ভূমিকা
‘Do you know what’s worth fighting for
When it’s not worth dying for?
Does it take your breath away
And you feel yourself suffocating?’
ডি-মাইনর কর্ডের ওপর করা আমার ভীষণ প্রিয় এক গান, ‘টুয়েন্টি ওয়ান গানস’। ব্যান্ড ‘গ্রিন ডে’ কে ধন্যবাদ পৃথিবীকে এমন গান উপহার দিয়েছে বলে। গানটা থেকে লাইনগুলো ধার করলাম কারণ আমি এখন যে উপন্যাস নিয়ে বলতে যাচ্ছি, তার নাম যে শুধু ‘ডি মাইনর’ তাই নয়, এর গোটা পটভূমিটাকে এই চারটি লাইন দিয়ে স্নান করানো যায়।
লেখকের কথা
লেখক জিল্লুর রহমান সোহাগকে প্রকৃতি ডালা উপুড় করে প্রতিভা দিয়েছে। প্রতিভা যদি প্রকৃতির প্রতিআভা হয়, তবে বলতে হবে প্রকৃতি তার মতো প্রতিফলক তল কমই তৈরি করেছে ভুবনে। জিল্লুর রহমান সোহাগের লেখক সত্ত্বা এখানে ব্যাক্ত। যা ব্যক্ত নয় এখানে, কিন্তু তার জীবনের অপর প্রধান, তা হলো তার গায়ক সত্ত্বা। সোহাগ বাংলাদেশে সাড়া তোলা বিকল্প ধারার এক ব্যান্ডের গায়ক, নিজ গানের গীতিকার, বাদক। রেডিওতে আবৃত্তি করেছেন। মঞ্চনাটক করেছেন একসময়। এমনকি সক্রিয় ছিলেন রাজনীতির মঞ্চেও।
কথাগুলো অপ্রাসঙ্গিক নয়, কারণ আমার বিশ্বাস সমস্ত শাখার নিচে মূল কাণ্ডটি তাঁর লেখা। সোহাগ যে গান করেন, সেটিও তার লেখার শক্তি থেকে উৎসারিত। প্রথম উপন্যাস ‘ডি-মাইনর’ নামটি আমার কথার সপক্ষে বোধ করি স্মিত হাসল। ডি-মাইনর কর্ড আমার কাছে সুন্দরের বোধের প্রকাশ এবং এই প্রকাশ রহস্যময়। যখন উপন্যাসের নাম ডি-মাইনর হলো, তখন সেই রহস্যময় সুন্দরের কাছে আমাকে লেখার ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা দায় লেখকের ওপর চাপল। লেখক কি তা পেরেছেন?
উপন্যাসের পটভূমি
নাম উল্লেখ না করলেও বিজয় সরণী, গুলশান, ধানমণ্ডি এসবের উল্লেখ বলে দেয় শহরটি ঢাকা। তবে এ ঢাকার সময়কাল ধরা নেই। লেখকের তৈরি বাস্তবতার এ ঢাকা এক অন্ধকার শাসনতন্ত্রের কেন্দ্র।
ক্ষমতার শেকড় তার গোপনীয়তায়। গোপনীয়তা যত সুরক্ষিত, ক্ষমতা তত দীর্ঘায়িত। একটা অপশাসকচক্র কী গোপন রাখবে? ভালো কাজ তো ধর্মে এমন গোপনে করতে বলা হয় যেন ডান হাতের কাজ বাম হাত না জানতে পারে। এই গোপন তো তা নয়। এ ধরনের শাসকের যা গোপন তা দমন আর পীড়নের কিছু জান্তব যন্ত্র। এই জান্তব যন্ত্রগুলো সরকার কার্যকর রেখেছে এবং ক্ষমতার স্বার্থে নরবলি দেওয়া তাদের কাজ। নাগরিকরা হলো সেই বিপুলা নরবলির জোগান। জান্তব যন্ত্রগুলো যেমন গোপন, গোপনতর সেই সব নরবলিও।
