আমাদের রাষ্ট্র বা সমাজের আনাচে-কানাচে অসংখ্য গল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কেউ কেউ সেগুলো কুড়িয়ে আনেন। কেউ আবার খুঁজেও পান না। তবে যারা কুড়িয়ে আনতে পারেন, তারা লেখক। এছাড়া প্রতিটি নাগরিকের মনের অন্দরেও ভিড় করে আছে অজস্র কথামালা। কেউ বলতে পারেন, কেউ বলতে পারেন না। যারা বলতে পারেন, তারা লেখক। যারা বলতে পারেন না, তারা পাঠক। তরুণ কথাকার শেরিফ আল সায়ার কুড়িয়ে এনেছেন, বলতে পেরেছেন। সেসব একত্রিত করেই সৃষ্টি করেছেন ‘খাঁচাবন্দি মানুষেরা’। পাঠকের দৃষ্টিতে তা একটি গল্পগ্রন্থ।
কথাশিল্পীর দায় প্রসঙ্গে বইটির ফ্ল্যাপে কবি-প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক বলেছেন, ‘কথাশিল্পীর মূল দায় সমাজের প্রধান অসুখ শনাক্ত করা। একই সঙ্গে সমাজে সংঘটিত ঘটনাপুঞ্জের কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কারের চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করা।’ তার কথার সঙ্গে একমত পোষণ করে গল্পকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। কারণ তিনি কাজটি যথার্থভাবেই করতে পেরেছেন। তার প্রতিটি গল্পে রাষ্ট্র বা সমাজের অসুখ শনাক্ত করেছেন। এমনকী ঘটনার সম্পর্কও আবিষ্কার করতে পেরেছেন।
‘খাঁচাচবন্দি মানুষেরা’ বইটিতে মোট আটটি গল্প রয়েছে। প্রত্যেকটি গল্পই আলাদা ধাঁচের। গল্পগুলো হচ্ছে—‘কেউ কথা বলে না’, ‘তরুণ উদ্যোক্তা মোসাদ্দেকের স্বপ্নবাক্স’, ‘খসখসে হাত’, ‘পরকীয়া’, ‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর’, ‘নিকোলাসকে কারা হত্যা করল?’, ‘আঁখির নোটবুক’ ও ‘মকলেস’।
বইয়ের প্রথম গল্প ‘কেউ কথা বলে না’। লেখক সত্যিই যেন গল্প বলেছেন। তার বলার ঢং আলাদা। গল্পের মধ্যেই পাঠকের সঙ্গে কথা বলেছেন লেখক। পাঠকের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। লেখক বলেছেন, ‘এই পৃথিবীতে মানুষের জীবন বোধ হয় সবচেয়ে সস্তা। এত সস্তা যে তার সারা জীবনের একটা স্বপ্ন মুহূর্তে নিভে যাবে। আর ফিরবে না কিছু, কিছুই ফেরানো যাবে না। মানুষই বোধ হয় একমাত্র প্রাণী যার মৃত্যুর কোনো কারণ থাকে না, কিন্তু মরে যাওয়ার পর কান্নার অনেক কারণ তৈরি হয়।’ অসম্ভব সুন্দর একটি গল্প। মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপড়েন উঠে এসেছে সাবলীলভাবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি জটিলতা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। গল্পে মনস্তাত্বিক জটিলতা অসমাপ্ত রূপেই সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায়। নাসির-প্রমা আর কোনোদিনই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলবে না। অভিমান থেকে প্রস্থানের দিকে এগিয়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় নাসিরের প্রয়াণ গল্পের যবণিকা টানতে সহায়তা করেছে। এরকম ঘটনা অহরহ ঘটতে পারে। গল্পের সার্থকথা সেখানে নয়। গল্পের সার্থকথা নির্মাণে, শব্দচয়নে। লেখকের বোধ পাঠককেও অনুরণিত করে দেয়।
