আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম সেরা প্রকরণ ছোটগল্প। বাংলাদেশের ছোটগল্প শুরুতেই একটি ভিন্ন পথে হাঁটতে শুরু করেছে। বিষয়বস্তু এবং ভাষাগত দিক থেকে শুরুতেই কলকাতার ছোটগল্প থেকে পৃথক ছিল। অনেকে অবশ্য কলকাতার ছোটগল্প অনুসরণ এবং অনুকরণ করেছেন। সাতচল্লিশের দেশভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধপরবর্তী আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সামরিক শাসন, স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থান,গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মতো বড় বড় ঘটনা এদশের ছোটগল্পে নিজস্বতার ছাপ রেখেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমকালীন এবং স্থানীয় নানা ঘটনার অভিঘাত। সাহিত্যের এই ধারাটিতে বাংলাদেশের লেখকেরা বিশ্বসাহিত্যে একটি শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে হয়তো। কিন্তু পর্যাপ্ত অনুবাদ এবং বিশ্বদরবারে উপস্থাপনার অভাবে তুলনা করা কঠিন।
নতুন শতাব্দীতের বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ছোটগল্প নতুন নতুন সংকট নিয়ে আসছে। সমকালীন কয়েকজন লেখকের কয়েকটি ছোটগল্প নিয়ে এখানে কথা বলা যেতে পারে।
গল্পগুলো হলো:
খেলাঘর ॥ সাবরিনা আনাম
মুখোশ মানুষ ॥ আশরাফ জুয়েল
প্রান্তজন ॥ পিন্টু রহমান
দুর্ভিক্ষ ॥ আনিফ রুবেদ
নামপুরুষ ॥ সুমন মজুমদার
ভুল করে ফেলে আসা ॥ সোলায়মান সুমন
প্রথমে ধরা যাক আনিফ রুবেদের গল্প ‘দুর্ভিক্ষ’। তেত্রিশ বছরের বেকার যুবকের আর্থিক সংকটের ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে দেশ-বিদেশের নানা সমস্যা। জোনাকি নামের এক বেশ্যার সঙ্গে গল্প করে রাত কাটিয়ে দেওয়ার পরে তার মনে প্রবল অনুশোচনা জাগে সময় এবং উপার্জন নষ্ট করার জন্য। কিন্তু বেকার যুবকের শরীর কি মনের কথা বোঝে? যৌনতার চাহিদা পূরণ করবে কে? লেখকের ভাষায়, ‘মানুষ মানুষকে টাকা ভিক্ষা দেয়, কাপড় ভিক্ষা দেয়, পরামর্শ বা উপদেশ ভিক্ষা দেয়। আমার দরকার হলো যৌনতা ভিক্ষা। আমি কোনো বেশ্যার কাছে যৌনতা ভিক্ষার জন্য আজ রাতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু আপনার সাথে কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছিলাম। তাছাড়া আপনি বলার আগে বুঝতে পারিনি আপনি বেশ্যা। আর এখন তো ভোর হয়ে এলো আর আপনার ফিরে যাবার সময় হয়ে গেল। আপনার কাছে যৌনতা ভিক্ষা তো এখন আর চাওয়া যাবে না। কী বললেন!’
