আসাদ মান্নানের কবিতায় যে জীবনচিত্র প্রতিভাসিত হয়ে ওঠে, তা বহুভঙ্গিম জটিলতায় আকীর্ণ। সমাজ-সংসারের যে বাস্তবতা তার পরিপ্রেক্ষণা ধৃত হয়, সেখানে ক্লেদযুক্ত, কালিমালিপ্ত জীবনের অভিঘাত যেমন, সুস্পষ্ট তেমনি মানবতা, ভালোবাসার জয়োধ্বজাও উত্তোলিত সগৌরবে। সময়ের আবর্তনচক্রে সত্তা অপরিহার্যভাবেই পরিবর্তিত হয়। তাইতো রক্তস্নাত স্বাধীন-স্বার্বভৌম রাষ্ট্রে যে কবি স্বাপ্নিক ডানা মেলতে উদ্যত, তাকেই আবার শোকাভিভূত হয়ে ভূমিতে পতিত হতে হয় রাষ্ট্রপিতার নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে।
কাব্যসাধনা আসাদ মান্নানের সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর মননের পরিচর্যাক্ষেত্র রূপে বিবেচিত। কাব্যসৃষ্টির প্রারম্ভলগ্ন থেকেই তার কবিতায় উন্মোচিত হয় দেশ-কাল-সমাজের বাস্তব পরিপার্শ্ব, প্রতিকূল প্রতিঘাত ও ব্যক্তিলোকের সংকট, সংগ্রাম ও প্রত্যয়। একইসঙ্গে নারী, নদী, নিসর্গ ও প্রেমের মতো বিষয়গুলোও কবিতাপ্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে কবির বয়ানভঙ্গির সারল্যে। স্বকালের সব ঘটনাই কবির মানসপটে অনিবার্যভাবেই অভিক্ষেপ রাখে। আর এই অভিক্ষেপের প্রতিফলন দেখা যায় তার কবিতায়।
আসাদ মান্নানের কবিতায় নতুন সংযোজন ‘কুয়াশা উপেক্ষা করে বসে আছে আশা’ (২০১৯)। বিভিন্ন বিষয় সংবলিত মোট সাইত্রিশ কবিতায় কাব্যটি সম্পূর্ণতা পেয়েছে। যদিও এর কেন্দ্রভাগে বিরাজমান কবির স্বভাবসুলভ দেশপ্রেম ও বাঙালি জাতির কর্ণধার বঙ্গবন্ধুর চেতনার উদ্ভাসন। একইসঙ্গে কবির স্বভাবসিদ্ধ সৃজনপ্রতিভা, পরিশীলিত মননসৌকর্য ও যাপিত জীবনলব্ধ সংবেদকেও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রেম-দ্রোহ, নিসর্গমগ্নতা, স্মৃতিচারণ, সমাজ-রাজনীতির জটিল আবর্তন চিত্রিত হয়েছে এই কাব্যে। কবিতায় তিনি জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন হতাশার কথা বলেন, আবার মুহূর্তেই দৃপ্ত উচ্চারণে প্রমূর্ত করে তোলেন আশার বাণী:
অজস্র মৃত্যুর ফাঁদ পথে পথে—সুযোগ পেলেই
কখনো চাপাতি হাতে দরোজায় করাঘাত করে
আসন্ন মৃত্যুর দূত; সঙ্গে নাচে মিডিয়া সন্ত্রাস—
বিভ্রান্তির মিথ্যা বুলি বিক্রি করে চণ্ডাল সুশীল।
সব ঝেড়ে ফেলি—যখন হৃদয়ে কান পেতে শুনি
