শিল্পী মাত্রই আত্মপ্রকাশে উন্মুখ থাকেন। কখনো শব্দে, কখনো সুরে, কখনো ছবিতে। কখনো বা অভিনয় হয়ে ওঠে তার সেই আত্মপ্রকাশের আরাধ্য মাধ্যম। এসব মাধ্যমের মধ্যে সম্ভবত শব্দে শব্দে নিজেকে প্রকাশ করার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি মানুষের। সেই প্রকাশ কখনো গল্পে, কখনো উপন্যাসে, কখনো গানে, কখনো কবিতায়, নাটকে কখনো বা প্রবন্ধ-গদ্যে। অর্থাৎ লিখিতভাবে নিজেকে প্রকাশ করার আনন্দ মানুষের প্রায়-সহজাত। তাই মানুষে লেখে। মনের ভাব প্রকাশ করে। নিজেকে বোঝায়, অন্যকে বুঝতে চেষ্টা করে। তেমনই স্বপ্রকাশের ভার নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়েছেন শারমিন সুলতানা। তিনি পেশায় শিক্ষক। গল্পের পাশাপাশি লিখে চলেছে প্রবন্ধ-গদ্যও। এবার প্রকাশিত হয়েছে তার গদ্যের বই ‘নজরুল ভাবনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’।
বইটিতে ১৬টি গদ্য রয়েছে। এরমধ্যে প্রথম দুটি ও শেষ গদ্যটি নজরুল বিষয়ক। প্রথম দুটির একটির শিরোনাম ‘নজরুল: চিন্তন ও মনন’, অন্যটি ‘রাজবন্দী নজরুল’। আর শেষ গদ্যটির শিরোনাম ‘বিদ্রোহী’র নজরুল’। প্রথম গদ্যে কাজী নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত আচরণ ও সাহিত্যিক আচরণ; জীবনধর্ম ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে তৎকালীন সমাজ থেকে শুরু করে বর্তমানকালের পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে লেখক নিজস্ব অভিমত প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম। একটি চেতনার নাম, নিজের ভেতরেই একটি বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠানের ধারণা।’ পুরো প্রবন্ধজুড়ে সেই চেতনার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কোন সে চেতনা? একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, নজরুলের চেতনা অতি অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক চেতনা। সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বরূপ বোঝাতে তার হামদ-নাত থেকে শুরু করে শ্যামাসংগীত প্রসঙ্গ টেনেছেন লেখক। একইসঙ্গে বিয়ের মাধ্যমে যে নজরুল ধর্মীয় সীমার প্রাচীর ভেঙেছেন, তারও বর্ণনা দিয়েছেন।
দ্বিতীয় গদ্য ‘রাজবন্দী নজরুল’। এই প্রবন্ধে নজরুলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দেশপ্রেম ও দেশপ্রেমমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে শারমিন সুলতানা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। তবে আলোচনা যতই সংক্ষিপ্ত হোক, তাতে সামগ্রিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা আছে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া থেকে শুরু করে কারাবন্দি হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন সময়কে তুলে ধরেছেন লেখক। এই গদ্যে নজরুল প্রসঙ্গে লেখকের মূল্যায়ন, ‘রাজবন্দী নজরুল তাই স্বজাতিক দরদ, মানবতাবাদী বোধ, সাম্যবাদী প্রার্থনা, ন্যায়পরায়ণতায় আপসহীনতা, দ্রোহে বিদ্রোহী আত্মপ্রত্যয় ইত্যাদিতে বিস্তৃত এক বিস্ময়, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের আবিষ্কারের একটি অন্যতম জ্ঞানের উৎস, অনুকরণের একটি আদর্শ।’