আনাড়ি যুবকের বেশ্যাগমনেও কেমন ভুল হয়ে যায়। আমাদের কিন্তু লেখক এই যুবকের বয়সটা উল্লেখ করেছেন। তেত্রিশ বছর। সুনীলের তেত্রিশ বছর ধরে কথা না রাখার জীবন। এই বয়সেও যৌনতার সামাজিক রূপ লাভ করতে পারেনি এই যুবকের। বিধাতার সাথে সাপলুডো খেলার কথাও আছে। এ যুবক জীবনে কোনো মই খুঁজে পায়নি তরতর করে ভাগ্যের উঁচুতলায় উঠে যাবে। সমকালীন সমস্যা নিয়েই লেখক নিজস্ব ভাষায় তুলে ধরেছেন অনেক সংকট। সব শেষে বলেছেন, ‘যৌনতার ভিক্ষা হয় না।’
শিক্ষিত তরুণের বেকারত্বের সংকট নতুন কিছু পুরনো সামাজিক সমস্যা। কিন্তু তরুণ লেখক আনিফ রুবেদ সমকালীন প্রেক্ষাপটে বিষয়টি নতুনভাবেই তুলে ধরেছেন। আর সে গল্পের ভাষাও নতুন।
সুমন মজুমদারের গল্প ‘নামপুরুষ’। এ গল্পের বুননে একজন লেখকের গল্পরচনার প্রয়াসের ভেতর দিয়ে এই গল্পটি সৃষ্টি হয়। উপস্থাপনার ভঙ্গিটি তরুণদের নিরীক্ষামূলক পদ্ধতি। গল্পের ভেতরের লেখক কল্পনা করেন তিনি একটি ধূসর মাঠের গল্প বুনছেন। তিনি মঞ্জুলি নামের একজন নারীর সঙ্গে কথা বলছেন। তার সঙ্গে আলাপ করে গল্পের প্লট ঠিক করছেন। আলেয়া নামের গ্রামের এক তরুণী স্বামী দিদার এবং সন্তান আমিনাকে রেখে মনিহারি দোকানের মহাজনের সংসারসমুদ্রে ঝাঁপ দেয়। স্বামী বরফকলে কাজ করত। তার চাকরি চলে যাওয়ার পরে যে আর্থিক টানাপড়েন শুরু হয় সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে আলেয়া ভালো থাকার ইচ্ছায় এই ঝুঁকি নেয়। লেখক এখানে গল্প বুনরে স্বার্থে বরফকলের চাকরি হারানোর কারণটা অজানা রেখে দিয়েছেন। দিদার এখন ভ্যানগাড়ি চালায়।
মহাজন তাকে দূরের গ্রামে নিয়ে নতুন বসতি গড়ে। কিন্তু মহাজনের সাথে তার অসম সম্পর্ক বেশিদিনের হবে না এটা যেন লেখক আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু বয়স্ক মহাজনের শরীরে নেমে আসে কালব্যাধি। বুকে ব্যথা আর প্রবল শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে সদরের হাসপাতালে নিতে হবে। এলাকায় ভ্যান গাড়ি পাওয়া যায় না। অগত্যা দিদারের ভ্যানে ওঠাতে হয়।
নাটকীয়ভাবেই দিদারের ভ্যানে চড়িয়ে মহাজনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। দিদারের মনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত গাড়ির গতি শ্লথ করে দেয়। কড়া রোদের জ্বালায় বিশ্রামও নিতে হয়। একটু জিরিয়ে দিদার তার বিবাহিতা স্ত্রী আলেয়ার হাত ধরে আবার তাকে নিয়ে ঘর করার স্বপ্ন দেখে। কারণ মহাজনের মতো বয়স্ক লোকের সঙ্গে বেশিদিন টিকতে পারবে না এটা দিদার জানে। হয়তো মহাজন মারা যাবে। তখন আলেয়া কোথায় যাবে? তাই দিদার তাকে পাওয়ার আশা করে। কিন্তু আলেয়ার দিক থেকে সাড়া পায় না দিদার। বরং আলেয়া তাকে সন্দেহ করে দিদার ইচ্ছা করে দেরি করছে কিনা। মহাজনের মৃত্যু কামনা করেই দিদার হয়তো বিলম্ব করছে। আলেয়ার মনের ভাষা বুঝতে পারে দিদার। তখন সে কাছা দিয়ে নতুন উদ্যমে জোরে প্যাডেল চালায়। আলেয়া আর তার বৃদ্ধ স্বামীকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য দিদার সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এই দিদার আর আলেয়ার স্বামী দিদার না। একজন ভ্যানচালক দিদার। তার কাজ রোগীকে বাঁচানোর দ্রুত ভ্যান চালিয়ে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া।
