মধ্যবিত্ত নিয়ে লেখা উপন্যাস ইদানিং আমার ভালো লাগে না। মাহবুব মোর্শেদের আগের উপন্যাস ‘ফেস বাই ফেস’ পিডিএফ আছে, কিছুদূর পড়েছিলাম। এবারের উপন্যাসটা এইমাত্র পড়ে উঠলাম। শুধু একটি কারণে এখানে মন্তব্য লিখছি।
একসময় অবুঝের মতোই বলা চলে উত্তর আধুনিকতা চর্চা করতাম। কেন্দ্র ভেঙে নতুন, ছোট ছোট কেন্দ্র নির্মাণের পক্ষে বলতাম। এখনো তাই চাই। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের উপন্যাস এখনো ঢাকাকেন্দ্রিক। পঞ্চাশের কথাসাহিত্যিকদের অনেকে আমার জন্মের বহু আগেই প্রয়াস চালিয়েছিলেন চিটাগাংয়ের এবং অন্য শহরের মধ্যবিত্তকে তুলে ধরার। আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখায় তা পেয়েছিলাম। সুদূর করাচির বাঙালি মধ্যবিত্তকেও তুলে ধরেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক, রাজিয়া খান ও আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন প্রমুখ। ১৯৭১-এর পরে ভাঙন কমেছে, ঢাকার শক্তি বেড়েছে। গ্রামজীবন নিয়ে হাসান আজিজুল হক, আবু বকর সিদ্দিক, মঞ্জু সরকার, জাকির তালুকদার, মামুন হুসাইন, মনিরা কায়েস ভালো লিখেছেন। কিন্তু উপন্যাসে নাগরিক মধ্যবিত্ত ঢাকার কেন্দ্র থেকে বের হতে পারেনি।
মাসখানেক আগে নিরমিন শিমেলের উপন্যাস ‘মেঘবলাকা’ আমার সামনে সেই ভাঙনের দেয়ালের ফাঁকটা দেখিয়ে দিয়েছে।
মাহবুব মোর্শেদের ‘তোমারে চিনি না আমি’ উপন্যাসের পটভূমিও শিমেলের মতোই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী মহানগরকেন্দ্রিক। যদিও উত্তরের এই বড় শহরটি সম্পূর্ণভাবে উঠে আসেনি। ভার্সিটি এরিয়া, ছাত্রাবাসকেন্দ্রিক জীবনের বর্ণনার কারণে। আমি খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেটকেন্দ্রিক অনেক উপন্যাস আশা করি। এই শহরগুলো এবং তাদের অধিবাসীদের জানতে চাই। ময়মনসিংহ হুমায়ূন আহমেদের লেখায় কিছু পেতাম। কাশেম বিন আবুবাকারের শ্রেণীর কিছু লেখক একসময় এই কাজটি করতে চেয়েছিলেন। ‘রিকশাওয়ালা’ নামের উপন্যাস পড়েছিলাম সেইযুগের বরিশাল শহরকেন্দ্রিক।
মাহবুব মোর্শেদ আমার কিছুটা আশা পূরণ করেছেন।
১. যদিও উত্তম পুরুষে রানা রহমান ঢাকা থেকে আত্মকাহিনি শুরু এবং শেষ করেছে।
২. উপন্যাসটি আত্মজৈবনিক ধারার।
৩. ব্যক্তিজীবনের প্রেম ও যৌনতা সেন্সর করে নান্দনিক করে তোলার চেয়ে বাস্তবতার বিরাট দাবিই লেখক পূরণ করেছেন।
৪. বিচ্ছিন্নতাবাদ রানার জীবনে সবচেয়ে বড়। বিচ্ছিন্নতাবোধই তাকে নারীর কাছে নিয়ে যায়। বুদ্ধদেব বসুর জীবন ও তার উপন্যাসে এ বিষয়টা ছিল।
৫. সমকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি স্প্যাচুলা দিয়ে বড় বড় স্ট্রোকে না এঁকে চিকন তুলিতে ধারণ করে লেখক নিজের অবস্থান সংহত করেছেন।
৬. বয়স ও পরিপার্শ্ব মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তায় পরিবর্তন ঘটায়, যেমন রানা- নাজনীনের দাম্পত্যজীবন।
৭. সরদারের মতো চরিত্রই উপন্যাসটির যকৃৎ হিসেবে অবস্থান করছে। সরদার ছাড়া এটি উপন্যাসই হতো না।
৮. সরদারকে মনে হয়েছে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’র ডাক্তার সব্যসাচী। সব্যসাচী তার লেখকের রক্ষণশীলতা ধারণ করে, রিয়ালিজমের বাইরে গিয়ে আইডিয়ালিজমের রাজ্যে সুভাষ বসুকে অনুসরণ করেছে। কিন্তু সরদার সমকালীন রুচিবোধ নিয়ে তার লেখকের চিন্তাকে অনুসরণ করেছে।
৯. সরদারের মৃত্যুও ঠিক আছে বলে মনে হয়।
১০. মাহবুব মোর্শেদ তার এই উপন্যাসে দরজা জানালা খুলে পর্দা তুলে প্রচুর আলো বাতাসের প্রবেশের পথ খুলে দিয়েছেন।
নতুন যুগের পাঠকদের জন্যই এই উপন্যাস। পুরনোরা ধাক্কা খেতে পারেন। তবু একটা নতুন কিছু।