জাফর আহমদ রাশেদ, নিঃশব্দ নিলীমায় মগ্ন নির্জনতার কবি। এ অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে কবিতা লেখা কতটা ধ্যানগম্ভীর হতে পারে, তা বোঝা যাবে না, সংবেদ থেকে প্রকাশিত জাফর আহমদ রাশেদের ‘দোনামোনা’ কবিতার বইটি না পড়লে।
এ কাব্যের কবিতাগুলো যেন মগ্ন চৈতন্যের স্রোত থেকে উঠে আসা ধ্বনিপুঞ্জ; যেন আমাদের দু’হাতের দশ আঙুলে তুলে দিচ্ছে প্রগাঢ় অভিজ্ঞতার ফসল। এক ধ্যানস্থের ভাবরশ্মি। তার কবিতা পড়লে বোঝা যায়, মানুষের কোলাহলে থাকেন তিনি কিন্তু মানুষকে তিনি উপেক্ষা করেন না। নির্জনতার সময় তরণীতে মাঝি হয়ে বসে থাকেন জাফর আহমদ রাশেদ। তার কবিতার সময় বর্তমান সময় নয়, ত্রিকালের বেণীবন্ধন যেন। শব্দেরা একটা নিজস্বতা, ধ্বনি এবং অর্থের অনষুঙ্গে পাঠকের হৃদয়কে আলোড়িত করে তোলে। বিশ্বাস রাখেন না তিনি সে চিরাচরিত সিনট্যাক্সটে। সুরের এক মহিমময় তান জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে তার কবিতার ধ্বনিমালাকে। কী অসামান্য, ধ্যান গভীরতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যখন বলেন:
আমি যদি তোমাকে দেখি আয়নায়, আর তুমি আমাকে, বলতে পারবে
বেঁচে আছে কে নেই।
প্রতিফলনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করা অর্থহীন
আর চোখ খুলে
প্রতিবিম্বের দিকে তাকালে দু-দুটো চোখের একটিকেও তুমি নড়তে দেখ না।
তুমি কীভাবে বলো বেঁচে আছো।
(জীবিত ও মৃত)
জাফর আহমদ রাশেদ হলেন সে কবি, যিনি শব্দকে তার পুরনো অনুষঙ্গের আলখেল্লা ছাড়িয়ে নতুন জ্যাকেটে সাজান, সাজাতে পারেন, সাজিয়ে থাকেন। নাম কবিতা ‘দোনামোনা’ পড়লেই বোঝা যায়, ধ্যানগাম্ভীর্যের বর্ণ খুঁজে ফেরাই মূল লক্ষ্য, তত্ত্ব নয়, তথ্য নয়। ‘দোনামোনা’র জায়গায় দ্বিধা শব্দটি বললে এক ভিন্ন অনুষঙ্গ তৈরি হয়ে যেত, শব্দকে তিনি যে অভিনিবেশে লক্ষ করেন, বোধের বাহন করে তুলেন, তেমনটি পারেন না অনেকেই। তিনি একেবারে কম কথায় বলেন। তার লেখা দীর্ঘ কবিতাগুলোও এ সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি মূলত সংহত কবি। নিজের ব্যক্তি অভিজ্ঞতাকে নিঙ্ড়ে-নিঙ্ড়ে তিনি কবিতার শরীর তৈরি করেছেন। প্রসঙ্গত ‘ডাক’, কবিতাটির কথায় ধরা যায়:
ছয় বছর একই কদম গাছের নিচে আড্ডা দিয়ে তারপর বুঝতে হলো
পানির কিনার ছাড়া আড্ডা হয় না।
…আমাদের এই যে দীর্ঘায়ু, বা এতটুকু বেঁচে থাকা, জলের সন্নিধ্যান বলে নয়?
কাঁচুলিতে সুবাস মেখে কিশোরীরা ছেলেদের হাত ধরে লেকের ধারে
বেড়াতে এসেছে পলাশের নিচে, তারাও নিশ্চয় দীর্ঘকাল মনে মনে
পলাশকে বলেছে-কদমের মতো মাটি ছেড়ে অতটা ওপরে যেয়োনা।
পাতাকে বলেছে কুলো, বলেছে
ওঠো বন্ধু ঘন হয়ে।
কে না জানে কোনো কোনো সুমধুরা পাখি ডাক দিয়ে পাতা আড়ালে চলে যায়!
