কথাসাহিত্য-বিষয়ক গবেষণা বা সমালোচনামূলক প্রবন্ধ সুপ্রচুর নয়। অর্থাৎ কবিতাবিষয়ক যত সমালোচনামূলক প্রবন্ধ বা গবেষণা-অভিসন্ধর্ভ লেখা হয়েছে, ততটা হয়নি কথাসাহিত্য নিয়ে। এর কারণ হয়তো এই, কবিতা আকারে ছোট, স্বল্পতম সময়ে দ্রুত পড়া যায়। দ্রুত বিশ্লেষণাত্মক বা পাঠোদ্ধারমূলক প্রবন্ধ-গদ্যও লেখা সম্ভব। বিপরীতে কথাসাহিত্য বিশেষত উপন্যাস নিয়ে কাজ করা বেশ সময়সাপেক্ষ-পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার। এই কারণে সমালোচক-গবেষকরা কথাসাহিত্যের চেয়ে বেশি আগ্রহ দেখান কবিতা-বিষয়ক আলোচনায়। কিন্তু সবাই একই পথের পথিক নন। ব্যতিক্রমও আছেন। সেই ব্যতিক্রমীদের একজন জান্নাতুল যূথী। এর প্রমাণ ‘দিলারা হাশেমের উপন্যাস: বিষয় ও প্রকরণ’। এই গ্রন্থটি লেখকের এমফিলের থিসিস হলেও পাঠোদ্ধার ও বিশ্লেষণে তার নিজস্বতার ছাপ থাকায় হয়ে উঠেছে হৃদয়গ্রাহী আলোচনা।
এই গ্রন্থে দিলারা হাশেমের উপন্যাসের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। করেছেন যৌক্তিক পাঠবিশ্লেষণও। একইসঙ্গে তার উপন্যাসের বিষয় ও প্রকরণ ধরে ধরে আলোচনা করেছেন গবেষক। পুরো বইকে তিনি ৫ অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। এর বাইরে লিখেছেন উপসংহার। সঙ্গে দিয়েছেন গ্রন্থপঞ্জিও। অধ্যায়গুলো হলো, ‘পরিপ্রেক্ষিত’, ‘বাংলাদেশের উপন্যাস ও দিলারা হাশেম’, ‘দিলারা হাশেমের উপন্যাস: সমাজ ভাবনা’, ‘দিলারা হাশেমের উপন্যাস: রাজনীতি ও ইতিহাস অনুষঙ্গ’ ও ‘দিলারা হাশেমের উপন্যাস: শিল্পপ্রকরণ’।
এই ৫ অধ্যায়ে দিলারা হাশেমের উপন্যাসগুলোর বিষয় ও প্রকরণ তুলে ধরেছেন। এসব আলোচনায় মূল পাঠ থেকেই উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তার বক্তব্যের সমর্থনে পূর্ববর্তী কোনো আলোচককে সাক্ষ্য মেনেছেন খুব কম। অর্থাৎ অকারণে পূর্ববর্তী আলোচকদের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করেননি। ততটুকুই করেছেন, যতটুকু অলঙ্কারে তরুণীর সৌন্দর্যের সহায়ক হয়। ফলে অতি উদ্ধৃতির ভারে গবেষণাপত্রটি নুয়ে পড়েনি।
লেখক যেখন বাদী বা বিবাদীর ভূমিকায়, সমালোচক-গবেষক সেখানে বিচারকের আসনে। তাই বাদী-বিবাদীরূপী লেখকের সাহিত্যকর্মে দোষ-গুণ নির্মোহভাবে আলোচনা করা সমালোচকের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এক্ষেত্রে নিছক সমালোচক যিনি, তিনি আদর্শ বিচারকের মতোই কাজ করেন। বিচারক যেমন অপরাধীকে শাস্তি দিলেও তার প্রতি সংবেদনশীল থাকেন, তেমনি সমালোচকও কবি-কথাশিল্পীর ছোটখাটো ভুল নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন না। বরং ভালো দিক নিয়ে সপ্রশংস আলোচনা করে পাঠককে মূল সাহিত্যকর্ম পাঠে আগ্রহী করে তোলেন। তবে, গবেষকের এতটা স্বাধীনতা নেই। তাকে প্রকৃত তথ্যই হাজির করতে হয়। না হলে তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই গবেষককে নির্মোহ থাকতে হয়। গবেষক জান্নাতুল যূথীও তেমনই একজন নির্মোহ-নিরপেক্ষ-বস্তুনিষ্ঠ গবেষক। তিনি এই গবেষণাপত্রে বাংলাদেশের উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত ধারাবাহিক পরিচয়, সমাজ, মধ্যবিত্ত, নারীভাবনা, রাজনীতি, ইতিহাসকে অনুষঙ্গ মেনে পুরো বইয়ে আলোচনা করেছেন। একইসঙ্গে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন দিলারা হাশেমের উপন্যাসের শিল্পশৈলীও।
