‘কবিতা, নাটক, উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনির মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। প্রথম তিনটি মূলত মানুষের কল্পনার ফসল। কাহিনি ও রস পাঠককে কল্পলোকে ভাসায়। যিনি লেখেন তিনি মূলত কল্পনার আশ্রয় নেন। এমনকি বাস্তব কোনো ঘটনা বা কারো ব্যক্তিজীবন নিয়ে লিখলেও সেখানে থাকে কল্পনার মিশ্রণ। কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে ভ্রমণকাহিনি। ভ্রমণ মূলত বাস্তবতা এবং উপলব্ধির এক জীবনমুখী উপাখ্যান। নাটক উপন্যাস পড়ে পাঠক কল্পলোকে ভাসবেন, কিন্তু ভ্রমণকাহিনি পড়ে বাস্তবতার ছোঁয়া পাবেন।’ এতক্ষণ এই যে কথাগুলো পড়লেন; সেগুলো একজন ভ্রমণলেখকের ভূমিকা। নিশ্চয়ই ভ্রমণবিষয়ক একটি বইয়ের ভূমিকা। তিনি উদয় হাকিম। তার ভ্রমণকাহিনি পাঠককে বাস্তবতার ছোঁয়া দিতে পারে; এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
উদয় হাকিম, লেখক-সাংবাদিক-করপোরেট ব্যক্তিত্ব। ভ্রমণ তার নেশা। পাশাপাশি ভ্রমণকালে ছবি তুলে রাখা, ভ্রমণ শেষে লেখার মাধমে পাঠকের সামনে তুলে ধরা তার মহতি উদ্যোগ। এ উদ্যোগেও তিনি সফল। তার একেকটি ভ্রমণকাহিনি হয়ে ওঠে একেকটি ভ্রমণ উপন্যাস। কাহিনি বর্ণনা, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, ইতিহাস-ঐতিহ্য বর্ণনা মিলেমিশে একটি অসাধারণ চিত্রকল্প ফুটে ওঠে পাঠকের সামনে।
তার এবারের ভ্রমণ কাহিনি দার্জিলিং ও কালিম্পং নিয়ে। যেগুলো প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দুটি শহর। শহর দুটির অজানা অনেক গল্প নিয়ে লেখা ‘দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ’ তার অষ্টম বই। বইটি চৌদ্দটি পর্বে বিন্যস্ত। এগুলো হলো,
সড়ক পথে ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি
পৌঁছলাম স্বপ্নের দার্জিলিং
দার্জিলিংয়ের পিস প্যাগোডা, রক গার্ডেন
দার্জিলিংয়ের চা বাগান আর জুলজিক্যাল পার্ক
দার্জিলিংয়ের আইনক্স
দার্জিলিং : অদম্য ক্ষমতার অধিকারী, বজ্রপাতের শহর
বাতাসিয়া লুপ
ঐতিহাসিক ঘুম রেল স্টেশন
লামাহাট্টা এবং ত্রিবেণী
কালিম্পং-এর পাইন ভিউ ক্যাকটাস নার্সারি
কালিম্পং: জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়
কালিম্পং-এ কাঞ্চনজঙ্ঘা
রবীন্দ্রনাথ এবং গৌরীপুর হাউজ
তিস্তা দর্শন।
উদয় হাকিমের ভ্রমণের শুরুতেই উঠে এসেছে তার ছেলেবেলার গল্প। লেখক বলেন, ‘শুনতাম ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা দার্জিলিংয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার সঙ্গে এর অনেকটা মিল আছে। ঠাণ্ডা, এই রোদ, এই বৃষ্টি। চা বাগান। ছায়া গাছ। শান্ত সুবোধ পাহাড়ি জনপদ। সুখী, সমৃদ্ধ নির্ভেজাল জীবনযাপন। সহজ সরল মানুষ। ছিমছাম নিরাপদ জনপদ।’
বাতাসিয়া লুপ এবং ঘুম রেল স্টেশন এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। আর ঘুম মনেস্ট্রি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়।
