জীবনের অর্ধশত বছর অতিক্রম করতে যাচ্ছেন কবি-গবেষক-প্রাবন্ধিক-গীতিকার-ছড়াকার-গল্পকার তপন বাগচী। বহুমুখী প্রতিভাবান এই মানুষটিকে নিয়ে বিশেষ আয়োজন আমাদের আশা জাগায়। শিল্পীকে প্রকৃষ্ট সম্মান করতে দেখলে নিজের কাছেই ভালো লাগে। আর কিছু না হলেও অন্তত শিল্পীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি সুযোগ তৈরি হয়। এমনকি শিল্পী সম্পর্কে অজ্ঞাতদের জানানোরও একটি প্রয়াস লক্ষ করা যায়।
কথাগুলো এ কারণেই বলা যে, সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কবি ও কথাশিল্পী বীরেন মুখার্জী সম্পাদিত শিল্প-সাহিত্যের ছোটকাগজ দৃষ্টির ‘তপন বাগচী প্রদীপ্ত ৫০’ সংখ্যাটি। তপন বাগচীর ৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে। এতে তপন বাগচীকে নিয়ে অগ্রজ, সমকালীন কবি-লেখক, বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী, ভক্ত ও অনুজদের মূল্যায়নগদ্য, স্মৃতিকথা, সাক্ষাৎকার ও নিবেদিত কবিতা-ছড়া প্রকাশিত হয়েছে। তপন বাগচী সম্পর্কে অনেক অজানা অধ্যায় উঠে এসেছে এ সংখ্যায়। দুই বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের মূল্যায়ন সত্যিই ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছে। ৩৬৮ পৃষ্ঠার এ আয়োজন সত্যিকারার্থে একজন শিল্পীকে উপস্থাপন করতে সর্বাঙ্গে যথেষ্ট না হলেও এ যাবতকালের শ্রেষ্ঠ সংকলন বলা যায়—নিঃসন্দেহে। এ জন্য শুরুতেই দৃষ্টির সম্পাদক বীরেন মুখার্জীকে সাধুবাদ জানাতে হয়।
তপন বাগচী সংখ্যাটিকে পনেরোটি পর্বে বিন্যাস করা হয়েছে। পর্বগুলো হচ্ছে—অগ্রজের চোখে, মূল্যায়ন-১, ছড়া ও কিশোর গল্প মূল্যায়ন, যাত্রা ও চলচ্চিত্র গবেষণার মূল্যায়ন, গীতিকবিতার মূল্যায়ন, সাক্ষাৎকার, স্মৃতিগদ্য ১, নিবেদিত কবিতা ও গল্প, স্মৃতিগদ্য ২, মূল্যায়ন ২, গ্রন্থালোচনা, অন্তরঙ্গ অবলোকন, বিশেষ রচনা, অভিসন্দর্ভ মূল্যায়ন ও জীবনপঞ্জি।
এ সংখ্যায় অগ্রজদের মধ্যে লিখেছেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, অসীম সাহা, আবু হাসান শাহরিয়ার, আবুল আহসান চৌধুরী, আল মাহমুদ, আসাদ চৌধুরী, কাজল চক্রবর্তী, গোপালকৃষ্ণ বাগচী, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, নিমাই ভট্টাচার্য, নির্মলেন্দু গুণ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, পবিত্র সরকার, প্রফুল্ল রায়, বাণী বসু, বিমানচাঁদ মল্লিক, বুদ্ধদেব গুহ, মনোজ মিত্র, মুহম্মদ নূরুল হুদা, মুহাম্মদ সাদিক, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, শংকর, শামসুজ্জামান খান ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাদের প্রত্যেকের লেখায় একজন অনুজের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। একই সঙ্গে এ কথাও বলা যায় যে, অগ্রজরাও অনুজদের রচনা বা সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন। আমার মনে হয়, তপন বাগচীর জীবদ্দশায় এরচেয়ে বড় কোনো সনদের আর প্রয়োজন নেই।
তপন বাগচীর সাহিত্যকর্মকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে মূল্যায়ন গদ্য লিখেছেন আনোয়ার কামাল, আবিদ আনোয়ার, আমিনুল ইসলাম, কুমার দীপ, গোলাম কিবরিয়া পিনু, গৌরাঙ্গ নন্দী, ফরিদ আহমদ দুলাল, মামুন রশীদ, মুহম্মদ শফি, মোহাম্মদ নূরুল হক, সমীর কুমার বিশ্বাস, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, সুমন সরদার, সৈয়দ রোকন, সৌম্য সালেক, অমিতাভ বিশ্বাস, পীযুষ কান্তি বড়ুয়া ও সেবক বিশ্বাস। প্রত্যেকেই তপন বাগচীর সাহিত্যকর্মের আলাদা আলাদা বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন।
