কবিতা শেষপর্যন্ত ব্যক্তি বিশেষের আবেগেরই ফসল। সে আবেগ প্রকাশকৌশল ও সংহতির গুণে হয়ে ওঠে সর্বজনীন। আবেগের সর্বজনীন রূপই শৈল্পিক মর্যাদায় অভিব্যঞ্জিত। কবির কাজ এই আবেগ ও অভিজ্ঞতার প্রকাশ এমনভাবে করা, যেন পাঠকের মনে হয়, ওই আবেগ ও অভিজ্ঞতায় তারও অংশগ্রহণ রয়েছে। কবির উচিত আরও একটি বিশেষ কাজ গুরুত্বের সঙ্গে করা। তা হলো—সমকালের বিভিন্ন রূপ কবিতায় ধরে রাখা। ত্রিশাখ জলদাস এই দুটি কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জড়তুল্যপাথর’-এ।
সমকালের রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক বাস্তবতায় কবিমন ব্যথিত, উত্তেজিত ও সংক্ষুব্ধ। ব্যক্তি বিশেষের ক্রোধ-প্রতিবাদে প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় তাৎক্ষণিক কোনো পরিবর্তন ঘটে না—তবে পরিবর্তনের সম্ভাবনায় একটি আলোড়ন সৃষ্টি অবশ্যই করে। সেই আলোড়নে অগ্রসর চিন্তার মানুষ ও সংবেদনশীলরা ভাবিত হন। সামাজিক পরিবর্তন একটি দীর্ঘ ও পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া। কারও পছন্দ-অপছন্দে তাৎক্ষণিকভাবে তাতে চিড় ধরে না। সাময়িকভাবে নড়ে ওঠে মাত্র। ত্রিশাখ জলদাস তাঁর ‘একটি অসরল কবিতা’, ‘ফিরে যাই অস্খলিত বীর্যের ভেতর সন্তর্পণে’, ‘মেটাফরমসিস’, ‘সংবিধিবদ্ধ স্বপ্নে’, ‘সময়ের গীত’ কবিতায় প্রচল সমাজের ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন, পাশাপাশি সমাজ-পরিবর্তনের স্বপ্নও দেখেছেন।
শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ—অতৃপ্তি। মাঝেমধ্যে অবদমনও সংহতি-প্রতীক্ষার সমার্থক হয়ে ওঠে। তখন অভিজ্ঞতার বিনিময় চলে কবিতায়। সে রকম একটি কবিতা ‘প্রত্যাবর্তনের আগে’। এই কবিতায় কবি ঘোষণা করছেন, দৈহিক মিলনে মানবজীবনে কেবল যে সুখ ও উদ্বেল থাকে তা নয়, থাকে গভীর বিষাদ, বিষণ্নতা; ক্লান্তিও। আর তখনই মনে হতে পারে—‘প্রতিবার সঙ্গম শেষে নারীর যুগল স্তন/সাপের ফণার মতো দুলে ওঠে।’ কিন্তু কেন এই দুলে ওঠাকে সাপের ফণার মতো মনে হয়? এ কি দমিত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ, না অক্ষমের আক্রোশ প্রকাশ?
__________________________________________________________________________________
মানুষ তার চিন্তা-আচরণ ও কর্মে ঐশী শক্তির পূজো করে—এ আচরণ প্রথাগত বলেই যে করে তা নয়, এর সঙ্গে যু্ক্ত হয়েছে স্বতন্ত্রচিন্তাশক্তি এবং যাপিতজীবনে সহ্য করা লাঞ্ছনা এবং প্রতারণা থেকে মুক্তি পাওয়ার সংস্কারও।
__________________________________________________________________________________
কবির কাজ মানুষের কাজ ও মহত্তকে সম্মান করা এবং আপন-আপন অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির আলোকে তা প্রকাশ করা। ত্রিশাখ জলদাস মানুষের সুখ-দুঃখকে অনুবাদ করেছেন কবিতায়। কবি এক অর্থে মানুষের অব্যক্ত ভাষার অনুবাদক এবং আবিষ্কারক। আর এই আবিষ্কারক বিশ্বাস ও সন্দেহের দোলায় দোদুল্যমান। কিন্তু ঈশচিন্তা মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলোর একটি। মানুষ তার চিন্তা-আচরণ ও কর্মে ঐশী শক্তির পূজো করে—এ আচরণ প্রথাগত বলেই যে করে তা নয়, এর সঙ্গে যু্ক্ত হয়েছে স্বতন্ত্রচিন্তাশক্তি এবং যাপিতজীবনে সহ্য করা লাঞ্ছনা এবং প্রতারণা থেকে মুক্তি পাওয়ার সংস্কারও। এ দিক থেকে দেখলে বোঝা যায়—ঈশ্বরের সৃষ্টি ক্ষমতার সঙ্গে সৃজনশীল মানুষের সৃজনীশক্তির মিল রয়েছে। এই মিলই মানুষকে ঈশচিন্তায় প্রাণিত করে। ফলে মানুষ ধরতে পারে ঐশীশক্তির চাতুর্যও। সেখানে ঠাঁই পায় মৃত্যুর মতো অমোঘ নিয়তিচিন্তাও। ফলে কবি ঘোষণা করেন, ‘আমি ও ঈশ্বর’ কবিতায় এইসব পঙ্ক্তি—
আমার ভেতর বয়ে চলে কোনও একনদী, কোনও স্রোত নেই
অপুষ্টির এই নদীটিতে, শ্যাওলা জমেছে প্রচুর। আত্মার
আবর্জনায় জমেছে নীল। প্রণয়ের নীলে বিদ্ধ হতে হতে
পলাতক যযাতি নীলের খুব গভীরেই ডুবেছে অরণ্যে।
……..
