সমকালীন তরুণ কবিদের মধ্যে গিরীশ গৈরিক ভিন্নমাত্রায় প্রোজ্জ্বল। শব্দচয়ন ও বাক্যবিন্যাসে সচেতন কবি। ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ৫৩টি কবিতা স্থান পেয়েছে গ্রন্থটিতে। লেখক অভিজিৎ রায়কে স্মরণ করেই যাত্রা শুরু করেছেন গিরীশ। গ্রন্থজুড়ে রয়েছে গ্রামীণ শব্দমালা। যে শব্দগুলো নাগরিক জীবনকেও আন্দোলিত করে। করে স্মৃতিতাড়িত। কংক্রিটের চারদেয়ালে বন্দি থেকেও কবিতায় খুঁজে পাই ধান, তালপাতা, হুক্কা, ছিলম, বল্লার চাক, তেজপাতা, ধনেপাতা, পানের বাটা, কোকিল, কাক, গুলতি, ঢ্যাপের খই, দুধের সর প্রভৃতি। এসেছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও-গান্ধর্ব লেন, ময়মনসিংহ, বিনয় মজুমদার, স্যামুরাই সোর্ড, মধুসূদন।
‘আমি অভিজিৎ রায় বলছি’ কবিতায় তিক্ততা প্রকাশ করেছেন তিনি। ধিক্কার জানিয়েছেন এমন পাশবিক হত্যাকাণ্ডের। কবি বলেছেন-‘এভাবে বেজিদের রক্তে কোবরা হত্যার এক প্রকার নেশা জন্মে/ অথচ সাপ ও বেজির দ্বন্দ্ব এখন মানুষের রক্ত থেকে পবিত্র গ্রন্থে।’
তার কবিতায় সমকালীন প্রেক্ষাপট, রাজনীতি, দেশপ্রেম, বাঙালির নিজস্বতা, আবহমান গ্রামবাংলা, মানবিকতা, নিপীড়িত মানুষের কান্না, নানাবিধ মূল্যবোধ ধরা দিয়েছে অকপটে। গিরীশ কপালের ভাঁজ গুনে জীবনের অর্থ না জানলেও খেজুরগাছের খাঁজ গুনে বলতে পারেন বয়স কত। তিনি হয়তো জন্মের সময় কাঁদেননি ঠিক; কিন্তু এখন কাঁদেন প্রতিনিয়ত। তবে তার কান্না কেউ হয়তো শোনেন না। কখনো কখনো তার কান্না কবিতা হয়ে ধরা দেয় সাদা কাগজে। তথাকথিত মৃত্যু নিয়েও হয়তো তার মধ্যে এক ধরনের দ্বিধাধন্দ কাজ করতে পারে। তবে তিনি মৃতদেহ দেখে মনে করেন, মানুষ মারা যেতে পারে। একটি খাঁটি বাস্তবতাকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন খুব সহজ ভঙ্গিতে। নারীর মর্যাদাকে কুক্ষিগত করে রাখার প্রয়াসকে কবি ‘বৃদ্ধ স্বামীর যৌনতা নিয়ে বলা হয়/মরিচ শুকিয়ে গেলেও ঝাল শুকিয়ে যায় না’(তালপাতা) বলে উল্লেখ করেছেন।
মানব-মানবীর প্রেম নিয়েও তার এক ধরনের সমীক্ষা রয়েছে। প্রেমে আঘাত, ব্যর্থতা, সার্থকতা, যৌনতা প্রয়োজনীয় উপাদান। আঘাতকে অভিশপ্ত ভেবেছেন কবি। আবার প্রেমিকার স্পর্শ কবির শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। কবির এমন স্বীকারোক্তিতে পাঠকের মনে নাড়া দিয়ে ওঠে ভালোবাসার মধুময় স্মৃতি বা বিচ্ছেদের অমোঘ বেদনা।
গিরীশের কবিতায় পারিবারিক কিছু জটিল অঙ্ক পাঠককে কঠিন ধাঁধায় ফেলতে পারে। আমাদের সমাজে বা পৃথিবীতে আজকাল ‘গর্ভ ভাড়া’ করা যায়। যেখানে মাতৃত্ব লুকিয়ে থাকে নিষেধের বেড়াজালে। প্রগতিশীল নারী বা স্বাধীনচেতা নারীর বুকের বাঁধন সন্তানের জন্য কখনো খোলে না। তবু তিনি মানবাধিকারকর্মী। সংসারের এমন বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা সন্তানের কাছে এ সমাজ এমন কী প্রত্যাশা করতে পারে? কবির এমন প্রশ্নের জবাব হয়তো কারও কাছে নেই। যার মা হওয়ার যোগ্যতা নেই, তার মাতৃত্বের সাধও থাকতে নেই।
