নতুন মাত্রার কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কবি ফজলুল হক তুহিনের কাব্যগ্রন্থ ‘দীর্ঘ দুপুরের দাগ’। দীর্ঘপথ পরিক্রমায় কবি যেন এক ক্লান্ত পথিক, নামকরণের মধ্যে সেই প্রতিফলন লক্ষণীয়। যাপিত জীবনের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে এ কাব্য।
কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো মূলত বর্তমান সমাজ বাস্তবতা, চলমান সময়, প্রকৃতি, প্রেম, দ্রোহ ও রাষ্ট্রের প্রতিই নিবদ্ধ। প্রতিটি চরণে কবি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন কখনো প্রেমময় আলোকের জ্যোতিতে, কখনো দ্রোহের উতল হাওয়ার গতিতে।
‘এই বুঝি ঢেউয়ে ঢেউয়ে মিশে যায় মুমূর্ষু উদ্বাস্তু প্রাণ/ ঝাঁক বেঁধে শুরু হয়ে যাবে ক্ষুধাতুর শকুনের অভিযান’-শুধু যাপিত জীবনের গ্লানি নয়, রাজনৈতিক টানাপড়েনও কবিকে আক্রান্ত করেছে। মানবতাহীন, নৈতিক মূল্যবোধহীন সমাজব্যবস্থার রোষানলের আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত কবির হৃদয়। জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে তাই কবি অকপটেই উচ্চারণ করেন,
জীবনের কাছে করজোড়ে আমি চেয়েছি কেবল সামান্য সুখ
হিংসার বাঘ খেয়েছে সকল, পরাজিত আমি জীবনবিমুখ
হাজার বছর কৃষ্ণপক্ষে থেকে এতোটুকু চেয়েছি সকাল
চিরতরে আজ ঊষার বিদায়, সড়কে বিছানো শিমুলের ডাল
এরপরও কবি মানবিক মূল্যবোধর জায়গায় আস্থাশীল। যা কবিকে বেঁচে থাকার নিরন্তর প্রেরণা জুগিয়েছে। মাটি ও মানুষের মমতা, প্রকৃতির অবারিত প্রেম, এসবই কবিকে আশায় বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে।
তুহিন তার কবিতার বিষয়, আঙ্গিক, শব্দ প্রয়োগ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প, রূপক এবং বাক্যের সাবলীল গঠনে হয়ে ওঠেন একজন নিপুন শিল্পী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নস্টালজিক স্মৃতি কাতরতার প্রকাশ ঘটলেও তিনি চলমান সময়ের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং রাজনীতির বাঁক বদলের রহস্য উন্মোচনেরও চেষ্টা করেছেন।
সইসব সূর্যপোড়া বৃষ্টিহীন দীর্ঘ দুপুরের দাগ
জীবন জমিনে জেগে আছে ইটের ভাটার মতো
শান্তিমাটি জ্বলতে জ্বলতে টেরাকোটা লাল
স্বপ্নমাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে মহাস্থানগড়ের দেয়াল
সুখ মাটি পুড়তে পুড়তে নাগাসাকি
এই দগ্ধ বুক দগ্ধ মন আমি এখন কোথায় রাখি?
মূলত গণমুক্তির চেতনাবোধ, মনন ও আবেগের সমন্বয়ে এক গভীর জীবনবোধ তাঁর কবিতায় সুন্দরভাবে চিহ্নিত হয়েছে। এক্ষেত্রে কবিকে যেমন হতে হয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত, তেমনি হতে হয়েছে কৌশলী সৈনিক।
আমি কোন্ দিকে যাবো?
গগনে গগনে শকুনের ডানা পবনে পবনে শিয়ালের হুক্কাহুয়া
সড়কে সড়কে বিষদাঁত বের করে ঘেউঘেউ করে কালের কুকুর
ফসলের মাঠে জনপদে পথে পথে চারদিকে বুলেটের খুন অপমৃত্যু
হরিণ শিকারে টোয়াপাতা ফাঁদ হয়ে ওত পেতে আছে সর্বনাশ
বাঁচার আশ্বাস আছে কারো কাছে?