আমি ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী নই অথচ ঈশ্বর খেলছেন এক
মনোহর খেলা। জন্মমৃত্যু আর বিলাপ বিনাশ ভিন্ন ভিন্ন চালে
আমার বুকের স্রোতহীন নদী থেকে তুলে নিচ্ছেন চতুর ইশ্বর।
আর ঈশ্বরের বিশ্বাসীদের একটি সাধারণ ধারণা এমন—কোনোকালেই কোনো সমাজব্যবস্থা নিরঙ্কুশ সুখে চলেনি। সর্বত্রই অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার সঙ্গে নিয়মের কড়াকড়ি ছিল। সামাজিক নিয়ম-কানুন সমাজের সবাই একইসঙ্গে সমানহারে মেনে চলেনি। এখনো চলে না। আর এই সমাজের অসঙ্গতিগুলো সংবেদনশীল মানুষগুলোকে কষ্ট দেয়। এই কষ্ট এবং অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণাসঞ্জাত দুঃখবোধ মিলে সমাজের প্রতি তাদের মিশ্র অনুভূতি জাগে। একদিকে ক্ষোভ, হতাশা, অন্যদিকে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন। এ সবই ঘটে ব্যক্তির মনোজগতে। বাইরের লোক সঙ্গে-সঙ্গে তার হদিস পায় না। ‘অবিচ্ছিন্ন স্বপ্নে’ সমাজের অব্যবস্থার প্রতি প্রচ্ছন্ন ঘৃণা এবং নতুন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে পদক্ষেপের স্বপ্ন। কিন্তু যে বেদনা শিল্পী সমাজ থেকে পায়, তার সহমর্মী সমাজে তাৎক্ষণিক মেলে না। এ সব অনিয়ম আর অব্যবস্থানা ঠেকাতে না পেরে কবি স্বীকার করেন—
অকস্মাৎ নেকড়েটি তীক্ষ্ম দাঁতের উল্লাসে বনের সমস্ত নির্জনতা,
সমস্ত পবিত্রতা এবং পূর্ণতাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় আর আমার
হাতের ধারালো ছুরিটি জড়তুল্য পাথরের মতো ডুবে যায় জলের
গভীরে।
মানবচিন্তার একটি বিশেষ অঞ্চলে ঘুরপাক খায় অযৌক্তিক কল্পনা-অবচেতনজাত ভাবনা। ‘কতিপয় মানচিত্র’ এই ধরনের অবচেনত মনের ক্রিয়া প্রকাশের ভাষিক রূপ। ‘অরীতি ও রোদ্দুরের গান’ও ওই অবচেতনের ফল। এ কারণে এই কবিতায়ও প্রকৃতি, মনোবিকাল এবং এই দুয়ের সম্মিলনে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়াগুলো ফুটে উঠেছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের তুলনা চলে নানাভাবে। প্রকৃতির বর্ণ-গন্ধ-রূপ-রসের সঙ্গে মানুষের মিল সন্ধান করেন কবি-শিল্পীরা। এসব শিল্পের আয়োজনকে করে তোলে মানুষের কাছে মনোগ্রাহী। ‘আমার শীতকাল’, ‘বৃষ্টির বিস্বাদে’, কবিতায় প্রকৃতি ও মানুষের অভিন্নরূপ চিত্রিত। কিন্তু ‘আমার শীতকাল’ কবিতায় ‘কিশোরীর শরীরে সদ্য জেগে ওঠা অনিন্দ্য সৌরভের মতো/ একটি শীতকাল বাস করে আমার আত্মার ভেতর’ বলার সঙ্গে-সঙ্গে জৈবিক প্রসঙ্গও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আবার এরই অন্যরূপ পাই—‘বৃষ্টির বিস্বাদে’ কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি—‘নিশীথে সঙ্গম শেষে কার আঁচলে কে এসে মুছে যায় ঘাম’ উচ্চারণের সঙ্গে-সঙ্গে। কিন্তু সে কেবল এক ধরনের অনুভূতি? কেন এ অনুভূতি? যান্ত্র-সভ্যতার প্রধান সমস্যা, মানুষের প্রতি মানুষের সন্দেহ। প্রতিটি কর্মের ভেতর সংশয়, সে সংশয়ী চিত্ত নিয়ে বিশ্বাসের অভিনয় করে যাওয়া। কারও প্রতি কারও আস্থা নেই, তবু মানুষ প্রতিদিন একে অন্যের সঙ্গে করে চলে যাবতীয় লেনদেন, ভাবনার বিনিময়ও। ‘বৃষ্টির বিস্বাদে’ ফুঠে ওঠে তেমন চিত্র—
