গল্প প্রথাগত কি প্রথাবিরোধী, অনুগল্প কি বড়গল্প; সেটি বড় কথা নয়। গল্প হয়ে ওঠাটাই আসল ব্যাপার। গল্প যদি দেহভাষা-মনোভাষার দিক দিয়ে পাঠকের হৃদয়ে কড়া নাড়ে, তবেই যথার্থ। তেমনই একটি গল্পে বই ‘কয়েকটি ভেড়া ও একটি মানুষ’। লেখক প্রণব আচার্য্য। বইটিতে আছে বিশটি অনুগল্প। কয়েকটি গল্প নিয়ে আলোচনা করা যাক।
‘লোকটির ব্যক্তি হয়ে ওঠা’ গল্পে লোকটি পথিক থেকে দেবতা হয়ে ওঠে। লোকটির অলৌকিকক্ষমতার বলে সবকিছুতে পরির্বতন আসে। লোকটি মাদারগাছের কাছে গেলে গাছটি লালফুলে ভরে যায়। ডোবার কাছে গেলে ডোবা টলটলে দিঘিতে রূপান্তরিত হয়। কংক্রিটের মাঠে গেলে মাঠ পরিণত হয় সবুজ ঘাসের মদিরা কার্পেটে। লোকটির বিড়ির ধোঁয়া থেকে জম্ম নেয় একঝাঁক শিশু। তারপর ওরা কিন্ডারগার্টেনের দিকে উড়ে যায়। এরপর সে মিরাকল ম্যান থেকে পথিক হয়ে যায়। গল্পের অন্য বাক-ফ্যান্টাসি শুরু হয়।
এ গল্পে বেশ উজ্জ্বল চিত্রকল্পের ব্যবহার লক্ষ করা যা। যেমন—’একুশ শতকের ট্রাক তাকে চাপা দিতে উদ্যত হতেই মুহূর্তে সেটি পরিণত হলো ব্যালে নৃত্যরত সুনিল রাজহাসে।’ চিত্রকল্পের পাশাপাশি রয়েছে সার্থক উপমার প্রয়োগও। যেমন—’লোকটির লুঙ্গির প্রতিটি রিপুর দাগ গুচ্ছ-গুচ্ছ মাদারফুল হয়ে জ্বলতে লাগলো।’ লেখক গল্পটি নিজস্ব ভঙ্গিতে বলে গেছেন। পাঠককে কোথাও হোচট খেতে হয় না। তবে, কিছু অসঙ্গতি গল্পটিতে ফুটে উঠেছে। গল্পকার মিরাকলম্যানকে চাপিয়ে নিজেই ইশ্বরের ভূমিকায় মেতে ওঠেন। তিনি লিখেছেন এবার লোকটিকে এনে দাঁড় করিয়ে দিলাম এক হাইব্রিড মাঠে। এছাড়া গল্পের শেষে লোকটির মৃত্যু-মর্গে সুনীল রাজহাঁস হওয়া। লেখক না দেখে লেখকের বন্ধুর দেখার বিষয়টি লেখক বা ঈশ্বরকে নিষ্ঠুর করে তোলে। আর একটি অসঙ্গতি হলো পথিককে দেবতা বানিয়ে হঠাৎ হারামজাদা বদমায়েশটা বলা।
আরেকটি গল্পের নাম ‘পা’। এটি একটি প্রেমের গল্প । গল্পটিতে মেয়েটির দুঘর্টনায় পড়ে পায়ের হাড় ভেঙে ফেলে। ছেলেটি তাকে অস্বীকার করে । এরপর নাটকীয়তর মধ্য দিয়ে ছেলেটি পা হারায়। মেয়েটির পা সুস্থ হয়ে ওঠে। লেখক এ গল্পে রূঢ় সমাজ বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন। প্রেমিকার দুঃসময়ে প্রেমিক বেঈমানি করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে. গল্পকার সস্তা পাঠকপ্রিয়তার দিকে কৌশলে পা বাড়িয়েছেন। তিনি লিখেছেন, কয়েকটি সন্ধ্যা মাস্তানটির কাছে বিনিয়োগ করার পর সে জানতে পারে, কে বা কারা যেন প্রেমিকটির বাম পায়ে গুলি করে। সন্ধ্যা বলতে লেখক এখানে যৌনতাকে ইঙ্গিত করেছেন? যা গল্পকার এড়িয়ে গেলেও পারতেন। এছাড়া গল্পকার ছেলে-মেয়ে; কাউকে মহৎ করে তুলতে পারেননি। মেয়েটির মাস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক। এরপর গুলিতে ছেলেটির পা হারানো। এ দ্বারা পাঠক মেয়েটিকেই প্রতিশোধপরায়ণ হিসেবে চিহ্নিত করবে।
‘বাঁশিওলা’ গল্পে লেখক লোকগল্পকে পুঁজি করে সত্যকে তুলে ধরেছেন। এ গল্পে লেখক কৈশর থেকে একজন বাঁশিওলাকে খুঁজছেন। সুরের মোহন টানে ঘর ছাড়তে । সময়ের গভীরে লেখক টের পান এ শহরের বাঁশিওলা সুর ফেরি করে না। মৃত্যু ফেরি করে। ফলে, তিনি সবাইকে বাঁশিওলার সুর শুনতে নিষেধ করেন। এ গল্পেও যথারীতি চিত্রকল্প উপস্থিত। যেমন, ‘উপকুলীয় সে জোৎসনায় সবগ্রাসী খুনের উল্লাসে জড়িয়ে ধরবে চিরতরে…।’ লেখক কেবল পরিবেশ বর্ণনায় চিত্রকল্পের আশ্রয় নিয়েছেন, তা নয়। একই সঙ্গে আত্মজিজ্ঞাসাকেও দিয়েছেন নান্দনিকতা। বলেছেন, ‘আমি কি তবে হ্যামিলিনের অবশিষ্ট শিশু?’ সবমিলিয়ে গল্পটি একটি সফল রচনা। লেখক নতুন স্বরে নতুন আঙ্গিকে মানুষের যাপিত জীবনের কষ্টকে তুলে ধরেছেন। তিনি বাঁশিওলা বলতে র্যাব-পুলিশকে ইঙ্গিত করেছেন! যাদের হাতে অনেক নিরীহ মানুষই গুম হয়ে যাচ্ছে।
সবচেয়ে ব্যতিক্রম গল্পটির নাম ‘কয়েকটি ভেড়া ও একটি মানুষ’। এই বইয়ের অন্য গল্পগুলোর বিষয়-আশয়ের চেয়ে ভিন্ন এ গল্প। গল্পটিতে লোকগল্পের মতো কতগুলো চেইন বা শেকল আছে । তবে মধ্যস্থতাকারী কোনো সূত্র নেই। এছাড়া গল্পটি এতবেশি বিমূর্ত যে, পাঠকের বুঝতে অনেক কষ্ট হতে পারে। এ যেন ভাষা না বুঝেও হিন্দি গানের মাতাল সুরে মাথা দোলানোর মতো ব্যাপার। সব মিলিয়ে প্রণব আচার্য্যের গল্পগুলো পাঠককে প্রথাগত গল্পভাষা, বুননশৈলী ও সংলাপের বাইরে এনে নতুন রুচি উপহার দেবে। এখানেই তার সার্থকতা।
কয়েকটি ভেড়া ও একটি মানুষ
প্রণব আচার্য্য
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০১৬
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
প্রকাশক: বাংলা বই
পরিবেশক: প্লাটফর্ম
মূল্য: ১০০ টাকা