‘পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক প্রথম অধ্যায়ে লেখক বাংলা উপন্যাসের কালানুক্রমিক বর্ণনা দিয়েছেন। তুলে ধরেছেন বাংলা উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি ও বিষয়-আশয়ের সংক্ষিপ্ত রূপ। একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ থেকে নজিবুর রহমান পর্যন্ত অনেক লেখকের উপন্যাসের বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরেছেন। দিয়েছেন নিজস্ব মতও। অবশ্যই নিজের মত প্রকাশের আগে এসব উপন্যাসের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক রূপ ব্যাখ্যা করেছেন। শুধু যে আলোচনা করেছেন, তা নয়; মাঝেমাঝে তুলনামূলক আলোচনাও করেছেন। বিশেষত বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চোখের বালি’র প্রধান চরিত্রগুলোর ভূমিকা আলোচনায় যূথী প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ দুজনের কাউকেই লেখক ছাড় দেননি। তাদের ধর্মীয় অবস্থান ও পক্ষপাতকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, ‘সামাজিক আদর্শবাদ প্রচারে বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। বঙ্কিম পাপকর্মের জন্য রোহিণীর মৃত্যু ঘটিয়েছেন গোবিন্দলালৈর হাতে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিনোদিনীকে সেভাবে রূপায়ন করেননি। তিনি বিধবার প্রেমকে ভর্ৎসনা করেনেনি কিন্তু শেষপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথও বিনোদিনীর স্বীকৃতি দেননি। বরং তিনি মহেন্দ্রর কাছে বিনোদিনীকে মাপ চাইয়েছেন। এরপরই উদ্ধুতি দিয়েছেন এভাবে, ‘‘মহেন্দ্র আসিয়া প্রণাম করিয়া কহিল, ‘বোঠান, মাপ করিয়ো।’ বিনোদিনী কহিল, ‘তুমিও মাপ করিয়ো ঠাকুরপো, ভগবান তোমাদের চিরসুখী করুক।’’ এই আলোচনা ও উদ্ধৃতির ভেতর একজন গবেষক-সমালোচকের মনস্তত্ত্ব ও ন্যায়বোধ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। জান্নাতুল যূথী দেখিয়েছেন, বঙ্কিম যেমন নীতিবাদী, তেমনি রবীন্দ্রনাথও। তারা কেউ মানবিক হতে পারেননি। তারা শিল্পচর্চা ও মানবিক আবেদনের চেয়ে নীতিজ্ঞানকে বড় করে তুলেছেন। সাহিত্যের নামে তারা ধর্মীয় আদর্শ ও সামাজিক নীতিবোধের চর্চাই করেছেন।
বর্তমানে নিগ্রহের শিকার উচ্চশিক্ষার অভিশাপে। অর্থাৎ সর্বত্রই পুরুষতন্ত্রের খড়্গ নারীর গলার ওপর ঝুলছে। সেই খড়গের ভয় দেখানো হয় কখনো নারীকে অন্তপুরে রেখে, কখনো বা বাইরে মাঠে নানা অভিযোগে হেনস্তার ভেতর দিয়ে।
সাহিত্য সমালোচকরা আলোচ্য বিষয়ের গ্রহণযোগ্যতা বিচার করেন সাধারণত নিজের অভিরুচি ও মর্জি অনুযায়ী। সমালোচকের বিবেচনাবোধ সবসময় অ্যাবসুলেট কিছু হবে, বিষয়টা তেমন নয়। অনেক সময় তার মত একান্ত ব্যক্তিগতও হতে পারে। তবে, সেই ব্যক্তিগত অভিমত শিল্পকে অস্বীকার করে নয়। শিল্পের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই তাকে শিল্পের বিচার করতে হয়। জান্নাতুল যূথীও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি দিলারা হাশেমের উপন্যাস আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় অধ্যায়ে বাংলাদেশের উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিত ঔপন্যাসিক দিলারা হাশেমকে নিয়ে আলোকপাত করেছেন। এই অধ্যায়ে বাংলাদেশের উপন্যাস নিয়ে আলোচনাকালে লেখক বলছেন, ‘…আধুনিক শিক্ষার এসব গ্রহীতারাই পরবর্তীকালে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে, অন্তত সংখ্যার দিক দিয়ে পুষ্ট করে তোলে। সাত চল্লিশের দেশবিভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসন, পয়ষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ভারত-পাকিস্তানযুদ্ধ, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম বাঙালির ব্যক্তি ও সমাজ মানসে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, যে আশা-নিরাশার জন্মদান করে, সবই বাংলাদেশের উপন্যাসে লক্ষণীয়।’ এই কটি লাইনেই সমালোচক বাংলাদেশের উপন্যাসের বিপুল পটভূমির একটি সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্র এঁকে দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের উপন্যাসকে পটভূমি ধরে লেখক মূলত দিলারা হাশেমের লেখক সত্তার প্রস্তুতি, উন্মেষ ও বিকাশ পর্ব সম্পর্কে বলতে প্রয়াসী হয়েছেন। লেখকের মতে, ‘দিলারা হাশেমের সাহিত্যচর্চার নেপথ্যে পারিপার্শ্বিক জগতের ভূমিকা ছিল। বরিশালে তার বেড়ে ওঠা কিন্তু যশোরে দাদার বাড়ি হওয়ায় মাঝেমাঝে সেখানে বেড়াতে যেতেন। এছাড়া তার নানাবাড়ি মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কিন্তু তার মামাবাড়ি বা নানা বাড়ি বলতে কলকাতায় বেড়াতে যেতেন। দিলারা হাশেমের মা কলকাতায় তার নানির কাছেই মানুষ।’ লেখক এরপর জানাচ্ছেন, দিলারা হাশেমের লেখকমানস গড়ে ওঠার পেছনে এভাবে বেড়ানো বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। ‘দিলারা হাশেমের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাকে লেখক হয়ে উঠতে সহযোগিতা করে।’ এই মন্তব্যের সমর্থনের জবানিতে লেখক হয়ে গড়ে ওঠার বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। এরপরই দিলারা হাশেমে উপন্যাস, গল্প, কবিতাগ্রন্থতালিকা তুলে ধরেছেন জান্নাতুল যূথী। প্রথম থেকে দ্বিতীয় অধ্যায়—এই পর্যন্ত দিলারা হাশেমের মানস গড়ন নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু ছোট একটি ত্রুটি রয়ে গেছে এখানে। ‘বাংলাদেশের উপন্যাস ও দিলারা হাশেম’ শীর্ষক অধ্যায়ে দিলারা হাশেমের মানসগড়ন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শৈশব-কৈশোর ও প্রতিবেশ বর্ণনা করেছেন শুধু। বাংলাদেশের সামগ্রিক উপন্যাস সাহিত্যে ঔপন্যাসিক দিলারা হাশেমের অবস্থান কোথায়, তা নির্দেশ করেননি।