সেসব শুনে শুনেই লেখকের মনের মধ্যে একটা দুর্নিবার ইচ্ছা জাগে-দার্জিলিংয়ে যাবেন। অবেশেষে সেই সুযোগও আসে। আসলে মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়। ছেলেবেলার সেইসব স্বপ্ন অবশেষে ধরা দিলো হাতের মুঠোয়। আর সেই সুযোগ করে দিলো কর্পোরেট ক্রিকেটে ওয়ালটন অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে। এর আগের বছর চ্যাম্পিয়ন হয়ে পুরো টিম গিয়েছিল ভুটান। এবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে দার্জিলিং।
এবার উদয় হাকিমের সফরসঙ্গী শাকিল, আলভি, ফিরোজ আলম, নুরুল আফসার চৌধুরী, এস এম জাহিদ হাসান, মামুন, মিল্টন, জাহিদ আলম, মিজান, সোহাগ, সাহেল, জনি সাইফুলসহ ১৫ জন। কিছুসময় ড্রাইভার মদুল সওদাগর, যিনি ভারতীয় মুসলমান। তার পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের। চাচারা এখনো বাংলাদেশে থাকেন। এছাড়া স্থানীয় গাইড পার্থ বাসনেত। তাদের ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে দার্জিলিং ও কালিম্পংয়ের কাহিনি।
ভ্রমণকাহিনিতে তিনি প্রাসঙ্গিক অনেক গল্প তুলে ধরেছেন। যা কাহিনির মজা আরও বাড়িয়ে তোলে। পাশাপাশি স্থানের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভূগোল-অর্থনীতি; কোনোটাই বাদ পড়ে না। কখনো কখনো তুলনামূলক আলোচনাও পাঠককে অনেক কিছু জানতে সহায়তা করে। লেখক যেভাবে বলেন, ‘দার্জিলিং নামটা শুনলেই সবার আগে আসে চায়ের কথা। চা বাগানের কথা। চোখ বুঁজে দেখতে পাই বিস্তীর্ণ চা বাগান। ছায়া গাছ। শান্ত শীতল প্রকৃতি।’
দার্জিলিং সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক আরও বলেছেন, ‘এটুকু অন্তত বুঝলাম, দার্জিলিং মোটেও সমতল কোনো শহর নয়। বিশাল পাহাড়ের গায়ে শত শত বাড়ি ঘর।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘রাতের দার্জিলিং! সত্যিই অপরূপ! দেখেছিলাম আগের রাতে। মিরিকের দূর পাহাড় থেকে। যেন আঁধার রাতে হাজারো জোনাকির নাচন। আরও কাছ থেকে মনে হয়েছিল পাহাড়ের গায়ে আলোর দেয়ালী। সে এক অন্যরকম সৌন্দর্য। দূর থেকে শুধু উপভোগ করা যায়। তার কোনো ভাষা নেই। অবর্ণনীয়।’
দিনের শেষে তিনি ভ্রমণকাহিনি লিখে রাখেন। তাই তো তার ভ্রমণকাহিনি পড়লে এমন কোনো প্রশ্ন নেই, যার উত্তর আপনি খুঁজে পাবেন না। কখনো কখনো দারুণ রসিকতাও করেন। মজার মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি জানান, দার্জিলিং ভ্রমণ করবেন অথচ চা বাগানে যাবেন না! তা তো হয় না! তাই তো চা কেনার অভিজ্ঞতা জানালেন এভাবে, ‘কেজি দুয়েক চা নিলাম। আমার কেনা দেখে যেন হামলে পড়লো হুজুগে বাঙালি। টিমের প্রায় সবাই চা কেনা শুরু করলেন। দোকানি মেপে, প্যাকেট করে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। অবশেষে দোকানের প্রায় সব চা শেষ। দোকানি খুশি বেশ!’
