সব কবিরই চেষ্টা থাকে কবিতায় নিজের স্বাতন্ত্র্য ফুটিয়ে তোলার। কবিতায় নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার। এটা করতে গিয়ে কেউ কেউ নিজের ভেতরের জটিলতা, বৈপরীত্য, বোধকে প্রাধান্য দেন। কেউ-কেউ অন্তর্গত বেদনার সঙ্গে চেনা দৃশ্য, চেনা পরিবেশ মিলিয়ে পাঠকের সামনে সহজ, সুন্দর দৃশ্য নির্মাণ করেন। যেন সেই পরিচিত দৃশ্যাবলি অদ্ভুত স্বপ্নময় হয়ে ওঠে। পাঠক নিজেকে দেখতে পায় কবির দেখানো আয়নায়। জাকির জাফরান কবিতায় প্রতিনিধিত্ব করেন সেই সময়ের, যা সহজ, অনুভবসম্ভব।
জাকির জাফরানের সঙ্গে আমার পরিচয় তার চিঠি কবিতার মধ্য দিয়ে। সেখানে তিনি বলেছিলেন—
আজ বাবা অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন
বললেন: ধরো, ডালে-বসা দুটি পাখি থেকে
শিকারির গুলিতে একটি পাখি মরে গেল
তবে বেঁচে থাকলো কয়টি পাখি?অঙ্কের বদলে এই মন চলে গেল
বেঁচে থাকা নিঃসঙ্গ সে-পাখিটির দিকে
আর মনে এলো তুমি আজ স্কুলেই আসোনি।
কবিতায় এই সহজিয়া বোধের মধ্য দিয়ে যে জটিল হৃদয়বৃত্তির সন্ধান তিনি দিয়েছিলেন, যে মুগ্ধতা জাগিয়ে তুলেছিলেন, সেই রেশ ধরেই পাঠ করি তার কবিতা। প্রথম পাঠে তিনি যে মুগ্ধ আবেশ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা ধরে রেখে নিজের বোধকে, নিজের ভাবনাকে অন্যের মাঝে সঞ্চারিত করে দেওয়ার কৌশল তিনি রপ্ত করেছেন, তাকে লালন করেছেন, ফলে মুগ্ধতার সেই রেশ হারিয়ে যায়নি। একটা সময় কবিতা থেকে আমাদের নিজস্বতা, আমাদের সীমার মাঝে অসীমের সন্ধানের যে চিরায়ত সাধনা, তা হারিয়ে যাওয়ার কথা বেশ জোরেসোরেই শোনা গিয়েছিল। কবিতাকে বিশ্বায়নের দুয়ারে দাঁড়িয়ে সেই হাওয়া পাইয়ে দিতে স্বেচ্ছাকৃত জটিল আবহ তৈরির প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। কবিতা হয়ে উঠেছিল নিখাঁদ শব্দের ব্যায়াম। সেখানে জোর করে পাঠককে কতিপয় শব্দ গেলানোর চেষ্টা হয়েছে, যেখানে সৃষ্টির চেয়ে নির্মাণ কৌশলই বেশি জোরালো ছিল। সেই খেলায় হারিয়ে না গিয়ে যারা কবিতার লাগাম টেনে ধরেছেন, যারা আবেগ আর যুক্তির মাঝে সেতু তৈরি করতে চেয়েছেন, যারা দৃশ্য আর কল্পনার মাঝে যোগসূত্র খুঁজে ফিরেছেন, যারা কবিতা থেকে তার স্বাভাবিক রূপ, রস, গন্ধ হারিয়ে যাওয়ার বিপক্ষে থেকে ইতিহাস-ঐতিহ্যের ভেতর থেকে লালন করেছেন মানবিকতা, তাদেরই প্রতিনিধি জাকির জাফরান।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সমুদ্রপৃষ্ঠা’র পর ২০১৫-এর বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নদী এক জনান্ধ আয়না’। বইয়ের কবিতার ভেতরে ঢোকার আগে দেখে নিতে পারি তার কবিতা সম্পর্কে ফ্ল্যাপে লেখা আমজাদ সুজনের মন্তব্য। সুজন বলছেন, ‘পোস্টমডার্নিজম, বিমূর্ততা, নিঃসঙ্গতা, অনৈব্যক্তিকতা, দ্যোতনা-ব্যঞ্জনা…কবিতা বিচারের এসব পুরনো স্কেল হয়তো এ কাব্যবইয়ের জন্য নয়। এসব উপকরণ দিয়ে মূলত কবিতার দুর্বলতা ঢেকে রাখা হয়। এ বইয়ের কবিতাগুলো ঢেকে রাখার দরকার নেই। খুব খোলামেলা। যে রকম জীবনের চেয়েও বড় আরও এক গভীর জীবন। অনুভব, আবেগ, প্রেম, অদ্ভুত রকমের অর্থহীন সব নতুন অর্থ তৈরি হয়। যে রকম কবিমন বাস করে অন্য কারও হৃদয়ে। অন্যের ভেতরে বসে নিজেকে প্রকাশ করার এক অন্যরকম ভাষা।’
