মানুষ কি কখনো সময়কে ধরতে পেরেছে? কারণ সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। নিজের নিয়মেই এগিয়ে যায়। তবে কেন এই টাইম মেশিন? কী তার কাজ? টাইম মেশিন কি সময় মাপার যন্ত্র না কি সময় ধরে রাখার উপায়? প্রশ্নগুলো মনে এলে আসমা সুলতানা শাপলার উপন্যাস কল্পবিজ্ঞান ‘টাইম মেশিন’থেকে কি তার উত্তর পাব? যদি পেয়ে যাই? তাহলে পড়া হোক বইটি।
এর আগে বলে নেই—এইচ জি ওয়েলস ১৮৯৫ সালে একটি গল্পের বই লেখেন। যার নাম The Time Machine রাখা হয়েছিল। তখন এটিকে সবাই কল্পকাহিনী হিসেবে ধরে নিয়েছিল। অনেকেই হাপিত্যেস করেছিল—যদি এমন হতো! কিছুদিন পর আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন, আমাদের পক্ষে আলোর গতিতে চলা অসম্ভব। কিন্তু গবেষণা থেমে থাকেনি। টাইম মেশিন গবেষণার ক্ষেত্রে যেটা মূল বিষয়বস্তু—সেটা হলো, ঘটনা ও তার প্রতিক্রিয়া।
বেশিদিন আগের কথা নয়, ২০১২ সালে টাইম মেশিন নিয়ে একটি হিন্দি ছবি বের হয়েছিল। যার নাম ছিলো ‘অ্যাকশন রিপ্লে’। এছাড়া যুগে যুগে টাইম মেশিন নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। আজও হচ্ছে। আমাদের এখন মনে হতে পারে যে, টাইম মেশিন হয়তো সম্ভব। কারণ আমরা অতীত দেখতে পাই স্মৃতি হিসেবে। আর জীবনের এক সেকেন্ড যেতে না যেতেই তা অতীত হয়ে যায়। আবার সম্ভাব্য ভবিষ্যতও আমরা কল্পনা করতে পারি। যেমন যুক্তি দিয়ে যদি চিন্তা করি যেকোনো একটা ব্যাপার ভবিষ্যতে ঘটবে। কখনো কখনো দেখা যায়, অদূর ভবিষ্যতে সেই ব্যাপারটিই ঘটছে। তাই এভাবে ভাবলে মনে হয়, সময়ের ভেতর দিয়ে তো যাওয়া যেতেই পারে, অন্তত কল্পনায়।
টাইম মেশিন এমন এক যন্ত্র, যাতে চড়ে ভ্রমণ করা যায় একসময় থেকে অন্য সময়ে। আশ্চর্য এই মেশিন মাঝে মাঝেই দেখা গেছে বিভিন্ন ছবিতে। কখনো এই মেশিন মানুষকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছে অতীতে, কখনো আবার এগিয়ে গেছে ভবিষ্যতে। কিন্তু সত্যিই কি টাইম মেশিন আছে? সত্যিই কি সম্ভব টাইম ট্রাভেল? আসমা সুলতানা শাপলা আসলে কী বলতে চেয়েছেন, সেটা জেনে নেওয়া যাক আগে।
আসমা সুলতানা শাপলার টাইম মেশিন শুরু হয় মা-মেয়ের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে। ঝুমুরের আট বছরের মেয়ে রূপকথা বই পড়তে চায়। ঝুমুর তাকে সব ধরনের বই পড়ার অনুমতি দেয়। এই বই পড়া থেকেই গল্প এগোতে থাকে। চাঁদে কেন মানুষ গিয়েছিল? মানুষের আগে কাকে পাঠানো হয়েছিল? বানর, কুকুর কেন পাঠানো হলো? এমন সব কথোপকথনের মধ্য দিয়েই চলে আসে রূপকথার বিজ্ঞানী হওয়ার বাসনা। বিজ্ঞানী হয়ে সে টাইম মেশিন তৈরি করবে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় ছোট বোন চন্দ্রকথাও।
টাইম মেশিন নিয়ে রূপকথা ও চন্দ্রকথার কথোপকথন চলতে থাকে। রূপকথা টাইম মেশিনের বিবরণ দিতে থাকে। সে তার মায়ের অতীত দেখতে টাইম মেশিন বানাতে চায়। মায়ের গ্রামেঘেরা অতীতের যাবতীয় অনুষঙ্গ চলে আসে। চলে বর্তমান পারিবারিক খুঁটিনাটি। কেউ ছবি আঁকা শেখে, কেউ শেখে গান। এমন পরিবেশ-প্রতিবেশের মধ্য দিয়ে হঠাৎ করে রূপকথারা বড় হয়ে যায়। আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। সেখান থেকে দেশের মাটিতে ফিরে আসে। এতে মনে হয়, সময়ের ঐক্য সঠিকভাবে রক্ষিত হয়নি।