বলির জন্য যে পশুগুলোকে মানুষ তৈরি করে, তাদের কিন্তু তারা লালন করে। বাইরে বিশ্বের যেটুকু সেই পশুদের নিজস্ব, তার কিছুই কিন্তু তারা জানতে পারে না। উপন্যাসে কল্পিত সরকার তেমন পশু তৈরির একটা বিরাট খামারে পরিণত করেছে দেশটাকে। এবং দেশের ইতিহাস বিকৃত। মানুষ যখন সংগ্রাম করে সফল হয়, সফল সংগ্রাম ভাস্কর্য দিয়ে ধরে রাখে- এ তার প্রবণতা। ভাস্কর্য তার কাছে স্মারক। যতবার সে তাকে দেখে, ততবার সেই স্মারক তোকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তুমি পীড়িত ছিলে, অতঃপর তুমি সংগ্রাম করেছ। জিতেছ। সুতরাং আবার যখন পীড়িত হবে, তখন যেন সংগ্রাম করতে ভুলো না। তুমি পারবে।
লেখকের ভাষায় ব্যক্ত করছি, ‘জনসাধারণের চিন্তাভাবনার সাথে প্রতীক বদলের একটা প্রত্যক্ষ সংযোগ আছে। বিশ্বাস না হলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটা গুঁড়িয়ে দাও, দেখবে মানুষ আপনাআপনিই ভুলতে শুরু করবে মাতৃভাষার স্বীকৃতিবিষয়ক রক্তপাতের ইতিহাসটা। ভয় দেখাতে চাও তো শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুল কিংবা পায়রার ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে বসিয়ে দাও জ্বলজ্বলে শিকারি চোখের কোনো হিংস্র দানবের ভাস্কর্য, দেখবে মানুষগুলো ঘুমের ভেতরও ভয় পেতে শুরু করেছে।’
ডি-মাইনর উপন্যাসে সরকার কী করছে। ভাস্কর্য বদলে দিচ্ছে। তাদের নিজস্ব প্রতীক দিয়ে বদলে দিচ্ছে সমস্ত স্মারক। সেই প্রতীক লোককে দেখাচ্ছে নখর বাগানো এক ঈগল, শিকারকে চিরে ফেলতে উদ্যত। ভয় দিয়ে লোক শাসন করতে চাইছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠছে তাদের পরিকল্পনামফিক। ‘এনাদার ব্রিক অন দ্য ওয়াল’! এই, পথচলতি! পিঙ্ক ফ্লয়েডের এ বিখ্যাত গানটিও কিন্তু ডি-মাইনর কর্ডে করা। উপন্যাসের একটি পর্যায়ের সঙ্গে এ গান প্রাসঙ্গিক। সেই ছাঁচে ঢালা শিশুদের জন্য সরকার এমন ব্যবস্থা করছে যেন তারা দেখতে পায়- হ্যাঁ, এই-এই ব্যবস্থাদিই বরাবর চালু। এটাই কল্যাণকর এবং অপরিবর্তনীয়। সুতরাং এভাবেই থেকো, যেমন থাকতে শেখালাম। যদি এর ব্যতিক্রম হয়, দেখবে অবাধ্যতার পরিণাম।
উপন্যাসে এক ঝলমলে সকাল কালো করে দিয়ে নগরীর সমস্ত স্কুল থেকে দলে দলে শিশুদের শিক্ষা সফরে নিয়ে যাওয়া হয় কারাগারে।
সাংস্কৃতিক ভিত ধসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোনো গান গাইবে না কেউ। কেউ ছবি আঁকবে না। কেউ গল্প লিখবে না। কোথাও কেউ বেড়াতে যাবে না। সমস্ত প্রণোদনার উৎস, শ্বাস ফেলার উপায়- এসবের প্রশ্রয়ঘরগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি ধসে পড়ছে। বেঁচে থাকা হয়ে উঠছে কঠিনতর। সারি সারি তরুণদের লাশ আসছে অজ্ঞাত উৎস থেকে। কুকুর ছিঁড়ে খাচ্ছে সেসব লাশ।
এমন এক নগরে বেঁচে থাকার জন্যে সংগ্রাম করছে পাঁচ তরুণ। কাউয়াস, ড্যানি, ব্রুস, লিপ্টন, এবং প্রধান চরিত্র রবিন। ওদের একটা গানের দল আছে। নাম চৌকাঠ। নিজেদের কিছু গান আছে। অনেক কর্ষণে তৈরি কথা, অশেষ যত্নে বসানো সুর। কিন্তু ওসব তারা গাইতে পারে না। রেস্তোরাঁয় মানুষের পছন্দসই অন্যের লেখা গান গাইতে হয়। নইলে পাঁচ ব্যান্ড সদস্যের অন্তত তিনজনের খেয়ে এবং প’রে বাঁচার রসদ জোটানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
