কোনো বিশেষ কাহিনি বা আখ্যানকে যথার্থ গল্প হয়ে ওঠার জন্য এর প্লট, সেটিং, চরিত্র, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি এবং দ্বন্দ্ব যথাযথভাবে ও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। পাঠক ও সমালোচক হিসাবে লেখকের কাছে আমার বরাববরই প্রত্যাশা থাকে—সুসংগঠিত প্লট, প্রাণবন্ত বর্ণনা ও একটি বার্তা। গল্প বলার ধরন এমন হবে—যা সহজেই মনোযোগ আকর্ষণ করে ও ধরে রাখে। পাশাপাশি স্থায়ী প্রভাব ফেলে। বিবরণের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকবে মৌলিকতা, মানসিক অনুরণন। উল্লিখিত বক্তব্যের আলোকে এখানে সুমন মজুমদারের গল্পগ্রন্থ ‘চাতক প্রায় অহর্নিশি’র ওপর কিছু আলোকপাতের প্রয়াস থাকবে।
বইয়ের গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট, চরিত্রের রূপায়ন ঘটনার বিবেচ্য বাস্তবতা, প্রকাশভঙ্গির কাব্যময়তা, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে গল্পের চরিত্রের দ্বন্দ্ব, সামাজিক ও মনস্তত্ত্বের ভেতর দিয়ে সাবলীলভাবে প্রকাশ করেছেন। বর্তমান সময় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির বিপন্নবোধ ও মনস্তত্ত্বের অনুসন্ধানে আখ্যান ও চরিত্রের গভীরতা নির্মাণে সচেষ্ট থেকেছেন সুমন মজুমদার। তার গল্পের মূল থিম ও চরিত্রের সমর্থনে ঘটনার রহস্যময়তা সামগ্রিক আদর্শে পাঠকের মনে জীবন ও মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তনকে প্রভাবিত করবে।
‘চাতক প্রায় অহর্নিশি’ গল্পগ্রন্থে রয়েছে আটটি গল্প। বইয়ের প্রথম গল্প ‘ছায়াচর্যা’। মানুষ সৌন্দর্য প্রিয়, রহস্যময় সৌন্দর্যের খোঁজে মানুষ চিরকাল হন্য হয়ে ছোটে। দুটি বিমূর্ত চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে গল্পের আবহ। আর প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছে বটগাছ। এই বটগাছ কালের সাক্ষী, শেকড়ের টান, নিজস্ব ঠিকানা, নিরাশ্রয়ের আশ্রয়। দুটি ছায়া মানুষ এই বটগাছের অন্ধকারে নিজেকে খোঁজে। আর পরস্পরকে স্পর্শ করে লীন হয়ে যায়। যা পাঠকের মনে গভীরতর আলোড়ন তোলার অবকাশ রাখে। যা এক অমীমাংসিত সত্যের মতো, রহস্যময় সুন্দরের মতো।
‘গোলাপসম’ দ্বিতীয় গল্পের নাম। এই গল্পের পটভূমি অসম বয়সী দুজনের প্রণয়ের ঘটনা নিয়ে রচিত। গল্পের সমাপ্তি বিয়োগান্তক। গল্পের প্রাণবন্ত, উচ্ছল মেয়ে সূচনা। যার উচ্ছ্বাস, উচ্ছলতা, উদ্দীপনা নতুন করে বাঁচতে অনুপ্রাণিত করে পঞ্চাশোর্ধ পঙ্গু এক মানুষকে। যাকে সে পেতে চায় প্রেমিকের মতো। কিন্তু তিনি সূচনাকে ভাবেন কন্যাসম। আর সূচনা তার মনে পিতৃহৃদয়কে উদ্বেল করে। এই গল্পের মোড় ঘোরে অন্য বাঁকে, যখন পঞ্চাশোর্ধ পঙ্গু মানুষটি বলেন, ‘ছি! তুই যা চাইছিস, তা আমার জন্য গভীর লজ্জা।’
সুবিনয় মুস্তফীর অপহরণ, অপহরণের কারণ, বিষয়বস্তু, চারপাশের পরিবেশ, জীবনবোধ ও মৃত্যু নিয়ে লেখকের ভাবনা এতে প্রকাশিত হয়েছে।