কবিতার শারীরিক অবকাঠামো নির্মাণেও কবি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, অনুপ্রাস সমৃদ্ধ নামকরণই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ- ‘দীর্ঘ দুপুরের দাগ’। শুধু আঙ্গিক গঠনই কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য নয়, উপলব্ধিগত এবং সর্বপরি শিল্পগত মান অক্ষুণ্নতাই কবিতাকে টিকিয়ে রাখে, সেদিক থেকেও কবি ফজলুল হক তুহিন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এতকিছুর পরেও রোমান্টিক সৃজনে আচ্ছন্ন হয়েছেন কবি। কবির রুদূরপ্রসারী মন সদা জাগ্রত স্বপ্নময় পৃথিবী নির্মাণে। স্বপ্নের দক্ষ নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে গড়তে চেয়েছেন প্রেমময় প্রাসাদ।
গণমানুষের কথাও উঠে এসেছে তুহিনের কবিতায়। অধিকার বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহানুভূতির হাত যেমন বাড়িয়ে দেন, তেমনি প্রতিবাদী হয়েছেন ঘুণে ধরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাঁর কবিতার বেদনায় দাগ থাকলেও আশাবাদী করে তোলেন অগ্রসরমান সমাজ ব্যবস্থার দিকে। একটি সুখী সমৃদ্ধ জীবনই তার অন্তিম গন্তব্য।
আমাদের ঘরবাড়ি পার্ক এভিনিউ মাঠ দুগর্ন্ধের ডাস্টবিন
আবাদি জমিন উত্তরাধিকার আজকাল পোকার কামড়ে পরিত্যক্ত
মানুষের মনে বাঘ শেয়াল ভালুক কুমীর হিংস্রতা করে ব্যক্ত।
দেখে দেখে শিহরিত ভয়ার্ত শোকার্ত আমি নির্বিকার
চোখ ফিরিয়ে নিলাম রাজপথে দেখে রক্তের আগুন
ব্যর্থ আমি চেয়ে আছি আগামীর দিকে—ফোটাবে সে প্রাণের ফাগুন।
প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, অন্তর্জগতের টানাপড়েন এসবই তার কাব্যিক চোখে ধরা পড়েছে সুচারুভাবে। গতানুগতিক প্রবাহে প্রভাবিত না হয়ে বরং চিরন্তন চৈতন্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছেন দ্বীধাহীন চিত্তে, এটি তার কবিতার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের গুণেই কবি আগমীর অগ্রযাত্রায় সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করবেন- একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই পথচলায় কবিকে নানামুখী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তার পরেও তিনি হতাশ নন কোনোভাবেই।
এ-এমন এক কালস্রোত
যেখানে চলেছে ভেসে শুধু রক্তপদ্ম
ডাঙায় কুমীর জলে হাঙরের বান
অথচ আমাকে যেতে হবে ভয়াল উজান।
যে যা-ই বলো না কোনো কিছুতেই হবে না এই ধারার বাঁক
যদি না একটি বার প্রাণপণে হতে পারি গতিমান ঝাঁক।
কবির সমগ্র জীবন পেণ্ডুলামের মতো বারবার দোলাচলে অস্থির-
জন্ম থেকে এভাবেই দুলে দুলে পাঁজরে জমেছে কালের কহর
সময়ের বাঁকে পাঁকে ঘণ্টাধ্বনি আমাকে অস্থির করে নিরন্তর
গৃহস্থ কৃষক হয়ে কোথাও সুস্থির হতে দিলো না কখনো
প্রত্যুষ গোধুলি কোনটাই আমি চাইনি জীবনে।
একবার ছুটে চলি অমৃতের অসীম আলোয়
অন্যবার ধাক্কা খেয়ে পড়ি গরলের অনন্ত কালোয়।
সহ্যহীন এই জোয়ার ভাটা কী পৃথিবীর মতো প্রাকৃতিক
দম শেষ না হওয়া পর্যন্ত কী এভাবে চলবে টিকটিক ঠিকঠিক?
শেষমেশ কবিতাকেই করেন সঙ্গী ফজলুল হক তুহিন। জীবনে-মরণে কবিতাকেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে চেয়েছেন। ক্রান্তিকালের অন্ধকার সরিয়ে গড়তে চেয়েছেন স্বপ্নময়, প্রেমময় জীবনের মজুবত প্রাসাদ। এ কাব্যগ্রন্থে কবির শৈশব-কৈশরগ্রন্থ প্রবহমান জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে। কবি ভুলতে চাননি তার অতীত ঐতিহ্য ও বাঙ্ময় জীবনের প্রতিচ্ছবি।
ছোটবড় মোট ৬৮টি কবিতা এতে স্থান পেয়েছে। ভিন্ন স্বাদের এ কবিতাগুলো পাঠমাত্রই এর নিগূঢ় অর্থ পাঠক আবিষ্কার করতে পারবে। কেননা, কবিতাগুলো সহজ-ব্যঞ্জনাময় এবং সাবলীল ভাষায় রচিত হয়েছে। পাঠক মহলে একটি আলোচিত হোক, সমাদৃত হোক এবং বহুল প্রচারে প্রসার হোক সেই শুভ কামনা।
দীর্ঘ দুপুরের দাগ
কবি: ফজলুল হক তুহিন
প্রকাশক: পরিলেখ
প্রচ্ছদ: ইয়াহিয়া সেলিম
মূলা: ১৪০ টাকা
প্রকাশকাল: একুশে বইমেলা ২০১৬