সমালোচকেরা সব সময়ই লেখকের রচনার বহুমুখী দিক তুলে ধরে তার বিশ্লেষণ করার প্রয়াস দেখান। এরমধ্যে সমাজ সচেতনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সমালোচক জানেন—লেখককে হতে হয় সমাজ সচেতন। সমালোচককেও। এক মাত্র সমাজসচেতন সমালোচকের পক্ষেই সম্ভব লেখকের সমাজভাবনা বিষয়ক ইস্যুগুলো চুরচেরা বিশ্লেষণ করা। সমালোচকের যদি সমাজসচেতনতার অভাব থাকে, তাহলে লেখকের দুর্বলতা কিংবা সফলতার কোনো দিকই তিনি শনাক্ত করতে পারবেন না। তখন তার সমালোচনা কেবল ব্যক্তিগত অভিমত ও রিডিংসর্বস্ব আলোচনায় পর্যবসিত হবে। জান্নাতুল যূথীও সমাজ সচেতন। তাই এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি দিলারা হাশেমের উপন্যাসে ‘সমাজ ভাবনা’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ‘দিলারা হাশেমের উপন্যাস: সমাজ ভাবনা’ শীর্ষক এই অধ্যায়ের শুরুতে সমালোচক লিখছেন, ‘উপন্যাসে সমাজজীবনের প্রতিফলন ঘটে। সমাজকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের গতি-প্রকৃতি পরিলক্ষিত হয়। একজন ঔপন্যাসিক সমাজ থেকে উপকরণ গ্রহণ করে কল্পনার আশ্রয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেন। তাই বলা হয, উপন্যাস সমাজ বাস্তবতা এবং কল্পনার সংমিশ্রণে সৃষ্টি।’এই উক্তির ভেতর দিয়েই তার মননের পরিচয় মেলে। তিনি যা বিশ্বাস করেন, তারই আলোকে দিলারা হাশেমের উপন্যাসে ‘সমাজ ভাবনা’র বিচার করেছেন।
এই অধ্যায়কে লেখক দুটি পরিচ্ছেদে ভাগ করেছেন। প্রথম পরিচ্ছেদের নাম দিয়েছেন, ‘মধ্যবিত্তের সংকট’। এই অধ্যায়ে দিলারা হাশেমের উপন্যাস ধরে ধরে মধ্যবিত্তের সামাজিক, আর্থিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকটের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্লেষণের মাঝেমাঝে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। করেছেন মূল্যায়নও। মধ্যবৃত্ত সমাজে যে অর্থনৈতিক টানাপড়েনের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক সংকটও প্রকট আকার ধারণ করেছে, সেই চিত্র কী পরিমাণে চিত্রিত হয়ে দিলারা হাশেমের উপন্যাসে, তারই চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন জান্নাতুল যূথী। এই পরিচ্ছেদের সমাপ্তি টানতে গিয়ে সমালোচক একবাক্যে এভাবে মূল্যায়ন করেছেন, ‘তাঁর প্রায় সকল উপন্যাসে মধ্যবিত্তের সংকট, হতাশা-নৈরাশ্য বিশেষভাব স্থান পেয়েছে।’
এই অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের নাম, ‘নারী-ভাবনা’। মূলত এই অধ্যায়ে সমালোচক নিজেকে পুরোটা নিংড়ে নিয়েছেন। তিনি জানেন, শিল্পের মূল অসুখ কী? অর্থাৎ আলোচ্য কেন্দ্রবিন্দু কী? সেই কেন্দ্রবিন্দুতে আলোর প্রক্ষেপণ করাই সমালোচকের কাজ। এই পরিচ্ছেদে দেখিয়েছেন, দিলারা হাশেমের উপন্যাসের মূল অসুখ হলো নারী-ভাবনা। গবেষক দেখিয়েছেন, বাঙালি সমাজে নারী আগে অবহেলিত ছিল শিক্ষার অভাবে। বর্তমানে নিগ্রহের শিকার উচ্চশিক্ষার অভিশাপে। অর্থাৎ সর্বত্রই পুরুষতন্ত্রের খড়্গ নারীর গলার ওপর ঝুলছে। সেই খড়গের ভয় দেখানো হয় কখনো নারীকে অন্তপুরে রেখে, কখনো বা বাইরে মাঠে নানা অভিযোগে হেনস্তার ভেতর দিয়ে। আলোচ্য গবেষক বলছেন, ‘দিলারা হাশেমের উপন্যাস নারীপ্রধান। তিনি নারী জীবনের নানাবিধ সমস্যা, সংকট, জটিলতা, সামাজিক বৈষম্য ইত্যাদি আলোচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি উপন্যাসে মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীদের জীবনসংগ্রাম, দ্বন্দ্বমথিত সত্তার রূপায়ণ করেছেন। তাঁর উপন্যাসে নারীদের একটি বিশেষ বলিষ্ঠ দিক আছে। তারা পরিশ্রমী, জীবনের সঙ্গে যুদ্ধে তৎপর, তারা জীবনসংগ্রামে পরাজিত হতে হতেও জয়ী।’