সত্যিকার অর্থেই পাঠক জাকির জাফরানের কবিতায় খুঁজে পান নিজেকে। তিনি কবিতার সেই শ্রেণীর প্রতিনিধি, যিনি নিজেকে, নিজের বোধকে বহুমাত্রিকতায় পাঠকের সামনে মেলে ধরতে পারেন। জাকির জাফরানের সচেতন মন, তার নির্মিত দৃশ্যাবলি পাঠকের মনকে স্বস্তি দেয়। চেনা জগতের জটিলতা নানান সংকেত, চিহ্ন এবং শব্দের সাঁকোতে জাকিরের কবিতায় নতুন জগত তৈরি করে। তার দেখা বস্তুও নিরপেক্ষ নয়। তাই পাঠককে নেশার ঘোরের মতো কবিতার ভেতের ঢুকে পড়তে সহায়তা করে। পাঠককে কবিতার ভেতর ডেকে আনতে যে দৃশ্য নির্মাণ করেন জাকির জাফরান, তার একটি উদাহারণ:
একদিন তুমি তরমুজ কেটে নিয়ে এলে
খেতে খেতে ভাবলাম—
তরমুজ কাটলে দু’ভাগ হয়ে পড়ে থাকে তার লাল আকাশ।
কিন্তু হৃদয় দু’ভাগ হলে মাথার ওপরে কোনও আকাশ থাকে না।
আজ তুমি নেই
আমি আলো আঁধারির মধ্যে বসে কাঁদলাম
কেউ আর তরমুজ কেটে নিয়ে আসে না এখন
আজ সত্যি সত্যি মাথার ওপরে কোন লাল আকাশও আর থাকলো না।
(লাল আকাশ)
আলোচ্য কবিতার বইয়ে জাকির তিনটি পর্বে ভাগ করেছেন তার কবিতাগুলো। লাবণ্যস্তম্ভের মতো, নদী এক জনান্ধ আয়না এবং রক্তমোচনের দেশে শিরোনামের তিনটি পর্বে ৬৩টি কবিতা রয়েছে। এ সময়ের প্রতিনিধি জাকির জাফরানের কবিতা আমিত্বময়, আকৃতিতে ছোট। কবিতার পঙ্ক্তিবিন্যাসও স্বল্পদৈরর্ঘ্যের। ছোট ছোট চেনা শব্দে জাকির নিজেকে পাঠকের সামনের উন্মোচন করেন। চেনা শব্দে, চেনা দৃশ্যে তিনি যে পঙ্ক্তি নির্মাণ করেন, তা থেকে পাঠকের অনুভূতি খুব দূরের নয়। তাই তার কবিতার সঙ্গে, তার জগৎ-এর সঙ্গে, তার চিন্তার সঙ্গে পাঠক একাত্ততা অনুভব করেন। এ কারণে জাকিরের কবিতা উদ্ধৃতিযোগ্য। তার কবিতা পাঠকের হৃদয়ে প্রভাবসঞ্চার করতেও সক্ষম হয়। সহজবোধ্য পঙ্ক্তিবিন্যাস হলেও জাকির জাফরানের কবিতা দূর-সঞ্চারী। দূর সময়ের ইঙ্গিত দেয়। পাঠককে ভাবনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়। বাংলা কবিতার মৌল উপাদান সমৃদ্ধ হয়ে তাই জাকির জাফরানের কবিতা ইতিহাস ঐতিহ্য চেতনার রাস্তায় হেঁটে চলে। আর এই হেঁটে চলার ভেতর দিয়ে নিজের অনুভূতিকে পাঠকের সামনে ছড়িয়ে দিতে পারেন তিনি।
ককটেল ফাটে—
এই শব্দ গিলে খায় দোয়েলে শিষ।রাস্তায় টায়ার পোড়ে—
এই ধোঁয়া ছেয়ে ফেলে সুনীল আকাশ।ছররা গুল
মাতৃগর্ভের নির্জনতাকেও খুন করে।আমার শহরে আমি আগুন্তক, মাগো!
কার কাছে যাবো!!
(হরতাল)
জাকির জাফরানের কবিতায় আবেগের প্রাধান্য থাকলেও তিনি আবেগের প্রাবল্যে কবিত্বকে বিসর্জন দেন না। নিজের ব্যক্তিসত্তা, বোধ, বিবেচনা ও প্রাত্যহিক জীবন তার কবিতার বিষয়বস্তু। সবসময়ই তার পঙ্ক্তিগুলোর সমন্বিত বাঁধনের ভেতর দিয়ে অখণ্ড একটি দৃশ্য রচিত হয়। শব্দের জটিলতা ছাড়াও যে কবিতা রচনা সম্ভব। সহজ-সরল ভাষ্যের ভেতর দিয়ে নিজের অনুভূতিকে যে প্রকাশ সম্ভব, তারই উদাহরণ জাকির জাফরানের কবিতা।
নদী এক জন্মান্ধ আয়না
কবি: জাকির জাফরান
প্রকাশকাল: একুশে বইমেলা ২০১৪
প্রকাশক: গদ্যপদ্য
প্রচ্ছদ: সঞ্জয় দে রিপন
মূল্য: ১৫০ টাকা।