লাঙলের ফলার মতো প্রতিটি ভোর আসে নতুন স্বপ্ন নিয়ে
নতুন বীজ আর ফসলের ঘ্রাণ নিয়ে।
-সুরাইয়া ইসলাম
আমাদের জীবনে প্রতিটি ভোর আসে নতুন সব সম্ভাবনার অফুরান খোরাক নিয়ে। নতুন আঙ্গিকে নতুন স্বপ্ন। অথচ আমরা ভুলে যাই আমাদের করণীয় সম্বন্ধে। উপমায় আচ্ছাদিত স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কাব্যিক বয়ানটি কবি সুরাইয়া ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দোলনা হারানো দিন’র প্রথম কবিতা ‘ভোর’র প্রথম দুই চরণ। কাব্যগ্রন্থটিতে বিবিধ বিষয়ের চমৎকার সব কবিতার সমাবেশ পাওয়া যায়। যেমন—স্মৃতিচারণ, আক্ষেপ, পরিবেশ সচেতনতা, প্রেম, বাস্তবধর্মিতা, মাতৃত্বের স্বরূপ, নদীপ্রেম, বিষণ্নতা, সমকালীন অসঙ্গতি, বোধ ও ধার্মিকতা ইত্যাদি। অধিকাংশ কবিতা নির্মাণ হয়েছে স্মৃতিতে ফেরার তাড়নার ঘোরে। প্রত্যেক মানুষই চায় স্মৃতিতে ফিরতে ও ফেরে। তারপর হয়ে যায় নস্টালজিক। কবিদের ক্ষেত্রে বলা যায়, এই নস্টালজিয়াই কবিতা নির্মাণের অন্যতম কাঁচামাল। দোলনা হারানো দিন কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো কবির বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার স্মৃতির নস্টালজিয়ার কাব্যিক অবয়ব। মাতৃত্বের পরম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবি নিজেকে দেখতে পান তার সন্তানের ছায়ায়। আর এই ছায়ার ভেতরই কবি তার শব্দের খেলা শুরু করেন আবেগ ও আস্থার ভরসায়।
কবি সুরাইয়া ইসলামের জন্ম ১৯৮৬ সালের ১২ মার্চ, ফরিদপুরের মধুখালীতে। চন্দনা নদীর স্রোতে পাক খেয়ে ওঠা জলের ঘূর্ণির মতোই তার শৈশব কেটেছে বিমূর্ত ঘোরে। ফরিদপুর চিনিকলের সবুজারণ্যে কৈশোরের দুরন্তপনায় মিশে ছিল বাঙালি সংস্কৃতির সব সঙ্গ ও অনুষঙ্গ। এ জন্যই তাঁর চেতনা ও বোধির নির্মাণে অসাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালিপনা প্রাধান্য পেয়েছে। সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী থাকাকালে সাহিত্য রচনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ায় এই পথটা আরও মসৃণ হয়। ওই সময় থেকেই তিনি জাতীয় দৈনিকসহ বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করছেন। অমর একুশে বইমেলা ২০১৯-এ প্রকাশিত ‘দোলনা হারানো দিন’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ।
সন্ধ্যা নেমে এলেই স্মৃতিচারণের ঘোড়া চেপে বসে কবির মগজে ও মননে। স্মৃতির পুরোনো অমসৃণ মায়াময় পথে কবি অস্বস্তি বোধ করেন, তবুও মহাকালের সবকটি ভুল মুর্খতার বশে গলবিলে ঢেলে অস্বস্তিতে ভোগেন অবিরাম। অতঃপর নিজেকেই নিজে করে ভর্ৎসনা, কেন ফিরলেন সে এই স্মৃতির ঘোরের ফাঁদে! যেসব প্রশ্ন তোয়াক্কা না করেই ‘সুবোধ সন্ধ্যা’ কবিতায় কবি বলেন—
সুবোধ বালকের মতো আজও সন্ধ্যাগুলো ঘরে ফিরেছে
নিশুথি ঝঞ্ঝা মাড়িয়ে একটি নিদাঘ ভোরে জগিং করবে বলে।
এই কবিতায় হয়তো ‘সুবোধ সন্ধ্যা’ কবি নিজেই। যে কি না চান নিশুতি রাতের স্মৃতির ঝঞ্ঝা মাড়িয়ে এক নিদাঘ ভোর।
পৃথিবীর অস্তিত্বকে হুমকি দেওয়ার নেতৃত্বে আছে পরিবেশ দূষণ আর বৃক্ষ নিধন। ধীরে ধীরে পৃথিবী হয়ে যাচ্ছে অবাসযোগ্য। তাপ বাড়ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে আমাদের অস্তিত্বের শূন্যতা। এসব সংশয় বুকে নিয়ে কবি তার ‘ঘাসবেলা’ কবিতায় লিখেছেন—
চারপাশের পলুশন আর ডিফরেস্টেশন
কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানান দিচ্ছে