এই পরিচ্ছেদে গবেষক উপন্যাস ধরে ধরে নারী চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। এসব নারী চরিত্র নির্মাণে দিলারা হাশেম কতটা বাস্তবনিষ্ঠ, জীবন ঘনিষ্ঠতার স্বাক্ষর রেখেছেন, তা বিচার করে দেখিয়েছেন গবেষক। দিলারা হাশেমের উপন্যাসের নারীদের পরিণতি পর্যবেক্ষণ করে গবেষকের উপলব্ধি হলো—‘বিয়ের মাধ্যমে একজন নারী তার সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করতে চায়।’ আবহমান বাঙালি নারীর ক্ষেত্রে এই শর্ত যে পনেরো আনাই খাটে, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গবেষক নিজেই বলছেন, ‘দিলারা হাশেম সমাজকে অতি কাছ থেকে দেখেছেন, সমাজে একজন নারীর অবস্থান কী এবং কেমনভাবে তাকে বেড়ে উঠতে হয়, সবই তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। নারীর চোখে তিনি নারীকে মূল্যায়ন করেননি বরং সমাজে একজন নারীর অবস্থান কেমন, তাই তিনি দেখিয়েছেন।’ আলোচ্য গবেষকের এই সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক, তা উপন্যাসগুলো পাঠেই প্রতীয়মান হবে। তবে, এখানেও যে প্রতীয়মান হচ্ছে, তার প্রমাণ গবেষকের দেওয়া উদ্ধৃতিগুলো। এইসব উদ্ধৃতি তার বক্তব্যের সারবত্তাকে ষোলো আনাই সমর্থন করছে।
ফলে তার এই গবেষণাপত্রটি হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পাশাপাশি দিলারা হাশেমের পাঠক-সমালোচকদের জন্যও একটি দিক-নির্দেশনামূলক গ্রন্থ। এখানেই জান্নাতুল যূথীর গবেষক জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।
এই গবেষণাপত্রের চতুর্থ অধ্যায়ের নাম ‘দিলারা হাশেমের উপন্যাস: রাজনীতি ও ইতিহাস অনুষঙ্গ’। এই অধ্যায়ে গবেষক কেবল দিলারা হাশেমের উপন্যাস নিয়েই কথা বলেননি, বলেছেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে রাজনীতি ও ইতিহাস প্রসঙ্গ নিয়েও। উপন্যাসের উন্মেষপর্ব থেকে শুরু করে দিলারা হাশেমের কাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট টেনে এনে দিলারা হাশেমের উপন্যাসের অবস্থান কোথায়, তা নির্দেশ করেছেন তিনি। উপন্যাসের অনুষঙ্গ হিসেবে রাজনীতি ও ইতিহাসকে ভিত্তি করে দিলারা হাশেমের কৃতিত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে গবেষক বলছেন, ‘‘দিলারা হাশেম রাজনীতি সচেতন লেখক। তার প্রায় প্রতিটি উপন্যাসে ‘রাজনীতি এবং ইতিহাস অনুষঙ্গ’ বিদ্যমান। (…) প্রায় সব উপন্যাসেই সাত চল্লিশের দেশভাগ, ছেচল্লিশের দাঙ্গা, পঞ্চাশের দাঙ্গা, পঁয়ষট্টির ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে।’’ গবেষক এখানে দিলারা হাশেমকে রাজনীতি সচেতন বললেও একই গুণ যে তার মধ্যেও বিদ্যমান, তারও প্রমাণ দিয়েছেন, একের পর এক উপন্যাস থেকে রাজনীতি ও ইতিহাসসংশ্লিষ্ট অনুষঙ্গ খুঁজে খুঁজে বের করে পাঠকের সামনে হাজির করে।
পঞ্চম অধ্যায়ের নাম শিল্পপ্রকরণ। এই অধ্যায়ে দিলারা হাশেমের উপন্যাসের শিল্পগুণ বিচার করেছেন গবেষক। তবে খবুই সংক্ষিপ্তভাবে। শিল্পগুণ বিচার করতে গিয়ে তিনি উপন্যাসের ভাষা, চরিত্র, কাহিনি, বর্ণনাভঙ্গি, শব্দের ব্যবহার, উপমা-উৎপেক্ষা-চিত্রকল্প, জীবন দর্শন, চেতনাপ্রবাহরীতি, প্রবাদপ্রবচনের প্রয়োগের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ব্যাখ্যা করেছেন উপন্যাসে ব্যবহৃত কবিতা, গান, আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগও।
