গল্প কী? দৈনন্দিন জীবনে আমরা কত রকম গল্পই তো বলে যাচ্ছি। দেশের গল্প, সমাজের গল্প, প্রেমের গল্প, সফলতা বা ব্যর্থতার গল্প—সর্বোপরি মানুষের গল্প। তবে আর দশজন মানুষের গল্প বলার ধরন আর একজন গদ্যশিল্পীর গল্প বলার ধরন নিশ্চয়ই এক নয়। আমার আলোচনার বিষয় মূলত সেটাই। জীবনে চলার পথে শোনা গল্প— করুণ বাস্তবতা বা কল্পনার নির্যাস মাত্র। তার হয়তো শিল্পমান নেই। সেই শোনা গল্পই যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরা হয়, তখন সেটা হয়ে যায় শিল্প। যে কাজটি করেন একজন গদ্যশিল্পী। সুবিন্যস্ত বুননে তিনি কথাগুলোকে শৈল্পিক রূপ দান করেন।
শৈল্পিক রূপে প্রকাশিত গল্প বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের কাছে। তারা পড়েন, আপ্লুত হন কিংবা বিব্রত হন। লেখকের সার্থকতা এখানেই নির্ভর করে। লেখা পাঠকের বোধগম্য হতে পারলেই গল্প সার্থকতা লাভ করে। সে প্রয়াসই চালিয়েছেন তরুণ কথাশিল্পী মাসুদ সুমন। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ড্রয়ার ভর্তি হাহাকার’।
গ্রন্থটিতে এগারোটি গল্প স্থান পেয়েছে। গল্পগুলো যথাক্রমে— ঘর ভরা জোছনা ছিল একদিন, বিশ্বাস, সম্ভাবনার অপমৃত্যু ও লৌকিক সমাচার, শোক, অমীমাসিংত ছোটগল্পের খসড়া, জোছনায় ভিজে যাওয়া দিনগুলি, খোয়ারি, স্বপ্ন এবং অন্যান্য, লাশ, অলৌকিক, একটি অতিপ্রাকৃত গল্প। তার গল্পের বিষয় নির্বাচন, ভাষাশৈলী, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, উপমা উপস্থাপন সার্থক পথে হেঁটে যেতে উদ্বুব্ধ করেছে। বাংলা গদ্যসাহিত্যে আরও একটি তারকার উপস্থিতি আমরা লক্ষ করব গল্পগুলো পাঠকালে।
বইয়ের প্রথম গল্পটি একটি পরিবারকে ঘিরে। গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবার। যে পরিবারের দিকে তাকালে আমি আমার পরিবারকে দেখতে পাই। গ্রাম্য রাজনীতিতে সব হারানো একটি পরিবার। একটি যৌথ পরিবার থেকে যে মানুষগুলোকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। সেই পরিবারের প্রতিনিধি হয়ে তৃতীয় পুরুষে গল্পটি বলে গেছেন মাসুদ সুমন। গল্পকারের ভাষায়, ‘বেশ কিছুদিন থেকেই কানাঘুষা চলছিল, আমাদের আলাদা করে দেওয়া হবে। আব্বা চাকরি-বাকরি কিছু করেন না। আগে জমি-জিরাত দেখাশোনা করতেন। এখন তাও করেন না। সারাদিন পড়ে থাকেন ভিলেজ পলিটিক্স নিয়ে। এবার আবার মেম্বারি নির্বাচন করলেন।’ পরিবারের মাত্র দুটি ছেলে সন্তান নিয়ে নতুন সংসার পাতেন বাবা-মা। শোয়ার জন্য খাট নেই, খাওয়ার জন্য প্লেট নেই— এভাবেই বলে যান লেখক। লেখক আমাদের দেখান- দুই ভাইয়ে প্রচুর মিল। আবার সামান্যতেই মারামারি। লেখক বলেন, ‘এ কারণে গ্রামের পোলাপান আমাদের দেখলেই ছড়া কাটে-
মিতুল শিমুল দুই ভাই
পথে পাইল মরা গাই
শিমুল কয় খাইয়া যাই
মিতুল কয় মার লাইগ্গা লইয়া যাই।
গল্পে গ্রামীণ জীবনাচার, একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন, গ্রাম্য রাজনীতির টানাপড়েন, ভ্রাতৃপ্রেম নিগূঢ়ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। এখানে জোছনা মাখা রাতগুলো আর খুঁজে পান না। খুঁজে পান ড্রয়ার ভর্তি হাহাকার। গল্পের এই শেষ কথাটিই তার বইয়ের শিরোনাম হয়ে উঠেছে।
