পাঠক হিসেবে আমি নিজেকে বিচিত্র বলে দাবি করি। কাঠামোবদ্ধ সাহিত্য রস অন্বেষণ বা জ্ঞান আহরণের জন্য বই আমি পড়ি না। বরং যখন যা যেভাবে হাতে পাই, পড়ে যদি আনন্দবোধ হতে থাকে, তাহলেই কেবল তা পড়া চালিয়ে যাই। আবার এটাও সত্যি যে, বই হাতে পেলেই তা সঙ্গে সঙ্গে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে পড়ে ফেলতে হবে, তেমনটাতেও আমি বিশ্বাসী না। বই আমার কাছে আইসক্রিমের মতো, যেটা খেতে হয় আয়েস করে একটু একটু করে চেটেপুটে। সমস্যা হলো কখনো এই বই আইসক্রিমটা ভালো লাগে, কখনো লাগে না। সবসময় পছন্দের আইসক্রিম কেনার মতো পকেটের স্বাস্থ্যও আমার নেই। সুতরাং সীমিত সামর্থ্যে অসীমিত স্বাদ খোঁজাই ফেব্রুয়ারির বই মেলা এলে আমার লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। সদ্য শেষ হওয়া মেলা থেকে যে কটা বই কিনতে পেরেছি আর পড়েছি, তার মধ্যে দুটি গল্পগ্রন্থ নিয়ে একটা তুলনামূলক আলোচনা ফাঁদার আইডিয়া কয়েকদিন ধরেই আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। একটি ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত নীহার লিখনের ‘চে ও হীমারন পাখি’ আর অন্যটি পুণ্ড্র প্রকাশন থেকে আসা জাহীদ ইকবালের ‘চাঁদেরহাটের ভাঙাপুল ও তেজপাতার বিছানা’। দুটি বইয়েরই গল্প কাঠামো, বর্ণন, চরিত্র সব আলাদা। উভয় লেখকেরই গল্পগুলোয় দেখাতে চাওয়া বিষয়বস্তুও ভিন্ন। কিন্তু কথা হলো তারপরও কেন তুলনামূলক আলোচনা মাথায় আসছে?
তুলনামূলক বিষয়টি মাথায় আসার প্রথম কারণ লেখকদ্বয় উভয়ই কবি। এরইমধ্যে নীহার লিখন ব্রহ্মপুত্রের কবি নামে পরিচিতি পেয়েছেন। অন্যদিকে জাহীদ ইকবাল একইসঙ্গে কবিতা আর কথা সাহিত্যের সাগরে সাঁতরে চলেছেন অনেকদিন। তবে কবি পরিচয়েই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বলে জানি। তারা উভয়ে কেমন লেখেন, কার মনীষা প্রজ্ঞা কতটা গভীর—সেদিকে যাবো না। বরং দু’জন কবির লেখা গল্পের বই দুটি নিয়েই আলোচনা এগোতে পারে। বই দুটির মধ্যে আমি তুলনা নিয়ে আসছি আরেকটি কারণে। নীহার ও জাহীদ উভয়ের গল্পগুলোর ঢং এমন রূপক ভাষার যে, সেটা কখনো এক ধরনের নির্লিপ্ত বিমূর্ততা তৈরি করে, আবার কখনো হয়ে ওঠে কর্কশ।
প্রথমে ‘চে ও হীরামন পাখি’ বইটি নিয়েই কথা বলা যাক। ১১টি গল্পসমৃদ্ধ বইটি কিন্তু মোটেও ঢাউস সাইজের নয়। কিন্তু এর ভেতরে নীহার বিভিন্ন সচেতন, অচেতন একইসঙ্গে অবচেতন বোধের যে ঢাউস মালমশলা ঢুকিয়েছেন তা সত্যি অপূর্ব স্বাদের। শুধু দারিদ্র্য নয়, তুমুল ভোগ বিলাসের মধ্যেও কোনো কোনো মানুষ সম্পূর্ণ একা হতে পারে। স্মৃতির অসুখ উসকে দিতে পারে অন্যের হয়তো সামান্য কিছু। ঠিক যেমন প্রথম গল্পটিতে রাস্তায় অস্থি-চর্মসার এক ভিক্ষুক নারীর গলার বিউটি বোন দেখে নিজের বিগত যৌবনের দুঃখ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বিত্ত-বৈভবে ডুবে থাকা রুবিনা সামাদের। আবার ‘ইনসোমনিয়া’ গল্প পড়ে যেন অদ্ভূত আচ্ছন্নতায় জড়িয়ে পড়তে হয়। গল্পের লোকটার জন্য পাঠকেরও মায়া হবে। বলা হয়, প্রায় সব গল্পেই লেখক আসলে অবচেতনভাবে নিজের কথাই লেখেন। ‘ইনসোমনিয়া’ নীহার লিখনের তেমন কোনো গভীর গোপন গল্প কি না—জানি না। তবে অজান্তেই আমিও লেখকের মাথায় হাত রেখে বলেছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখো আমরা আমাদের মতো করে সব ঠিক করে নেবো।