অনন্ত রাত্রির শেষে বৃষ্টির বিস্বাদে এসে যদি
ছুয়েঁ যায় কোনো একট নিষিদ্ধ নদীর জল, তবে
হুহু করে কাঁদে নারী, উল্টে যায় আত্মমগ্ন সর্পিল চিতল।
এখানে ‘আত্মমগ্ন’তা আসলে স্বার্থপরতার প্রতীক, আর ‘সর্পিল চিতল’ তারই দ্ব্যর্থবোধক বর্ধিত শব্দযুগল। অবিশ্বাস ও সন্দেহের ভেতর ব্যক্তি নিজে আত্মমগ্নতার অভিনয় করে, আর সর্পিল চিতল হয়ে সময় বুঝে সটকে পড়ে আসন্ন বিপদের ঝুঁকি থেকে।
আধুনিক কালের কবির দায় অনেক। এরমধ্যে তাঁর সময়কালকে বিশ্বস্তভাবে উপস্থাপন করা সবচেয়ে বড় দায়। কোনো রং চড়িয়ে নয়, অভিজ্ঞতার আলোকেই বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার অন্বয় ঘটিয়ে। তবে কবির কাজ সময় নিয়ে নয়, সময়ের অভিঘাত নিয়ে। তাঁর কাজ সময়ের অভিঘাতকে কবিতার অনুষঙ্গ করে তোলা। ত্রিশাখ জলদাসের মধ্যে এই গুণটি রয়েছে। ‘চারপঙ্ক্তি’, ‘ধানগীত’, ‘পরাবৃত্ত কথন’, ‘ছাপচিত্র’, ‘সম্পর্ক’, ও ‘সংবিধিবদ্ধ স্বপ্নে’ কবিতায় ত্রিশাখ জলদাস একটি অস্থির সময়ের প্রতিক্রিয়া এবং ওই সময়ের পারিপার্শ্ব চিত্রায়ণের চেষ্টা করেছেন। বিশেষত ‘সংবিধিবদ্ধ স্বপ্নে’র ভেতর।
ও চাঁদ পূর্ণতা দাও, নিয়ে যাও শরবিদ্ধ রাতের আঁধারে
সহস্রের রাজনটি নৃত্য করে সঙ্গোপনে ধ্যানের মন্দিরে
কামের চৌষট্টি কলায় যদি ভাঙে ধ্যান, তবে কে রবে এই
ছায়ামগ্নে, কে যে নেবে অমৃতের স্বাদ। শরীরের পিঁপড়ারা
এসে খেয়ে নিলে গুড়, শিশ্নের অঙ্গারে আহা পুড়ে যাবে শ্বাস।
অপূর্ণ সঙ্গমে যদি ডুবে যায় রাত, স্বমেহনে জেগে থাকে
নগ্ন এক চাঁদ।
এখানে মূলত মানবজীবনের অচরিতার্থতার সঙ্গে প্রকৃতির সাদৃশ্য কল্পনা করা হয়েছে। কবিতাটির ‘অপূর্ণ সঙ্গমে যদি ডুবে যায় রাত, স্বমেহনে জেগে থাকে / নগ্ন এক চাঁদ’ সমাপ্তিসূচক চরণ নয়, সম্পূর্ণতারও নয়। তাহলে? এখানে প্রকৃতির সঙ্গে নারীকেও একীভূত করে দেখানো হয়েছে।
__________________________________________________________________________________
এছাড়া তাঁর মধ্যে রয়েছে তুমুল স্বপ্নচারিতা; স্বপ্নবিলাসিতাও। অথচ স্বপ্নচারী কবিকে ভয় পেতেন প্রথম আধুনিকদের অন্যতম সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। কারণ নিজে ছিলেন প্রাজ্ঞ এবং প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগী। সঙ্গত কারণে স্বপ্নচারিতার প্রতি বিরাগ ছিল তাঁর। সুধীন্দ্রনাথের ওই রচির প্রতি সম্মান জানিয়েও বলা যায়— কবি মাত্রই স্বপ্নচারী।