কবির মনের মধ্যে একটি ছবি অঙ্কিত হয়ে আছে। ছবিটি কবিকে ভুলিয়ে রাখে। হয়তো কোনো অঞ্চলের ছবি। কোনো স্মৃতিময় সময়ের ছবি। ছবিটাকে কবি আগলে আগলে রাখতে চান যেকোনো কিছুর বিনিময়ে। গিরীশ আসলে সত্যিকারের একজন কবিতাকৃষক। এমন শব্দচাষি সাহিত্যের জমিনকে ঠিকই উর্বর করবেন। তার রোপিত ফসল অনাদিকাল রসপিপাসুর ক্ষুধা মেটাবে। ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’ ঠিকই একদিন মুখস্থ হয়ে যাবে। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ কথাটি সত্যি হয়ে উঠবে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কবি চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পছন্দ করেন। নিজেকে জানান দিতে পারেন সগৌরবে-স্বমহিমায়। কবি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন-‘বাঁশ কেটে যেমন বাঁশি বানাতে পারি আবার বাঁশমিশাইল মারতে পারি/ আবার পারি চুম্বক থেকে চুম্বনের সৃষ্টি করতে।’(মোকাম)।
শব্দে-শব্দে চমৎকার খেলা খেলেছেন তিনি। শব্দভাণ্ডারকে ঋদ্ধ করেছেন। শব্দ নিয়ে এমন সুন্দর ভাবে খেলা যায়-তিনি আমাদের শেখালেন। কথায় কথায় বাঙালির ইতিহাস, ভাষাপ্রেম, দেশপ্রেম টেনে আনার প্রবণতা তার যৌক্তিক প্রকাশের হাতিয়ার। কথার জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ করার একটা বিশেষ ক্ষমতা তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তাঁর কবিতায় মৃত্যুচেতনা এসেছে একাধিক বার। আসলে কোনো পর্বে নির্ধারিত করে রাখার মতো গ্রন্থ এটি নয়।
এর যেমন উন্মেষ পর্ব রয়েছে, রয়েছে বিস্তার পর্ব। তবে অন্তিম পর্ব খুঁজে পেতে অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘকাল। কবির জীবদ্দশায় অন্তিম পর্বের সন্ধান না করে কেবল তাঁর অগ্রসরতাই দেখতে পাবো। তিনি হয়তো ‘শব্দের কুঠার ভেদ করে ঢুকে যেতে পারে তোমাদের ডিমের কুসুমে’।
তিনি তাঁর কবিতায় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তিনি জীবনের অর্থ খুঁজেছেন। গণতন্ত্রকে সমাজতন্ত্রের বিষচুম্বন থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। কবির ভাষায়-
অবশ্য আমাদের কাছে জীবন অর্থ পুঁজিবাদের ঢেঁকি পাড়ের ঢিপঢাপ
আর সে কারণে আমরা রক্তের মাঝে ইটের গুড়া সঞ্চয় করি বলি
এসো হে গণতন্ত্রের ধোপা- ধুয়ে দাও আমাদের সমাজতন্ত্রের রক্ত নির্যাস
হয়তো এসকল বিষচুম্বনে আমাদের শরৎবাংলা আজ হয়ে গেছে কুফরিস্তান
(হুক্কা)
ময়মনসিংহ জংশনের এক ভিখারিকে দেখতে পাবেন গিরীশের কবিতায়। যিনি ভিক্ষা পাওয়ার লোভে নিজের ঘা-কে জিইয়ে রাখে। আসলে আমরা তো সেটাই করি। নিজের ঘা-টাকে নির্মূল করার চেষ্টা করি না। লোভের বশে আমরা অনেক হীনকাজও করতে দ্বিধান্বিত হই না। কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরকে ডেকে বলছেন-
শুনে যাও ভারতচন্দ্র- দেখে যাও ভারতচন্দ্র
তোমার সন্তানের দুধের বাটি- আজ ভিক্ষার থালা
(ময়মনসিংহ জং)