শেষ পর্যন্ত স্বামী দিদার ভ্যানচালক দিদারের কাছে হেরে যায়। সমাজের নিম্নশ্রেণীর ভ্যানচালক তার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের কাছে বড় থাকে। তার সর্বশেষ প্রচেষ্টা মানবিক বোধ থেকে উঠে আসা। গল্পটিতে নাটকীয়তা আছে,বুননে নতুনত্ব আছে, নিরীক্ষাপ্রবণতা আছে। আর ভাষাগত নতুনত্বও রয়েছে।
সোলায়মান সুমনের গল্প ‘ভুল করে ফেলে আসা’। এ গল্পে আছে প্রজন্মব্যবধান এবং শ্রেণীব্যবধান। মা ছিলেন দরিদ্র এবং অশিক্ষিতা গ্রামীণ সহজ সরল এক নারী। আর ছেলে লেখাড়া করে বড় হওয়া, ডাক্তার হওয়া পুত্রের নগর এবং গ্রামীণ জীবনের টানাটানি। ছেলে চায় মাকে শহরে নিয়ে আসবে। কারণ বাসা থাকে খালি। ছেলে ডক্টর আজহারের স্ত্রীও ডাক্তার। দুজনেই পেশাগত কারণে ব্যস্ত থাকে। তাদের সন্তানরা বিদেশে অবস্থান করে। শহরের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য ছেলে চায় মাকে নিয়ে যাবে নিজের বাসায়। কিন্তু মা গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবেন না। গ্রামে তিনি একা থাকেন। ছেলে আজহারের শূন্যস্থান পূরণ করেন গবাদি পশুপাখি পোষার মাধ্যমে। তিনি প্রিয় সন্তানের শূন্যতা পূরণ করেন মোরগের নাম ‘আজাহার’ রেখে।
ডাক্তার আজহার বিশ্বপ্রবীণ দিবস উপলক্ষে রাজশাহী শহরের একটি সেমিনারে বক্তৃতা দিতে এসেছিল। অংশগ্রহণ করার পরে গ্রামে যায় মায়ের সাথে দেখা করতে। শহরে ফিরে যাওয়ার সময় কী যেন ভুলে রেখে গেছে ভেবে বড় রাস্তার কাছে গিয়ে মাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে কিছু রেখে গেছে কি না। মা মনে করতে পারেন না। ডাক্তার আজহার তার মনটিই ফেলে রেখে গেছে। এ গল্পেও শেষে নাটকীয়তা সৃষ্টির প্রচেষ্টা দেখা যায়। সমকালীন মধ্যবিত্তের এবং নগরায়ণের প্রভাবে মানুষ কেমন করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারই নমুনা তুলে ধরেছেন লেখক। আজহার তার মাকে শহরে নিয়ে রাখলে হয়তো নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই হয়তো মা সুলভে পেতেন। পশুবিচিকিৎসকরে কাছ থেকে ওষুধ খেয়ে ড্রবীণ বয়সে অসুখে ভুগতে হতো না। কিন্তু এই মা যে রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’র ফটিকের মতো জীবনের শেষ ছুটি নিতেন না তার কী নিশ্চয়তা! শেকড় থেকে বিচ্ছিন্নতার বেদনায় মা হয়তো বেঁচেই থাকতেন না। লেখক কিন্তু শেষ পর্যন্ত আজহারকেই গ্রামের সুতায় বেঁধে রাখতে চেষ্টা করেছেন।