ছানিপড়া চোখের মৃতপ্রায় মা, একাকী মৃত কুহক দা, অন্ধকারের এলিস অরণীর মতো চরিত্রগুলো জীবনের বাঁকবদল ঘটিয়ে দেওয়া বিচিত্র মাইফলক হয়ে এসেছে।
তারা প্রত্যেকে যুবক। মনে কত রঙিন স্বপ্ন ছিল! প্রসঙ্গত পথচলতি। বন্ধ হয়ে যাওয়া আশির দশকের ব্যান্ড রকস্ট্রাটার ‘আর্তনাদ’ গানের লিরিকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। যাহোক। যুবকদের সেই স্বপ্নগুলো কিন্তু ভাঙা স্বপ্নের বুলভার্দে মার খেয়ে কুঁকড়ে পড়ে থাকছে। উঠে বসতেও পারছে না, দাঁড়ানো দূরের কথা। এই- আবার ব্যান্ড ‘গ্রিন ডে’র কাছে ফিরে গেলাম- ‘বুলভার্দ অব ব্র্রোকেন ড্রিমস’। এবার আমার কি একটু অন্যায় হয়েছে? কারণ এই গান যে ডি-মাইনর কর্ডে লেখা নয়। তবে, এই অন্যায়ের জন্য ক্ষমা নাও চাইতে পারি। যুক্তি- পৃথিবীর এই যে বিকল্প বার্তাগুলো এসেছে এই গানগুলোর ভেতর দিয়ে, জিল্লুর রহমান সোহাগের উপন্যাস ডি-মাইনরের ভাষ্য বারংবার ফিরে এসে তার কাছে হাঁটু ভেঙে বসে কাঁদছে।
উপন্যাসে দুটো স্তর আছে। স্তরগুলোকে আলাদা করা হয়নি। কিন্তু পড়তে গিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। প্রথম স্তর উপন্যাসের প্রকৃতি রস-সঞ্চারি। দ্বিতীয় স্তরটি প্রথম স্তরের সঙ্গে সঙ্গত করার জন্যে রাখা। প্রথম স্তরটি রাজনৈতিক আবহের দিক থেকে ধ্বংসপূর্ব। তবে প্রকৃতি তখনো সদয়।
দ্বিতীয় স্তরটিতে কিন্তু তা নয়। দ্বিতীয় স্তরে রাজনীতির রঙ ধূসর, তবে কেউ বুঝতে পারে না। কারণ সেই যে শিশুরা- যারা পারবে না তলিয়ে চিন্তা করতে- তারা তো বড় হয়েছে। ততদিনে প্রকৃতি নির্দয় হয়েছে। ঢাকা শহরে তখন সালফার বৃষ্টি হয়।
চরিত্র
প্রথম স্তরের আলাপে আসি। চৌকাঠ ব্যান্ডের কথা বলছিলাম। পাঁচ চরিত্র। কাউয়াস, ড্যানি, ব্রুস, লিপ্টন ও রবিন।
ওদের বয়স কম। রঙিন দেখার কথা ছিল সব কিছু। ওদের মনে প্রেম ছিল। রবিন ভালোবাসার মেয়েটির মতো কাছে পেতে চেয়েছিল সুপর্ণাকে। কিন্তু সে কি মৃত্যুমতি উদ্বেগ তার। আর শঙ্কার ঢেউ ভাঙছে মনে। ভালোবাসা যে ঘরে সান্দ্র হয়ে সৌরভ ছড়াবে, সেই ঘরের দেয়ালগুলো নজরদারির চোখ হয়ে তাকিয়ে আছে ওদের।
দ্বিতীয় স্তরের প্রধান যে চরিত্র, রনন, সে প্রথম স্তরের রবিনের প্রায় অনুরূপ। এবং অনবদ্য রসায়নের ভেতর রবিন-রনন দুজনের জীবন মিলেমিশে গেছে। এই রহস্যময়তাকে ডি-মাইনর কর্ডের সঙ্গে হয়ত তুলনা করা যায়।