সামগ্রিক বিচারে এই গবেষণাপত্রটিতে গবেষক একদিকে যেমন তাত্ত্বিক গবেষণা রীতি অনুসরণ করেছেন, অন্যদিকে তেমনি ফলিত রীতিরও স্বাক্ষর রেখেছেন। আবার গবেষণা করতে গিয়ে জান্নাতুল যূথী আলোচ্য বিষয়ের সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। এরপর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন। একইসঙ্গে তথ্য বিশ্লেষণ শেষে তার বিবরণ দিয়েছেন। সব মিলিয়ে তিনি এই গবেষণাপত্রে সামাজিক পদ্ধতি, সনাতনী পদ্ধতি, বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতির মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এতে তার গবেষণাপত্রটি হয়ে উঠেছে বহুরৈখিক আলোচনায় প্রোজ্জ্বল।
পুরো গবেষণাপত্রটিতে লেখক সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন দিলারা হাশেমের উপন্যাসে ‘নারী-ভাবনা’বিষয়ক পরিচ্ছেদে। এই পরিচ্ছেদেই গবেষককে বেশি পরিণত ও প্রাজ্ঞ মনে হয়েছে। অন্যান্য অধ্যায়ের মধ্যে বিশেষত শেষ অধ্যায়, যেখানে শিল্পপ্রকরণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে নিতান্তই তাড়াহুড়োর ছাপ স্পষ্ট। ‘নারী-ভাবনা’ পরিচ্ছেদে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। এখানে গবেষক অন্যান্য অধ্যায়ে যেমন কখনো ঝরনার মতো দ্রুত পথ অতিক্রম করেছেন, কখনো তিনি দ্রুতগামী হরিণের মতো চোখের পলকেই আলোচনা শেষ করেছেন। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রয়োজনের তুলনা কম করে উদ্ধৃতি দিয়েছেন বেশি। কিন্তু ‘নারী-ভাবনা’বিষয়ক পরিচ্ছেদে চলেছেন বর্ষা শেষে শরতের প্রায় শান্ত নদীর মতো ধীর গতির স্রোতের মতো। মূলত এই পরিচ্ছেদেই গবেষক জান্নাতুল যূথীর জীবন জগৎ, শিল্প ও বিষয় সম্পর্কে ধারণা ও প্রজ্ঞার ছাপ পাওয়া যায়। কোনো রকম মতবাদের অনুসারী না হয়েও নারীজীবনের সংগ্রামের চিত্র সম্পর্কে নিজের নিস্পৃহ-নিরপেক্ষ বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ ঘটিয়ে দিলারা হাশেমের উপন্যাসের বিশ্লেষণ করেছেন।
জান্নাতুল যূথী গবেষক হিসেবে দিলারা হাশেমের উপন্যাসে প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গে সন্ধান করেছেন, সেই অনুষঙ্গের বিন্যাস করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। বিন্যাস শেষে বিশ্লেষণ করেছেন, একইসঙ্গে দিয়েছেন নিজস্ব অভিমতও।
গবেষণাপত্রের ভাষা জটিলতামুক্ত। সহজ-সরল। অনেক জটিল বিষয়কেও তিনি সরল বাক্যে, চেনা শব্দে বর্ণনা করেছেন। সেই বর্ণনা একদিকে পাণ্ডিত্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আন্তরিকতার ছাপও। তিনি উপন্যাসগুলোর বিষয় নিয়ে যেমন আলোচনা করেছেন, তেমিন বিশ্লেষণ করেছেন আঙ্গিক-প্রকরণও। ফলে তার এই গবেষণাপত্রটি হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পাশাপাশি দিলারা হাশেমের পাঠক-সমালোচকদের জন্যও একটি দিক-নির্দেশনামূলক গ্রন্থ। এখানেই জান্নাতুল যূথীর গবেষক জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।