তার ‘বিশ্বাস’ গল্পটি আমাদের মতো মানুষের গল্প নয়। দুটি বেলে মাছের জীবনের আখ্যান। দুটি মাছের বিশ্বাস আর বেঁচে থাকার গল্প। স্বামী বেলে মাছ আর স্ত্রী বেলে মাছের শঙ্কা, আসন্ন বিপদ ও সবশেষে মুক্তি গল্পটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। গল্পটি প্রকৃতির। প্রকৃতিতে মানুষ ছাড়াও কত প্রাণী রয়েছে। তাদেরও রয়েছে জীবন। সেখানে হতাশা-ব্যর্থতা, লোভ, জিঘাংসা, বুদ্ধিভিত্তিক পথচলা, বিশ্বাস সবই রয়েছে। পানির অভাবে নদী-খাল শুকিয়ে যাওয়া, পরিবেশ বিপর্যয়, জলজ প্রাণী হ্রাসসহ প্রভৃতি বিষয় তুলে আনা হয়েছে। মাছ দু’টির মৃত্যুচিন্তা বিবেক সম্পন্ন মানুষকেও হার মানায়।
মাসুদ সুমনের তৃতূয় গল্পটি একদল যুবকের। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে যারা মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শেষ করে জীবনের নানা জটিলতার মুখোমুখি হয়েছেন। কেউ প্রতিষ্ঠার ভান ধরে আছেন, কেউ লড়ে যাচ্ছেন, অথচ একজন কেবল ব্যতিক্রম। সে সব সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে অপমৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আমানসিক চাপ যাকে লৌকিক আচারে ‘পাগল’ খ্যাতি দিয়েছে। আমাদের গ্রামীণ সমাজের সুস্পষ্ট প্রতিকৃতি আমরা তার মধ্যে দেখতে পাই। আমরা অবাক হয়ে যাই— শেকলে বাঁধা সত্ত্বেও তিনি যখন বলেন, ‘তোরা সবাই মিল্লা আমারে পাগল বানায়া দিলি?’
‘শোক’ গল্পটি যে সয়ের; সে সময়ে মানুষ অতোটা সচেতন হয়ে ওঠেনি। স্বামীর হাতে স্ত্রীর মৃত্যু তখন যেন অনেকটা পুণ্যের মতো নির্ধারিত ছিল। গল্পের পরিণতিতে করমালীর মৃত্যুটা অনিবার্য ছিল কি না, লেখকই ভালো বলতে পারবেন। অথচ করমালীর বুকের মধ্যে হাহাকারটা স্থায়ী রূপ পেলেই মনে হয় গল্পটা সার্থক হতো।
একজন তরুণ কবির অবেচতন মনের ভাবনাগুলো তুলে এনেছেন ‘অমীমাসিংত ছোটগল্পের খসড়া’ গল্পে। সেই ভাবনায় এসেছে প্রকৃতি, প্রেম, সমাজ- আমাদের চারপাশ। শেষটা কেমন নাটকীয়। তরুণ কবির মৃত্যুই যেন গল্পে অনিবার্য হয়ে উঠলো। সে মৃত্যুর মাঝেও প্রশ্ন— নিহত না কি আত্মহনন? ‘জোছনায় ভিজে যাওয়া দিনগুলি’ গল্পটিতে কৈশোর-উত্তীর্ণ ছেলেদের মাধ্যমিক পাঠের সামগ্রিক অনুভূতি মিশে আছে। না বলা ভালোবাসা, অনুচ্চারিত আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে গল্পে। গল্পটি পড়লেই সবার ইচ্ছে হবে- আবার ফিরে যাই স্কুল জীবনে। অনেকটা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হবেন পাঠক।
‘খোয়ারি’ গল্পটি শ্রেণীহীন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্নে ভরপুর। কিন্তু বিপ্লবরা একা কখনোই তা পারে না। আদর্শ আর নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সবাই যার যার স্বার্থ কায়েম করে। বিপ্লব তা পারে না। ব্যর্থতা-গ্লানি-জরা তাকে কুরে-কুরে খায়। সাম্যবাদের সংজ্ঞা খুঁজতে খুঁজতে কত কথা, কত স্মৃতি, কত স্বপ্ন উঁকি দেয় তার মনের দরজায়। ভয়ে-লজ্জায়-ঘৃণায়-অপমানে সে দরজা আর খোলে না বিপ্লব। আটকে দেয়— সবকিছুর মুখের ওপর।