চরিত্রগুলোর ভেতর রবিন, লিপ্টন আর কাউয়াসকে আমার সার্থক চরিত্র মনে হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের একটা বিবর্তন উপস্থিত উপন্যাস জুড়ে। বাস্তব জীবনে আমরা যদি প্রকৃতির উপন্যাসের কোনো চরিত্র হই, তাহলে কখন আমরা সার্থক চরিত্র হবো। যখন আমাদের বিবর্তন থাকবে। তা ইতিবাচক কি নেতিবাচক যেমনই হোক। এই তিনজনের ভেতর মানুষের তিন ধরন ক্রমান্বয়ে বিকশিত।
বাকি চরিত্রগুলো মানুষের অনিবার্য পরিণতিকে বরণ করেছে। মানুষ যেমন কখনো আহিত, কখনোবা নির্লিপ্ত; কখনো ব্যবহৃত, কিন্তু আদতে যা ছিল সে তা-ই থাকে, চরিত্রগুলো তেমন। সব চরিত্র তো বিবর্তিত হতে জন্মে না। একটা চূড়ামানুষের পায়ের নিচে কত উত্তোলক পিণ্ড লাশ হয়ে পড়ে থাকে।
প্রধান চরিত্রগুলো যৎসামান্য আনন্দ আর বিপুলা ব্যথার ভেতর দিয়ে গিয়ে আমার অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছে। এমন চরিত্র নির্মাণের জন্যে লেখকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। একটা ছায়া-চরিত্র আছে, রবিনের বাবা। হাসি কান্না মেশানো মনোহর আবহ তৈরি করেন। যখন বুক ভার হয়ে থাকে, তখন এ ধরনের চরিত্র সে ভার হালকা করে। ছানিপড়া চোখের মৃতপ্রায় মা, একাকী মৃত কুহক দা, অন্ধকারের এলিস অরণীর মতো চরিত্রগুলো জীবনের বাঁকবদল ঘটিয়ে দেওয়া বিচিত্র মাইফলক হয়ে এসেছে।
কিছু সার্থকতা
মানুষের তীব্র বেদনাবোধ আর যৌনতার ভেতর একটা সম্বন্ধ এ উপন্যাসে আবিষ্কৃত হয়েছে। আমি মোহিত হয়েছি। লেখকের ভাষায়-‘প্রতিটা শোকের আড়ালে লুকিয়ে থাকে শক্তিশালী এক অদৃশ্য চুম্বক যা দুজন বিপরীতধর্মী মানুষের ভেতর জাগিয়ে তোলে তুমুল জৈবিক তাড়না। সুপর্ণা যখন আমার শক্ত দু’হাতের ভেতর, বুকের ভেতর, গুঁড়ো গুঁড়ো হতে থাকে কাচের মতো, গলে যেতে থাকে মোমের মতো; তার ভেতরের শোকের কান্নারা যখন রূপ নেয় শরীরী তৃপ্তির অস্ফূট মর্মরশব্দে; ঠিক তখনই শোক আর জৈবিক তাড়নার পারস্পরিক যোগসাজশটা আমার কাছে ধরা পড়ে।’
জিল্লুর রহমান সোহাগের লেখায় সেই মেজাজ এসেছে অনেকখানি। ‘ডি-মাইনর’ লেখকের প্রথম উপন্যাস। যদি বাজি ধরি এ ঔপন্যাসিকের জয়যাত্রার ওপর, মন বলছে জিতে যাব।
শোকের সঙ্গে মানুষের আরেকটা সম্বন্ধবিচার ভালো লেগেছে। ‘এতদিনে জেনে গেছি শোকেরা স্বভাবে উদ্বায়ী। অল্প আঁচেই উড়ে যায়, যেতে হয়। এই আঁচটা সময়ের, ব্যস্ততার কিংবা নিত্যকার দরকার-অদরকারি ভাবনার উপরিপাতনের।’
কিছু সার্থক উপমা তৈরি হয়েছে বলে আমি মনে করি। ‘কালী নদীর উপরকার সেই ব্রিজটি আমাদের কাছে ছিল অভিভাবকের স্নেহউদ্বেল বুকের মতো’, ‘বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ কখনো মনে হয় বিজয়া দশমীর মেলায় কেনা বেলুনবাঁশি’, ‘আব্বা গুনগুন করে গান গাইতেন আর টিনের বেড়াটায় তাল ঠুকতেন এক হাতের আঙুলের টোকায়। আমার চোখে তখন বিড়ালপায়ে নেমে আসত ঘুম।’