সূচনা অবাক হয়ে, কিছুক্ষণ নীরবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখ জলে ভরে এলে গভীর দুঃখ নিয়ে বলে, ‘পঙ্গুপতঙ্গ কেন এমন গভীর অসুখে পড়লাম বলো তো? অবসন্ন মর্মে কেন এত বিষের ফণা?’ সত্যি বলতে, ভালোবাসা গভীর অসুখ ও আরোগ্যহীনের যন্ত্রণা। সূচনা চরিত্রে দুরন্তপণা ও গতিময়তা আছে। কিন্তু গল্পের শুরুতে যে ছেলেটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক তিনটা কুড়ি মিনিটে, এই একই সময়ে রেলিংয়ের পাশ দিয়ে তাকাতেই সেই মধ্য বয়সী ছেলেটাকে দেখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম সে গল্পের নায়কের দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকায়, মৃদু অভয় মেশানো হাসি হাসে। এই চরিত্রটি কোনো কার্যকর যোগসূত্র স্থাপন করেনি গল্পে। গল্পের খাতিরে ধরে নিতে পারি, নায়কের প্রথম যৌবনে প্রেমের এবং শেষটাকে মৃত্যুর সূত্র; তাহলে এখানেই শেষ করতে হতো। নায়কের একটা নাম থাকা ভীষণ প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। বারবার পঙ্গুপতঙ্গ পড়তে ও বলতে অশোভন ঠেকছে। তবে, গল্পের শেষটুকু চমৎকার।
তবু কথা থেকে যায় এই গল্পের পটভূমি ও প্রধান দুই চরিত্রের ওপর সামাজিক ও ধর্মীয় চেতনা কতটুকু প্রভাব ফেলেছে—তা নিয়ে। এই অসমবয়সী প্রেমের সম্পর্ক ও বিবাহে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও সূচনার মুখে যে পাপের কথা উচ্চারিত হয়েছে, তা মূলত সামাজিক দৃষ্টিকোণ আর পাপবোধ তৈরি ও বহন করেছেন গল্পের নায়ক, সূচনার মাঝে বিস্তার ঘটিয়েছেন তিনিই। সূচনা বয়সে তরুণ তার উদ্দমতা, প্রাণ-চঞ্চলতা, বিপরীত স্রোতে চলার সাহসী প্রবণতা সবকিছু মিলিয়ে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে গল্পের নায়ক যতটা ধর্মীয় সংস্কারে আচ্ছন্ন তার চেয়ে বেশি সামাজিকবোধ তার মনকে আচ্ছন্ন ও প্রভাবিত করেছে।
‘আট বছর আগের একদিন’ গল্পে জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগে’ কবিতার মূল উপজীব্য নিয়ে লেখক আলাদা প্রেক্ষাপটে আলাদা স্বাদের নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করেছেন। সুবিনয় মুস্তফীর অপহরণ, অপহরণের কারণ, বিষয়বস্তু, চারপাশের পরিবেশ, জীবনবোধ ও মৃত্যু নিয়ে লেখকের ভাবনা এতে প্রকাশিত হয়েছে।
‘সুবিনয় মুস্তাবী’ ও ‘অপহরণকারী’ দুটি কাল্পনিক চরিত্র একই সমান্তরাল গতিতে প্রবাহিত, দুজনেই আত্মহননের মনোসমীক্ষায় আলোড়িত কিন্তু অপহরণকারী সুবিনয়কে অপহরণ করেছে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে। এই অপহরণ পর্ব ও এর সমাপ্তি বর্তমানে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অবদমনের অসমর্থিত হত্যাকাণ্ডের চিত্র। এই গল্পে চরিত্র দুটি সম্পূরক। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, জীবনের পরিপূর্ণতা কোনো কিছুই তাদের মন থেকে মৃত্যু-বীজানুর উল্লাসকে দলিত করতে পারেনি।