পিন্টু রহমানের গল্প ‘প্রান্তজন’। এখানে আছে সমসাময়িক জঙ্গিবাদী সমস্যার ভিন্ন দিক। উত্তরবঙ্গের নীলফামারীর কিছু লোক দক্ষিণ দিকে সরে আসে অভাবের তাড়নায়, মঙ্গার তাড়নায়। যদিও এখন মঙ্গা শব্দটি মিডিয়ায় ব্যবহৃত হয় না। দক্ষিণের যেখানে তারা আসে সেখানকার মানুষ জঙ্গি বলে সন্দেহ করে। লোকজন পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কমরেড মাবুদ আলী শ্রমিকশ্রেণির মানুষের পক্ষে কাজ করেন। তিনি এসে ক্ষুধাতাড়িত মানুষগুলোকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করেন। তাদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লোকই আছে। এলাকাবাসী, মেম্বার ও গণ্যমান্য লোকদের জেরার মুখে অনিমেষ গীতা থেকে পাঠ করে শুনিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করেছিল যে, সে হিন্দু, সে জঙ্গি নয়। গনেশ হালদার অনিমেষকে তার মেয়েকে পড়ানোর কাজে নিযুক্ত করেন। অনিমা অনিমেষের কাছে গীতা শেখে।
এভাবেই তাদের দিন কাটছিল। খেটে খাওয়া মানুষেরা এখানে ভাতের ঘ্রাণ পেয়ে মাটিবর্তী জীভন যাপন শুরু করে। কিন্তু কিছুদিন পরে পুলিশের হানা দেখা দেয় জঙ্গি দমন অভিযানে। সেদিন গ্রামের লোকেরা পুলিশের হাতে পায়ে ধরেও রাখতে পারে না। পুলিশ তাদের জঙ্গি বলে ধরে নিয়ে যায়। অনেকেই দরিদ্র লোকগুলোর জন্য কান্না করে কিন্তু অনিমা কাঁদতে পারে না।
এ গল্পের মূল প্রসঙ্গের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ এবং আখচাষীদের আন্দোলনে পুলি নির্যাতনের কথাও উঠে এসেছে। পিন্টু রহমানের গল্পে দুটি স্তর থাকে। একটি সমকালীন সংকট আরেকটি থাকে সংকটের উৎস আবিষ্কারের প্রবণতা। যেখানে দেখানো হয় সংকটের পেছনেও আছে নানা সংকট।
উপর্যুক্ত চারটি গল্পের মধ্যে আনিফ রুবেদ, সুমন মজুমদার এবং পিন্টু রহমানের গল্পে সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষেরা স্থান পেয়েছে। তাদের নানা সংকট তুলে ধরা হয়েছে। সোলায়মান সুমনের গল্পে দুটি শ্রেণীর মধ্যেকার টানাপড়েন দেখানো হয়েছে।
এছাড়া রয়েছে সাবরিনা আনামের ‘খেলাঘর’ এবং আশরাফ জুয়েলের গল্প ‘মুখোশ মানুষ’ সমাজের উঁচুতলার গল্প। যারা ইচ্ছা করলেই বিমানে চড়ে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড বা যুক্তরাষ্ট্রে উড়াল দিতে পারে। তবে তাদের আর্থিক সচ্ছলতা থাকলেও তারা সংকটমুক্ত না, এ কথাটাই লেখকেরা পাঠককে জানাতে চেয়েছেন। সাবরিনা আনামের গল্পটি যাকে বলা হয় নিটোল প্রেমের গল্প। নায়িকা শুদ্ধতা তার স্বামীর মধ্যে দেখতে পায় কঠোরতা। এই কঠোরতা সচেতন পাঠককে মনে করিয়ে দিতে পারে তলস্তয়ের আনা কারেনিনা এবং তার স্বামী আলেক্সেই আলেকসান্দ্রভিচের কথা। আলেকসান্দ্রভিচ ছিলেন পাথরের মতো শক্ত মানুষ। তার কাজ ও আচরণ ছিল আন্তরিকতাশূন্য কিন্তু দায়িত্বশীল। দায়িত্ববোধ ছাড়া যেন তিনি কাজ করতে পারতেন না। শুদ্ধতার স্বামী সৈকত কিন্তু আদতে এমন ছিল না। সে পরিচয়ের পর থেকেই শুদ্ধতাকে নিয়ে কবিতা লিখত। কবিতা তো হৃদয়হীন মানুষেরা লিখতে পারে না। হাজার বার শুদ্ধতাকে বলেছিল ভালোবাসি, কিন্তু শুদ্ধতা বিশ্বাস করে নাই। লেখকের ভাষায়, ‘শেষ পর্যন্ত সৈকতের ভালোবাসার ওজন পরীক্ষা করতে ওর সবক’টা কাব্যগ্রন্থ সে অল্পসময়ে পড়ে ফেললো এবং সৈকতের কাব্যগ্রন্থগুলো পড়ে তার যা উপলব্ধি হলো, তা হচ্ছে সে সৈকতের সাহিত্যের ল্যাবরেটরির একটা উপাদান মাত্র। কেননা সৈকতের অন্যান্য কাব্যগ্র্ন্থের শরীর জুড়েও অসংখ্য নারীর উপস্থিতি খুবই লক্ষণীয়। সুতরাং শুদ্ধতাকে ঘিরে সৈকতের সাহিত্যের পাত্র খানিকটা পূর্ণ হলেই সে যে আবার অন্য উপাদান খুঁজে নেবে, ভিন্ন মাত্রায় সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে মনোযোগী হবে এটাই স্বাভাবিক।’