পাশাপাশি তারা দেখলেন শিলিগুড়ি, রক গার্ডেন, জুলজিক্যাল পার্ক, হিমালয়ান মাউেন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, তেনজিং রক, সেন্ট জুসেফ স্কুল, চা বাগান, লামাহাট্টা, ত্রিবেণী, ক্যাকটাস নার্সারি, কাঞ্চনজঙ্ঘা,গৌরীপুর হাউজ ও তিস্তা। আসা-যাওয়ার পথে দেখলেন অনেক কিছু। এরমধ্যে বাগানের ধার থেকে চা কেনাটা ছিল লেখকের জন্য স্পেশাল। এছাড়া সিনেমা দেখার স্মৃতিও কম সুখকর নয়। সিনেমার কাহিনিও বর্ণনা করেছেন লেখক। মৃত্যুবরণ না করেও কিভাবে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা যায়, সেটাই সিনেমার উপজীব্য।
জেনে রাখা ভালো বা অনেকেরই হয়তো জানা, তারপরও বলতে হয়, দার্জিলিং শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। যার অর্থ দুর্জয় লিঙ্গ। হিমালয় সংলগ্ন এই দার্জিলিংকে তুলনা করা হয়েছে অদম্য ক্ষমতার অধিকারী শিবের সঙ্গে। যে হিমালয় শাসন করে। এটি একটি মনোরম শৈল শহর। যা চায়ের জন্য বিখ্যাত। তবে বাতাসিয়া লুপ, ঘুম রেল স্টেশন, ঘুম মনেস্ট্রি জায়গাগুলোও চমৎকার। বাতাসিয়া লুপ থেকে আশপাশের পাহাড় মনোমুগ্ধকর। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকে পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘ। কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ হিমালয়ের নিকটবর্তী কিছু চূড়া দেখা যায় এই লুপ থেকে। বাতাসিয়া লুপ এবং ঘুম রেল স্টেশন এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। আর ঘুম মনেস্ট্রি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়।
এ প্রসঙ্গে লেখক বলেন, ‘ঘুম রেল স্টেশনটি দার্জিলিং শহরের কেন্দ্র থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে। যদিও এখন এটি শহরের অংশই হয়ে গেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৭৪০৭ ফুট। ঘুম ভারতের উচ্চতম রেলস্টেশন। এ লাইন কিন্তু টয় ট্রেন লাইন। দার্জিলিং হিমালয়ান রেল কর্তৃপক্ষ (ডিএইচআর) এই ট্রেন পরিচালনা করছে। ১৯৯৯ সালে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। ১৮৭৯ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে এই রেলপথ নির্মাণ করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ৮৬ কিলোমিটার। দুই জেলা দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ির মধ্যে যাতায়াত করে এই ট্রেন। এটি দুই ফুট ন্যারো গেজ রেল পরিষেবা। আজও ওই ট্রেন বাষ্পচালিত ইঞ্জিনে চলে। তবে দার্জিলিংয়ে মেল ট্রেনের জন্য ডিজেল চালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়।’
পাঠককে ধরে রাখার অপার ক্ষমতা রয়েছে উদয় হাকিমের। পড়তে শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত পাঠক নিবৃত্ত হবেন না।