রূপকথা দেশে যখন ফিরে আসে; তখন ২০৩৬ সাল। উপন্যাসের শেষে দেখানো হলো রূপকথার জন্ম ২০০৭ সালে। তাহলে রূপকথার বয়স যখন আট বছর; তখন কত সাল চলছিল? সেটা কি ২০১৭ সাল? মাঝখানের এই বছরগুলো কোথায় হারিয়ে গেলো? উপন্যাসে শুধু বলা আছে, ‘এইভাবে পার হয় কিছুকাল, সোনালি শৈশব রূপকথা আর চন্দ্রকথার।’ সে যা-ই হোক, দেশের গবেষণাগারে বসেই যোগাযোগ করে তার ছাত্র ঈশানের সঙ্গে। নেভাদা কোস্ট ইউনিভার্সিটির স্পেশাল অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে ঈশানের তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় অত্যাধুনিক টাইম মেশিন। তবে ঈশান কিছু মেটিরিয়ালস নিয়ে দেশে এসেছিল। কিন্তু কেন? আসুক, তাতে আপত্তি নেই। তাকে বিমানবন্দরে রিসিভ করতে যায় চন্দ্রকথা। কারণ রূপকথা তার গবেষণায় ভীষণ ব্যস্ত ছিল।
দেশে এসে রাতে ঘরের সব বাতি বন্ধ করে শুধু একটি আয়নার সামনে ধুপ জ্বেলে কিছু মৃত মানুষের আত্মার সঙ্গে কথা বলার মধ্যে কী এমন সাফল্য ছিল? সেখানে ‘লেখক আঙ্কেল’ নামে কাউকে দেখি আমরা। এই লেখক আঙ্কেলটি কে? যিনি ঝুমুরের পরিবারের সবাইকে চেনেন? আয়নায় এ গবেষণার কার্যকারিতা কী ছিল? বা কিসের পূর্ব-প্রস্তুতি? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তা বোধগম্য নয়। কেননা আমি বিজ্ঞানের ছাত্র বা শিক্ষক নই। সে যাকগে, টাইম মেশিন তো শেষ পর্যন্ত বিদেশের ওয়ার্কশপেই বানাতে হলো। তবে সেখানে রূপকথা যায়নি কেন? মেশিনটি বানিয়ে বিমানে করে বাংলাদেশে আনা হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন থেকে যায় পাঠকের মনে। বাংলাদেশে তাদের কাজে যুক্ত হন বিখ্যাত বিজ্ঞানী এ জেড আকবর খান। টাইম মেশিন তৈরিতে তার ভূমিকা আসলে কী? বিদেশে ঈশানের ওই ওয়ার্কশপে টাইম মেশিনটি তৈরি হয়। ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে নিজের গবেষণাগারে বসে তা দেখেন রূপকথা ও তার পরিবারের লোকজন। যে টাইম মেশিনের ব্যাপ্তি ১৯৭৪ সাল থেকে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ রূপকথার মা ঝুমুরের জন্মসাল অবধি।
মেশিনটি দেশে আনার পর শুরু হয় পরীক্ষার পালা। মেশিনে উঠে বসে ঈশান ও রূপকথা। উপস্থিত রয়েছেন সাংবাদিকরা। বাসায় বসে মনিটরিং করছেন প্রফেসর আকবর খান। চলতে চলতে কোথায় যেন মিলিয়ে যায় মেশিনটি। একসময় সন্ধান পাওয়া যায় মেশিনের। সেটা তখন অবস্থান করছিল ২০১১ সালে। দর্শকদের বিশ্বাস করানোর জন্য চলে যায় ২০১৫ সালে। নালন্দা বিদ্যালয়ের অতীতের স্মৃতি দেখানো হয়। এরপর ২০০৭ সালে এসে আটকে যায় টাইম মেশিন। আর পেছনে যেতে পারে না। কারণ রূপকথার জন্ম ২০০৭ সালে। প্রফেসর বলেন, কারো জন্মের আগের অতীতে কেউ যেতে পারবে না। এই তথ্য অবশ্য রূপকথার জানা ছিল না। জানতেন শুধু ওর প্রফেসর। তাই একবুক বেদনা নিয়েই ২০০৭ সাল থেকেই ফিরে আসতে হয় রূপকথাকে। তবু এই অভিযানকে দেশবাসীসহ বিশ্ববাসীর কাছে সার্থক বলে দাবি করেন প্রফেসর।