আকাশের সমান উঁচুতে পাতা রক্তের বেদিতে
অলৌকিক কণ্ঠে বাজে জীবনের উদ্দীপ্ত কোরাস—
আলোর পাখিরা ওড়ে; চতুর্দিক আনন্দে মুখর।
(আসাদ মান্নান ২০১৯ : ১১)
কবি জীবনের শুভবোধের জাগরণ চান, ইতিবাচক চিন্তাপ্রবাহধারার উন্মেষ কামনা করেন। প্রতীক্ষা করে থাকেন সেই বাংলাদেশের জন্য যেখানে সব অপশক্তির দৌরাত্ম্য নিশ্চিতভাবে নিশ্চিহ্ন হবে। কবির বহুলপ্রতীক্ষিত সেই আকাঙ্ক্ষার উৎসারণক্ষেত্র হয়ে ওঠে কবিতা:
ক্লান্তি জরা অবসাদ ঝেড়ে
নতুনের হাত ধরে
অই হাঁটে পুরনো গয়াল।
বৈশাখী হাওয়ার টানে
সব কিছু ভেঙেচুরে
সমুদ্র পাহাড় নদী
ওলোট-পালোট করে
আকাশ কাঁপিয়ে
দুর্বিনীতা চণ্ডালিনী বাতাসের
ঝুটি ধরে, দ্যাখো
কে আজ এগিয়ে যাচ্ছে
সভ্যতার মানবশেকড়ে;
দ্যাখো ভাই দ্যাখো বোন
দ্যাখো বন্ধু প্রিয়জন
বর্বরতা খর্ব হয়ে পেছনে হঠেছে—
বাঙালি মানব হলো মিলনের মোহনার চরে:
তৈরি হোক আজ এক গোত্রহীন আলোর বসতি।
(তদেব : ২৭)
এভাবেই সমাজব্যবস্থার অবরুদ্ধ নৈরাজ্যিক নিশ্চলতাকে তিনি আয়ুধ তুল্য কবিতার গতিশীল শব্দের পেষণে বিধ্বস্ত করে সাম্যসমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রগামী হন। আর এমন সৃজনশীলতা সম্ভব হয় তার প্রাতিস্বিক কবিত্বশক্তির গুণেই।
আসাদ মান্নান কাব্যচর্চার মধ্য দিয়ে জীবনকে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে অন্বেষণ করেন। কবিতায় তাই বারবার তার চিন্তাচেতনার বহুমাত্রিক রূপান্তর দেখা যায়। জীবন-মৃত্যুর অবিচ্ছিন্ন বন্ধনের মাঝে কবি ইতি-নেতির কোনোটিকেই এককভাবে প্রতিস্থাপিত করতে পারেন না, কোনোটিকেই নিরঙ্কুশভাবে জয়ী বা পরাজিত হিসেবে গণ্য করতে পারেন না। উভয়ের মাঝে এক অভেদ্য সংলগ্নতা আবিষ্কার করেন। তবু জীবনের আশা-নিরাশাকে এই নিরবচ্ছিন্ন সংলগ্নতার মধ্য থেকেই অঙ্কুরিত করে তোলেন।
মুহূর্তে চলছে এ লড়াই জীবন—মৃত্যুর
কেউ কারো চেয়ে কোনো অংশে এতখানি কম নয়,
যতখানি কম হলে পরাজয় তার দিকে যাবে।
চূড়ান্ত প্রস্থান রথে জীবনের অপর পৃষ্ঠায়
যদিও মৃত্যুর ছবি আঁকা আছে রঙ ও রেখায়
তবুও জীবনচাষী আশা বুকে লাঙ্গল চালায়
সন্দ্বীপের ধূ ধূ চরে—যদি কোনো রাতে চাঁদ এসে
ধরা পড়ে কৃষাণীর ভাঙা ঠোঁটে—নবজাতকের
কান্না শুনে জন্ম নেয় নতুন ঈশ্বর; বসন্তের
ফুলনারীদের কণ্ঠে বাজে জোড়া কোকিলের মরা গান!