ঘুমের আশেপাশেই বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পট রয়েছে। সেগুলো হলো: মিরিক, সান্দাকফু (নেপাল সীমান্তবর্তী) ও বিজনবাড়ি ইত্যাদি। এছাড়া, লেখকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, দার্জিলিংয়ের পাশের এই জায়গাটি, লামাহাট্টা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ভ্রমণপিপাসু কোনো মানুষেরই ক্ষমতা নেই এমন সৌন্দর্যকে এড়িয়ে যাওয়ার। এখানকার একটি বিষয় লক্ষণীয়। রাস্তার পাশে রঙিন কাপড়ের অসংখ্য নিশান। এখানে কৃপা লাভই মূল উদ্দেশ্য। কিছুটা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও ছিলো। বলা হয়ে থাকে, এইসব রঙিন কাপড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস মানুষের মনকে শুদ্ধ করে, সুন্দর এবং পবিত্র ভাবের উদ্রেক করে। মন্দির, সেতু বা বিভিন্ন স্থাপনার পাশেও এ ধরনের প্রার্থনা পতাকা দেখা যায়।
ত্রিবেণী জায়গাটি পড়েছে কালিম্পংয়ের মধ্যে। পশ্চিম থেকে এটিকে কালিম্পংয়ের প্রবেশদ্বার বলা চলে। একদিকে সিকিম থেকে এসেছে তিস্তা। অন্যদিক থেকে গভীর বন পেরিয়ে স্বচ্ছ জল নিয়ে এসেছে রাঙ্গিত। কাঞ্চনজঙ্ঘার নিচের কাবরু পর্বতের একটি গেইসার বা উষ্ণ প্রস্রবন থেকে রাঙ্গিতের উৎপত্তি। এরা ত্রিবেণীতে মিলিত হয়ে ভাটিতে বয়ে গেছে তিস্তা নামে। সবুজে মোড়া রহস্যময় ঘন বন। তার ফাঁক গলে সুউচ্চ পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা যুগল স্রোতস্বীনি এখানে আলিঙ্গন করেছে। তারপর বয়ে গেছে হাজারো মাঠ পেরিয়ে।
হিন্দু পূরাণ মতে, ত্রিবেণী হচ্ছে পবিত্র তিন নদীর সঙ্গমস্থল বা মিলনস্থল। ওই নদীর পূণ্য ধারায় তারা স্নান করে পবিত্র হন। নদী তিনটি হচ্ছে: গঙ্গা, যমুনা ও স্বরস্বতী। ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে ওই তিন নদীর মিলনস্থলটি একটি তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। হিন্দু তীর্থযাত্রীরা সেখানে গিয়ে পুণ্যস্নান করেন। তির্থযাত্রীদের ধারণা, তিন নদীর ওই পবিত্র ধারায় স্নান করলে পাপমুক্তি ঘটে।
কালিম্পংয়ের চারপাশেই বিশাল বিশাল পাহাড়। মনে হয় আকাশে হেলান দিয়ে আছে। অফুরন্ত সবুজের মাঝে বাড়ি-ঘর। এখানে প্রাণ আছে, শান্তি আছে। বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া যায়। জীবনকে উপলব্ধি করা যায়। জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। ভ্রমণপিপাসুদের এমন জায়গাই পছন্দ। কোলাহল নেই। আবার জনমানবহীনও নয়।
লেখক বলেন, ‘কালিম্পং শব্দের অর্থ হচ্ছে, যে শৈলশিরায় মানুষ খেলা করে। এটি লেপচা শব্দ। লেপচা নেপালি ভাষা। তার মানে কালিম্পং অর্থ পাহাড়ের মাথায় খেলা করা। আগে সেখানে আদিবাসীদের মধ্যে গ্রীষ্মকালে ক্রীড়ানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। বিশেষ করে বৃটিশ আমলে শত্রুদের (ব্রিটিশ দখলকারী) কবল থেকে দেশ রক্ষার কৌশল হিসেবে শক্তিচর্চার একটি উপায় হিসেবে ওই ক্রীড়ানুষ্ঠান হতো। কারণ তখন বলে কয়ে সরকারের বিরোধিতা করা সম্ভব ছিল না। প্রকাশ্যে শক্তির চর্চাও ছিল না।’
