী পাঠকের আদর লাভ করুক।