(তদেব : ৫৮)
প্রত্যেক সচেতন মানুষই এই বিষয়ে অবগত থাকে যে, অস্তিত্বশীল হতেই মানবসত্তার রূপান্তর সাধিত হয়। কবিও এর ঊর্ধ্বে নন। কারণ বর্তমান সময়ে যে সমাজব্যবস্থায় কবি বাস করেন, সে ব্যবস্থা। কিন্তু যখনই এই বাস্তব জগতের সঙ্গে কবির অন্তর্জগৎ একটি দ্বান্দ্বিক বা সাংঘর্ষিক রেখায় এসে উপনীত হয়, তখনই তার সত্তার স্বাধীনতা বাধা পায়। অস্তিত্বসংকট প্রকটভাবে অনুভূত হয়। আর কবিচিত্ত অনুভূতিপ্রবণ হওয়ার নিমিত্তেই তার চেতনার বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ অন্য সব জগতের বহুবিধ সংকট থেকে প্রাতিস্বিক অস্তিত্ব সংবেদে উপনীত হতে পারে। মূলত অস্তিত্বসংকটে নিমজ্জিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে বিচিত্রমুখী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার মাধ্যমে কবি আসাদ মান্নানের চিন্তার গতিশীলতাও সঞ্চারমান থাকে। তবে, কবির মননে বিচরণরত সব ভাবনার মাঝে যে চিরন্তনবোধ সক্রিয় থাকে, তার সমার্থক শব্দ বঙ্গবন্ধু বলাটাই যথার্থ বলে বিবেচ্য।
কবি তার বোধ ও বোধির উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে কবিতায় প্রমূর্ত করে তোলেন সাম্প্রতিক সব বিষয়বস্তুকে। সত্যান্বেষী কবি মানবতার অবমাননাজনিত মর্মযন্ত্রণাকে।
কবির কাছে বঙ্গবন্ধু কেবল একটি নাম বা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি অথবা জাতির জনকই নন, বরং একটি দর্শনও। যে দর্শনের মধ্য দিয়ে তিনি সব অপশক্তি ও অরাজকতার পতন সাধিত করতে পারেন; নিষ্কলুষ, নিশ্চিন্ত আগামীর স্বপ্ন দেখতে পারেন। কবি বিশ্বাস করেন, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার দুই কন্যাই পারেন তার সব অসম্পূর্ণ স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন করতে। বঙ্গবন্ধু নামক দর্শনকে শাশ্বত মর্যাদার আসনে আসীন করতে। তাই কবি তাদের জন্যও শুভকামনা করেন। প্রার্থনারত হন কবিতায়:
পিতা! তোমার কন্যার হাত ধরে
আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্রকে তাড়িয়েছি
তার হাত ধরে
আমরা বিশ্বকে
কী অবলীলায় দেখিয়ে দিয়েছি
আমরাও পারি, আমরাও …
আড়ালে যে
তোমার স্বপ্নের সীমাহীন তাড়া ও তাড়না!অভিবাদন
দেশরত্ন শেখ হাসিনা!
দেশকন্যা শেখ রেহানা!
আপনাকেও অভিবাদন,
যে আপনি সহযোদ্ধা
আড়ালে মায়ের মতো কী অটল দাঁড়িয়ে আছেন!
আমাদের কিছু কিছু আয়ু দিয়ে
আমার আয়ুর বিনিময়ে
পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে
আপনাদের দু’বোনের দীর্ঘতর আয়ু চাই।
(তদেব: ১৯)
স্বাধীন স্বদেশে বাঙালির আবেগ অনুভূতি হয়ে ওঠে অনিরুদ্ধ। অনিকেত সময়কে পেছনে ফেলে নিশ্চিত-নিশ্ছিদ্র নিকেতনে স্থিত হওয়ার স্বপ্ন-বাসনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রত্যেক বাঙালিকে তাড়িত করে ফিরতে থাকে প্রতিনিয়ত। কবিও এর ব্যতিক্রম নন। তিনিও পারেন না এই প্রতীক্ষিত আশার সীমানাকে উৎক্রম করে যেতে। তাই পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিবেশের দুঃস্থ ও নৈরাশ্যকবলিত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে যে একমাত্র বঙ্গবন্ধুর তনয়াই ধুয়েমুছে শুচিস্নিগ্ধ শ্রেয়বোধসম্পন্ন ভূমিতে রূপান্তরিত করতে পারেন তাঁর প্রজ্ঞাশাসিত ও সুচিন্তিত পরিকল্পনার সমন্বয়ে। সেই আশাবাদই আসাদ মান্নান কবিতায় ব্যক্ত করেন।
তেত্রিশ বছর ধরে যারা জীবিতের অভিনয় করে
তাদের হৃদয়ে ‘দেশপ্রেম’ এই মৃত শব্দটিকে
গাঢ় মমতায় ফের জাগালেন যিনি তার দেহে
জনকের রক্ত আর স্বপ্ন বহমান: মৃত্যুভয়
তুচ্ছ করে, বিমূঢ় বেদনারাশি বুকে চেপে রেখে
অশুভের ষড়যন্ত্র, কুয়াশার জাল ছিঁড়ে ছিঁড়ে
গৌরবে সৌরভ নিয়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন আজ
রবীন্দ্রনাথের গানে; আমাদের মানস অন্দরে।
মহিমা নামের কত শত নির্যাতিতা কিশোরীকে
মায়ের আঁচল দিয়ে আগলে নেন বুকের মহলে
জ্বালালেন স্বপ্নশিখা অগ্নিদগ্ধ মানুষের প্রাণে;
সব অপদেবতার ক্রোধ, ঈর্ষা তাড়াতে তাড়াতে
জাতিকে পিতার স্বপ্নে জাগালেন নতুন প্রত্যয়ে:
সবার সন্তান যেনো বেড়ে ওঠে মায়ের ছায়ায়।
(তদেব: ১২)
আসাদ মান্নানের কবিতাপাঠে একথা সুস্পষ্ট রূপে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে যে, তার নন্দনযাত্রা মানবতার চিরায়ত ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হতে চায়। অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতার চেতনাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে কবি দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ। কবি তার স্বকালে সংঘটিত বিষয়-আশয়কে এড়িয়ে যান না, যেতে পারেন না। কবি তার বোধ ও বোধির উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে কবিতায় প্রমূর্ত করে তোলেন সাম্প্রতিক সব বিষয়বস্তুকে। সত্যান্বেষী কবি মানবতার অবমাননাজনিত মর্মযন্ত্রণাকে। একইসঙ্গে মর্মস্থিত মানবতার উপলব্ধিকে জারিত করতে চান সমগ্র মানববিশ্বের মননের মাঝে:
১.