তবে তিব্বতি ভাষায় কালিম শব্দের অর্থ রাজার মন্ত্রী। আর পং শব্দের অর্থ ক্ষমতার কেন্দ্র। তাহলে জায়গাটির নামের অর্থ বেশ রাজকীয়। ক্ষমতার কেন্দ্র যে মন্ত্রীদের হাতে। তিব্বতি ভাষায় এরকম অর্থ হওয়ার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। সে যা-ই হোক, মূলত কালিম্পং বিখ্যাত আবহাওয়ার কারণে। শীতল মনোরম পরিবেশ সবাইকে আকর্ষণ করে। ব্রিটিশরা দার্জিলিংয়ের বিকল্প শৈল শহর গড়তে গিয়ে কালিম্পংয়ের শ্রীবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। একসময় এটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। পশুলোম, উল, খাদ্যশস্য আমদানি-রপ্তানি হতো এখানে। যে কারণে নেপাল থেকে অনেক লোক ওই অঞ্চলে চলে আসে। এতে বাণিজ্য প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার লোকসংখ্যা বেড়ে যায়। তিব্বত থেকে ব্যবসায়ীরা জেলেপালা পাস দিয়ে এ অঞ্চলে আসতেন। তখন তাদের যাওয়া-আসার পথে কুপুপ, জুলুক, আরিতার, পেডং এসব জায়গা ছোট ছোট ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়।
এরপর আসি গৌরিপুর হাউজ প্রসঙ্গে। জানা যায়, অনেক বিখ্যাত মানুষ গৌরীপুর হাউজের আতিথ্য নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কালিম্পং গেলে সেখানেই থাকতেন। সাদা দোতলা বাংলো বাড়ি। পাশ্চাত্য মিশ্র রীতিতে তৈরি। এখনো পাহাড়ের ওপর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। নিঃসীম শূন্যতা, অনাবিল আকাশ, প্রকৃতির নিটোল মায়া; সবই টানে প্রকৃতিপ্রেমীদের। তবে বাড়িটি এখন জীর্ণশীর্ণ। ঠিক যেন পোড়ো বাড়ি। এখন বাড়িটির অবস্থা যা-ই হোক না কেন, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ অনেক বড় কিছু। তার স্মৃতিমাখা জায়গাটি সংরক্ষণের দাবি রাখে।
সবশেষে জানবো তিস্তা দর্শনের গল্প। লেখক বলেন, ‘তিস্তা নিয়ে বলতে গেলে দিস্তায় দিস্তায় কাগজ শেষ হয়ে যাবে। ত্রি সেরাতা বা তিন প্রবাহ থেকে নামটি এসেছে। তিনটি প্রধান শৃঙ্গ থেকে নেমে আসা তিনটি ধারা যুক্ত হয়েছে তিস্তায়। সিকিমে এর উৎপত্তি। অবশ্যই হিমালয় থেকে।’ তবে ইতিহাসে জানা যায়, তিস্তার উৎস উত্তর সিকিমের হিমালয় পর্বতমালার ১৭৮৮৭ ফুট উচ্চতায়। কেউ বলে চিতামু হ্রদ থেকে, আবার কেউ বলে সোলামো নামের একটা হ্রদ থেকে তিস্তার শুরু। হতে পারে আঞ্চলিক ভাষায় ওই দুই নামেই ডাকা হয় হ্রদটিকে। হ্রদটি শেসচেনের কাছে ডোংখা গিরিপথের উত্তরে অবস্থিত।
গল্প, রোমান্স, আবেগ মিশ্রিত ভ্রমণকাহিনিটি তিনি শেষ করেছেন এভাবে, ‘ভোরবেলা টেকনিক্যাল এসে নামলাম। ড্রাইভার ব্যাগ নিয়ে প্রাইভেট কারে তুললো। কিন্তু তুমুল বৃষ্টি। ক’দিন আগে দার্জিলিংয়ে যে বৃষ্টি হচ্ছিলো, সেটি বাতাসে ভেসে ভেসে বাংলাদেশে এসে ঝরছিলো। সাগর কিম্বা হিমালয়ের জল বাংলায় এসে পড়ছিলো। দার্জিলিঙে বৃষ্টি কালিম্পঙে রোদ। আবার বাংলাদেশে বৃষ্টি! প্রকৃতি এমনই।’ এখানেই তার লেখার মুন্সীয়ানা। পাঠককে ধরে রাখার অপার ক্ষমতা রয়েছে উদয় হাকিমের। পড়তে শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত পাঠক নিবৃত্ত হবেন না।
আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি। দার্জিলিং বা কালিম্পং যাওয়ার সাধ্য না থাকলে বইটি পড়ে কল্পনায় ঘুরে আসতে পারবেন যে কেউ।
দার্জিলিঙে বৃষ্টি কালিম্পঙে রোদ
লেখক: উদয় হাকিম
প্রকাশনী: অনিন্দ্য প্রকাশ
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশকাল: মার্চ ২০২১
মূল্য: ৫০০ টাকা