__________________________________________________________________________________
কবিতার প্রকরণ ও ভাষারীতির সম্পর্ক সুনিবিড়। আঙ্গিকের ওপর নির্ভর করে এর শব্দ চয়ন, গঠন এবং প্রয়োগরীতি। ত্রিশাখ জলদাসের কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলোর অধিকাংশই প্রচলিত এবং প্রথাগত। তাহলেও সত্য—শব্দচয়নের ক্ষেত্রে তিনি আবেগতাড়িত বেশি, বুদ্ধি ও মননের গুরুত্ব সেখানে কম। ফলে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে আবেগের উৎসারণ। তবে সে আবেগ সংহতিতে স্পষ্ট। এছাড়া তাঁর মধ্যে রয়েছে তুমুল স্বপ্নচারিতা; স্বপ্নবিলাসিতাও। অথচ স্বপ্নচারী কবিকে ভয় পেতেন প্রথম আধুনিকদের অন্যতম সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। কারণ নিজে ছিলেন প্রাজ্ঞ এবং প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগী। সঙ্গত কারণে স্বপ্নচারিতার প্রতি বিরাগ ছিল তাঁর। সুধীন্দ্রনাথের ওই রচির প্রতি সম্মান জানিয়েও বলা যায়— কবি মাত্রই স্বপ্নচারী। আর এমন বক্তব্যের সমর্থন পাঠ করে নিতে পারি ত্রিশাখ জলদাসের ‘আমার ঘুমে দুলে যায় চন্দ্রবান বালিকানিবাস’ কবিতার আদ্যোপান্ত। একজন স্মৃতিকাতর মানুষের অতীতচারণের বর্ণনাও।
বালিকারা বেণী দুলিয়ে বৌছি খেলে,
বালিকারা অযাচিত হাসে
নেশা ঘুমে…
আমার ঘুমে দুলে যায় চন্দ্রবান বালিকানিবাস।
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি—পরমসত্যের উন্মোচন এবঙ আপন উপলব্ধির প্রকাশ। ‘সময়ের গীত’ মূলত আধুনিক কালের জটিল সময় ও গতির মধ্যে বসে থাকা একজন মানুষের অন্তর্গত উপলব্ধি ও বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। এই উপলব্ধি ও আত্ম-উন্মোচনের যুগলমিলন দেখি ‘কৃষ্ণকলি, কী অদ্ভুত স্বপ্নের ভেতর’ কবিতায়। এ কবিতায় একপাক্ষিক সংলাপ উৎকীর্ণ। প্রেমিক ক্রমাগত বলে গেছেন, কিন্তু প্রেমিকা কেবল নীরব শ্রোতা। না নিজে কিছু বলে, না প্রেমিকের কথার কোনো উত্তর দেয়। শেষপর্যন্ত কথকের একঘেয়েমি মনে হয়। তাই শেষ উচ্চারণ—
কৃষ্ণকলি, স্বপ্নে
কিংবা জাগরণে নয়, আমাদের প্রেম
ডুবে থাকবে অনুভূতির পূর্ণতায়।
মৃত্যুচিন্তা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। মৃত্যুচিন্তা ও আধ্যাত্মচেতনার একটি সুনিবিড় সম্পর্ক রয়েছে—যেখানে মানুষ শেষপর্যন্ত নিয়তির কাছে নিজেকে নিঃশর্তভাবে সঁপে দেয়। ‘মৃত্যু ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’য় সেই সত্যই উচ্চারিত।
আধুনিক কালের কবিতায় গল্প নয়, গল্পে বীজ, বিবৃতি নয়, বক্তব্যের সারাংশ গৃহীত। তাই গল্প দিয়ে যে কবিতার শুরু, সে কবিতা শেষপর্যন্ত গল্পের কাহিনি বর্ণনায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু ত্রিশাখের ‘চন্দ্রাহত সংলাপ’ সে ধরনের কবিতা নয়। বিপরীতে ব্যক্তির অভিজ্ঞতা বিনিময়ের স্মারক। যদিও এটিও গল্পের সংলাপ দিয়েই শুরু হয়েছে। এদিকে, ‘অনুকীর্তন’ মূলতত প্রবাদধর্মী দুই পংক্তি করে তিন স্তবকের সৃষ্টি। সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনের কিছু চিরন্তন সত্য প্রকাশ পেয়েছে এখানে।