রোহিঙ্গা শিশুর রক্তে গুলিবিদ্ধ মানবতা ভাসে
শরনার্থী সভ্যতাকে নগ্ন করে অন্ধকার আসে:
অবাক দু’চোখে তার বেদনার অশ্রুধারা নামে,
এ আসলে অশ্রু নয়; শান্তি অস্ত্র-কেনা চড়া দামে:
কেবলে রোহিঙ্গা ওরা! ওরা ভাই আমার সন্তান;
দানবের কণ্ঠ ছিড়ে আনতে হবে মানবের গান।
(তদেব : ৩৫)
২.
আপনার পুত্রের রক্তে এ কেমন আলো আপনি জ্বাললেন
হে মহান মাওলানা ইমদাদ রাশিদী!
মসজিদের ইমাম থেকে
আপনি হয়ে গেলেন আজ
মানবতার প্রকৃত খলিফা:
কতিপয় মৌলবাদী দাঙ্গাবাজ হিংস্র জানোয়ার
অসান্তির দাবানলে পুড়ে দেয় মানবউদ্যান
ওরা খুন করে
আপনার মাসুম বাচ্চাকে;
… … …
ভালোবাসা মানুষেরে করেছে মানুষ
ভালোবাসা বেঁচে থাকে শুধু ভালোবেসে;
যেখানে মানুষ থাকে সেখানেই জন্মে মানবতা:
তবে কি ভারতে আজ মরে গেছে
মানবতা এবং মানুষ!
(তদেব : ১৫)
কবি বাকরুদ্ধ হয়ে যান মৌলবাদী দাঙ্গার নির্মম শিকার হওয়া এই নিষ্পাপ শিশুর অপপ্রয়াণে, কবির হৃদস্পন্দন হিমঘরের বরফ শীতলতায় নিষ্প্রাণত্ব প্রাপ্ত হয় ভূলুণ্ঠিত মানবতার আর্তক্রন্দনে। তিনি সংশয়গ্রস্ত ও বিপুল বিস্ময়ে জানতে চান:
কি আছেন ভাই, কেউ কি শুনছেন?
আজ এই দুঃসময়ে
কোথায় মহাত্মা গান্ধী
কোথায় রবীন্দ্রনাথ
কেউ কি এমন নেই বিশাল ভারতে!