দ্বিতীয় গল্পটি একজন তরুণ উদ্যোক্তার। তবে এ উদ্যোক্তা সফল নন। সফল হতে হতে ব্যর্থ হয়ে গেছেন। আড়ালে বসে কেউ কলকাঠি নেড়েছেন। লেখক বলেন, ‘এলাকার লোকজন থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন-সবার কানে চলে গেল কেউ তুলে নিয়ে গেছে মোসাদ্দেককে। এরপর নানান জনের নানান মত আর প্রশ্ন।’ গল্পটিতে সমকালীন সমস্যা উঠে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অন্তর্জালের বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখতে পাই আমরা। একজন উদ্যোক্তা মোসাদ্দেককে অকারণে তুলে নেওয়ার কাহিনী আমাদের চোখে পড়ে। এই তুলে নেওয়া সংস্কৃতি ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে। সমাজের অসঙ্গতি সবারই চোখে পড়ে, কিন্তু তা থেকে প্রতিবাদের মিছিল নিয়ে আসে ক’জন? অসঙ্গতিগুলোকে নিয়তি ভেবে আমরা চুপ করে থাকি। তখন মোসাদ্দেকের সারিতে যুক্ত হয় আরও অনেকে। অসঙ্গতিগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। অপরাধগুলো নিয়মে পরিণত হতে থাকে। লেখক এখানেই ব্যতিক্রম যে, তিনি অপরাধকে অপরাধ বলতে পেরেছেন। গল্প শুধু মনোরঞ্জনের জন্যই নয়। গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়েছেন।
‘খসখসে হাত’ গল্পে রূপান্তরকামী গ্রামের দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখের সামনে। প্রত্যেকটি শহুরে মানুষের শেকড়ের কথা বলা হয়েছে। লেখকের মনে কিছু প্রশ্নের উদয় হয়েছে, যা একেবারে অবান্তর নয়। গল্পের ভাষায়, ‘সখিনা যেদিন মারা গেল, সেদিন আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল। সখিনার নামের সঙ্গে ব্যাপারী টাইটেল ছিল না কেন? এই ব্যাপারী টাইটেল কোথা থেকে আমাদের নামে যুক্ত হলো-এই প্রশ্নের উত্তর এখনো আমার কাছে অজানা।’ গল্পের গ্রামবাংলার নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিদিনকার দৃশ্য যেন এমনই—‘আমি বিরক্ত হয়ে উঠতাম, আসলে ভয়ে উঠতাম। জামা বদলে, আব্বার পিছু পিছু মসজিদে যেতাম। নামাজ পড়ে ঘরে এসে আবার ঘুম দিতাম।’ লেখকের তখন মনে হয়েছে, এক বিড়ির দোকানদার তার ছেলেকে নিয়ে বড় কোনো স্বপ্ন দেখেন। লেখকের ভাষায়, ‘তবে কী স্বপ্ন দেখেন, তা আব্বা কখনো আমাকে ডাক দিয়ে বলেননি।’ এটি চিরচেনা এক গ্রামীণ গল্প। গরিব বাবার সংগ্রামের গল্প। ছেলে মানুষ করানোর স্বপ্ন। সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মে হয়। কিন্তু প্রায় গল্পে দেখি, বাবারা সুফল পাওয়ার আগেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান। আমরা সবাই জানি, মানুষ মরণশীল। তবে বাবা হিসেবে বিড়ি ব্যাপারী সার্থক। তিনি যা চেয়েছেন, তা পেয়েছেন। হয়তো ভোগ করে যেতে পারেননি। কখনো কখনো মানুষের জীবনে শত পূর্ণতার মাঝেও কিছু অপূর্ণতা থেকেই যায়। লেখকের মুন্সিয়ানা এখানেই। বাস্তবতাকে গল্পের মতো করে মানুষের সামনে উপস্থাপনা করার ধৈর্যশীল কৌশল লেখক রপ্ত করতে পেরেছেন।
