সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে কবিদের চিন্তার ধরন। নতুনরা কবিতাকে ভাবছেন আগের চেয়ে ভিন্নভাবে। এরকমই একজন ভিন্নচিন্তার কবি মাসুম মুনাওয়ার। অমর একুশে বইমেলা-১৭- তে প্রকাশিত হয়েছে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ জলবন।
কবির কল্পনায় জলবন একটি নান্দনিক নদী। ত্রিমাত্রিক দৃষ্টিতে সেখানে তিনি নির্মাণ করেছেন একটি ভিন্ন জগত। এই জগতই কবির সারাজীবনের ব্রত। জলবন-এর এই জগতকে কবি সাজিয়েছেন নৈসর্গিক সৌন্দর্য, কৃত্রিম চিত্রকলা আর বাস্তবতার বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে। এসব অনুষঙ্গের সহায়তায় কবি নিজের চিন্তাকে সচেতনভাবে রূপায়ন করেছেন।
জলবনের প্রথম কবিতার নাম ‘সামগ্রিক ইতিহাস’। যাদের রক্ত আর ঘামে ভিজে গড়ে ওঠে সভ্যতার এই ইট-কাঠের ইতিহাস, তাদের কবি দেখেছেন গভীর বেদনাভরা চোখ দিয়ে। কয়েকটি পঙ্ক্তি:
…শুকনো ঘাম আর রক্ত মিশে গড়ে ওঠে কংক্রিটের জীবন
লাল ইটের দেয়ালজুড়ে বিচ্ছেদ আঁকে পা-কাটা মতিন
তবুও থেমে থাকে না উন্নয়ন, উচ্ছেদ কিংবা সামগ্রিক ইতিহাস
বঞ্চনার অন্তর্গত বিদ্রূপের রঙ খুঁজে ফেরে সান্ত্বনার হিসাব।
সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, ‘কবির কর্তব্য হচ্ছে, নৈমিত্তিক ক্ষেত্র থেকে, সাধারণ বাস্তবতা থেকে জীবনকে উদ্ধার ক’রে এনে শব্দের জগতে তা’কে প্রাণবন্ত ও চঞ্চল করা।’ মাসুম মুনাওয়ার কবির সেই কর্তব্য পালনের চেষ্টা করেছেন। সামগ্রিক অলিখিত ইতিহাসে একজন পা-কাটা মতিনের অবদানকে তিনি শব্দের জগতে প্রাণ দিয়েছেন। সমাজবাস্তবতার ছাপ এখানে স্পষ্ট হলেও খুবই নির্মোহ চিন্তার দ্বারা তিনি শহুরে সভ্যতার সঙ্গে নিম্নবর্গের নির্মম সম্পর্কের সন্ধান করেছেন।
পল্লীর প্রতি কবির আলাদা প্রেম তার কথায়, ভাষায়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আরেকটি কবিতা পড়া যাক:
বাঁশের হুকা টানতে টানতে আমাদের সকাল হবে
আমরা বাড়ি ফিরব
কাশতে কাশতে লাঙল আর জোয়াল কাঁধে
সরিষার তেল মাখতে মাখতে টুকটাক প্রেম করে নেবো…।
(আমরা তখন এলিয়েন হয়ে যাব)
অথবা এই কবিতাটি:
…চুল থেকে নিয়ত ঝরে তিলের তেলের সুঘ্রাণ। চুলে গুজে বাঁশফুল
কদমের ঘ্রাণে সাঁতরিয়ে যাব ধলা নদী আর কৃষকের কাঁচা আল্
মিলিয়ে নেবো ঠোঁট কালচে মাটির লাহান জবজবে মায়াবি পিঠে।
(দুঃখবোধ)
পল্লীর ভাব-ভাষার এতটা নিপুণ প্রয়োগ তখনই করা সম্ভব, যখন কবি পল্লীকে ধারণ করেন হৃদয়ের গভীরে। ‘কালচে মাটির লাহান জবজবে পিঠ’—গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে মাটিকে পর্যবেক্ষণ না করলে কারও পক্ষে এমন উপমা ব্যবহার সম্ভব নয়।
ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে যারা ধর্মবিদ্বেষ ছড়ায়, তাদের উদ্দেশে কবির শ্লেষাত্মক বক্তব্য:
আমাদের শহরে চাঁদ উঠলে তোমার ঘুম পায়
নীল ঘুম, ঘুমের ভেতর
আড়ালে তোমার হাত খোঁজে অন্য কোনো জোছনা।
(…)
কেলোদের কোলাহলে আমার শুধু ঘুম পায়।
(ধর্মনিরপেক্ষতা)
জলবন-এ কবি সন্ধান করেছেন তার আত্মপরিচয়। কবিতার পরতে পরতে তার ছাপ পড়েছে। ‘মহাকালের জিকির ১’ কবিতায় বলেছেন,
…কার কথা ভাবো মন যেখানে জেগেছে লালন
নদীয়ার নদ ভাবো সহজিয়া পদ
লালনের বাণী জপো প্রেমের গজল।
‘ছায়াদের গল্প-১’ কবিতায় দেখি প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে কবির অনুভূতির সাতকাহন:
…আশ্বিনের বিকেলের মতো ভালো আছি
অভিমানে কেটেছে ওই কার্তিকের সকালগুলো।…
আশ্বিনের সঙ্গে, কার্তিকের সঙ্গে কবির উপমা সকাল-বিকালের মতো নৈমিত্তিক সময়ের। যাপিত জীবনকে কবি দেখতে চেয়েছেন প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে। এখানেই কবির উপমার স্বাতন্ত্র্য। সমগ্র ‘জলবন’ কবির উপমার এই বিশেষত্বেরই সাক্ষ্য দেয়। ‘কংক্রিটের জীবন’ কবির সৃষ্ট এই শব্দগুচ্ছের দিকে তাকালেই দেখা যায়—নাগরিক নিম্নবর্গের চিত্র। একটি মাত্র শব্দ, অথচ কী গভীর! আবার, ‘মানুষগুলো ফড়িঙের মতো উড়ে চলে চোখের কোণে’—ঘরেফেরা মানুষের দিকে তাকিয়ে কবি দেখেছেন ফড়িঙের উড়ে যাওয়ার দৃশ্য। উপমা আর চিত্রকল্পের আড়াআড়ি গভীরতা কবির গভীর অন্তর্দৃষ্টিপ্রসূত ফল।
চিত্রকল্প/ নির্মাণে কবির সহায়ক হয়েছে যাপিত জীবনের প্রায় প্রতিটি অনুষঙ্গ। জলবন্-এর কয়েকটি চিত্রকল্প দেখানো যায়:
..আইল্যান্ডে দাঁড়ানো গাছে শুল হয়ে বেঁধে প্রতিটি হর্ন
ধুলোবালিগুলো লুটোপুটি খায় গাড়ির পিছন পিছন…
(বিচ্ছেদের পোস্টার)
এখানে নিত্যযাপিত নাগরিক জীবনের অতি পরিচিত কিছু দৃশ্য এঁকেছেন ভিন্ন দৃষ্টিতে। ‘আইল্যান্ডে দাঁড়ানো’ গাছগুলোকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন শুলরূপী হর্নের সামনে। চলন্ত একটা গাড়ির পেছন পেছন লুটোপুটি খেতে খেতে ধুলোবালি উড়ে যাচ্ছে—এ দৃশ্য কারও কাছেই নতুন না হলেও কবির উপস্থাপনে হয়ে উঠেছে অভিনব।
সবমিলে ৪১টি কবিতা সংকলিত হয়েছে জলবন-এ। এতে সংকলিত হয়েছে নিরূপিত ছন্দের সঙ্গে অনিরূপিত ছন্দের কবিতাও। সবধরনের কবিতায়ই কবির ভাষিক চাতুর্য লক্ষণীয়। তবে কবির শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দ্বিরুক্তির প্রবণতা ক্ষেত্রবিশেষে একঘেয়ে লাগতে পারে। উদাহরণ:
…দালান ফেরত শূন্য বস্তাগুলো উষ্টা খেতে খেতে ঘরে ফেরে
ককিয়ে ককিয়ে হাঁটে বুড়ো জয়নুদ্দিন আর শাপলার মা…
(সামগ্রিক ইতিহাস)
পাশাপাশি দুটি পঙ্ক্তিতে ‘খেতে খেতে’ ও ‘ককিয়ে ককিয়ে’ দু’টি দ্বিরুক্ত শব্দ কবিতার স্বাভাবিক চাল বিঘ্নিত করেছে বলে মনে করি। আবার—
বাঁশের হুকা টানতে টানতে আমাদের সকাল হবে
আমরা বাড়ি ফিরব—
কাশতে কাশতে লাঙল আর জোয়াল কাঁধে
সরিষার তেল মাখতে মাখতে টুকটাক প্রেম করে নেবো…।
(আমরা তখন এলিয়েন হয়ে যাব)
‘টানতে টানতে’, ‘কাশতে কাশতে’ এবং ‘মাখতে মাখতে’ এই কবিতায় অতি প্রাসঙ্গিক তিনটি শব্দ হওয়ার পরও পরপর পঙ্ক্তিতে ব্যবহৃত হওয়ায় শ্রুতিতে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। এছাড়া একাধিক জায়গায় ‘দ্বিরুক্তি ব্যবহারজনিত’ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। আশা করছি, পরবর্তী সময়ে লেখার ক্ষেত্রে কবি এসব বিষয়ে লক্ষ করবেন।
শব্দগঠনের ক্ষেত্রেও কিছু জায়গায় ত্রুটি চোখে পড়ে। যেমন—দালান ফেরত, হিসেবের খাতায়, দল বাঁধা; হতে পারতো, যথাক্রমে—দালানফেরত, হিসাবের খাতায়, দলবাঁধা প্রভৃতি।
‘কাঙাল’ কবিতার শেষ দুই পঙ্ক্তির শুরুতে ‘আমি’ শব্দটির দুবার ব্যবহার কবিতাটির ক্ষেত্রে বাহুল্যদোষ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে:
আমি প্রেম ছুড়ে ফেলার ভয়ে অবশেষে নিজেকেই ছুঁড়ে ফেলি
আমি নিঃস্ব হয়ে ঘুরি আকাশের প্রান্তে নতুন কোন প্রভূর খোঁজে।
‘দুঃখবোধ’ কবিতার এই পঙ্ক্তিটিতে: ‘…ঘুম থেকে জেগে যাই যে নারীর প্রেমে সে নারীর শরীর বড় চেনা…’
‘যে নারী/ সে নারী’ এই শর্তমূলক শব্দগুচ্ছ ব্যবহার না করে কবি এর বিকল্প ভাবতে পারতেন। সেক্ষেত্রে বাক্যটির সৌন্দর্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকতো না।
বাংলা একাডেমি প্রণিত সর্বশেষ বানানের নিয়ম অনুযায়ী বিবেচনা করলে জলবন-এ কতিপয় বানান ভুল আছে। আমরা আশা করি, লেখক ও প্রকাশক উভয়েই এক্ষেত্রে আরও আন্তরিক হবেন। এছাড়া মুদ্রণজনিত কিছু ভুল আছে। পরবর্তী সংস্করণে এসব সংশোধন করতে সংশ্লিষ্টরা আরও আগ্রহী হবেন, এ আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
মাসুম মুনাওয়ারের কবিতায় শব্দের ব্যবহার এতটাই নির্ধারিত যে, অর্থের অস্পষ্টতার সম্ভাবনা সেখানে অত্যন্ত কম। এই বৈশিষ্ট্যই জলবন-এর কবিতাকে দান করেছে স্বতন্ত্র মাত্রা। তার কবিতায় একইস্থানে স্থান পেয়েছে—ইতিহাস, সমকাল ও ভবিষ্যৎ।
জলবন
মাসুম মুনাওয়ার
প্রকাশক: বাংলার কবিতা প্রকাশন
প্রচ্ছদ: আল নোমান।
মূল্য: ১২০ টাকা।