বাংলাদেশি চলচ্চিত্র খুব বেশি দেখা হয় না। যা দেখি, তা-ও হাতেগোনা। এই না দেখার কিছু কারণও আছে। কারণগুলো আজ না হয় না-ই বললাম। তা কমবেশি সবার জানা। তবে মৌলিক ধারার সিনেমাগুলো একটু দেরি হলেও দেখি। সে তালিকাও একেবারে ছোট নয়। রুচিশীল গল্প, ব্যতিক্রমধর্মী নির্মাণ, সুনিপুণ অভিনয় হলে অবশ্যই দেখি।
এবার ব্যতিক্রমধর্মী সে যাত্রায় যুক্ত হয়েছে একটি চলচ্চিত্র—‘গেইম রিটার্নস’। নির্মাতা রয়েল খানের অ্যাকশন থ্রিলারধর্মী সিনেমা এটি। এ ধরনের সিনেমা খুব একটা দেখি না আমি। এটি দেখার মূল কারণ চিত্রনায়ক নিরব হোসেন। উদীয়মান এই তারকাকে অনুপ্রেরণা জোগাতেই একঝাঁক সংবাদকর্মীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম আমিও।
বলতে পারেন এই সিনেমার নায়কের জন্যই সিনেমাটি দেখা। এমনকি বহুদিন পরে ঢাকার প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া। কারণ দেরি হলেও আমি সিনেমা বাসায় বসে ইউটিউবে দেখতে পছন্দ করি। আড়াই-তিন ঘণ্টা প্রেক্ষাগৃহে বসে থাকার সময় হয়ে ওঠে না। এবার প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে যেটা মনে হয়েছে:
১. মনমতো ছবি পেলে দর্শক হলে যায়
২. কাহিনি ভালো হলে পুরোটা দেখে
৩. অভিনয় ভালো হলে হাততালি দেয়
৪. রোমান্স দেখলে সিটি বাজায়
৫. নাচ-গান ভালো হলে উজ্জীবিত হয়
এর সবই পেলাম সিনেমা হলে গিয়ে। শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার শো দেখেছিলাম রাজধানীর ‘অভিসার’ সিনেমা হলে। সিনেমাটি একইসঙ্গে চল্লিশটি প্রেক্ষাগৃহে চলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্রমতে, গত শুক্রবার মুক্তি পাওয়া সিনেমাটির দর্শকপ্রিয়তায় হলো মালিকরা সন্তুষ্ট। এমন সুদিনের অপেক্ষাতেই ছিলেন তারা।
এই সফলতার পালকে যে নামটি যুক্ত হয়েছে, তার নাম নিরব হোসেন। তার পূর্ববর্তী সিনেমাগুলো আমার দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে ‘গেইম রিটার্নস’ দেখে মনে হলো:
১. এই গেম শুধু চলচ্চিত্রের কাহিনীর নয়
২. এই গেম চিত্রনায়ক নিরবেরও
৩. তার খেলার শুরুটা হোক এখানেই
কারণ ভালো অভিনয়শিল্পী না থাকার যে ধোঁয়া পরিচালকরা তুলেছিলেন; সেই ধোঁয়ায় জল ঢেলে দিতে পারলেই তার গেম রিটার্ন হবে। এমন প্রত্যাশা আমাদের।
নিরব হোসেনের সাবলীল অভিনয় মুগ্ধ করেছে দর্শকদের। নায়িকাদের সঙ্গে কেমিস্ট্রিটাও ভালোভাবে নিয়েছেন সবাই। সিনেমার শেষে গিয়ে আকাঙ্ক্ষা যেন তীব্র হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছিল, সিনেমা তো শেষ হয়নি। দুই ঘণ্টা ১৮ মিনিটও খুব কম সময় মনে হয়েছে। অ্যাকশন দৃশ্যে নিরবের শারীরিক গঠন ও পোশাক ইতিবাচকভাবেই সাড়া দিয়েছে। পাশাপাশি সংলাপ বা আঙ্গিকে কোনো বিচ্যুতি লক্ষ করা যায়নি। অন্যদিকে চিত্রনায়িকা তমা মির্জার যতটা উদ্ভাসিত হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়তো হতে পারেননি। তবে লাবণ্য তার অভিনয়গুণে মুগ্ধ করেছেন দর্শককে। কিন্তু তার সংলাপের দুর্বলতা অভিনয় সাফল্যকে কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে।
বলতে গেলে নিরবকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে সিনেমার গল্প। নিরব পেশাদার খুনি। ছবিতে তার নাম ‘মায়া’। একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে একের পর এক খুন করেন। ব্ল্যাঙ্ক চেকগুলো জমা করে রাখেন। অর্থের তেমন প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে। তবে তার খুনি হওয়ার কারণ আমরা কখনোই জানতে পারি না। মায়াকে সহযোগিতা করা লাবণ্য অর্থাৎ শায়না নামের মেয়েটি নিরবের অজান্তেই তাকে ভালোবাসে। একইসঙ্গে বসবাসও করে। সেটাকে অনেকটা লিভ টুগেদারও বলা যায়। তবে এতে কোন যৌনতা নেই।