‘নিষেধব্য’ চতুর্থ গল্প সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, জীবনদর্শন, সমাজতান্ত্রিক চেতনা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দর্শনের অবক্ষয়, নাগরিকের রুদ্ধশ্বাস জীবনযাপন বাকস্বাধীনতা হরণ, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়ে লেখক নির্ভীক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। উচ্চারণ করেছেন দুঃসাহসিক উচ্চারণ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র ও প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এখানে যে প্রেক্ষাপটে আখ্যান বর্ণনা করা হয়েছে, তা চলমান রাজনৈতিক সংকট, রাষ্ট্রীয় পীড়ন বর্তমান সামাজিক অবস্থা। কোনো কালে কোনো শাসক বা সরকার তার সমালোচনা মেনে নিতে পারেনি। এখনো পারে না । যথাসম্ভব তা রোধ করার জন্য নানা রকম কৌশল প্রয়োগ করা হয়। এমনকি বিনা-বিচারে হত্যার ও নানারকম কৌশল ব্যবহার করা হয়। বিপ্লবী মোল্ডার ও বন্ধু প্রফেসরকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা চলমান সময়ের সমাজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের যে চিত্র পাওয়া যায়, তার বাস্তবতা নেই। তবে, পীড়ন আছে।
‘চাতক প্রায় অহর্নিশি’ এটি একটা ভিন্নমাত্রার গল্প। এখানে জমজ ভাইবোনের বিপন্ন মানসিক চিন্তার দ্বন্দ্ব, কখনো একে অন্যকে হত্যার পরিকল্পনার চিত্র আঁকা হয়েছে। জন্মের সময় তাদের মা মারা যায়। চাতক ২৫ বছর বয়সের যুবক, তার চিন্তা-চেতনায় সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য, মিল-অমিল, হিত-বিপরীত ইত্যাদি শব্দগুলো প্রতিনিয়ত নিজের মধ্য আলোড়ন সৃষ্টি করে প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাপ্রবাহ, নিষ্ঠুরতা, হত্যা এসব বিষয়গুলো খুব তাড়িত করে এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিস্তার করে চাতককে খুনের জন্য প্রণোদিত করে।
‘মানুষ কেন খুন করে? আইনি আর ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা, সাংস্কৃতিক হস্তক্ষেপ, প্রতিশোধের ঝুঁকি এবং খাঁচাতে জীবন কাটানোর হুমকির পরও প্রতিদিন পৃথিবীতে না জানি কত শত মানুষ খুন হয়। […] হঠাৎ আমার মনে হচ্ছে সুগন্ধাকে খুন করলে কেমন হয়।’ আমরা প্রতিদিন খবরের কাগজে দেখি সম্পদ-সম্পত্তির কারণে, প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য, পরকীয়া সম্পর্কের জেরে পিতা-মাতা সন্তানকে, প্রেমিকাকে প্রেমিক নৃশংসভাবে হত্যা করে।’ খবরের কাগজে প্রকাশিত এইসব হত্যা সংক্রান্ত সংবাদ পড়ে চাতক ভীষণভাবে আহত হয় এবং মনো-চিন্তনকে আচ্ছন্ন করে। তার মনের ভেতর জীঘাংসায় খেলা করে অন্য একজন। প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যে এক পরছায়া বাস করে। কখনো কখনো সেই পরছায়া বিভিন্ন ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বা পরিস্থিতি তৈরি করে। এই সূত্রের মজবুত ভিতের ওপরে চাতক লেখকের সফল ও মৌলিক সৃষ্টি। চাতক যখন সুগন্ধাকে খুন করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত, তখন সে ভাবছে ‘খুনটা করার আগে কোন বিশেষ কথাটা তাকে বলা যায়, তা এখন ভাবতে হবে। বিশেষ কথার যে আমার অবাব নেই। মৃত্যুর আগে বাবার অবাক দৃষ্টি, কিংবা কিশোরী বেলায় ওর পছন্দের মানুষটির শেষ চিৎকার কিংবা…। ’ এভাবেই গল্পের শেষ থেকেই আবার পাঠকের মনে নতুন উদ্দীপনা জাগায়।