গিরীশের কবিতাগুলো দীর্ঘ নয়। বাক্যের আতিশয্য নেই। যতটুকু সাবলীলভাবে বলা যায়। সহজ কথাতো আর সহজেই বলা যায় না। তবু অল্প কথায় অনেক কথার ব্যঞ্জনা রেখে গেছেন প্রতিটি পঙ্ক্তিতে। শুধু একটি দীর্ঘ কবিতা (তুলনামূলক) ‘নগ্নফুলের কবিতা’ চোখে পড়ল। কিন্তু কথার গাঁথুনি এত চমৎকার যে, পাঠককে কিনারায় টেনে নিয়ে যায়।
জগতকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারও আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে অতিজাগতিক জাদুমন্ত্রের সঙ্গে জীবনের বাস্তবতা কবি মেলাতে পারেন স্বচ্ছন্দে। কবি বলেন-
আমার বিধবা পত্নীর চোখের কাজল ধুয়ে
যে নদে প্রবাহিত হচ্ছে
আমি সেই নদের তান্ত্রিক নাবিক।
(তেলাপোকা)
অথবা
পৃথিবীতে যত বাঘ আছে তারও অধিক আছে বাঘের মূর্তি
অথচ বাঘ নয়- বাঘের মূর্তি আমাকে চেটেপুটে খায় ভাবনার ঘরে।
(গান্ধীপোকা)
জীবনের প্রতিটি পরতে জাগতিক মোহ, বাস্তবতা সমানতালে খেলা করে। খেলা করে আমাদের আবেগ অনুভূতির সঙ্গে।
গিরীশের কবিতায় মিথ, চিত্রকল্প, পরাবাস্তবতা এসেছে। কিন্তু তিনি তাঁর দায় থেকে সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। তাঁর কবিতার গঠনশৈলী দেখে মনে হয়েছে তিনি নতুন বা ভিন্নতর একটি জগত তৈরি করার চেষ্টা চারিয়ে যাচ্ছেন। চেতন, অবচেতন অবস্থার কোনো এক স্তরে গিয়ে কবি বলেন-
আমার মেয়ের হাতরেখা বাঘবন্দি খেলতে খেলতে
ঢুকে যায় জমাটবাঁধা চুইনগাম রাত্রির গভীরে
সেই রাত্রির গভীরে
সব তাস বিবি হতে পারে না
কিছু তাস চিরকালীন গোলাম থেকে যায়।
(নগ্নফুলের কবিতা)
কিংবা
ঘুম থেকে জেগে দেখি রক্তাক্ত ওষ্ঠের আহাজারি
মাকে হত্যা করে যারা ওরেস্তেস কিংবা পরশুরাম হতে চায়
তারা গণতান্ত্রিক বনবিবির আশীর্বাদ পেতে পারে
কবিতার খাতায় তারা নির্বাচিত জল্লাদ
অথচ তারাই একদিন সূচের গুহা চেটে আদ্রেঁইস হতে চেয়েছিল
তারা এখন মাকড়সাজালে বন্দী।
(সিসিতিস)
কবি সামগ্রিক ভাবনার মধ্যেও কখনো কখনো নিজেকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। নিজের অবস্থান, গ্রহণযোগ্যতা, সফলতার মাপকাঠি খোঁজেন। তাই একটু ভিন্ন স্বরে বলতে চান-
অনেকদিন ধরে নিজেকে দেখতে পারছি না
চারিদিকে শুধু আন্ধার
জানি গোধূলির মেঘসড়ক সর্বদা রক্তাক্ত হয়
তবু হাঁটছি যদি পাই গৈরিক আলোর রেখা।
(মশারী)
সবশেষে বলতে পারি, কবির কবিতা নিয়ে বিশদ আলোচনার অবকাশ নেই। বাকি দায়িত্বটুকু পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিতে চাই। তাঁর কাব্যশৈলী আমাকে বিমোহিত করেছে। এমন সরল কাব্য ঝংকার আমাকে ভাবিয়েছে। কবিতা আসলে আলোচনার বিষয় নয়। পাঠের বিষয়- উপলব্ধির বিষয়। গিরীশের কবিতা টেনে নিয়ে যায়। কবি শব্দ চয়নে, বাক্য গঠনে, কাব্যের শরীর নির্মাণে, অলঙ্কার প্রয়োগে, ছন্দ ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন। অন্ত্যমিলযুক্ত না হলেও ছন্দের সাংগীতিক দোলায় আবিষ্ট করবে পাঠকের হৃদয়- জয় করবে মন। কবিতার এমন ক্ষরার কালে ক্ষুধার্ত ধানের নামতা প্রবল বর্ষণ হয়ে ঝরে পড়ুক কাব্য আঙিনায়।