‘পরকীয়া’ এ সময়ের একটি আলোচিত ইস্যু। ঘর ভাঙার যেন উৎসব চলছে। জীবনের অস্থিরতা যেন সাগরের উত্তাল ঢেউকেও হার মানায়। তাই গল্পে পরকীয়ার কারণ লেখক আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন এভাবে ‘মাঝে মাঝে ভাবি, আমার এই যে হঠাৎ হঠাৎ অবজ্ঞা, অবহেলা—এজন্যই কি মাকসুদ দূরে সেরে গেলো? নাকি আমাকে আর তার ভালো লাগে না। আমার বুড়িয়ে যাওয়া শরীর কি মাকসুদকে আর টানে না? এ জন্যই কি অন্য কোথাও অন্য কোনো খানে, অন্য কারও কাছে শান্তি খুঁজে বেড়ায়?’ এছাড়া কখনো কখনো অর্থনৈতিক সংকট সম্পর্কে লেখক বলে ওঠেন, ‘এই শহরে একজনের ইনকামে চলা বড় কঠিন।’ কিংবা ‘মধ্যবিত্তের জীবন এক অদ্ভুত গোলকধাঁধা। এটা থেকে বের হওয়া বড় মুশকিল।’ কারণ মাসের ২৫ তারিখেই বেতন শেষ হয়ে আসে। তখন মহাবিপদে পড়ে যেতে হয়। হতাশা প্রকাশিত হয় মাঝে মাঝে। যুক্ত হয় প্রযুক্তির উৎকর্ষ। ‘সেখানে ফেসবুক নামক এক আশ্চর্য মিডিয়া এসেছে। যেখানে মাকসুদ বুঁদ হয়ে থাকে। আর আমাকে বলে, আমার সেকেন্ড ওয়াইফ হলো ফেসবুক।’ এরপর ‘আজ যখন মাকসুদ ঘরে ঢুকল। তখন হুট করেই ওর চোখের দিকে তাকালাম। ঠিক তখনই আমি তার চোখে প্রতারণা দেখতে পাচ্ছিলাম।’ জীবনের একটি চরম বাস্তবতার গল্প। প্রমাণ নেই বলে আমরা অনেকেই তাদের অপরাধী বলতে পারি না। আবার এ-ও জানি, সে অপরাধ করছে। তবে এভাবে সন্দেহ পুষে রেখে একটি সংসার কতদিন চলতে পারে? লেখক এ গল্পে জীবনের খাঁটি করুণ বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছেন। লেখক পরকীয়ার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো সমাধান দিতে পারেননি। সমাধান হয়তো তার কাছে নেই। কিছু কিছু বিষয় অমীমাংসিতই থেকে যায়। পরকীয়ার মতো সামাজিক একটি ব্যধিকে একা রোধ করার ক্ষমতা কেউ রাখে না।
শেরিফের ‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আবু ইব্রাহিম। একই নামে শহীদুল জহিরের একটি বিখ্যাত চরিত্র আছে। লেখক তা পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেন। তবে এখানকার ইমদাদুল হক নামে একজন ভদ্রলোক আছেন। সেই ‘ভদ্রলোক দেরি করে বিয়ে করেছেন। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে বয়স বেড়ে গেছে। বয়স যখন ৪০ বছর পার হয়েছে, তখন হক সাহেবের মনে হয়েছে তার একটা বিয়ে করা উচিত।’ তিনি মরহুম আবু ইব্রাহিমের স্ত্রীকে বিয়ে করেন। লেখক বলেন, ‘কেন মানুষ মরে যায়? না মরলে কী হয়?’ রূপাকে হক সাহেব বিয়ে করার পর রূপার মনে হয়েছে, স্ত্রীকেও স্বামীরা ধর্ষণ করে। রূপার সঙ্গে যখন হক সাহেব যৌনমিলন করেন, রূপার তখন ভয় হয়। মনে মনে ভাবে, আবু ইব্রাহিম তাকে দেখছে না তো? তবে একটা সময় আসে, রূপার তখন আর আবু ইব্রাহিমের কথা মনে পড়ে না। যে আবু ইব্রাহিম তার কাছে কন্যা চেয়েছিল। অথচ আজ রূপা বুঁদ হয়ে গেছে তার কন্যা রুবিনা হকের ভেতর। আর হক সাহেবের প্রেমে রূপা এখন মাতাল। এভাবেই রূপার জীবন বয়ে যায়। তাই তো লেখক বলেন, ‘এই দুনিয়ায় প্রত্যেকেই এক একজন আবু ইব্রাহিম। প্রত্যেকের মৃত্যুই হাঁসের পালকের চেয়ে হালকা।’ গল্পটি আসলে কঠিন কোনো আখ্যান নয়। বাস্তবে এমনটি হতেই পারে। মৃত্যু, বিবাহ, যৌনতা—কোনো কিছুই মানব জীবনের বাইরের অংশ নয়। সেই স্বাভাবিক বিষয়গুলো অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে লেখকের বয়ানে। গল্পের স্বাভাবিকতা এখানে।