একটি তুচ্ছ ঘটনায় আবারও চ্যালেঞ্জ নেমে আসে মায়ার জীবনে। সেখানে হাজির হয় ভিলেনেরই (মায়ার আগের বস) ছোট ভাই। যাকে আমরা কাহিনীর এ পর্যন্ত কোথাও দেখতে পাইনি। সুন্দর একটি স্বাভাবিক জীবন আবার বদলে যায়। কিন্তু প্রেমিকা খুন হওয়ার পর মায়াকে আবার অস্ত্র তুলে নিতে হয়।
‘মায়া ইজ ব্যাক’ সংলাপটিই সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মায়া নামধারী নিরবও যেন সরব হয়ে ব্যাক করলেন বাংলা চলচ্চিত্রে। ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘রাজনীতি’, ‘অহংকার’সহ কয়েকটি সিনেমার ভরাডুবির পর হলমুখী দর্শক দেখে মনে হলো, ‘মায়া (নিরব) ইজ ব্যাক’ কথাটি সার্থক।
সিনেমার প্রধান খলনায়ক চরিত্রে মিশা সওদাগর বরাবরই ব্যতিক্রম। আরবি-ইংরেজির সহাবস্থানে মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দিতে তার বাহাদুরি চোখে পড়ার মতো। তবে প্রাতিষ্ঠানিক কিলিং আমরা এই প্রথম দেখলাম। তাই গল্পের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কাহিনীতে ক্লাইমেক্স আনার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। ভালোবাসার মানুষকে খুন করার দায়িত্ব দিয়েছেন প্রেমিকার হাতে। বরং খুন করতে গিয়ে অন্যের হাত থেকে নিজের শিকারকে বাঁচিয়ে দিয়ে ভালোবাসার দুর্বলতাই প্রকাশ করেছেন তিনি। সিনেমার মাঝপথে একজনকে সরিয়ে দিয়ে অন্যজনকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন অবলীলায়। অবশেষে হিংসার কাছে ভালোবাসারই জয় হয়েছে।
সফলতার পাশাপাশি সিনেমার ভেতরে অসঙ্গতিও উঠে আসতে পারে। যে বিতর্ক শুরুতেই দেখা গিয়েছিল নায়িকার একটি পোশাকে বলিউড নায়িকা ঐশ্বরিয়ার পোশাকের সঙ্গে মিল দেখে। এসব দেখে কোথাও কোথাও এর দুর্বলতা নির্ণয় করা সহজ হতে পারে:
১. অন্য কোনো কাহিনীর ছায়া
২. প্রযুক্তির ভুল ব্যবহার
৩. পোশাক নির্বাচনে সচেতনতার অভাব
৪. শট ডিভিশনের অনভিজ্ঞতা
৫. আলো স্বল্পতা
৬. প্রি-প্রোডাকশনে মনোযোগিতার অভাব
৭. যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব
এসব ক্ষেত্রে নির্মাতাকে আরও বেশি পর্যবেক্ষণ এবং নিরীক্ষা করতে হবে। কাহিনীর সঙ্গে চিত্রায়ণকে বাস্তবসম্মত করে তুলতে হবে।
এরপরও আশার কথা হচ্ছে, বাংলা চলচ্চিত্রে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। ‘আয়নাবাজি’, ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ও ‘ডুব’র ভিড়ে ‘গেইম রিটার্নস’ জায়গা করে নিয়েছে দেখে এটুকু আশ্বস্ত হওয়াই যায়। তবে ছবিটি আরও কিছুদিন পর মুক্তি পেলে একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ পেতে পারতো। যেহেতু এখনো রাজধানীসহ দেশজুড়ে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ও ‘ডুব’র আলোচনাই চলছে। তবু এরমধ্য থেকে গত দু’দিনে নিরবের এই সিনেমাটি নতুন আশা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
মনে হচ্ছে, পরীক্ষিত পরিচালক, অভিজ্ঞ চিত্রগ্রাহক, সফল চিত্রনাট্যকার ও আত্মপ্রত্যয়ী সহশিল্পীর হাতে পড়লে নিরবের মধ্যেও জ্বলে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ তার সাবলীল অভিনয়, উচ্চারণ, অঙ্গভঙ্গি সঠিকভাবেই কাজ করছে। ফলে সফলতার চূড়ায় যেতে নিরবকে খুব বেশি বেগ পেতে হবে বলে মনে হয় না।
নিরবের এই যাত্রা দীর্ঘ হোক। হলমুখী হোক ঢাকাই ছবির দর্শকরা। চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরে আসুক। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা লোকসানের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে লাভের মুখ দেখুক। একটি শিল্পমাধ্যম মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থা থেকে মাথা তুলে দাঁড়াক। যাত্রা শুরু হোক এখান থেকেই। অ্যাকশন থ্রিলারে আরও বৈচিত্র্য আসুক। থ্রিলার হোক থ্রিলারের মতোই টানটান উত্তেজনা আর রুদ্ধশ্বাসনির্ভর।