তবে শেষ মুহূর্তে এসে আমার মনে পড়ে যায় ‘অ্যাকশন রিপ্লে’ সিনেমার কথা। সেখানে আমরা দেখতে পাই, একটি ছেলে তার বাবা-মায়ের সংসারে অশান্তি দূর করার জন্য টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে চলে যায়। কিন্তু সে সময় ছেলেটি জন্মই নেয়নি। অথচ সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে, কথা বলে। তখন তার বাবা-মায়ের দৈহিক মিলনই ঘটেনি, অথচ সে দাঁড়িয়ে আছে বাবা-মার সামনে। আবার দেখা যায়, টাইম মেশিন নিয়ে ছেলেটি সেই প্রফেসরের কাছে যায়; যিনি টাইম মেশিনটি তৈরি করেছেন। অথচ সে সময় প্রফেসর টাইম মেশিনের কাজই শুরু করেননি। তাহলে দেখা যায়, অতীতে গিয়ে ছেলেটি এবং টাইম মেশিনের কোনো অস্তিত্বই থাকে না। আবার ছেলেটি ভবিষ্যতে ফিরে আসার পর কারও কিছু মনে নেই। কিন্তু প্রফেসরের মনে থাকার কথা যে, ছেলেটি তারই টাইম মেশিন নিয়ে ভবিষ্যৎ থেকে এসেছিল এবং বাবা-মারও মনে থাকার কথা, ভবিষ্যৎ থেকে ছেলেটি এসেছিল।
সিনেমায় দেখা যায়, ছেলেটি যে সময়ে জন্ম নেয়নি; সেই সময়েও সে যেতে পেরেছে। আসমা সুলতানা শাপলার টাইম মেশিন বলছে ভিন্ন কথা। অর্থাৎ রূপকথা ২০০৭ সালে গিয়ে আটকে যায়। সে যদিও তার মায়ের জন্মসাল ১৯৭৪ পর্যন্ত যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যেতে পারে না। তাকে ফিরে আসতে হয়। এই সিনেমা দেখার পরে টাইম মেশিন সম্পর্কে নতুন করে আর কী জানার আছে আসমা সুলতানা শাপলার উপন্যাসে? সেক্ষেত্রে আরো বেশি গবেষণার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়। টাইম মেশিনের অস্তিত্ব আসলেই আছে কি না, তা কিন্তু আমরা স্পষ্ট নই। ২০১৭ সালে প্রযুক্তিনির্ভর এই বিশ্বে এমন উপন্যাসের উপযোগিতা কী, এমন একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। সময়টা কল্পকাহিনীর নয়; বাস্তবতার। এখনকার মানুষ রিয়েলিটিতে বিশ্বাসী। একসময় সাপের গল্প-উপন্যাস খুব সুখপাঠ্য ছিল। একসময় ভূত-প্রেত নিয়ে মানুষের খুব আগ্রহ ছিল। টাইম মেশিনের আগ্রহটাও অতীত হয়ে গেছে বলে মনে হয়।
প্রতীকী অর্থে যদি বলি, তবে আমার দৃষ্টিতে টাইম মেশিন হচ্ছে মানুষের কল্পনাশক্তি। একজন মানুষ অতীতকে কতটুকু ধারণ করতে পারে এবং ভবিষ্যৎকে কতটুকু উপলব্ধি করতে পারে, সেটার সমীকরণই হচ্ছে টাইম মেশিন। এক্ষেত্রে একজন লেখক বা কবিই একটি যথার্থ টাইম মেশিন। টাইম মেশিন তার মস্তিষ্ক। সে হিসেবে লেখক আসমা সুলতানা শাপলার টাইম মেশিনটিও সফল। যদিও আমরা তার অতীতকে টাইম মেশিনে স্পষ্ট দেখতে পারিনি। তার কল্পনা বা লেখার বর্ণনায় তাতে যতটুকু জেনেছি, ঝুমুরের অতীত খুব বেশি সুখকর নয়। এ কারণেই হয়তো তিনি টাইম মেশিনটিকে ২০০৭ সালে প্রথম মেয়ের জন্মসালে গিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন। অতীতের সুখময় বা বিষাদিত স্মৃতি সন্তানের চোখের সামনে তুলে আনেননি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অন্তত সেটাই স্বাভাবিক।
সবশেষে লেখকের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে উপন্যাস পড়েও ছোটগল্পের মতো আকাঙ্ক্ষাটা রয়ে গেল। রয়ে গেল অন্তরের অতৃপ্তি। আশা করি উপন্যাসটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে।
টাইম মেশিন
লেখক: আসমা সুলতানা শাপলা
প্রকাশক: আত্মজা পাবলিশার্স, কলকাতা
প্রচ্ছদ: নাজিয়া ইবনাৎ রোদশী
প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০১৭
মূল্য: ১২০ টাকা