শেরিফের ‘নিকোলাসকে কারা হত্যা করেছিল?’গল্পে রাজনীতি সচেতনতা আছে। সমসাময়িক সমস্যার বিবরণ আছে। রাজনৈতিক সহিংসতার কথা আছে। বীভৎস লাশ দেখার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। তাই একজন পুলিশ অফিসারেরও আবেগ কমে গেছে। ফলে নিকোলাসের আত্মহত্যা তাকে আবেগাপ্লুত করে না। পুরো গল্পে এক পুলিশ অফিসারের তদন্ত কাজ সুন্দরভাবে বিবৃত হয়েছে। পুলিশ শহীদুলের জবানিতে কঠিন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, ‘সোস্যাল মিডিয়ায় যে সব ফোনকলের রেকর্ড বের হয়ে যায়। ওসব কীভাবে সাপ্লাই হয়? ওসবের সময় কি কোনো দরখাস্ত লাগে?’ নিকোলাসের আত্মহত্যার সূত্র ধরেই এগিয়ে যায় গল্পটি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম গল্পের উপাদান হয়ে ওঠে। বিষোদগার করা হয় চিকিৎসকদেরও। বলা হয়, ‘এই দেশে বহু রোগীকে তো ডাক্তাররা মেরে ফেলে ভুল চিকিৎসা কিংবা অবহেলা করে।’ লেখকদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল নিকোলাসের। তার মতে, ‘অধিকাংশের মেরুদণ্ড বিক্রি হয়ে গেছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করে কেউ লেখে না। ন্যায্যতার কথা কেউ আর বলে না।’ তাই দেশ নিয়ে নিকোলাসের অনেক কষ্ট। দেশের মানুষকে নিয়ে তার অনেক কষ্ট। গল্পটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লেখা। ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর রাজধানীর পিজি হাসপাতালের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মাহুতি দেয় নিকোলাস নামের এক যুবক। তারই ছায়া অবলম্বনে এগিয়ে গেছেন লেখক।
‘আঁখির নোটবুক’ গল্পে লেখক বলতে চেয়েছেন, মানুষ আসলে মানুষের পাশে দাঁড়ায় না। এ দেশে ধর্ষিত হয় অসংখ্য নারী। পুলিশ-মিডিয়ার জন্য ধর্ষিতা এক চটকদার চরিত্র। লেখক বলেন, ‘রূপন্তি কখনো-সখনো ভাবে আর আবিষ্কার করে, নির্জন এই পৃথিবীতে সে একাকী দাঁড়িয়ে। তখন রূপন্তির মনটাও অনন্ত বিষাদে ভরে ওঠে।’ মৃত আঁখির ভাবি রূপন্তি কোচিং মালিক সম্পর্কে আগেই জানতো। কোচিং সেন্টারের মালিক রুস্তম চরিত্রহীন। তার দ্বারা প্রতারিত আঁখি নিজেকে ধর্ষিতা ভেবেই আত্মহত্যা করে। এ গল্পে প্রেমের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্কের নেতিবাচক দিকটি উঠে এসেছে। পাশাপাশি প্রতারিত আঁখিদের করুণ জীবন প্রতিফলিত হয়েছে। ভাইয়ের সংসারে বেড়ে ওঠা আঁখির জীবনে ঝড় তুলে আনা মানুষটি সমাজের চোখে একজন চরিত্রবান। অথচ আঁখিকেই চরিত্রহীনের কলঙ্ক নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে হয়। জীবনের জটিলতম ঘটনার সরলতম বিবরণে গল্পটি সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে।