তপন বাগচী রচিত ছড়া ও কিশোর গল্প মূল্যায়ন করেছেন অমিত রঞ্জন দে, চন্দন কৃষ্ণ পাল, নরেশ মণ্ডল, মহসিন হোসাইন, সমীর আহমেদ, সুকুমার চৌধুরী। যাত্রা ও চলচ্চিত্র গবেষণার মূল্যায়ন করেছেন অনুপম হীরা মণ্ডল, সাইফুল আলম, মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, শাহ সিদ্দিক। গীতিকবিতার মূল্যায়ন করেছেন কাজী মহম্মদ আশরাফ, দীনা আফরোজ, ফরিদুজ্জামান। তপন বাগচীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন বঙ্গ রাখাল। তবে পুরো সংখ্যাতে একটিই সাক্ষাৎকার পেয়েছি।
স্মৃতিগদ্য লিখেছেন চিত্তরঞ্জন সরকার, জাকির শাহ, নিমাই মণ্ডল, পিয়াস মজিদ, মহিবুল আলম, শিপ্রা গোস্বামী, হরিদাস ঠাকুর, এন জুলফিকার, মাসুদ রহমান, রেজা ঘটক। নিবেদিত কবিতা ও গল্প লিখেছেন অণিমা মুক্তি গমেজ, অরবিন্দ চক্রবর্তী, ঋতুশ্রী ঘোষ, চারুলেখা বিশ্বাস, জয়দ্বীপ চট্টোপাধ্যায়, নাহিদা আশরাফী, দেবাশিষ সাহা, বদরুল হায়দার, বিটুল দেব, বিমল গুহ, মিশকাত রাসেল, মুহম্মদ আশরাফুল আলম, শেখ একেএম জাকারিয়া, স্বপন মোহাম্মদ কামাল ও হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
ড. তপন বাগচীর কয়েকটি বই নিয়ে আলোচনা করেছেন আখতারুজ্জাহান, এমরান হাসান, পরিতোষ হালদার, শ্যামসুন্দর শিকদার। অন্তরঙ্গ অবলোকন করেছেন আবুল আজাদ, খালেক বিন জয়েন উদ্দীন, জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস, তমালিকা চক্রবর্তী, প্রতিভা রানী কর্মকার, প্রভাত কুমার দাস, ফারুকুর রহমান চৌধুরী, বাবু রহমান, বাবুল আশরাফ, বিভূতিভূষণ মণ্ডল, মোস্তফা হোসেইন, শাহ্জাহান আলী ভূইয়া, শেখ আব্দুস সালাম, শোয়াইব জিবরান, সুমনকুমার দাশ, রঞ্জিত চন্দ্র দাস, রফিকুর রশীদ, সুহৃদ সরকার, সোহেল মাজহার, হামীম কামরুল হক, হাসানআল আব্দুল্লাহ।
এ আয়োজনের বিশেষ রচনা লিখেছেন ড. তপন বাগচীর জীবনসঙ্গী কেয়া বালা, শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ, সৈয়দ আঁখি হক। বাংলাদেশের যাত্রাপালার ওপর করা অভিসন্দর্ভ মূল্যায়ন করেছেন প্রফেসর ড. আবুল আহসান চৌধুরী, প্রফেসর ড. আশরাফ সিদ্দিকী, প্রফেসর ড. স্বপন বসু। এছাড়া বেশকয়েকজন অগ্রজের কথার অনুলিখন করেছেন সৈয়দ আঁখি হক। সবশেষে রয়েছে ড. তপন বাগচীর জীবনপঞ্জি।
জীবনের অর্ধশত বর্ষের উপহার হিসেবে তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন তার ৭১টি বই। পুরস্কার এবং স্বীকৃতি পেয়েছেন ২৫টি। বাংলাদেশে এবং ভারতে বহু সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন এবং বক্তৃতা রেখেছেন। তিনি আটটি সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছেন। মাদারীপুরের কদমবাড়ি ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া এই প্রতিভাধর ব্যক্তি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। অনেক বাক পরিবর্তনের পর কর্মজীবনে থীতু হয়েছেন বাংলা একাডেমিতে। সেখানে তিনি উপপরিচালকের পদ অলঙ্কৃত করে আছেন।
পুরো সংখ্যাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে ড. তপন বাগচীকে আমিই সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। যেহেতু এ সংখ্যায় আমারও একটি মূল্যায়ন গদ্য রয়েছে। সংখ্যাটি হাতে পেয়ে সূচিপত্রের পরই তপন বাগচীর কিছু আলোকচিত্র আমাকে বিমোহিত করেছে। তবে মনে হচ্ছিল আরও কিছু আলোকচিত্র স্থান পেতে পারতো। পারিবারিক বলয়ের কিছু ছবি প্রত্যাশা করতেই পারি। মাসুক হেলালের করা নান্দনিক প্রচ্ছদে ৩০০ টাকা মূল্যের দৃষ্টি ড. তপন বাগচী সম্পর্কে যে পাঠকের চোখ খুলে দেবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