‘বিবলিয়’ গল্পের যে মায়াজাল বুনেছেন লেখক নীরা ও নীলকে নিয়ে, তার রহস্য উদঘাটন খুব সহজ ব্যাপার নয়। আবার পরাবাস্তবতার কুহকে তা কখনোই অসম্ভব নয়। চমৎকারভাবে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সুপ্রতিষ্ঠ চরিত্র নীরা এবং নীন (সুনীন গঙ্গোপাধ্যায়) মায়াবাস্তবতার ওপর নির্ভর করে নিপুণভাবে নির্মাণ করেছেন তাদের মনস্তত্ত্ব ও গল্পের প্রেক্ষাপট।
‘সুড়ঙ্গ’ গল্পের যে চিত্র লেখক নির্মাণ করেছেন, তা থেকে সহজেই বুঝতে পারি আমরা তিনি জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন খুব গভীরভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সবটুকু দিয়ে। দৈনন্দিন জীবনের টানাপড়েনের মাঝে সহসাই ডুবে যেতে যেতে নিজের অস্তিত্ব কে আর অস্বীকার করতে পারে না সৌরভ।
শিল্প ও পণ্য এ দুটো পুরোপুরি ভিন্ন। শিল্পকে পণ্য করে বিক্রি করলে তার শৈল্পিক চেতনা তথা শিল্পীর মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে প্রাত্যহিক জীবনের অভাব-অনটন সচ্ছল-সুন্দর জীবন-যাপনের বাসনা ইত্যাদি একজন শিল্পীকে মোকাবিলা করে। শিল্পী ও জীবনকে নিয়ে বাঁচাতে হবে। ‘মৌলিকতা শিল্পীর অপরিহার্য অনন্যতা। কিন্তু একটা অনিচ্ছাময় করুণা সৌরভকে এমন বিপন্ন করে তুলতো যে, ও কথা থামিয়ে দিতো। শুধু সুগন্ধা কেন নিজের ভাই-বোন কিংবা প্রিয় বন্ধু বলে চেনে, সেও কখনো আগ্রহ দেখায়নি। একেবারে কাছের মানুষদেরই যদি সে কখনো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারে তাহলে অন্য কেউ কেন তার লেখা পড়বে। একজন মুখ্য আর গৌন লেখকের মধ্যে এটাই পার্থক্য।’ এখানে লেখক বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। আমরা লেখকেরা পাঠক তৈরি করতে পারছি না অথবা ধার করা চটুল জৌলুসময় লেখা দিযে জনপ্রিয়তা পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু সেটা কতটা শিল্প কতটা কালোত্তীর্ণ হবে, তা ভাবার বিষয়।
কিছু চরিত্রকে খুব কাছের চেনাজানা পরিচিত মনে হয়েছে আবার কিছু কাল্পনিক ও ধোয়াশা তৈরি করেছে। কোন কোন গল্পে একসঙ্গে তথ্য পরিবেশন করেছেন এতে মনোযোগ নষ্ট হয়েছে।
শেষ গল্প ‘নপুংসক’। এখানে একজন সহজ-সরল-ভীতু স্বভাবের অগোছালো মানুষের জীবনচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। যে ব্যক্তি কোনো কাজই সুচারুভাবে করতে পারে না, তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না, প্রতিশোধ নেয় না। তার মানে এই নয় যে, তার রাগ, ক্ষোভ ঘৃণা নেই। তার আছে মানবিক গুণসম্পন্ন হৃদয়, আছে দয়া, ক্ষমাশীলতা নির্বিরোধ মানসিকতা। এর বিপরীত ধারায় প্রবাহিত কিছু উজবুক মানুষের হাতে মেয়ের স্কুলের সামনে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়। এই গল্পে প্রধান চরিত্র যাকে লেখক রূপায়ণ করেছে নপুংসকের অভিধায়। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজের মতো করে নিজের মনের মধ্যে থাকেন অন্যকে বিরক্ত না করে নিজের মতো করে দিন যাপন করেন। এই বৈশিষ্ট্য তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। আবার এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই সবাই তাকে তিরস্কার ও অবেলা করে বিভিন্নভাবে তিনি বুলিংয়ের শিকার হন। মাঝেমাঝে তার ভেতরে বাস করা অন্য মানুষটা প্রতিরোধ-প্রতিশোধের জন্য হিংস্র হয়ে ওঠে। এই গল্পের প্রধান চরিত্র বিভিন্ন সামাজিক ঘটনা ও ব্যক্তি মননের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে সহজ, সংক্ষিপ্ত, ভাবার্থপূর্ণ সংলাপে। ‘একটু চুপচাপ আর নিজের মধ্যে থাকা মানুষকে সবাই বোকা ভাবে।’ বলতে শুনি, ‘না, তুমি আমাকে যা ভাবছ আমি তা নই। আমি আমার মতো নিজের মনের মধ্যে থাকি, তাকে ভীরুতা, কাপুরুষতা বলে না।’
এই বইয়ের গল্পের প্লট নির্বাচন এবং আখ্যান বর্ণনায় পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে সহজ-সরল-গতিময় ভাষা ও সংলাপের ওপর নিভৃত করে প্রতিটি চরিত্র দাড়িয়ে গেছে। ‘গায়ের পাতলা শার্ট ভিজে চামড়ার মধ্যে লেপ্টে আছে অদৃষ্টের মতো। না তবু আমি পেছনে তাকাবো না। যার উদ্দেশ্য যত মহৎ, তাকে তার মতো করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমি এক মহৎ উদ্দেশ্যের শপথ নিয়েছি। আমাকে যেকোনো মূল্যে এখান থেকে বাঁচতেই হবে।’ (নিষেধব্য)।
আবার ‘সুড়ঙ্গ’ গল্পে সৌরভের ব্যর্থতা, বিপন্নতার মনোসমীক্ষণের তীব্র আলোর প্রতিফলন ফেলে—তার অন্তর্লোকের বর্ণনা করেছেন এভাবে—‘কেবল অসম্ভব একটা জেদ ওর মাথার মধ্যে বলতে থাকে, না এই লেখাটা তোমার নয়। এটা প্রসিদ্ধ লেখক মুসতবা আমজাদের। বিশাল এক পুকুরে প্রলোভনের হালকা বড়শী ফেলেছেন তোমার মতো চুনোপুটিকে ধরতে। তার এই গুহা তোমার জন্য ধাঁধা। আর এই মেরুদণ্ডহীন উরগ আসলে তুমি। যাও প্রতিদিনের মতো গা লেপ্টে লেপ্টে নিজের অন্ধকার গুহায় গিয়ে ঢোকো। এখানে সৌরভের অস্তিত্বেও সংকট ও বিপন্নতাকে সহজ ভাষায় সাবলীলভাবে প্রকাশ করেছেন।
এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্পের সময় স্থান পটভূমি, চরিত্রের ব্যক্তিক বিপন্নতা, মনোসামাজিক ও মনস্তাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মাণ করেছেন। সামগ্রিক আদর্শে যে বার্তা দিয়েছেন, তা পাঠকের জীবন ও মানসিকতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।কিছু চরিত্রকে খুব কাছের চেনাজানা পরিচিত মনে হয়েছে আবার কিছু কাল্পনিক ও ধোয়াশা তৈরি করেছে। কোন কোন গল্পে একসঙ্গে তথ্য পরিবেশন করেছেন এতে মনোযোগ নষ্ট হয়েছে। সুমন মজুমদার বর্তমান সময়ের তরুণ প্রজন্ম তার লেখা গল্পগুলোতে জীবনের বহু দিক থেকে বিভিন্নভাবে আলো ফেলেছেন সচেতনভাবে ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে যৌক্তিক নান্দনিকভাবে পরিস্ফুটনের চেষ্টা করেছেন। এই চেষ্টা অব্যাহত থাক। তবে আলোর রেখামাত্রা প্রক্ষেপণে, চরিত্র নিরূপণে আর সচেতন হতে হবে।