(তদেব: ১৫)
অর্থাৎ কবি যেন মানবতার ধ্বজাধারী সব বিশ্বমানব-মনীষার কাছেই এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের কারণ জানতে চান, তার মনন-উত্থিত প্রশ্নের উত্তর জানতে চান, এই হত্যাযজ্ঞের বিচার চান। একইসঙ্গে এমন কলুষিত পশুচক্রের করালগ্রাস থেকে মানবতার পুনরুদ্ধার কামনা করেন।
বর্তমান জিঘাংসা পরিকীর্ণ সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থান নিয়েও আসাদ মান্নানের কবিমনন শঙ্কাগ্রস্ত এবং কবিসত্তা ব্যথিত হয়। সব রিরংসা-বিবমিষার ঊর্ধ্বে উঠে নারীদের বাসযোগ্য একটি সুস্থ, সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা ও ইতিবাচক দৈশিক সঙ্গতি বিনির্মিত হবে এমন শ্রেয়ানকামনাই কবির কবিতায় প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। নারীকে কবি কেবল একজন মেয়ে হিসেবেই নয় বরং মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে এবং তদানুযায়ী মর্যাদা দিতে সম্মুখস্ত হন। কবিতার মধ্য দিয়ে অন্য সবার কাছে তার এই নারীমুক্তির বার্তা পৌছে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। একটা পূর্ণাঙ্গ সমাজ তথা উন্নত দেশ যে নারী ও পুরুষ এই উভয়ের সমান্তরাল ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠতে পারে, কবি এই সত্যকে স্বকীয় সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করেন। তিনি বিশ্বাস করেন নারীশক্তির জাগরণ ও নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্ব উদ্ভাসিত হবে।
অথচ নারীকে ওরা মেয়ে বলে, মানুষ বলে না;
ভোগের রসদ ভেবে কী উদ্ভট ফতোয়ার ছুরি
লালসার জিহ্বা থেকে ছুড়ে মারে নারীর শরীরে;
ঘৃণার চাবুক ছাড়া মানুষকে কী করে বাঁচাবো!
ওদের অশ্লীল জিহ্বা টেনে ছিড়ে দাঁড়াও মানুষ
নারীকে মানুষ ভেবে পৃথিবীকে বাগান বানাও।
(তদেব : ২৮)
নারীলোলুপ রাবণ বিনাশের প্রার্থনা করেন কবি। নারী সম্পর্কিত সব ধর্মীয় গোঁড়ামিকে আসাদ মান্নান রূখে দেন দৃঢ়ভাবে। তিনি সমাজচৈতন্যের বিবর্তনের মূল অবলোকন করেন প্রখর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। এক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিকাঠামোর নিখাদ সত্যচিত্র রূপায়ণে তিনি কবিতায় শিল্পের পরিচর্যা করতেও পারঙ্গমতার ছাপ রাখেন। এক্ষেত্রে কবির বাস্তব সময়ে সংঘটিত সত্য এবং কাব্য কোনোরূপ সংঘর্ষে সংলিপ্ত হয় না। কেননা সময়ের সাথে সত্যের, আর সত্যের সাথে কাব্যের সম্পর্ক অনিবার্য এবং অবশ্যই অপরিহার্য।
‘কুয়াশা উপেক্ষা করে বসে আছে আশার’ কাব্যে নেতি থেকে ইতির দিকে উত্তরণের সরল-সন্ধান দেন কবি। তার ইতিবাচক জীবনাভিজ্ঞানের আলোকে সবার মাঝে এই বিশ্বাসের বীজ বপন করে দিতে প্রয়াসী হন, অসুরশক্তির আগ্রাসন থেকে একদিন সমাজ, দেশ পরিত্রাণ পাবে। অশুভশক্তি আপাদমস্তকভাবে ভূতলে পতিত হবে, নিঃশেষিত হবে, সমূলে উৎপাটিত হবে। কবি এই বোধকে তার স্বতন্ত্র কল্পবিশ্বে এমনভাবে অভিব্যক্ত করেন, যাতে কবিতা অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠে। অতপর কবি েপ্রতীক্ষায় নিমগ্ন থাকেন সেই শুভশক্তির বিজয়প্রহর দৃষ্টি সম্মুখে সত্যরূপে অবলোকন করতে। তাই তার কবিতা কোনো প্রতিবন্ধকতাকে আমলে নেয় না, কোনো ঘেরাটোপে আত্মসমর্পণ করে না। বরং ক্রমাগত ঘূর্ণায়মান জীবনের ইতিবাচক আশাগুলোকে কবিতা-কলেবরে ধারণ করে।
১.
কুয়াশা আমার চোখে তৈরি করে বিভ্রান্তির নকল আশ্রম;
যতদিন ফুটবে ফুল, গাইবে গান পাখি, আর নদী যাবে বহে
ততদিন শহীদের রক্তমাখা এ মাটিতে কোনো ডাকিনীর
আসন হবে না; ওরা কী জানে না, মানুষের ইতিহাসে শুধু
মানুষই অমর হয়, অমানুষ চিরকাল অমানুষই থাকে:
কুয়াশা উপেক্ষা করে কী উদগ্রীব অপেক্ষায় বসে আছে আশা।
(তদেব : ৯-১০)২.