এত এত গুণীজনের অভিমত, স্মৃতিগদ্য, মূল্যায়ন পড়ে তপন বাগচীর প্রতি পাঠক যথাযথ ধারণা পাবেন বলেই আমার বিশ্বাস। একটি বিষয় পাঠককে খুব আকৃষ্ট করবে। আর তা হলো—প্রত্যেকের মূল্যায়নের সুর একই কণ্ঠে ঝঙ্কৃত হয়েছে। প্রায় জনের মন্তব্যই সাবলীল ও বস্তুনিষ্ঠ। বর্তমান তেলবাজির যুগেও এমন নির্মোহ আলোকপাত সত্যিই আশ্চার্যান্বিত করে। সবার মতেই তিনি বন্ধুবৎসল, পরোপকারী, নিরহঙ্কারী, আত্মভোলা, নির্মোহ, নিবেদিতপ্রাণ, নিবিষ্ট পাঠক, আত্মমগ্ন গবেষক। তার সম্পর্কে কারও কোনো অতিকথন আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। ফলে অকপটেই বলে দিতে পারি, ড. তপন বাগচী যা, তা-ই বলেছেন তার অগ্রজ ও অনুজরা। সস্তা জনপ্রিয়তার ধারায় ভেসে যাওয়ার মতো অভিধা তিনি অর্জন করেননি।
শুধু এপার বাংলায়ই নয়; ওপার বাংলাতেও তার সমান গ্রহণযোগ্যতা লক্ষ্য করা যায়। তার গান, গবেষণা, ছড়া, কবিতা—সমানভাবেই সমাদৃত দুই দেশের বাংলা ভাষাভাষীর মধ্যে। বহু কর্মগুণে গুণান্বিত এই মানুষটি শত বছরের কোটায় পৌঁছাবেন এমন প্রত্যাশা আমাদের সবার। লেখালেখির জগতে প্রচলিত একটি কথা হচ্ছে—কবি-সাহিত্যিকরা বেঁচে থাকতে সমাদর পান না। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, তপন বাগচীকে কিছুটা হলেও সমাদর করতে পেরেছেন বীরেন মুখার্জী। ওপার বাংলাতেও তার পঞ্চাশ পূর্তিতে বিশেষ আয়োজন হয়েছে শুনে আরও বেশি আনন্দিত হয়েছি।
ড. তপন বাগচীর পরোপকারের যে তালিকা এখানে পেয়েছি, তা একত্রিত করলে একজন মানুষের পক্ষে এতোটা পরোপকার সত্যিই মানব ইতিহাসে বিরল। শত্রু-মিত্র পরিবেষ্টিত হয়েও তিনি নির্লোভ থেকেছেন তার কর্মে-দক্ষতায়। তার বাগ্মিতা, ছন্দজ্ঞান, গীতিময়তা, কাব্যমধুরতা, নিরীক্ষা বাংলা সাহিত্যে নতুন এক মাত্রা সংযোজন করেছে। তিনি অগ্রজের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন, অনুজের শ্রদ্ধায় বিনয়ী হয়েছেন।
ব্যক্তি তপন বাগচীকে নিয়ে খুব বেশি আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। তার প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না। পাঠক শুধু এই সংখ্যাটি পড়লেই জেনে যাবেন তার আদ্যোপান্ত। তবে দৃষ্টি আয়োজিত ড. তপন বাগচী সংখ্যাটি আরও সতর্কতার সঙ্গে পাঠকের সামনে এলে মন্দ হতো না। ছোটকাগজের প্রতি পাঠকের প্রত্যাশা বরাবরই উচ্চমার্গীয়। নির্ভুল বানান, নান্দনিক বাক্যগঠন পাওয়ার দাবি তো ছোটকাগজের কাছেই করা যায়। এমনকি পাঠকও তাই মনে করেন। তবে সময় সংক্ষিপ্ততা বা সম্পাদনার দুর্বলতা যা-ই হোক না কেন, মুদ্রণজনিত ত্রুটি-বিচ্যুতি কখনো কখনো তথ্যগত জটিলতা সৃষ্টি করে। বিষয়টি সম্পাদককে মনে রাখার অনুরোধ করবো। তারপরও সবকিছু ছাড়িয়ে সংগ্রহে রাখার মতোই একটি সংখ্যা উপহার দিয়েছেন সম্পাদক। এই সংখ্যাটি ড. তপন বাগচী সম্পর্কে জানতে আমাদের তথ্যভাণ্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করবে। আগামী প্রজন্মের কবি-লেখকদের জন্যও আকরগ্রন্থ হিসেবে বিরাজ করবে।
সবশেষে আয়োজক, লেখকসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদন করছি। অশেষ শুভ কামনা গুণী এই মানুষটির জন্য। তিনি বেঁচে থাকুন আমাদের মাঝে। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকুন অনন্তকাল। হামীম কামরুল হকের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমিও বলতে চাই—যাত্রা নিয়ে লেখা ড. তপন বাগচীর উপন্যাসটি হাতে পেতে চাই। উপন্যাসটি আলোর মুখ দেখুক। তপনের আলোয় আলোকিত হোক আমাদের সাহিত্য জগৎ।