সভ্যজগতে গণিত কোন কাজে না লাগে! মানুষের জন্মের আগে থেকেই গণিত আমাদের কাজে লাগতে শুরু করে। মায়ের গর্ভধারণের পর থেকেই দিন-তারিখ গণনা শুরু হয়। এর পরে দিনমাস যোগ আর বিয়োগ হয়। মৃত্যুর পরেও মানুষ একটি তারিখ রেখে যায়। সেই তারিখটি পারিবারিক কাজে লাগে। যোগ্যতা অনুসারে তা ঐতিহাসিক গুরুত্বও লাভ করে। কাজেই গণিত আমাদের নানা কাজে লাগে। কিন্তু জীবনের সব কাজের বর্ণনা কি এক বইয়ে দেওয়া সম্ভব? সম্ভব না বলেই গণিতের শিক্ষক এবং সাধক সফিক ইসলাম তাঁর গণিত আমাদের কী কাজে লাগে, বইয়ে বিজ্ঞানের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরেছেন। বইটি বিশেষভাবে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং এ বিষয়ে কৌতূহলী যে কোনো পাঠকের উপযোগী করে লেখা হয়েছে।
তুলতুলে আবেগের চেয়ে খসখসে বাস্তবতার লোক সফিক ইসলাম। কিন্তু গণিতের রাজ্যের এই অধিবাসীর সাহিত্যের সাম্রাজ্যে অবাধ বিচরণ থাকায় সচ্ছন্দে তিনি একটি কোমল ভাষা রপ্ত করেছেন আগেই; তাই বইটি সুখপাঠ্য হয়েছে।
আমাদের দেশে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক হয়ে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতেও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার একটি অন্যতম প্রধান কারণ গণিতভীতি। এই ভীতি দূর করার জন্য বাজারে গণিতের অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। গণিতের মজা, ধাঁধা, রহস্য, আনন্দসহ অনেক দিক নিয়ে লেখা হয়েছে সেসব গ্রন্থ। এর মধ্যে নতুন এই বইটির গুরুত্ব কী? এ প্রশ্নের উত্তর না জানলে গণিতের নিয়মিত একজন পাঠক বইটি হাতে নিতে চাইবেন না। পড়তেও ইচ্ছা করবে না। গণিতের প্রতিযোগিতাও চালু আছে। তবু গণিতের ভয়ে এবং এই বিষয়ে ফেল করার কারণে অনেক ভালো শিক্ষার্থীও লেখাপড়া ছেড়ে দিচ্ছে। জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না।
গণিতের ইতিহাসের সঙ্গে একটি গণিতরাজ্যের ভৌগোলিক সীমারেখাও বইটিতে উঠে এসেছে। লেখকের মতে, ‘বইটি গণিতের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সাজানো হয়েছে। গণিতের উন্নতির সঙ্গে-সঙ্গে মানব সভ্যতার উন্নতির স্বরূপ এবং প্রকৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সর্বোপরি গণিত কীভাবে মানুষের মনোজগতেকে বিকশিত করতে পেরেছে সেই সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা দেওয়া হয়েছে।’
তবে এটি কোনো বিশেষজ্ঞ পাঠকের জন্য নয়। নয় গণিতে অভিজ্ঞ কোনো পাঠকের জন্যও। গণিতের কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো টেক্সটবুকও নয় এটি। এমনকি উচ্চতর গণিতের ছিঁটেফোঁটাও নেই। গণিতের এই বইটি যেন ‘কেবল প্রাথমিক গণিত সম্পর্কে যাদের ধারণা রয়েছে তারাই বইটি পড়তে পারে’—এই উদ্দেশ্যে গাণিতিক সূত্র এবং জটিল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এড়িয়ে পূর্বে অর্জিত সাহিত্যের সাবলীল ভাষায় লিখেছেন লেখক। ছোট-ছোট আঠারোটি অধ্যায় নিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। অধ্যায়গুলোর নামকরণই বলে দেয় ভেতরে কী আছে। যেমন প্রথম অধ্যায়ের নাম, ‘গণিতের স্বরূপ’। এ অধ্যায়ে গণিতের সহজ ইতিহাস এবং গণিতের স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। এখানে লেখকরে একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি—‘প্রত্যেক মানুষই কোনও-না কোনওভাবে গণিতবিদ। গণিতের ন্যূনতম জ্ঞান ছাড়া কোনো মানুষই বেঁচে থাকতে পারে না।’ শুধু মানুষই নয় গণিতের ব্যবহার যে অন্য প্রাণীও জানে তা লেখক উল্লেখ করেছেন। ‘গণিতের ন্যূনতম এই জ্ঞান সকল প্রাণী জন্মগতভাবে অর্জন করেছে।’