‘বিদ্রোহী’র নজরুল’ শিরোনামের গদ্যে নজরুল রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্পর্কে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। এই কবিতার লেখার সময় থেকে শুরু করে প্রকাশ ও প্রকাশকাল নিয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছেন। একইসঙ্গে কবিতাটির অবিনশ্বরতা নিয়ে নিজের নিঃসংশয়ী মনোভাবের কথাও প্রকাশ করেছেন। শারমিনের মতে, ‘‘চির সাম্যবাদী বাঁধনহারা নজরুলের কালজয়ী সর্বকালের হুঁশিয়ারি ‘বিদ্রোহী’, যা শতবছরে নয়, আলোকরশ্মির বিচ্ছুরণ ঘটাবে সহস্র বছর অনাগত অন্ধকার জুড়ে। আর নজরুল একটি যুগ, কাল ও নব জাগরণের দীপ্ত শিখা হয়ে রবে চিরন্তন।’’
এই শঙ্কা একজন ভাষা শিল্পীর নয় কেবল, একজন মানবহিতৈষীরও। লেখক সমাজ-সময় সচেতন বলেই সময়ের এই দাগকে চিহ্নিত করেছেন দরদি মন দিয়ে।
লেখককে সমাজ সচেতন হতে হয়। আর সমাজ সচেতন লেখককে চোখ রাখতে হয়, সমকালীন রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পালাবদলের দিকেও। শারমিনও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই লিখেছেন শিক্ষা-সংস্কৃতি, নারীবাদ, ভাষাপ্রেম,শোষণ, রাজনীতি, মহামারী, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়েও।
‘দৃষ্টিকোণ’ গদ্যে ব্যক্তি-পরিবার-সমাজের রুচি-অভ্যাস-আচরণের অসঙ্গতির সমালোচনা করেছেন। তুলে ধরেছেন বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি। একইসঙ্গে সমস্যা শনাক্তির পাশাপাশি এর সমাধানের উপায়ও বাতলে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘… অবশ্যই এই সত্যকে জীবনে কাজে লাগাতে বা বিশ্বাস করতে বোধ করি প্রয়োজন গ্রহণ করার মানসিকতার, যা নিজের পাশাপাশি অন্যকে মেনে নেয়, অন্যের দৃষ্টিকোণকে মেনে নেয়। আর এই গ্রহণ করার মানসিকতা বাড়াতে হলে প্রথমেই যা করতে হবে, তা হলো বয়স, অভিজ্ঞতা, সময় শিষ্টাচার ইত্যাদি শব্দকে নমনীয় হতে হবে। যদিও এটাও একটি আপেক্ষিক বক্তব্য।’ অর্থাৎ তিনি পরামর্শ দিয়েছেন বটে, তবে সেই পরামর্শকে ধ্রুব দাবি করে তা পাঠক-সমাজের ওপর চাপিয়ে দেননি। তিনি নিজের মত-প্রকাশ করেছেন, সমাজ চাইলে তা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু গ্রহণে সমাজ বাধ্য নয়। শিল্পী মাত্রই কর্মের স্বাধীনতায় যেমন বিশ্বাসী, তেমনি চিন্তার স্বাধীনতায়ও। তাই নিজে যা বিশ্বাস করেন, অন্যের জন্যও তা বরাদ্দ করতে শিল্পী সবসময়ই সচেষ্ট থাকেন।
‘জানা কথার কাসুন্দি’, ‘সময়ের চোরাবালিতে নিমজ্জিত অভিরুচি’, ‘ব্যক্তিত্ব’ ‘শিক্ষা ও শিক্ষিত’ ও ‘বোধ’ শিরোনামের গদ্যগুলোয় সমাজের রুচি, ব্যক্তির রুচি-মর্জি, আচরণের অসঙ্গতিকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। রুচি গঠনের জন্য সহায়ক উপকরণগুলোর ওপর জোর দিয়েছেন। এ জন্য তিনি যুক্তিপর পর যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