আধুনিককালের সমাজব্যবস্থা নিশ্চিতরূপে পুঁজিনির্ভর। পুঁজির বিকাশ যত বাড়ছে, মানবিক সম্পর্কগুলোও তত স্বার্থশ্লিষ্ট হয়ে উঠছে। ফলে ভালোবাসায়ও তার প্রভাব পড়েছে। ‘কফিসপে’ সে ধরনের ভালোবাসা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক নির্ভর সামাজিক অবস্থার বিবরণ। কবি সমাজ সচেতনতার স্বাক্ষর রেখেছেন এ কবিতায়। এবং তা সাফল্যের সঙ্গেই।
__________________________________________________________________________________
লিখেছেন অক্ষরবৃত্তের মাত্রা-পর্ব-পংক্তিকে ভেঙেচুরে, নিজের মর্জিমাফিক। কিন্তু নিরূপিত ছন্দের প্রচল নিয়মের প্রতি তাঁর অনাগ্রহের কারণ হয়তো সমকালের রচনারাশির ছন্দহীনতা।
__________________________________________________________________________________
ত্রিশাখ জলদাসের প্রজ্ঞা, পরিমিতি বোধের পূর্ণ স্বাক্ষর রয়েছে ছোট্ট একটি কবিতায়। কবিতাটির নাম ‘বাড়িটা’। এ কবিতায় তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ শেষপর্যন্ত নিঃসঙ্গ এবং প্রকৃতি ও নিয়তির কাছে অসহায়। পুঁজিবাদী বিশ্বে পুঁজিহীনের নীতিকথা, ব্রতকথার মূল্য অতি সামান্যই—বক্তৃতা থেকে মুদ্রিত অক্ষর পর্যন্ত। এরপর কোনো মূল্য নেই। মানুষকে যেখানে একাকী হিসেবে কল্পনা করেছে, সেখানে আপাতত কল্পনার স্বরোধ ঘটিয়েছেন ত্রিশাখ।
ওইযে উঠোন একা একা চলে যাচ্ছে
তার পেছনে ফিরে যাচ্ছে রোদ্দুর।
কিন্তু সারিবদ্ধ গাছ, দরজা জানালা
কিংবা খাটসমেত বাড়ি কোথাও যাচ্ছে না।
বাড়িটাকে মূলত একা ভাবা যায় না।
তাবে বাড়িটার এপাশে আগুনমুখী,
ওপাশে কমলা সুন্দরী হাট।
অথচ বাড়িজুড়ে এখন ক্রিয়াশীল
উপবৃত্ত এবং শূন্যতা।
তাঁর চিত্রকল্পের বিশেষত্ব এই যে—এগুলো যতটা দৃশ্যগ্রাহ্য, তারও বেশি অনুভবভেদ্য। উপমাও তাই। ছন্দে তিনি সিদ্ধহস্ত হওয়া সত্ত্বেও, নিরূপিত ছন্দের প্রচল নিয়মে লেখেননি। লিখেছেন অক্ষরবৃত্তের মাত্রা-পর্ব-পংক্তিকে ভেঙেচুরে, নিজের মর্জিমাফিক। কিন্তু নিরূপিত ছন্দের প্রচল নিয়মের প্রতি তাঁর অনাগ্রহের কারণ হয়তো সমকালের রচনারাশির ছন্দহীনতা। এই ছন্দহীনতার স্রোতে ভেসে ভেসে যাওয়া কতিপয় কবিযশপ্রার্থীর খ্যাতির মোহ হয়তো এই কবিকেও প্ররোচিত করে থাকতে পারে। কারণ যাই হোক, কবিকে মনে রাখতে হবে—শিল্পে নিয়ম-শৃঙ্খলায় চূড়ান্ত কথা। শৃঙ্খলায়-ই মুক্তি, শৃঙ্খলায়-ই আনন্দ।
কবিতার নিষ্ঠাবান পাঠক মাত্রই মানবেন—গত দশ বছরে খুব বেশি ভালো কবিতা লিখিত হয়নি। বই তো নয়ই। যে কয়টি কবিতার বই বের হয়েছে, সেগুলোও হাতে গোনা। আর এই কবিতার আকালের যুগে ‘জড়তুল্য পাথর’ নিঃসন্দেহে শিল্পের উত্তম চাষাবাদ।