রমণী হাতের নূন, ধমনীর গোপন উৎসব!
কিছুই চাইনা আজ, চাই শুধু মহান দাতার
অবারিত দয়া আর তার সঙ্গে হালকা নিয়ামত,
যা দিয়ে কবির মতো শ্রমিকের আয়ুর গোলায়
তোলা যাবে নবান্নের গন্ধমাখা চুমুর ফসল
আমার উঠোন জুড়ে তৈরি হবে আলোর আশ্রম!
(তদেব : ৪৬)
উৎকলিত প্রথম কবিতাংশে পরিলক্ষিত হয় যে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে কতিপয় ক্ষমতালোভী মানবতাবিরোধী ভ্রষ্ট তথাকথিত রাজনীতিবিদেরা রাষ্ট্রযন্ত্রের চালিকাশক্তির আসন দখল করে যে অরাজক, অমানবিক ও শোষন-ত্রাসণের রাজত্ব কায়েম করে, তা কবির কাছে কুয়াশা রূপী বিভ্রান্তির মেকি, ক্ষণস্থায়ী আশ্রমের মতো যার কোনো ভিত্তিভূমি নেই। অন্যদিকে তিনি বিশ্বাস করেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই স্বাধীন স্বদেশের আলো-হাওয়া যতদিন পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হবে, প্রস্ফুটিত ফুলের সৌরভে সুবাসিত হবে, ততদিন এই দেশের মাটিতে কোনো ডাকিনী রূপী শোষকের ঠাই হবে না। কেননা, সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই এই পৃথিবীর ইতিহাসে শুধু মহৎকর্ম এবং মহান মানুষই শাশ্বত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। আর অমানুষ চিরকালই মানুষের ঘৃণা, তাচ্ছিল্য, অভিশাপে নিক্ষেপিত হয় বিস্মৃতির কৃষ্ণগহ্বরে। তাই সাময়িকভাবে কুয়াশার আস্তরণ আমাদের আকাক্সিক্ষত ভবিষ্যতের পথে বাধা সৃষ্টি করলেও সেই কুয়াশার ওপারেই উদগ্রীব প্রতীক্ষায় বসে থাকে আশা ও সম্ভাবনাময় আগামী।
কুয়াশার প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে একদিন ঠিকই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে উপনীত হবে প্রিয় স্বদেশ, স্বদেশের প্রতিটি মানুষ। আর কবির কবিতা হবে এমন স্বদেশ গঠনে চলার পথের পাথেয়।
দ্বিতীয় কবিতাংশে কবির সুপ্ত বাসনা ব্যঞ্জিত হয়ে ওঠে। তিনি এই পার্থিব জগতের কোনোকিছুর প্রতিই মোহাবিষ্ট নন; শুধু বিশ্বকর্তার কাছে এতটুকু কৃপাই কামনা করেন, যতটুকু দিয়ে এক কবি তার সৃষ্টিপাত্রে তুলে রাখতে পারেন নবান্নের গন্ধমাখা সৃজনকর্ম।
কবির কাছে কবিতা পরিশুদ্ধি লাভের আয়ুধ স্বরূপ গৃহিত হয়। যা কবির জরাগ্রস্ত সত্তা, ক্লেদ-ক্লিন্নতা পরিকীর্ণ মনন এবং পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত মনকে ‘আগুনের পরশমণি’র (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০১৫ : ২৯২) দুর্লভ শুচি স্পর্শের মতো অনুভববেদ্য আবিষ্টতায় ঘিরে রাখে। ‘এক টুকরো মৌলিক আগুন’ কবিতায় কবির ভাষ্য:
যেখানে কবিতা নিজে
নিজেরই আগুন
ভালোবেসে আমি বলি,
আমার আত্মার
এক টুকরো মৌলিক আগুন।
(তদেব: ৩২)
এ কারণেই কবি বলতে পারেন, ‘একটি কবিতা পাবো এ আশায় বসে আছি চৈতন্যের দ্বীপে’ (তদেব : ২২)।