‘আমাদের ভাষাজ্ঞান’, ‘শোষণের রূপভেদ’, ‘পহেলা বৈশাখ: অভিন্ন চেতনার ভিন্ন স্বরূপ’, ‘নারী: একটি ধারণার নাম’ শীর্ষক গদ্যগুলো মূলত ভাষাতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত। এসব গদ্যে লেখক ভাষার বোধ, শাসক-শোষকের রূপ ও নারীবাদকে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে, যতটা ব্যাখ্যা করেছেন, তারও বেশি দিয়েছেন নিজস্ব অভিমত। ফলে এসব গদ্যে লেখকের মননশীলতা একটি পরিশীলিত রূপ ফুটে উঠেছে। সমাজ-রাষ্ট্র-সংস্কৃতি সম্পর্কে লেখকের বোধ ও মনের স্বচ্ছ চিত্র এতে আঁকা হয়েছে।
রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আন্দোলনের ফলে সমাজে যেমন পরিবর্তন সাধিত হয়, তেমনি প্রাকৃতিক কারণেও বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়। চলমান মহামারী করোনা বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ সমাজের সব খাতে প্রভাব ফেলেছে, তা অনস্বীকার্য। এরপ্রভাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও বিপুল পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। বদলে গেছে আঙ্গিক-প্রকরণসহ সামগ্রিক রূপ। বিষয়টি লক্ষ করেছেন শারমিন। লিখেছেন, ‘মহামারী প্রভাবিত সংস্কৃতি’ শীর্ষক গদ্যে। বর্তমান সময়কে নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘বায়োস্কোপে অতীত দেখবে নিউ নরমালের শেকড়হীন প্রজন্ম। সবকিছু চলে যাবে মেশিনের নিয়ন্ত্রণে, প্রযুক্তির অধীনে পুতুল হয়ে নাচবে আমাদের বন্ধনহীন অনিয়ন্ত্রিত সম্পর্ক, যদি না অন্তরে সযত্নে সবকিছুকে রেখে দিয়ে আমরা সচেতন হয়ে ফিরে যেতে চাই আবার যৌথ জীবনে। নয়তো অবরুদ্ধতার কানামাছি খেলা শেষে চোখ খুলে যা দেখব, তা হবে চির অপরিচিত অবয়ব, যা আমাদের নয় কিংবা আমরা যার নই।’ এই শঙ্কা একজন ভাষা শিল্পীর নয় কেবল, একজন মানবহিতৈষীরও। লেখক সমাজ-সময় সচেতন বলেই সময়ের এই দাগকে চিহ্নিত করেছেন দরদি মন দিয়ে।
বইটিতে এত ভালো দিক থাকার পরও কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। প্রথমত সূচিবিন্যাস। নজরুল বিষয়ক গদ্য রয়েছে মাত্র তিনটি। নিয়ম অনুযায়ী নজরুল-বিষয়ক গদ্যগুলো হয় শুরুতে, না হয় শেষদিকে একসঙ্গে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে শুরুতে দুটি গদ্য, শেষে একটি রাখা হয়েছে। যা সূচিবিন্যাসের ক্ষেত্রে বড় ত্রুটি বলে গণ্য হতে পারে। এছাড়া রয়েছে বানান বিভ্রাট। বানানে প্রাচীনরীতি-নবীন বা প্রমিতরীতির কোনো একটি গ্রহণ করা হয়নি। একই রচনায় উভয় রীতির বানান রয়েছে। এছাড়া সাধারণ বানানের ক্ষেত্রে নিয়ম রক্ষা করা হয়নি। যেমন, ‘কারাবন্দি’কে ‘কারাবন্দী’, ‘স্পষ্টবাদিতা’কে ‘স্পষ্টবাদীতা’, ‘আপসহীন’কে আপোসহীন লেখা হয়েছে। আশা করি, পরবর্তী সংস্করণে এসব ত্রুটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
নজরুল ভাবনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
শারমিন সুলতানা
প্রচ্ছদ: শামীম আরেফীন
প্রকাশক: ঘাসফুল
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২২
মূল্য: ১৬০ টাকা।