গণিতের মতো জটিল বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে সফিক ইসলাম অনেকগুলো গল্পের উপস্থাপনা করেছেন। বইয়ের অনেক অধ্যায়েই গল্প আছে। গল্পের কারণে বইটি হৃদয়গ্রাহী হয়েছে। তবে এটি কোনো ‘গল্পে গল্পে গণিত’ ধরনের বই নয়। মানুষ গণিতের প্রথম ব্যবহার করেছিল পরিমাপের কাজে। এ বিষয়ে লেখক চমৎকার ভাষায় লিখেছেন বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়। অধ্যায়টির নাম ‘প্রাথমিক গণিত: পরিমাপের বিজ্ঞান’। এখানে বানর, শিম্পাঞ্জি, মৌমাছি, ডলফিন, মুরগি ও পিঁপড়ার গণিতধারণা নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিছু সহজ পরীক্ষার কথাও তিনি বলেছেন, যেগুলো খুব সহজেই পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব। অন্যসব প্রাণীও যে গণিতের ধারণা রাখে এই বিষয়ে সহজেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। ‘আকার ও নিরাকারের যোগসূত্র’ অধ্যায়ে পরিমাপের প্রয়োজনীয়তা, সমস্যা এবং বিমূর্ত বিষয়সমূহকে পরিমাপযোগ্য করে তোলার প্রয়োজনীয়তা এবং পদ্ধতির কথা বলেছেন লেখক। এখানে গণিতবিদদের দার্শনিক চিন্তারও পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
এভাবে পাটীগণিত, সংখ্যাতত্ত্ব, ম্যাট্রিক্স, সূচক ও লগারিদম, বীজগণিত, জ্যামিতি, কার্তেসীয় জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, ফাংশন, অন্তরীকরণ, সমাকলন, বাইনারি গণিত, যুক্তিতত্ত্ব এবং বিনোদন হিসাবে গণিতের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যুদ্ধে সেনাবিন্যাস, গোপন বার্তা প্রেরণ, ভূমিকম্পনের তীব্রতা পরিমাপ, এটিএম কার্ড ব্যবহার, খেলাধূলার ফিকচার তৈরি ও ব্যবহার, ভিডিও এনিমেশন ও গেম তৈরি এবং স্থাপত্যবিদ্যায় ত্রিমাত্রিকতার ব্যবহার, জনসংখ্যা হ্রাসবৃদ্ধির পরিমাপ, সুরতরঙ্গ পরিমাপ, কম্পিউটার প্রোগ্রামসহ ডিজিটাল প্রযুক্তির নানা কাজে গণিতের ব্যবহারের কথা লেখক সংক্ষেপে সহজ ভাষায় আলোচনা করেছেন।
বিজ্ঞান ছাড়াও অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণাসহ নানা কাজে গণিতের ব্যবহার রয়েছে। ভাষাচিন্তা, সাহিত্য গবেষণা, দার্শনিক সিদ্ধান্ত অনুমান এবং প্রমাণ এমনকি ধর্মগ্রন্থগুলো ভালোভাবে বুঝতে হলেও গণিতের ব্যবহার লাগে। শুরুতেই বলা হয়েছে ছোট একটি বইয়ে সব ধরনের ব্যবহারের কথা লেখা সম্ভব নয়, তাই লেখক বিজ্ঞানের কয়েকটি শাখায় গণিতের ব্যবহারের দিকটাই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। লেখকের ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় গণিতের ব্যবহার নিয়ে লিখবেন। ইতিহাস, ভূগোলসহ মানবিক বিদ্যার শাখাপ্রশাখাগুলোতে গণিতের ব্যবহারের দিকগুলো আলোচনা না করা পর্যন্ত বইটিকে সর্বজনীন বলা যাবে না; হয়তো বিজ্ঞানের শিক্ষক-শিক্ষার্র্থীদের কাছেই আদরণীয় হয়ে থাকবে। আশা করা যায় সিরিজগ্রন্থে ভবিষ্যতে লেকক সেসব দিক দিয়ে আলোচনা করবেন।
বইটি প্রকাশ করেছে প্রকৃতি-পরিচয়। প্রচ্ছদপোশাকে দৃষ্টিনন্দন করেছেন সব্যসাচী হাজরা। ভেতরে প্রয়োজনীয় চিত্রসংযোজন করা হয়েছে। লেখচিত্র এবং রেখাচিত্র ব্যবহার করা হয়েছে সরলভাবে অনুধাবনের জন্য। বইটির পাঠকপ্রিয়তা এবং সাফল্য কামনা করছি।