বাংলাদেশের মানুষ উত্তরাধিকারসূত্রে যে জীবন ও সমাজ পারিপার্শ্বিকতা অর্জন করে, তা যুগপৎভাবে ভঙ্গুর ও ক্ষয়িষ্ণু। স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্পেষণে ব্যক্তিজীবনেই কেবল নয় বরং সামষ্টিক জীবনেও নাভিশ্বাস উঠে যায়। মানবতাবিরোধী রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম-নিপীড়ন ও শোষণ-ত্রাসণজনিত অব্যবস্থার দরুণ এবং জীবনধারন নিমিত্তে প্রতিনিয়ত ব্যক্তি-মূল্যবোধকে অনিবার্য বলির শিকার হতে হয়। এমন নৈরাশ্যপূর্ণ অরাজক পরিস্থিতির মাঝে যে কবিচৈতন্যের বিকাশ সাধিত হয়, সেখান থেকে কবি কেবল এই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করেন যে সকল অবরুদ্ধতার শৃঙ্খল ছেদ করে বাংলাদেশ একদিন তার স্বাধীন সার্বভৌম দেশের স্বতন্ত্র মর্যাদায় মাথা তুলে দাঁড়াবে বিশ্বদরবারে। তাই হতাশা নয় বরং দ্রোহী শিঞ্জনে উল্লসিত হয়ে ওঠে কবির কবিতার প্রতিটি চরণ। ‘একদিন প্রতিদিন: ১৭ মে ১৯৮১’ কবিতায় আশাবাদী কবির দৃপ্ত উচ্চারণ:
বজ্রাদপি অবিনাশী সেই কণ্ঠ কে যেন হঠাৎ
বাতাসে উড়িয়ে দিলো: ‘ভয় নাই, ওরে ভয় নাই
শহীদের স্বপ্ন আর রক্ত দিয়ে তৈরি করা দেশে
কে আছে এমন খুনি যে আমারে মারিবার পারে!
সে জারজ হারামজাদা-তার নেই পিতৃপরিচয়;
আমার সন্তান তুই, তোর হাতে তার পরাজয়
সমূলে হবেই হবে; নিয়তির অমোঘ বিধান:
আমার হাসুর হাতে ফিরে আয় স্বপ্নের স্বদেশ।
(তদেব : ৩৭-৩৮)
এখানে একইসঙ্গে কবির বিপ্লবী চেতনা, প্রতিবাদ প্রবণতা এবং তীব্র আশাবাদ ঝংকৃত হয়ে ওঠে। উন্নত, সমৃদ্ধ, গতিশীল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন প্রতিভাসিত হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু তনয়ার স্বদেশ প্রত্যাবনের মধ্য দিয়ে। দেশবিরোধী কুচক্রীমহল নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের জাল বুনে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে তার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকেই ধুলিস্যাত করতে চেয়েছিল, তার চেতনাকে সমূলে উৎপাটিত করতে চেয়েছিল। অথচ নিয়তির অমোঘ বিধানের পথ ধরেই জাতির কর্ণধার বঙ্গবন্ধুর নির্বাসিত আত্মজার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন হবে এবং অপশক্তি সম্পূর্ণ মূলবিচ্ছিন্ন হয়ে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় স্বদেশভূমি পুনরায় আপন ভিত্তিভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হবে সে নির্জলা সত্যকেই কবি এখানে প্রমূর্ত করে তোলেন।
স্বদেশ, সমাজ, রাজনীতিচিন্তার শৈল্পিক প্রকাশক্ষেত্র আসাদ মান্নানের কবিতা। কবির স্বতন্ত্র জীবনবোধের স্বচ্ছন্দ বিচরণভূমি এই কাব্যক্ষেত্র। মঙ্গলময় স্বপ্নের সঙ্গে বাসরত কবি জীবনের যাবতীয় নেতিবাচকতাকে স্বাত্ম-সংবেদে চিহ্নিত করেও যবনিকাপ্রান্তে প্রতীক্ষা করে থাকেন ভবিষ্যতের জন্য, যা বিনির্মিত হবে প্রেমে, মানবিকতায়। কারণ কুয়াশা শুধু সামনে ধাবমান অভিযাত্রীকে ক্ষণকালের জন্য দিকভ্রষ্ট করার প্রায়াস চালাতে পারে, তার চলার গতিতে ধীরতা আনতে পারে কিন্তু তাকে স্থবির করার ক্ষমতা তার নেই। কুয়াশার প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে একদিন ঠিকই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে উপনীত হবে প্রিয় স্বদেশ, স্বদেশের প্রতিটি মানুষ। আর কবির কবিতা হবে এমন স্বদেশ গঠনে চলার পথের পাথেয়।