লেখকের ‘মকলেস’ গল্পটি বস্তিতে বেড়ে ওঠা এক যুবকের। বস্তিতে যে কেউ বড় হতেই পারে। সেটা স্বাভাবিক। তাহলে গল্পের মূল ভিত্তি কোথায়? সেটা হচ্ছে- এই সমাজের প্রতি লেখকের একটি বার্তা রয়েছে। তা হচ্ছে— মাদক ব্যবসায়ীরা যেন আড়ালেই থেকে যান। বরং বলি হন অন্য কেউ। তা না হলে মকলেস কাজ করে একটি গ্যারেজে। গ্যারেজের আড়ালে সেখানে ইয়াবা ব্যবসা হয়। মকলেস তা জানে না। ফলে একদিন ক্রসফায়ারের শিকার হতে হয় তাকে। এ প্রসঙ্গে লেখক বলেন, ‘গাঁজা থেকে শুরু করে ইয়াবার রমরমা ব্যবসায় ব্যাপক প্রভাবশালী শমসেরের কী বালটা ছিঁড়ছে কেউ? অথচ নুরু কিংবা মকলেসরা নর্দমায় পড়ে থাকে মাদক ব্যবসায়ী হয়ে।’ সমাজের বা রাষ্ট্রের ব্যর্থতার একটি উৎকৃষ্টতম উদাহরণ হতে পারে গল্পটি। রাষ্ট্রে বা সমাজে জন্ম নিয়ে একটি শিশু স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা পায় না। অথচ যাবতীয় অস্বাভাবিকতা তাকে রোজ কুড়ে কুড়ে খায়। বলাৎকার, যৌন হয়রানি, মাদকাসক্তি মকলেসের জীবনে ভয়াবহ টর্নেডো হয়ে দেখা দেয়। আমার মনে হয়, লেখকের চোখে মকলেসের নিথর মৃতদেহ নিথর সমাজের প্রতিবিম্ভ মনে হয়েছে।
শেরিফ আল সায়ারের ‘খাঁচাবন্দি মানুষেরা’ অসংখ্য মানুষের গল্প। জীবনের গল্প, বেঁচে থাকার গল্প, হেরে যাওয়ার গল্প, হারিয়ে যাওয়ার গল্প। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা পাপ, অন্যায়, অসত্যের জীবনালেখ্য। তার প্রতিটি গল্প এমনভাবে প্রথিত যে, বাস্তবতাকে চশমা ছাড়াই অবলোকন করা যায়। অথচ এই দৃশ্যগুলো আমরা রোজ দেখি। ঘটনাগুলো খুবই পরিচিত। কিন্তু প্রত্যেকটি ঘটনাই যে গল্প হতে পারতো, তা ভাবিনি। কিংবা প্রত্যেকটি গল্পই যে, বাস্তব হতে পারে তা-ও কল্পনা করিনি। লেখক সার্থকতার সঙ্গেই যাবতীয় সঙ্গতিগুলো গল্পে গল্পে তুলে এনেছেন। তার প্রতিটি গল্পই যেন একেকটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে।
সুতরাং বলাই যায়—লেখক পেরেছেন। সাহসিকতার সঙ্গে সমাজের যাবতীয় অসঙ্গতি আটটি গল্পে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাঠকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন—এই মকলেস, আঁখি, নিকোলাস, নাসির, বিড়ি ব্যাপারী, আবু ইব্রাহিম—সবাই আমাদেরই প্রতিনিধি। সরল বর্ণনা, মধুর সংলাপ, কৌশলী শব্দচয়ন আর নিরাপদ বাক্যগঠন গল্পের মাধুর্যকে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন লেখক। আশা করি, বইটি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে। পাঠক নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম কিছু গল্প উপহার পাবেন। লেখকের এমন বিপ্লবী পদক্ষেপে পাঠক হয়ে উঠুক সাহসী হাতিয়ার।
বই: খাঁচাবন্দি মানুষেরা
লেখক: শেরিফ আল সায়ার
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশনী: আদর্শ