কিছু আক্ষেপ
মানুষ ভাষায় যোগাযোগ করে। পাঠকের সঙ্গে ডি-মাইনর উপন্যাসটি সবচেয়ে বড় দূরত্ব তৈরি করতে পারে এর ভাষা দিয়ে। আমি মনে করি ভাষা কখনো বেশি অলংকারপূর্ণ হয়ে উঠেছে এখানে। ততটাই, যতটা অলংকার গদ্যের পক্ষে বেমানান।
কিছু জগৎ নির্মাণ-সম্ভাবনা বিকশিত করা হয়নি। যেমন সালফার বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক পরিবেশ, শিশুদের মনোজগৎ, সরকারি অপরাধজগৎ, নজরদারির কিছু উপলক্ষ্য, মানুষের পরিণাম।
কিছু পরিবেশ বা চরিত্র আছে বিকশিত করতে লোভ হয়। সেই লোভজাত আরেকটা দুঃখ তৈরি করেছে উপন্যাসের ‘বখাটেদের দল’। ওই বখাটেরা ছিল ঘুরে দাঁড়ানো মানুষের প্রতিনিধি। যৌবনে পায়ের নিচে নরক রেখে সরু সুতোর ওপর হাঁটার প্রতীক। ভবিষ্যৎ না-দেখা উদ্বেল বিপ্লবীর আবেগের প্রতীক, যারা তাৎক্ষণিক আঘাত করলেও শেষমেশ প্রতিবিপ্লবের হাত দৃঢ় করে। তো, রবিন রননদের ওপর মনোযোগ অক্ষুণ্ন রেখেই ওই ‘বখাটেরা’ যেন আরো খানিকটা অবকাশ পেতে পারত বিকাশিত হওয়ার।
এসব যেন মিষ্টির লোভ দেখিয়ে পরে সরিয়ে নেওয়া। তবে লেখক টিকিট কাটিয়ে আমাকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক জাদুঘরে। জাদুঘর আমাকে মিষ্টির আক্ষেপ ভুলিয়ে দিলো। শেষমেশ অবশ্য পাঠক হিসেবে দুঃখ নেই।
‘One, twenty one guns
Lay down your arms
Give up the fight
One, twenty one guns
Throw up your arms into the sky’
তবে লেখক হিসেবে হয়ত লেখকের দুঃখটা রয়ে গেছে।
প্রতিটা অধ্যায়ের নাম বেশ মিষ্টি, কখনো কাব্যিক। যেমন ‘ভোরের বিমান ও বৈকালিক প্রজাপতি’, ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’, ‘সহসা অলীক সন্ধ্যারাতে’, ‘সিম্ফোনি ৪৫’। কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে অধ্যায়ের নামগুলো গল্পের শরীরে বেমানান হার। কিছু বেশ মানানসই, যেমন দেহ তেমন অলংকার।
উপসংহার
উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয়েছে জ ই মানিককে। কবি জ ই মানিক এ উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার কিছু দিন আগে অন্যভুবনে চলে যান। তাঁকে নিতে কোনো তরী আসার কথা ছিল না, আসেওনি। তিনি স্বেচ্ছায়, একা সাঁতরে ওপারে পৌঁছান। কোনো পিছুডাক তাঁকে ফেরাতে পারেনি। আমার প্রায়ই মনে হতো, এ উপন্যাসের পাঠযাত্রায় তিনিও আমার সখা।
যাই হোক-
ধ্বংসের পূর্বনাদ শোনা যে মানব সমাজ সোহাগ আঁকতে চাইলেন, সেখানে শিল্পীর কষ্টের চিৎকার গানের মতো শোনায়। হয়ত তার সুরটা ‘ডি-মাইনর’। নতুন সহস্রাব্দে উপন্যাসের মেজাজ বদলে যাচ্ছে। জিল্লুর রহমান সোহাগের লেখায় সেই মেজাজ এসেছে অনেকখানি। ‘ডি-মাইনর’ লেখকের প্রথম উপন্যাস। যদি বাজি ধরি এ ঔপন্যাসিকের জয়যাত্রার ওপর, মন বলছে জিতে যাব।