মাসুদ সুমনের গল্পগুলো সত্যিই হাহাকারে ভরা। কেমন হতাশায় ঘিরে ধরে পাঠককে। আমাদের পড়াশোনা, বিকৃত সমাজ, চুপিচুপি প্রেমে পড়া—কেমন লাজুক লতার মতো তরতর করে বেড়ে যায়। আবার কিঞ্চিৎ স্পর্শেই কেমন চুপসে যায়। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একান্ত অন্তর্গত সমস্যা-সম্ভাবনার গল্প তার গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। শুধু স্বপ্নই দেখে যায় প্রতিটি চরিত্র। যেমন স্বপ্ন দেখে মিলাও। ‘স্বপ্ন এবং অন্যান্য’ গল্পে লিটুকে মিলা প্রশ্ন করে— ‘আচ্ছা লিটু ভাই আপনার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আপনি কি চলে যাবেন?’ লিটুরা চলে যায়, মিলারা তাই সারাজীবন স্বপ্নই বুনে যান। গল্পে গল্পে স্বপ্নের বেসাতি সাজিয়েছেন গল্পকার। সে স্বপ্ন আদৌ সফল হয়— কখনো বা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
‘লাশ’ গল্পে একটি লাশের আত্মকাহিনী বিবৃত হয়েছে। লেখক নিজেই লাশের জবানিতে কথাগুলো বলেছেন। গল্পের এমন ধরন হয়তো নতুন নয়; তবে ভালো লেগেছে। মৃতদেহ বা মৃতব্যক্তির অনুভূতি বা ভাবনাগুলো আমরা তো কখনোই জানতে বা বুঝতে পারি না। এবার না হয় ক্ষাণিকটা জানলাম গল্পচ্ছলে।
‘অলৌকিক’ গল্পে কালো জুব্বা পরিহিত লম্বা চুলওয়ালা পানখাওয়া দাঁতের একজন যাত্রীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। অনেকের ধারণা তিনি ‘পাগলা বাবা’। তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের কারণেই গাড়িটা মাঝপথে ফেঁসে গেছে। অতপর পাগলা বাবার ফের আগমনে গাড়ি আবার স্টার্ট নেয়। সবই সাজানো নাটক। ড্রাইভারের সঙ্গে পাগলা বাবার পরবর্তী কথপোকথনে আমরা তা জানতে পারি। এমনি করেই তো লালসালুর মজিদ ও বহিঃপীরের শান-শওকত দিন দিন বাড়তে থাকে। এমন চোখ ফাঁকি দেওয়া অলৌকিকতা তখনও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।
মাসুদ সুমন তার ‘একটি অতিপ্রাকৃত গল্প’ নামক গল্পে বলেছেন, ‘অলৌকিক বলে আসলে পৃথিবীতে কিছু নেই।’ কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তিনি ঘুম না আসা মাঝরাতে একা একা হাঁটতে গিয়ে ফিনফিনে সাদা শাড়ি পরা এক নারীকে দেখতে পান। তিনি জীবনানন্দের বনলতা সেন আবৃত্তি করেন। সাহস সঞ্চারের জন্য নজরুলের বিদ্রোহী আবৃত্তি করেন। তবু একটি অশরীরী ভয় লেখককে ঘিরে ধরে। এটা দ্বারা হয়তো তিনি পৃথিবীতে জ্বীনের অস্তিত্বকেই স্বীকার করেছেন।
তার প্রতিটি গল্পেই যেন লেখকের প্রতিকৃতি দেখতে পাই। গল্পে গল্পে জীবন ঘনিষ্ট দৃশ্যপট যেন তা-ই বলে। যে সময় তিনি পেরিয়ে এসেছেন, যে বোধ তাকে তাড়া করেছে, যে স্বপ্ন তাকে ঘুমোতে দেয়নি, যে প্রেম তাকে আজো ভাবায়— সেই ভাবনাগুলোই তিনি ব্যক্ত করেছেন শিল্প মাধ্যমে।
অন্য অনুষঙ্গ হিসেবে মার্বেল, অণ্ডি অণ্ডি, চোখ পলানতি খেলাসহ শৈশবের অনেক খেলা উঠে এসেছে তার গল্পে। গ্রামীণ শিষ্টাচার, লোকাচার, প্রচলিত ধারণা সুনিপুণভাবে বিবৃত হয়েছে মাসুদ সুমনের গল্পে। অর্থাৎ প্রথম গল্পগ্রন্থেই তিনি আমাদের আশান্বিত করেছেন। আমরা তার এই আশা জিইয়ে রাখতে চাই। তবে তার গল্পগুলো শৈশবের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে সর্বব্যাপী হয়ে উঠুক, ভাবনার আরও বিস্তার ঘটুক, নিরীক্ষায় শানিত হোক— এ প্রত্যাশা রইলো।
ড্রয়ার ভর্তি হাহাকার
লেখক: মাসুদ সুমন
প্রকাশনী: জেব্রাক্রসিং
মূল্য: ১৪০ টাকা
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০১৭