(পৃষ্ঠা: ৬০)
জাফর আহমদ রাশেদের ‘দোনামোনা’র প্রতিটি কবিতায় নির্জন বিষাদকে ঘিরে থাকে প্রকৃতি। প্রতিটি কবিতায় বিষাদ ভেঙ্গে ভেঙ্গে তিনি পৌঁছাতে চান গভীর ব্যথা সমুদ্রের মাঝে। একেবারে মাঝখানে। প্রকৃতির বিস্তৃত পটচিত্রে এই বিষাদকে স্থাপন করে জীবনের বিচিত্র সমগ্রতার আভাস মেলে ধরেছেন শব্দের পল্লবে পল্লবে। তার কবিতা ‘দোনামোনা’ থেকে:
দাইমা আমাদের বিশ্বাস করিয়েছিলেন যে আমার জন্ম জলভাগে
…আশ্চর্য কেচ্চাকার দাইমা আমার
… দাইমা আমার মা অথবা মা-ই দাইমা আমাদের
মাছেদের এ রকম হয়।
অশেষ ভাই বোন আমাদের মাছেদের
শুধু মনে নেই কে যেন এমন রুক্ষ ডাঙ্গায় ঠেলে দিয়েছে। এই তীব্র
আতপে কখন এলাম। কোনো ভূমিকার কথা মনে পড়ে না যেখানে
জলচরেরা একবার অন্তত বলবে-দেখা হবে!
সমুদ্রের টান এলে গুছিয়ে নিতে কেন এত দোনামোনা লাগে?
(পৃষ্ঠা: ৬১)
গ্রন্থের ‘শীতের স্তন’, ‘নিঃসঙ্গমে’, ‘আমি লক্ষ্মির প্রেমিক নই’, ‘মানুষের মৃত্যু হলে ভূত হয়ে যায়’, ‘বালক-বালিকা কিংবা বৃক্ষের আকাশ প্রণয়’, ‘ওয়ানওয়ে’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘চিন্তাদি’ শীর্ষক কবিতাগুলো পড়তে পড়তে জাফর আহমদ রাশেদ সম্পর্কে ব্যক্তি মনের তীরভূমিতে প্রতিবারই ছুটেছে একান্ত ঝিনুকের সুন্দর প্রতিভাষ। তার কবিতার পাঠ আমার কাছে অনেক ছবি, অভিজ্ঞতার সংশ্লেষ। শব্দের মায়াজাল বসে থাকে নিবিড় হয়ে আছে তার কবিতায়। কবিতার ভেতর ওঠে আসা শব্দগুলো শুধুই বেজে ওঠে অনুভবের সেতারে। গভীর নির্জনতা আর ধ্যানলীনতার ভাষ্য জাফর আহমদ রাশেদের কবিতায় বারেবারে আবিষ্কার করেছি।
কবিতায় রূপকে, রূপকে নতুন অভিজ্ঞানের আলোকে পার্থিব রহস্যের সন্ধান করতে করতে শব্দকে বেঁধেছেন তিনি নতুন চাঁছের বাঁধনে। কবিতায় অভিজ্ঞতার শিকড়কে ছড়িয়ে দিয়েছেন সময় আর হৃদয় ভাবনার গভীর প্রান্থেপ্রান্তরে। যেখানে বাইরের অভিঘাতে হৃদয়ের নক্ষত্র খসে পড়ে। উদাহরণ:
আছে তো মাছ-মাংস, সঙ্গে শিম বিচির সম্ভাবনা গিলে হত্যার পাপ থেকে নিষ্কৃতি মেলে না
বয়ঃসন্ধিকালে চালতে তলায় বীর্যমোচন হলো। সঙ্গমে বীতশ্রদ্ধ হলেই
কী লিঙ্গ নেড়ে ছেড়ে মৃত ইঁদুর ঝুলিয়ে রাখতে কে বারণ করেছে?
অবসাদে সুখ করো, মন্দিরা বাজাও।
…মুনিঋষিদেবতারা রথির যাচঞা জানাতেন, বিপ্রতীপ কর্ণ-ক্রোধ শুধু-জন্মের কথা তার
কে না জেনেছে!
… আমিষে আস্তাহীন সংযমী লোকটিও হত্যা সমর্থন করে। আচার্য
জগদীশচন্দ্র বলেছেন খাঁটি কথা: গাছের প্রাণ আছে বটে!
(পৃষ্ঠা: ১০)
‘দোনামোনা’র প্রতিটি কবিতায় তথাকথিত প্রচলিত কবিতার সীমান্ত ভেঙে দিয়েছেন জাফর আহমদ রাশেদ। নিঃশব্দের আলোকভুবন থেকে শব্দ এনে তাকে মিশিয়ে দিয়েছেন তিনি অভিজ্ঞতার সারাৎসারে। কথার পিঠের ওপর মৃদু তানপ্রধানের লয়, আবার কখনো বা পুঞ্জীভূত মেঘের মতো ভিড় করেছে ধ্বনি প্রাধান্যের রূপমাধুরী। কবিতায় তারা বৃষ্টিবিন্দুর মতো ঝরেছে নীরবে। নীরবতার নির্জনতায় মগ্ন চৈতন্যের স্রোত তার কবিতাকে দিয়েছে গতি। এক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ওপর ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো-চুপটি করে বসে থাকে প্রতিটি শব্দ, তার কবিতায় কোলাহল নেই। কোলাহলের ঝড়কে থামিয়ে মগ্ন নিঃসঙ্গ নির্জনতায়, কবিতার ভেতর দিয়ে জাফর আহমদ রাশেদ তৈরি করেছেন নিঃশব্দ নীলিমা।