আমার মতে বইটিতে সবচেয়ে জরুরি দুটো গল্প নীহার বলেছেন ‘পাগলটা’ আর ‘চে ও হীরামন পাখি’। ‘পাগলটা’ গল্পটি পড়তে পড়তে অজান্তেই মনে হতে থাকে নানামুখী যন্ত্রণায় অস্থির এই জীবনে যদি সত্যিই পাগলটার মতো নির্বিকার হওয়া যেতো, তাহলে হয়তো খানিক শান্তি পেতাম। আর শেষ গল্পে রাজকুমাররূপী চে গেভারার সঙ্গে এক হীরামনের কথোপকথন আমাদের নতুন করে আশাহীনতার ভ্রমের মধ্যে ফেলে। দ্বিধাগ্রস্ততায় চের মতো আমিও মাথা নিচু করে থাকি। মনে মনে বলি, চারদিকে সত্যি কত জন। এর মধ্যে কে যে মানুষ, কে যে রাক্ষস—আমি ঠিক ঠাহর করতে পারি না।
লক্ষণীয় হলো গোটা বইটিতে নীহারের ভাষা খুব ঝরঝরে এবং সহজ। প্রতিটি গল্পেই বিভিন্ন বাক্যে নানা ধরনের মেটাফোর ব্যবহার করলেও তা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠেনি। লাইনে লাইনে গভীর কাব্যিক বোধ থাকলেও অযথা উপমার ব্যবহার করে সেটাকে ভারী করে তোলেননি।
এবার যদি আসি জাহীদ ইকবালের ‘চাঁদেরহাটের ভাঙাপুল ও তেজপাতার বিছানা’ বইটিতে, সেখানে ঘটেছে ঠিক তার উল্টো। বইটির প্রতিটি গল্পেই লেখক শৈল্পিক রূপে সমাজের একেবারে নিম্নবর্গের মানুষের রুক্ষ-কঠিন জীবন আর যৌনতার ফ্যান্টাসি তুলে ধরেছেন। এসেছে অবদমিত কাম, লিপ্সা, আসক্তি, মোহসহ নানা কিছু। এই যৌন ফ্যান্টাসির ভাষা এতটাই রুক্ষ যে অস্বস্তিতে আচ্ছন্ন লাগে। ‘বুনো ষাঁড়’, ‘ন্যাঙটু’, ‘জনক’ ও ‘একটি ব্রার গল্প’ লেখাগুলোয় এমনই তীব্র বুনো ছাপ আছে যে পাঠকের ইন্দ্রিয়কে ঝাঁকুনি দেয়। ‘বুনো ষাঁড়’ গল্পের ফিদু বা ন্যাঙটু বাবার মতো অ্যান্টা-প্রোটাগনিস্টদের প্রতি একসময় ঘৃণা যেমন হয়, তেমনি তারা মায়ারও উদ্রেক করে। বইটির ‘আমন ধানের মৌসুম’ গল্পটিও খুব ভালো। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। সে কারণেই মূলত এই তুলনামূলক আলোচনা।
উভয় লেখক কবি হলেও নীহার লিখন যেভাবে তার গল্পে কাব্যিক ছাপ অক্ষুণ্ন রেখে কবিতা ভাব এড়িয়ে যেতে পেরেছেন জাহীদ তা পারেননি। জাহীদ ইকবালের প্রতিটি গল্পেই লাইনে লাইনে এসেছে অসংখ্য উপমা। যা প্রথম প্রথম হয়তো পড়তে ভালো লাগে, কিন্তু পরে তা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যৌনতার বিষয়টি আরও প্রকট করে তুলতে ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দের পৌনঃপুনিকতাও চোখে পড়ার মতো। আছে বানান ভুলের বিভ্রাট ও কিছু কিছু শুদ্ধ বাক্যের শব্দের মধ্যে অবচেতনভাবে বসে যাওয়া আঞ্চলিক শব্দ। গোটা পণ্ডুলিপিটি সঠিকভাবে সম্পাদনার অভাবেই এমনটা হয়েছে বোধ করি।
নীহার লিখন বা জাহীদ ইকবাল দু’জনের গল্পগ্রন্থের মধ্যে তুলনা করে আমি কখনোই এটা বোঝাতে চাইছি না যে তারা কে কতটা ভালো লিখেছেন, বা কে কতটা খারাপ লিখেছেন। আমার উদ্দেশ্য শুধু এটাই বলতে চাওয়া যে, জাহীদ যে দুর্দান্ত গল্পগুলো বলেছেন তা তুলে ধরতে তিনি আরেকটু যত্নশীল এবং সচেতন হলে সেগুলো আরও অসাধারণ কিছু দাঁড়াতো। নীহারের সফলতা যে, তিনি গল্প বলার চ্যালেঞ্জে জাহীদের খামতির দিকগুলোতে ৯০ শতাংশ উৎরে গেছেন।