অস্তিত্বের শূন্যতা।
…
এক চোখ থেকে আরেক চোখের দূরত্ব
বড়জোর সাড়ে তিন আঙ্গুল
তারপরও ওরা কেউ কাউকে
দেখতে পায় না;
‘দম্পতি’ কবিতার প্রথম দুই লাইন পড়ে আমি থেমে গেলাম। আঙুল দিয়ে মেপে দেখলাম দুই চোখের মধ্যবর্তী দূরত্ব। আসলেই তো, দুই আঙুল। সাধারণ মানুষের চেয়ে কবিরা এখানেই বিশেষ হয়ে ওঠেন। কবিদের চোখ কিছুই এড়ায় না, সূক্ষ্ম নমুনা থেকে বিশাল কোনো নিদর্শন সবই ধরা পড়ে যায় কবির ঐশ্বরিক চোখে।
অভিমানের বশে মানুষ সকল সম্পর্ক অস্বীকার করতে পারে কিন্তু মাতৃত্বের সম্পর্কের কাছে পাষাণ হৃদয়ও সহজে হয়ে যায় কুপোকাত। কবি সুরাইয়া ইসলামও অনুরূপ। তার ‘সম্পর্ক’ কবিতায় পাওয়া যায়; তিনি বলছেন, তিনি এই পৃথিবীর কেউ না, কোনো পরিবার বা এক ব্যক্তিরও! গাঢ় অভিমান। অথচ পরক্ষণেই কবি স্বীকার করেন মারিশা নামের এক শিশুর সঙ্গে মাতৃত্বের সম্পর্ককে রসদ করে তিনি বেঁচে আছেন এই পৃথিবীতে। কবিতায় পাই—
আমি তোমাদের কেউ নই
না কোন পরিবারের, না তোমার
…
শুধু মারিশা নামের ছোট্ট শিশুটি যে আমায় মা বলে জানে
আমার বুকের উষ্ণতা বোঝে, তারই মাঝে খুঁজে নেয় বাঁচার রসদ।
সময় ছুটে চলে পাষাণের মতো। যার নেই কোনো পিছুটান। ছুটতে ছুটতে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় প্রিয় সব মুহূর্তের ঝাপি। শৈশব-কৈশোরের আনন্দঘন আবহ নিমিষেই হারিয়ে যায় সময়ের অতল গহ্বরে। কবি এই নিষ্ঠুর নিয়মের নির্মমতায় হারিয়ে ফেলে তার স্মৃতিময় সোনালি কৈশোর। বহু খুঁজেও সে ফিরে পাননি তার হারানো অতীত। সময়ের পরিক্রমায় একদিন তিনি লক্ষ্য করলেন যে—তার মেয়েরও কৈশোর হারিয়ে গেছে! এরকমই নান্দনিক বিমর্ষতার আবহের চিত্রকল্প ফুটে ওঠে কাব্যগ্রন্থটির নামকবিতা ‘দোলনা হারানো দিন’ কবিতায়।
কলোনির বড় শিমুল গাছটির তলায়
একদিন আমার কৈশোরকে হারিয়ে ফেললাম
…
অথচ ছয়তলার বেলকোনিতে একদিন মেয়েটাও
তার শৈশব হারিয়ে ফেলল
কবি যখন নিজের কৈশোর হারানোর বেদনায় কাতর; তখন তিনি অনুধাবন করলেন তার মেয়েরও কৈশোর অতিক্রম হয়ে গেছে। তারপর লিখলেন—
এরপর আমি আর মেয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে
কেবল বজ্রপাতের শব্দ শুনতে থাকি।
এর ঠিক পরের কবিতার নাম ‘নবান্ন’। যেখানেও ঠিক একই আক্ষেপের পাসরা সাজিয়েছেন কবি। কাব্যিকতার ছলে কবি বলেন—
কোনো এক হাটবারের বিকেলে
হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিল যে রঙের কৌটা
সেটা আমাদের শৈশব।
এছাড়া ‘দোলনা হারানো দিন’ কাব্যগ্রন্থটিতে অসংখ্য চমৎকার উপমার হদিস মেলে—
১। লাঙলের ফলার মতো প্রতিটি ভোর আসে নতুন স্বপ্ন নিয়ে। (ভোর)
২। সুবোধ বালকের মতো আজও সন্ধ্যাগুলো ঘরে ফিরেছে। (সুবোধ সন্ধ্যা)
৩। আর আমি পোয়াতি মেহগনির ফাটা ত্বক। (পোয়াতি)
৪। প্রসব যন্ত্রণার চেয়েও বিশ্রী সেই রাত। (অনাগত)
৫। যেন ঝরাপাতার কোল জুড়ে একটি সবুজ কুশি। (সম্পর্ক)
৬। পাছে ছাতিম গাছকে ছাতা ভেবে নিই। (হাঁটছি)
৭। তোমার আমার সখ্য
. যেন ধোঁয়াটে, কাদাজলমাখা এক বাস্তুদেবতা। (সখ্য)
কাব্যগ্রন্থটি কবির প্রথম সৃষ্টি হলেও লেখার নৈপুণ্যে তা বোঝার উপায় নেই। ছন্দ-মাত্রার জটিল হিসাবকে পাশ কাটিয়ে কবি এক চমৎকার সৃষ্টির নমুনা রেখেছেন। আমি বইটির বহুল প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি।
দোলনা হারানো দিন
সুরাইয়া ইসলাম
প্রকাশনী: প্রমীত
প্রকাশকাল: বইমেলা-২০১৯
মুদ্রিত মূল্য: ১৫০ টাকা