কবি শামীম হোসেন। লেখালেখির বয়স একযুগেরও কিছু বেশি। ইতঃপূর্বে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ চারটি। এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হলো আরও একটি কাব্যগ্রন্থ- ’ধানের ধাত্রী’। কবিতার তাঁর কাছে যতটা শিল্প, তারও বেশি জীবনের চিত্রায়ণ। তাই শামীম কেবলই এঁকে চলেন, জীবনের চিত্র, লিখে চলেন, যাপনের গাথা। কাব্যের প্রথম কবিতা- ’পাথরের চোখ’।
জীবনের রূঢ়বাস্তবতার ছবি আঁকতে গিয়ে শামীমের উপলব্ধি হয়েছে, দুঃখ কেবল একার নয়। এটা সামষ্টিক অভিজ্ঞতারও অংশ। তাই তাঁর মনে হয় ’মোহনায় এসে নদীরা ফেলছে দীর্ঘশ্বাস’। কিন্তু কেন? এর উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, তাহলো- ক্রুরতা, রূঢ় আচরণ, রাজনৈতিক ভণ্ডামি, অর্থনৈতিক দুর্দশা, নৈতিক অবক্ষয়ে আকীর্ণ উপস্থিত কাল। একইসঙ্গে মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম-ভালোবাসা-মমতাও ম্লান হয়ে এসেছে। কেউ কারও দুঃখে এখন দুঃখিত হয় না, ব্যথিত হয় না অন্যের কষ্টে। সঙ্গতকারণেই অনেক প্রত্যাশিত বিষয় পেয়ে গেলেও এখন তাতে আনন্দ জাগে না মানুষের মনে। মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির সামঞ্জস্য প্রায় ঘটে না।
তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ আশাভঙের বেদনায় ব্যথিত হয়। তারই প্রতীকী উচ্চারণ, ‘মোহনায় এসে নদীরা ফেলছে দীর্ঘশ্বাস।’ শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকে পরিণত বয়সের অভিজ্ঞতার সঙ্গে একীভূত করার সামর্থ্য কবিকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তোলে। ’কৃষ্ণ বুকের চাতালে’ কবিতায় এই অভিজ্ঞতার সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। উল্লেখ করার মতো দুটি পঙক্তি- ‘ভেতরে অঢেল জোনাকি স্রোতের ইশকুল/ নামতার মতো ফোটে মহুয়ার ফুল’। পঙক্তি দুটির মধ্যে বিস্ময় আছে, অন্ত্যমিল আছে, আর আছে স্মরণীয় শব্দগুচ্ছ। সবচেয়ে বড় যে বিষয় রয়েছে, তাহলো অতীত স্মৃতি, শৈশব-কৈশোরের অভিজ্ঞতার সঙ্গে উপস্থিত কালের অভিজ্ঞতার বিনিময়। ’নরসুন্দাপারে’ শামীম ‘ঝড় ও ঝাপটার অন্তরালে/ উন্মোচিত হৃদয়’ নিয়ে মানুষের সামনে উপস্থিত হন।
মানুষকে শোনান মানবতার কথা, ভালোবাসার কথা, যে ভালোবাসা তিনি ‘পাথরের চোখ’ দেখতে দেখতে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছেন। বাঙালি কবি মাত্রই, প্রেমের কবিতায় মুক্তি খোঁজে। শামীমও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি যেন নিজেকেই প্রশ্ন করেন, ‘কীভাবে বন্দি হয়ে লিখো তৃমি প্রেমের কবিতা!’ পঙক্তিটা প্রশ্নশীল হলেও যতিচিহ্ন দিয়েছেন বিস্ময়সূচক। এবং তা সচেতনভাবেই।
অর্থাৎ এই রূঢ়সময়ে যখন বেঁচে থাকাই, কঠিন, তখন প্রেমের কবিতা রচনা কিছুটা বিস্ময় সৃষ্টি করে বটে। একই অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে, ‘পাখি ও বিমান’ কবিতায়। ‘পাখিদের রানওয়ে থেকে পালক ঝরছে/ দুহাত পেতে কুড়িয়ে নিচ্ছি/ গুঁজে রাখছি কানের পাশে; বান্ধবীর খোঁপায়।’ যুদ্ধ সংকুল পৃথিবীতেও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে। মানুষ ভালোবাসা পেতে ও ভালোবাসতে চায়, তাই জীবন বিপণ্ণ জেনেও পরস্পরকে আকর্ষণ করে তারা। আর এই রূঢ় সময় ও সভ্যতার ক্রান্তিকালকেই এই কবিতায় চিত্রিত করেছেন শামীম।
একজন স্বপ্নবান দরিদ্র বাবার অকৃত্রিম সন্তানবাৎসল্য প্রকাশিত হয়েছে ‘কন্যার প্রতি’ কবিতায়। একই সঙ্গে সমাজের প্রতি প্রকাশ পেয়েছে তীব্র শ্লেষও। গ্রন্থের শেষ কবিতা ’অদৃশ্য করাত’। ৭২ পঙক্তির দীর্ঘ কবিতা। এ কবিতায় উঠে এসেছে প্রেম-কাম-, দেশ-কাল, সভ্যতা-পুরাণ ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা খণ্ডাংশ। তোমাকে ডাকি না আমি; দুঃখ ডাকি আর মরণে মরণে হই ফিনিক্স পাখি তীরে বেঁধা দেহে দেখ বহু ক্ষত আমাকে পোড়ালে তুমি- পুড়বে তত জগতের নিয়মে শুধু ভিজে যায় চোখ গোপনে লুকিয়ে রাখি অনাগত শোক। মানব জীবনের চিরন্তন বেদনায় সিক্ত এই পঙক্তিগুলো। এখানে উঠে এসেছে মানুষের দুঃখ সহ্যের সীমা ও কষ্ট গোপন করে রাখার চিরায়ত রীতি। আর এই দুয়ের মাঝখানে বসে, ভালোবাসার তীব্র আকাঙ্ক্ষার চিত্রও।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার আশি ভাগেরও বেশি মানুষ সরাসারি কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কৃষক মানেই, নিষ্ঠুর একই সঙ্গে দরদি সম্পাদক। কৃষক মানেই মমতায় ভরা হৃদয়, ফসলের পরম সেবক। ‘ধানের ধাত্রী’ কবিতায় সেই পরম সেবক কৃষকের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। শেষপর্যন্ত একাব্য হয়ে উঠেছে শব্দচাষী শামীমের পরম মমতামাখা কবিতাবলির আশ্রয়। পাঠকের ভালো লাগবে বলে আমার বিশ্বাস।
ধানের ধাত্রী
শামীম হোসেন
প্রকাশক : নদীপ্রকাশ
প্রথম প্রকাশ : একুশে বইমেলা ২০১৫
প্রচ্ছদ : রাজিব রায়
মূল্য : ১০০ টাকা।