শুদ্ধতা বোঝে একজন কবির কাছে সে কবিতার উপাদানমাত্র। তাই সে সৈকতের আচরণে দেখতে পায় অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরেও কোনোভাবে যোগাযোগের চেষ্টা সৈকতত করেনি। সৈকতের ওপর রাগ তার। কিন্তু সবশেষে সৈকত যখন ফোন করে প্রিয়জনের কণ্ঠে গান শুনতে চায়। তখন শুদ্ধতা রাগ ধরে রাখতে পারে না। রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে ওঠে, ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি।’
গল্পটিতে শুদ্ধতার রাগ-অভিমান বা আত্মমুক্তির চেয়ে প্রেমই মুখ্য হয়ে থাকে। হয়তো লেখক এটাই বোঝাতে চেয়েছেন অন্য সব তত্ত্ব দিয়ে জীবনের সব সংকট মোকাবিলা করা যায় না। ভালো বাসা পেতে হলে ভালোবাসাই লাগে। তত্ত্ব দিয়ে ভালোবাসা পাওয়া যায় না।
আশরাফ জুয়েলের ‘মুখোশ মানুষ’ও প্রেমের গল্প। গল্পলেখক হাসিব জামিল তার পরিচিতদের নিয়ে গল্প রচনা করেন। এ সময়ের সহপাঠী শৈলীকে একবার নগ্ন দেখার আগ্রহও জানিয়েছিল। সেই গল্পলেখকের গল্পের নায়িকা হতে চায় না শৈলী। তার স্বামী আর্কিটেটক্ট সাইমুম। স্বামী হিসাবে দায়িত্বশীল এবং সচ্ছল। ম্যানহাটানে থাকে। দুজন মানুষ নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজনে মুখোশ খোঁজে। এখানে মুখ না মুখোশটাই আসল বিষয়। মানুষের পুরনো সম্পর্ক এবং সামাজিকতার মাঝখানে মুখোশই প্রধান ভূমিকা পালন করে। ‘শৈলী মুমের দিকে তাকায়, তাকিয়েই থাকে। তেরো বছর আগের হাসিব, যে হাসিব শৈলীকে তার গল্পের সামান্য একটা চরিত্র করতে রাজি হয়নি। এই মুহূর্তে দুই জন মানুষই প্রাণপণে নিজেদের চেহারার মুখোশটাকে আঁকড়ে রাখার চেষ্টা করছে, যেন কিছুতেই সেটা খসে না পড়ে, যেন মুখোশের ভেতর থেকে কিছুতেই বেরিয়ে না আসে তাদের প্রকৃত চেহারা, যেন তারা আজীবন পরস্পরের কাছে হয়ে থাকে|’
এখানে লেখক দেখিয়েছেন সমাজের উচ্চবিত্তের মানুষের যে কত রকমের মুখোশ থাকে তার প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যবহার। শৈলী মুখোশ খোঁজে হাসিবের কাছ থেকে নিজেকে ভিন্ন ভাবে সরিয়ে রাখা এবং বাহ্যিক সমাজের কাছে ভদ্রতা ধরে রাখার জন্য। আবার হাসিবও মুখোশ খোঁজে শৈলীর কাছে নিজের পুরনো পরিচয় থেকে ভিন্ন পরিচয় তুলে ধরার জন্য। লেখক গল্পটি নান্দনিকতার ঔৎকর্ষে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন।
সমকালীন ছয় জন গল্পকারের গল্পে আগামী দিনের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। অনুশীলন অব্যাহত থাকলে সাফল্যের দুয়ারে তাঁরা পৌঁছতে পারবেন। আগামীতে তাঁরা পাঠককে নতুন কিছু দেবেন, সে আশা করা যায়।